গীতা মাধুরী
প্রথম দিন
গীতার মুখ্য বিষয় হল ভাগবানকে জানা।
একজনই আমদের আরাধ্য দেবতা, তিনি হচ্ছেন দেবকী পুত্র ভগবান কৃষ্ণ।
আর এই ভগবান কৃষ্ণকে আরাধনা করার একটাই মন্ত্র ,সেটা হল নাম।
শ্রীল প্রাভুপাদ তার ব্যাখ্যাতে লিখেছেন “নাম মহা নাম – হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে / হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে’
একটাই শাস্ত্র আমরা পড়বো সেটা হচ্ছে দেবকী পুত্রের গীতি আর সেই শাস্ত্র পড়ে আমরা জানতে পারব যে দেবকী পুত্র ভগবানই আমদের আরাধ্য দেবতা আর তাঁকে পুজা করার বিভিন্ন মন্ত্র থাকলেও কেবল নামের মাধ্যমে তাঁকে পুজা করা যায়। আমদের প্রত্যেকের একটাই কাজ হওয়া উচিত , সেই দেবকী পুত্রের সেবা করা। তারমানে এই না যে আমদের সব কাজ (চাষবাস, চাকরি, ইত্যাদি) ছাড়তে হবে। সবকিছু করুন কিন্তু আমদের জীবনের মধ্যমণি হিসাবে ভগবানকে রাখতে হবে।
শ্রীল ভাক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেছেন- “কৃষ্ণের সংসার কর ছাড়ি অনাচার”
কৃষ্ণই আমদের সংসারের মালিক। আমরা যাই উপার্জন করি তা দিয়ে ভগবান কৃষ্ণের ভোগ নিবেদন করে আমরা জীবন ধারন করব।
শ্রীল প্রভুপাদ , তাঁর ভাক্তিগীতিতে বলেছেন- “গীতার উপদেশ ভাই বুঝ ভাল করি, পাইবে কৃষ্ণের কৃপা বজিবে শ্রীহরি।“ গীতার উপদেশ ভাল করে বুঝলে কৃষ্ণের কৃপা লাভ করা যায়।
ভাগবদ গীতার উৎস –
ভাগবদ গীতা হচ্ছে মহাভারতের একটি অংশ, মহাভারতের সার, মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের ২৫-৪২ অধ্যায়ের এই ১৮টি অধ্যায়ে ভাগবদ গীতাটি বর্ণনা হয়েছে (৭০০ টি শ্লোকে)। সেই ১৮টি অধ্যায়কে আমদের আচার্যগন ৩ ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথম ৬টি অধ্যায় হল কর্মষটক [এখানে ভগবান বর্ণনা করেছেন যে আমদের কি কর্ম করা উচিৎ, কর্ম ৩ প্রকার {কর্ম (সকাম কর্ম বা পুণ্যকর্ম), অকর্ম (ভগবানের সেবা করা), বিকর্ম(পাপকর্ম)}, কর্ম কাকে বলে এবং কোন কর্মের কি ফল]। ৭-১২ অধ্যায় হল ভক্তিষটক। ভগবান এই ৭-১২ অধ্যায়ে ভক্তির মূল বিষয় গুলি ব্যাখা করেছেন আর শেষে ৬টি অধ্যায় হল জ্ঞানষটক। এই অধ্যায় গুলিতে ভক্তিকে পরিপুষ্ট করার জন্য জ্ঞানের বর্ণনা দিয়েছেন যাকে বলা হয় ভক্তিমূলক জ্ঞান। এই হল মোট ১৮টি অধ্যায়।
আচার্যগন বলেছেন ১৮টি অধ্যায়ের মধ্যে গীতার ৭-১২ অধ্যায় (ভক্তিষটক) হচ্ছে মূল বিষয়। এই ৭-১২ অধ্যায়ের মধ্যে নবম অধ্যায় শ্রেষ্ঠ এবং এই নবম অধ্যায়ে ৩৪টি শ্লোক আছে। এই ৩৪টি শ্লোকের মধ্যে অন্তিম শ্লোক অর্থাৎ ৩৪নং শ্লোকটি হল শ্রেষ্ঠ।
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি যুক্ত্বৈবমাত্মানং মৎপরায়ণঃ।।৩৪।।
অনুবাদঃ তোমার মনকে আমার ভাবনায় নিযুক্ত কর, আমর ভক্ত হও, আমাকে প্রণাম কর এবং আমার পূজা কর। এভাবেই মৎপরায়ণ হয়ে সম্পূর্ণরূপে আমাতে অভিনিবিষ্ট হলে, নিঃসন্দেহে তুমি আমাকে লাভ করবে।
এই শ্লোকটি হচ্ছে গীতার সার শ্লোক। এইস্লক্তি ভগবান গিতাই ২ বার বর্ণনা করেছেন , ১বার নবম অধ্যায়ে র ১বার ১৮নং অধ্যায়ে।
তাহলে এখানথেকে আমরা জানতে পারছি ভাগবদ গীতার আমরা পেয়েছি মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের ২৫-৪২ অধ্যায়ের এই ১৮টি অধ্যায় থেকে।
ভাগবদ গীতার মূল বিষয়বস্তু
ব্যাসদেব গীতার মাহাত্যাতে বলেছেন “ সমস্ত বেদ, উপানিষদ, পুরান, ইতিহাস, শাস্ত্র যা কিছু রয়েছে , তা সব কিছু যদি একটি গাভীর সাথে তুলনা করা হয়। তাহলে এই গাভীকে দহন করেছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সমস্ত শাস্ত্রের সার সংকলন করে বৎস/বাচুর রুপী অর্জুনকে প্রদান/পান করিয়েছেন।“
এখন প্রশ্ন আসে, আমরা গাভী পালন করি, সেই গাভীর দুধ কি বাচুরের জন্য নাকি সাধারণ মানুষের জন্য?
সাধারণত, সাধারণ মানুষের জন্য। বাচুরতো সুধুমাত্র একটি উপলক্ষ। অথচ বাচুর না থাকলে কিন্তু দুধ আসে না। সেই জন্য অরজুনের মাধ্যমে ভগবান আমদের জ্ঞান দিয়েছেন।
শ্রীল প্রাভুপদ বলেছেন- গীতার ৫টি মূল বিষয় ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল এবং কর্ম।
ঈশ্বর কে?
আমদের সনাতন ধর্মে আমরা খুবই বিভ্রান্ত যে ঈশ্বর কে , আমরা দেখি অন্যান্য ধর্মে (ইসলাম ধর্মে তারা একজন আল্লাহ্কে পুজা করে, খ্রিষ্টান ধর্মে তারা যিশুকে পুজা করেন) সবাই একজনকে পুজা করেন। কিন্তু হিন্দু ধর্মে কতজনকে পুজা করে লোকে। কিন্তু প্রতেক ধরমের একটি গাইডলাইন আছে। যেমন- ইসলাম ধর্মে, তারা একজনকে পুজা করে সেটি তারা তাদের ধর্ম পুস্তকে কেন্দ্র করে পুজা করে।তাদের ধর্ম পুস্তক হল কোরান, তারা ছোট থেকে কোরান পড়ে এবপ্ন পড়ে জানতে পারে তাদের ঈশ্বর হচ্ছেন আল্লাহ্। খ্রিষ্টানরাওঁ তাই, তারা তাদের বাইবেল পড়ে জানতে পারে যিশু হচ্ছে তাদের ঈশ্বর। সেরকম আমদের সনাতন ধর্মের পুস্তক হচ্ছে ভগবদ গীতা। ভগবদ গীতা পড়ে আমরা জানতে পারব আমদের আরাধ্য দেবতা কে।
তাই গীতার প্রথম বিষয়বস্তু হল ঈশ্বর কে?
ডাক্তার হতে গেলে মেডিকেল বই পড়তে হবে কিন্তু বাজার থেকে মেডিকেল বই কিনে পরলে ডাক্তার হওয়া যাবে না তিক তেমনি গীতা নিজে পড়তে জানা যাবে কিন্তু যথাযথ ভাবে ধর্মের বিষয়ে জানতে গেলে, ধর্ম বিষয়ে অবিজ্ঞ মানুষের কাছে গিয়ে জানতে হবে
তাই মহাপ্রভুর পার্ষদ সরূপ দামোদর গোস্বামী চৈতন্যচরিতামৃত তে বলেছেন- যাও পড় ভাগবদ বৈষ্ণব স্থানে / একান্ত আশ্রয় কর চৈতন্য চরণে।
আরো গীতাতে বলেছে জীবের আসল সরূপ কি? প্রকৃতি টা কেমন? কাল কিভাবে সবকিছু ধ্বংস করে? কোন কর্ম আমদের করা উচিৎ?
প্রথম অধ্যায়- (বিষাদ যোগ) এই যোগে ভগবান কোন জ্ঞান প্রদান করেনি। এই অধ্যায়ে তিনি অর্জুনের প্রশ্ন শুনেছেন। অর্জুন এখানে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর যে ভুল ধারনা, তাঁর দেহ ধর্ম, কূল ধর্ম, মন ধর্ম সব তুলে ধরেছে এবং বর্ণনা করেছেন যে যুদ্ধ করলে তাঁর পরিবার, সমাজ সব ধ্বংস হয়ে যাবে।
প্রথম অধ্যায় থেকে আমরা এই শিক্ষা পায় যে আমদের দেহ ধর্ম, মন ধর্ম, সমাজ ধর্ম, আমদের সনাতন ধর্ম না। আর যতদিন আমরা এই দেহ, মন ও জাতি ধর্ম ছাড়বো না ততদিন আমদের কপালে শুধু বিষাদ জুটবে যেমন অর্জুনের জুতেছিল। অর্জুনের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে। এই সমস্ত কথা বলে অর্জুন যুদ্ধ করতে নারাজ হয়েছিল।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে গিয়ে তিনি ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, দীক্ষা নিয়েছিল। দীক্ষা প্রদান করার পড়ে ভগবান তাঁকে আত্ম জ্ঞান (আমি দেহ নই, আমি আত্মা) প্রদান করেন। এই আত্মার করণীয় কি সে বিষয়ে তিনি জ্ঞান প্রদান করেছেন।
আত্মা হচ্ছেন পরমাত্মার অংশ যেরকম হাত হল আমার অংশ, এই হাতের কাজ হচ্ছে আমার শরীরের সেবা করা। সামনে যদি ভাল খাবার থাকে হাতে তুলে আমার মুখে আসবে আপনার মুখে না। ঠিক সেইরকম কেউ যদি আমাকে মারতে আসে তাহলে আমার হাত উঠে যাবে শরীরকে রক্ষা করার জন্য যেহেতু হাত শরীরের অংশ তাই হাতের কাজ হচ্ছে শরীরের সেবা করা। ঠিক সেইরকম আত্মা হচ্ছে পরমাত্মার অংশ, আত্মার কাজ হচ্ছে পরমাত্মার সেবা করা। পরমাত্মার সেবা কিভাবে করব?
তখন চলে গেল তৃতীয় অধ্যায়ে- কি করে কর্ম করা উচিৎ? জ্ঞান যুক্ত হয়ে কর্ম করা উচিৎ তাই চতুর্থ অধ্যায়ের নাম জ্ঞান যোগ।
গীতার জ্ঞান আপনি গ্রহন কিরেছেন তাঁর প্রমান হল পঞ্চম অধ্যায় (কর্মসন্ন্যাস যোগ)
এই অধ্যায়ের ১০নং শ্লোকে বলেছেন আপনি যদি যথার্থ ভাবে গীতার জ্ঞান লাভ করে থাকেন তাহলে এই জগতের কোন সুখ/দুঃখ আপনাকে স্পর্শ করতে পারবেনা আপনি সবসময়ভগবানের দিব্য আনান্দে থাকবেন ঠিক যেমন পদ্মপত্র জলে থাকলেও তাঁকে জল ভিজাতে পারেনা।
তারপর ষষ্ট অধ্যায়- আপনের জীবনকে আনান্দে রাখতে গেলে মনকে সংযত করতে হবে। এই অধ্যায়ে মন সংযমের কোথা বলেছেন। এটা হল পুরো কর্মষটকের বর্ণনা।
তারপর ভগবান শুরু করেছেন ভক্তি। যখন আপনি কর্মের ব্যাপারে ভাল ভাবে জানতে পারবেন তখন ভক্তি জগতে প্রবেশ করবেন। সপ্তম অধ্যায়ের নাম হল ভক্তিযোগ। ভক্তিটা কোন বাবাবেগ না। ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘emotion is not devotion’ অর্থাৎ বাবাবেগটা ভক্তি না। ভক্তি করতে গেলে যথার্থ ভাবে জানতে হবে। সপ্তম অধ্যায়ে ভগবান বিজ্ঞান দিয়ে বুঝাবেন আমাদের কি করা উচিৎ।
ভক্তি করছেন নিকা তাঁর জন্য অষ্টম অধ্যায়। ভক্তির ফল হচ্ছে মৃত্যুর সময় ভগবানকে স্মরণ করে, ভগবানের নাম উচ্চারণ করে মৃত্যু বরণ করা এবং ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়া। ভগবান বলেছেন অন্তিমকালে যে আমক স্মরণ করে দেহ ত্যাগ করবে সে আমার কাছে ফিরে আসবে।
তারপর নবম অধ্যায় রাজগুজ্য় যোগ। যিনি ভক্তি করেন তাঁর সঙ্গে ভগবান কিভাবে আদান প্রদান করেন, তাঁর সমস্ত প্রয়োজন, অভাব রয়েছে ভগবান নিজে বয়ে নিয়ে যান এবং তাঁকে ভগবান সবসময় সুরক্ষিত রাকেন। ভগবান তাঁর সঙ্গে সবসময় থাকেন। ভগবান বলেছেন এই জগতে আমি সবার কাছেন সমান, আমি সবাইকে ভালবাসি কিন্তু যে আমার ভজনা করে তাঁর প্রতি আমি পক্ষপাতিত করি।
আর সেই ভক্তিকে ভক্তিযোগে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভগবান তাঁর বিভূতি প্রকাশ করে আর সেটি হচ্ছে দশম অধ্যায়
একাদশ অধ্যায়ে অর্জুন জানতে চাইলেন ‘প্রভু আপনি যে বিভূতি আমাকে বর্ণনা করলেন আমি টা দেখতে চাই’ তাই একাদশ অধ্যায়ে (বিশ্বরূপ দর্শন যোগ) ভগবান তাঁর বিভূতি অর্জুনকে দর্শন করিয়েছেন। সংক্ষেপে বলা যাই দশম অধ্যায় হল অডিও বক্তৃতা আর একাদশ অধ্যায় হল ভিডিও।
তারপর হল দ্বাদশ অধ্যায় যেখানে তিনি ভক্তি যোগের সারাংশ দিয়েছেন মাত্র ২০টা শ্লোকে। এই অধ্যায়ের ৬ এবং ৭ নং শ্লোকে ভগবান বলেছেন ‘ নিজি কর্ম করে আমাকে অর্পণ করেন, ভক্তিযোগের মাধ্যমে আমার ভজনা করেন তাঁকে আমি আমার ধামে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। শেষের ১৩ শ্লোক থেকে ভগবান বর্ণনা দিয়েছেন ‘আমার ভক্ত কত শ্রেষ্ঠ, আমার ভক্ত আমার কত প্রিয়’। ভগবান ভক্তের ২৬টি এক এক করে গুণকীর্তন করেছেন এবং সেই সঙ্গে এতাও বলেছেন ভক্ত হতে গেলে আমাদের কি কি করণীয়।
আর শেষ ৬টি অধ্যায় জেতা হল জ্ঞানষটক, ১৩ অধ্যায় প্রকৃতিপুরুষবিবেগ যোগ , সেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, প্রকৃতি, পুরুষ, জ্ঞান, গেহ- এই ৬টি তথ্য বর্ণনা করার পড়ে তিনি ১৪ অধ্যায় (গুনত্রয়বিবাগ যোগ) যেখানে ৩টি গুণ আমাদের শরীরে কিভাবে কাজ করে, কোন গুনে কোন খাবার পছন্দ হয়ই, কোন গুনের কি স্বভাব, কোন গুনে মারা গেলে আমরা কি লাভ করতে পারব এই সব বর্ণনা রয়েছে।
তারপর হল পঞ্চম অধ্যায় (পুরুষোওম যোগ) যেখানে বলেছেন এই জগত টা হল চিন্ময় জগতের একটা প্রতিবিম্ভ, এখানে সুখের জন্য আমরা হাত্রাছি এই সুখ কিন্তু এখানে নেই। ভগবান বলছেন এই জগতে কোন প্রকার সুখ আমরা অন্বেষণ করতে পারিনা বা পাবও না। যেমন আপনি পুকুরের পারে গিয়ে দেখবেন গাছে আম ধরেছে সেই আমের প্রতিবিম্ভ জলেও দেখা যাছে কিন্তু জলে জাপ দিয়ে আমরা আমটা পাব না, আমটা পেতে গেলে গাছে উঠতে হবে। ভগবান বলেছেন এই জগতে কোন প্রকারের সুখ নেই। সুখ পেতে গেলে চিন্ময় জগতে যেতে হবে।
তারপর ১৬ অধ্যায়- এই ভজনা করে ভগবানের কাছে যাওয়ার জন্য একটা গুণ লাগবে, দৈবগুণ তাই ১৬ অধ্যায়ের নাম হচ্ছে দৈবাসুর সম্পদ বিবাগ যোগ। এই অধ্যায়ে বর্ণনা আছে দৈবগুণ ও অসুরগুণ গুলি কি? আমরা কি দৈবগুনে অবস্থান করি নাকি অসুরিক গুনে অবস্থান করি।
১৭ অধ্যায় ( শ্রদ্ধাত্রয় বিবাগ যোগ) এই অধ্যায়ে বর্ণনা আছে ৩ প্রকার শ্রদ্ধা ,কারা দেব দেবীর পুজা করে, কারা রাক্ষসের পুজা করে, কারা গুরুদেবের পুজা করে আর কারা ভগবানের পুজা করে, ৩ প্রকার পুজা, ৩ প্রকার যজ্ঞ, ৩ প্রকার খাবার, ৩ প্রকার কর্ম আদি বর্ণনা আছে।
এভাবে ১৭টি অধ্যায়ের মাধ্যমে গীতার জ্ঞান সমাপ্ত হয়েছে। আর ১৮ অধ্যায়ে সম্পূর্ণ জ্ঞানের সারসংক্ষেপ বলা হয়েছে।
আমাদের বুঝতে সুবিধার জন্য গীতাই অর্জুন ১৬টি প্রশ্ন করেছে।
• প্রথম প্রশ্ন করেছেন ২য় অধ্যায়ের ৫৪ নং শ্লোকে। ভগবান যখন ভক্তিযোগ বর্ণনা করছিলেন তখন অর্জুন জিজ্ঞেস করলেন ‘ভক্তিযোগ অবলম্বন করছেন এমন মানুষের স্বভাব কিরকম হবে? তিনি কিভাবে কথা বলেন? কিভাবে অবস্থান করেন? কিভাবে বিচরণ করেন?’
• দ্বিতীয় প্রশ্ন করেছেন ৩য় অধ্যায়ের ১ নং শ্লোকে। অর্জুন জিজ্ঞেস করলেন ‘ভক্তি করতে গেলে কি আমাদের কাজ করতে হবে নাকি আমি বসে বসে মালা জপ করেই হবে?’
আমরা অনেক সময় দেখি মন্দিরে যখন বেশি সেভা পড়ে যাই তখন আমরা বিরক্ত হয়ে বলি কাটার জন্য এসছি নাকি। আমরা নিজেরাই বিভ্রান্ত ভক্তি মানে কর্ম বাদ দিয়ে ভক্তি করা নাকি দুটোই করা। ভগবান বুঝাবেন ভক্তি এবং কর্মের মধ্যে সম্পর্ক।
• ৩য় অধ্যায়ে আরো একটি প্রশ্ন করেন ‘অনিচ্ছা সত্তেও কেন আমি পাপ কাজে লিপ্ত হই?’
• ৪র্থ অধ্যায়ের ৪ নং শ্লোকে ‘সূর্যদেব (বিবিশন) তো অনেক আগে জন্মেছিল, আপনি কি করে তাকে জ্ঞান প্রদান করেছিলেন?’
• ৫ম অধ্যায়ের ৫ নং শ্লোকে তিনি পুনরায় আবার একই প্রশ্ন করে যেটি তিনি ৩য় অধ্যায়ে করেছিলেন ‘ কর্ম করব নাকি ভক্তি করব?’ একই প্রশ্ন তিনি গীতাই ৩বার করেছেন ৩য়, ৫ম, ১৮ম অধ্যায়ে। কেননা আমরা নিজেরাই বিভ্রান্ত যে কর্ম করব নাকি ভক্তি করব।
• ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে ৬ নং প্রশ্ন ‘আমি মনকে কীভাবে স্থির করব তা আপনি আমাকে প্রদর্শন করুন?’
• ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে ৭ নং প্রশ্ন ‘আমি যদি ভক্তি করতে গিয়ে পতিত হয়ে যায় তাহলে আমার কি গতি হবে?’
• ৮ম অধ্যায়ে ৮ নং প্রশ্ন ‘৮টি ত্বত্ত কি?’
• ১০ম অধ্যায়ে ৯ নং প্রশ্ন ‘আমি তোমার বিভূতি জানতে চাই তুমি তোমার বিভূতি বর্ণনা কর?’
• ১১তম অধ্যায়ে ১০ নং প্রশ্ন করেছেন ‘আমাকে কৃপা করে তোমার বিভুত দেখাও’
• ১১তম অধ্যায়ে ১১ নং প্রশ্ন, বিভূতি দেখার পড় ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করেন ‘তুমি কে? তোমার আসল স্বরূপ কি?’
• ১২তম অধ্যায়ে ১২ নং প্রশ্ন করেন ‘নিরাকার উপাসনা আর সাকার উপাসনার মধ্যে কন্তি শ্রেষ্ঠ?’
• ১৩তম অধ্যায়ে ১৩ নং প্রশ্ন ‘প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান, গেহ সম্পর্কে আমাকে বলুন?’
• ১৪র্থ অধ্যায়ে ১৪ নং প্রশ্ন ‘ত্রিগুনাতিত বা যিনি তিন গুণকে অতিক্রম করেছেন তাঁর লক্ষন কি?’
• ১৭তম অধ্যায়ে ১৫ নং প্রশ্ন ‘মানুষের শ্রদ্ধার সাথে গীতার জ্ঞানের সাথে মিলছে না এই সম্পর্কে তুমি কিছু বল?’
• ১৮ম অধ্যায়ে ১৬ নং প্রশ্ন ‘ভক্তি করব নাকি কর্ম করব?’
এই প্রশ্ন গুলি আমাদের ভাল ভাবে জেনে গীতার জ্ঞান অনুভব করতে হবে।
গীতার জ্ঞান অর্জনের যোগত্যাঃ-
• সদ গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিতে হবে।
• গুরুদেবের সেবা করতে হবে।
• গুরুদেবের প্রতি শরণাগতি।
• গুরদেবকে প্রশ্ন করতে হবে।
• চার নিয়ম পালন করে পাপ মুক্ত হতে হবে।
• কৃষ্ণ ভক্ত হতে হবে।
• সংযত পরায়ণ হতে হবে।
আমরা চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনীতে দেখি, তিনি যখন সন্নাস্য গ্রহণ করে পুরীতে ছিলেন এবং তিনি যখন দক্ষিন ভারতে ভ্রমনে গিয়েছিলেন তখন তিনি চাতুর মাস্যতে , শ্রীরাঙ্গমে, ব্যঙ্কট ভট্টের বাড়িতে ছিল। আর সেখানে পাসে একটি জগন্নাথ মন্দির ছিল। তিনি সেখানে প্রতিদিন জেতেন এবং দর্শন করতেন। আর সেই মন্দিরে এক ব্রাহ্মণ প্রতিদিন গীতা পাঠ করতেন। সেই ব্রাহ্মণ ছিল নিরক্ষর, অক্ষর জ্ঞান জানতেন না। তাহলে গীতা পরতেন কি করে? সেটাই প্রশ্ন।
গীতা পড়তে গেলে অক্ষর জ্ঞানের থেকেও বেশি গুরু কৃপা প্রয়োজন।
গীতা পড়লে কি লাভ হয়?
• মোহ থেকে মুক্ত হব।
• পাপ পূর্ণ উভয় কর্ম থেকে মুক্ত হব।
• সংসার বন্দন থেকে মুক্ত হব।
• আর এই ধরাধামে জন্ম হবে না।
• কষ্ট লাভ করতে হবে না।
• শেষ বয়সে ভগবানকে লাভ করতে পারবে।
ভগবান কৃষ্ণ বলছেন- কেউ যদি নিয়মিত গীতা পড়েন, আমি তাঁর গীতা পাঠের জ্ঞানযোগের দ্বারা পূজিত হব। কেও যদি পড়তে পারে না কিন্তু শ্রবণ করে তাহলে সে স্বর্গ প্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ পাঠ করলে ভগবৎ ধাম যাওয়া যায় এবং শ্রবণ করলে স্বর্গে যাওয়া যায়। আর কেও যদি গীতা প্রচার করে, গীতা দান করে, গীতার জ্ঞান দান করে তাহলে সে প্রেমভক্তি লাভ করবেন, জীবনের শেষে ভগবানকে প্রাপ্ত হবে, ভগবানের অত্যন্ত প্রিয় হতে পারবে।
বিভিন্ন মুনি, ঋষিরা গীতার ব্যাপারে কি বলেছেন তা গীতার পেছনে লেখে আছে। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন- যখন সন্দেহ আমাকে গিরে ধরে, হতাশার সম্মুখে উপস্থিত হয়, যখন কোন আশার আলো দেখতে পায় না তখন আমি ভাগবদ গীতা তুলেনি শান্তি পাওার জন্য। গীতা তেখে আমি কিছু শ্লোক খুঁজে পায় জেগুল আমাকে শান্তি দেয়, হাসতে উৎসাহ দেয়, আমি সব দুঃখ ভুলে যায়, তাই তোমরাও গীতা পড়।
আইনস্টাইন বলেছেন- আমি যখন ভগবদ গীতা পড়ি বা মনে করি যে ভগবান কি করে বিশ্ব সৃষ্টি করেন, আমি অবাক হয়ে যায়।
শ্রী অরবিন্দ বলেছেন- ভগবদ গীতা শুধু প্রকৃত শাস্ত্র নয়, প্রত্যেক যুগের জন্য এটি সভ্যতার একটি নতুন অর্থ।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- ফলের আশা না করে কর্ম করার কৌশল ভগবদ গীতাই আছে।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন- এই ভগবদ গীতা হচ্ছে মানব সমাজের প্রতি ভগবানের একটি বিশেষ আশীর্বাদ, তাই এঁকে আশয় করুন।
মহাপ্রভু বলেছেন- ভারত ভুমিতে মনুষ্য জন্ম হইল যার, জন্ম সার্থক করি কর পরোপকার।
যারা ভারত ভুমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের প্রত্যেকের কর্তব হচ্ছে এই ভগবদ গীতা পড়ে জন্ম সার্থক করা এবং যারে দেখো তারে কহ কৃষ্ণ উপদেশ আমার আজ্ঞায় গুরু হইয়া তারো এই দেশ।
যার সঙ্গে দেখা হয় তাঁকে কৃষ্ণ উপদেশ বা কৃষ্ণ কথা বল আর তুমি যদি ভগবদ গীতা প্রচার কর, ভগবদ গীতার কথা বল ভারতবাসী হিসাবে তাহলে তোমাকে বিষয় কোনদিন বাধে পারবে না আর তুমি আমার সঙ্গ পেয়ে যাবে।
জয়পতাকা স্বামী বলেছেন- আমরা এই গীতা তখনই বুঝতে পারব যখন আমরা প্রভুপাদের তাৎপর্য পড়বো।
-সমাপ্ত-
দ্বিতীয় দিন
প্রথম অধ্যায় (বিষাদ যোগ)-
এই অধ্যায়ে মোট ৪৬টি শ্লোক।
ধৃতরাষ্ট্র উবাচ
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ |
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়।। (১/১)
অনুবাদঃ- ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞেস করল- হে সঞ্জয়! ধর্মক্ষেত্রে যুদ্ধ করার মানসে সমবেত হয়ে আমার পুত্র এবং পান্ডুর পুত্ররা তারপর কি করল?
ধৃতরাষ্ট্র ঘরে বসে বসে যুদ্ধ দেখেছেন এবং এই একটি প্রশ্ন তিনি করেছিলেন।
তাৎপর্যে প্রভুপাদ লিখেছেন যে ধৃতরাষ্ট্র জন্ম তেখে অন্ধ ছিলেন। শ্রীল ব্যাসদেব এসেছিলেন তাঁকে দৃষ্টি প্রদান করতে কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বললেন-‘আমি এই যুদ্ধক্ষেত্রে আমার পুত্রদের হত্যা দর্শন করতে পারব না।‘ তাই তিনি সঞ্জয়কে এই দিব্যদৃষ্টি প্রদান করেছিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্র এর কাছে বসিয়ে দিয়ে গেলেন যাতে সমস্ত ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি শুনান।
ভগবদ গীতা শুরু হয়েছে ধৃতরাষ্ট্র এর শ্রীমুখ থেকে। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে, ধৃতরাষ্ট্র তো পাণ্ডবদের বিপক্ষে ছিল তাহলে কেন তাঁর কথা দিয়ে ভগবদ গীতা শুনতে হবে?
এর উত্তরে আচার্যগন বর্ণনা দিয়েছেন, ধৃতরাষ্ট্র শুধু মাত্র তাঁর ভুমিকা অবলম্বন করে ভগবানের লীলাই সহায়তা করেছেন।
বিদুরের পরিকল্পনাই যখন ধৃতরাষ্ট্র গৃহ ত্যাগ করে হরিদ্বারে পৌঁছালেন তখন তিনি ৫দিনে তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করলেন। একান থেকে আমরা বুঝতে পারি ধৃতরাষ্ট্র অসুর ছিল না তিনি ভক্ত ছিল যে ৫দিনে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র এর আরেকটি যোগত্যা হচ্ছে তিনি ভগবানের এই যুদ্ধের লীলা শুনতে আগ্রহী ছিলেন।
যুদ্ধ হছিল কুরুক্ষেত্রতে আর ধৃতরাষ্ট্র ছিল হস্তিনাপুর (বর্তমানে দিল্লি)। যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্ত ঘটনা সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে শুনাছিল, ব্যাসদেবের কৃপাই।
গীতার প্রথম শব্দ হচ্ছে ধর্মক্ষেত্রে। এর থেকে আমরা যদি ধর্ম করতে চাই তাহলে ধর্মের বই পড়তে হবে। আর ধৃতরাষ্ট্রের এই প্রশ্নের একটি তাৎপর্য হয়েছে এবং এই প্রশ্ন আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে, কারণ এই একটা প্রশ্নের উপর পুরো গীতা দারিয়ে আছে। এই প্রশ্নের উত্তর সঞ্জয় গীতার একদম শেষে দেবে। আর মাঝখানে বিস্তারে বর্ণনা থাকবে।
ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্ন ছিল আমার পুত্ররা জয়ী হবে তো?
সঞ্জয় উত্তর দেই শেষ শ্লোকে
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম।।১৮/৭৮।।
অনুবাদঃ যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত।
এখানে ধৃতরাষ্ট্রের মনে আশঙ্কা জেগেছে, তাঁর প্রশ্নের মাধ্যমে সেই আশঙ্কা প্রকাশ পায়। তিনি প্রশ্ন করেছেন যুদ্ধ করার মানসে আমার পুত্র, পান্ডুর পুত্ররা কি করল? অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের ফল জানতে চাইছে না, আমরা যেমন খেলার কোন দল কত রান করেছে জিজ্ঞেস করি, তিনি ছাইলে এরম জিজ্ঞেস করতে পারতেন যে কোন পক্ষ কত দূর যুদ্ধ করে জয়ী লাভ করেছে। সে কথা কিন্তু জিজ্ঞেস করেননি। তিনি জিজ্ঞেস করছেন আমার পুত্র, পান্ডুর পুত্ররা কি করল? তারমানে এর বিতরে একটা সন্দেহ কাজ করছেন যে তাঁর পুত্ররা জয়ী হবে কিনা।
ধৃতরাষ্ট্রের মনে আশঙ্কা ছিল যে আমার ছেলে যুদ্ধক্ষেত্রের পবিত্র ভুমিতে গিয়ে আবার ধর্ম অবলম্বন করে নিয়ে যুদ্ধ না করে কি বসে রাজ্য ৫০/৫০ ভাগ করে নেবে। এই ভয় তাঁর ছিল। তাই সে এরম প্রশ্ন করল যে তারা যুদ্ধ করার মানসে গিয়ে যুদ্ধ করছে নাকি বসে মীমাংসা করছে।
‘আমার পুত্র আর পান্ডুর পুত্র’ এখানেও তাঁর মনে একটা বেদ্ভাব ফুটে উটেছে। উভয় পক্ষতো গৌরব পক্ষ, কিন্তু তিনি এখানে বলেছে আমার পুত্র ও পান্ডুর পুত্র কেননা তিনি চাইছিলেন যে আমার পুত্ররাই জীবিত থেকে রাজ্য ভোগ করুক।
আরেকটা ঘটনা প্রভুপাদ এখানে তুলে ধরেছে ‘ধর্মক্ষেত্রে’ ‘ধর্ম ক্ষেত’ ক্ষেত মানে হচ্ছে জমি, ধানের জমি আর এতা হল ধর্মের ক্ষেত তাই প্রথম থেকেই ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে যে এই ধর্মের ক্ষেতে শুধু ধর্মই প্রস্পুটিত হবে। এখানে অধর্মের বিনাশ হবে। ধান ক্ষেতে যেমন আগাছা গুলি তুলে ফেলে দেওয়া হয় ঠিক তেমনই ধর্মক্ষেত্র থেকে অধর্মকে তুলে ফেলে দেওয়া হবে। এখানে শুধু ধর্মের প্রতিষটা হবে।
এই প্রশ্নের উত্তর সঞ্জয় দ্বিতীয় শ্লোকে দিয়েছেন,
সঞ্জয় উবাচ
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্যোধনস্তদা।
আচার্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ।।(১/২)।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন-হে রাজন্! পান্ডবদের সৈন্যসজ্জা দর্শন করে রাজা দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে বললেন---
সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা দিতে শুরু করলেন, বললেন- হে মহারাজ, পাণ্ডবদের সৈন্যসজ্জা দর্শন করে রাজা দুর্যোধন রথ থেকে নেবে গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে নিবেদন করলেন।
এই অনুবাদ একটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়- ‘হে রাজন’ মানে ধৃতরাষ্ট্র আর ‘রাজা দুর্যোধন’ কিন্তু দুর্যোধন তো রাজা নয়। রাজা দুজন কি করে হয়? দুর্যোধন তো রাজকুমার, তিনি তো এখন রাজা হননি। তারমানে অনুবাদে ভুল রয়েছে, দুজনকে কেন রাজা বলা হয়েছে।
যেহেতু ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে ইচ্ছা করেছিলেন যে তাঁর ছেলে রাজা হবে তাই সঞ্জয় তাঁকে উৎসাহমূলক বাক্যের দ্বারা উৎসাহিত করেছেন।
যেমন দরুন আপনার ছেলে কোন কাজ করে না, পড়াশুনা করে না, কুব বদমাশ। কেও যদি আপনাকে এসে বলে-‘আপনার অকর্মণ্য ছেলেটি কোথায়?’ তাহলে আপনি নিশ্চয়ই উৎসাহিত হবেন না। যদি আপনাকে বলা হয়- ‘আপনার ওই ছেলে কুব ভালো সুদু একটু পড়াশুনা পারে না কিন্তু সভাব চরিত্র খুব ভালো’ তাহলে আপনি নিশ্চয়ই উৎসাহিত হবেন। ঠিক সেরকমই সঞ্জয়ও ধৃতরাষ্ট্রকে উৎসাহিত করেছেন।
রাজা দুর্যোধন রথ থেকে নেবে গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে হাত জোর করে মাথা নিচু করে বলছেন-
পশ্যৈতাং পান্ডুপুত্রাণামাচার্য মহতীং চমূম্ ।
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা।।৩।।
অনুবাদঃ হে আচার্য! পান্ডবদের মহান সৈন্যবল দর্শন করুন, যা আপনার অত্যন্ত বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদের পুত্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বূহ্যের আকারে রচনা করেছেন।
প্রথমে গিয়েই গুরুদেবের কাছে বলছেন- ‘হে গুরুদেব আপনি দেখুন পান্ডবপক্ষের সৈন্যক্ষমতা।’
এটাই উচিৎ যখন আমরা কারো সাথে লড়তে যাব, অপর পক্ষের শক্তিটাও তুলনা করা দরকার।
দরুন আপনি কোর্টে কারো সঙ্গে কেসে লড়বেন, আগে বিচার করবেন যে ওর সাথে লড়তে পারবেন কিনা, লোকবল আছে কিনা, অর্থ বল আছে কিনা, বুদ্ধি বল আছে কিনা। তো সেভাবে দুর্যোধন আলোচনা করছেন- আপনি দেখুন, আপনার বুদ্ধিমান শিষ্য ও দ্রুপদের পুত্র, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পান্ডবদের সৈন্যকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন।
এখানেই দুর্যোধনের আরেকটা কূটনীতি ফুটে উঠেছে, ‘আপনার অত্যন্ত বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদের পুত্র’, দুটোই কিন্তু এক লোকে বুঝান হচ্ছে। প্রভুপাদ এর রহস্য উতগাঠন করেছেন তাৎপর্যতে, তিনি বলছেন- দ্রুপদের সঙ্গে দ্রোণাচার্যের ছোটবেলা থেকেই একটা বন্ধুত্ব ও মনোমালিন্য ছিল। দ্রোণ এবং দ্রুপদ ছোটবেলাই একই গুরুকুলে পড়াশুনা করতেন, দ্রোণ ছিলেন ঋষি পুত্র আর দ্রুপদ ছিলেন রাজপুত্র (রাজকুমার)। গুরকুলের জীবনটা ছিল অনেক কঠিন জেতা দ্রোণের পক্ষে সম্ভব ছিল কিন্তু দ্রুপদের পক্ষে অনেকটাই অসম্ভব ছিল। একজন রাজপুত্রের পক্ষে গুরুকুল জীবন অত্যন্ত কঠিন ও অত্যন্ত তপস্যাময় জীবন। সেই সুত্রে দ্রোণ, দ্রুপদকে গুরুকুল জীবনে অনেক সহায়তা করেছেন এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা সরূপ দ্রুপদ মাঝে মাঝে বলতেন,’দেখ বন্ধু পরবর্তী কালে আমি রাজা হব, তুমি যেভাবে আমার সহায়তা করলে, আমি তোমার ঋণ সরূপ আমার রাজ্যের ৫০% তোমাকে আমি দিয়ে দেব। স্কুল জীবনে বন্ধুবান্দবের সাথে এরম অনেক কথাই আমরা আলোচনা করি। কিন্তু যখন আমরা বড় হয়ই চাকরি করি যে যার জীবনে ফিরে যায় তখন এই কথাগুলো আর মনে তাঁকে না। ঠিক সেরকম দ্রুপদের ও মনে ছিল না।
দ্রুপদ রাজা হয়েছেন কিন্তু দ্রোণ মুনিপুত্র হিসাবে সেই দারিদ্র জীবনে থেকে গেছেন। একদিন এত দরিদ্র এত দরিদ্র, পুত্র অশ্বত্থামা, তাঁকে বরনপোসনার জন্য কিছুই ছিল না। তখন তাঁর মনে পরল তাঁর বাল্যকালের বন্ধুর সেই কথা, সে ভেবেছিল সেতো ব্রাহ্মণ, আমার রাজ্যের অর্ধাংশের দরকার নেই, সে শুধু একটি গাভী চেয়ে নিয়ে আসবে। গাভীর দুধ দিয়ে সে তাঁর পুত্র সন্তানকে লালনপালন করবে। এই আশা নিয়ে তিনি দ্রুপদের রাজসভায় গেলেন, দারির কাছে খবর পাঠিয়েছেন দারপাল গিয়ে রাজার কাছে নিবেদন করেছেন, ‘আপনার বাল্যকালের বন্ধু আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।‘ দ্রুপদ খোঁজ নিয়ে দেখলেন যে কে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসছেন।
রাজার সঙ্গে বন্ধুত্ব কার হয়ই?
রাজার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাজার হয়, তাই তিনি বলেছেন এই ধরনের আমার কোন বন্ধু ছিল না। কি কারনে তিনি এরম বলেছেন সেটা বর্ণনা নেই কিন্তু হয়ই তো তিন নিজের সন্মানের কাতিরে এই ধরনের একজন গরিব মানুষকে তাঁর বন্ধুর পরিচয় দেইনি। দ্রোণ বিফল মনরব হয়ে ওখান থেকে ফিরে এলেন। ভাগ্যক্রমে তিনি তখনকার দিনের সবথেকে বড় গুরকুলের শিক্ষক হয়ে গেলেন। আর সেই গুরুকুলেই পড়তে গেলেন শতকৌরব পুত্র ও পঞ্চপাণ্ডব, ১০৫ ভাই পড়াশুনা করলেন। পড়াশুনা করার পরেই যখন গুরুকুল জীবন সমাপ্ত তখন ১০৫ ভাই গিয়ে গুরুদেবের কাছে নিবেদন করলেন, ‘হে গুরুদেব আমাদের শিক্ষা সমাপ্ত, আমরা আমাদের গৃহে ফিরে যাব, কৃপা করে আপনি বলুন আপনার গুরু দক্ষিনা সরূপ আমরা আপনার জন্য কি করতে পারি বা কি দিতে পারি। তখন দ্রোণাচার্য বললেন- ‘হ্যাঁ আমি তোমাদের কাছে দক্ষিনা চাই, তোমরা এখন যাও দ্রুপদরাজকে যুদ্ধে পরাস্ত করে বন্দী করে নিয়ে আসো। এখানে আমি দেখব তোমরা কতটা দক্ষতা অর্জন করেছ। সেই সঙ্গে আমার দক্ষিনাও প্রাপ্ত হবে। ১০৫ ভায়ের মধ্যে কে যাবে?’ ১০০ বাই বলে তারা আগে যাবে আর এইদিকে ৫ ভায়ের মধ্যে ভীম বলে সে আগে যাবে।
ভীম সবসময় তৈরি তাকেন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কিন্তু যুধিস্তির অনুমতি না দিলে সে যেতে পারবে না। তো ভীম তখন যুধিস্তির মহারাজের দিকে তাকান এবং মাথা নিচু করে নেই কারণ অনুমতি নেই। তো যুধিস্তির মহারাজ বলেন তোমরা শত ভাই আগে যাও। তখন তারা অত্যন্ত উৎসাহের সাথে শত ভাই গিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন দ্রুপদ রাজার বিরুদে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত দ্রুপদ মহারাজ সেই ১০০ ভাইকে পরাস্ত করে দিলেন। তারা পরাজিত হয়ে ফেরত এলেন। তখন ভীম চিন্তা করলেন নিশ্চয়ই এবার আমার পালা আসবে কিন্তু যুধিস্তির মহারাজ বলেন- ‘অর্জুন তুমি যাও, তুমি একাই যথেষ্ট, যাও গিয়ে দ্রুপদ মহারাজকে বন্দী করে গুরুদেবের কাছে নিয়ে আসো।‘ অর্জুন গিয়ে পরাস্ত করে সেই দ্রুপদ রাজকে বন্দী করে গুরুমহারাজের চরনে এনে দিলেন।
দ্রোণ বসা থেকে উঠে বন্দন খুলে দিলেন এবং বলেন- ‘বন্ধু তোমার কি মনে পড়ে সেই গুরুকুল জীবনের প্রতিশ্রুতি? তুমি বলেছিলে তোমার রাজ্যের অর্ধাংশ তুমি আমাকে প্রদান করবে। তাই তোমার সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নদীর এপারের রাজ্যটা আমি নিলাম আর নদীর ওপারের রাজ্য তোমার দক্ষলে থাকল।‘
দ্রুপদ রাজকে ছেড়ে দেওয়া হল কিন্তু দ্রুপদ রাজ অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে তিনি আর রাজ্যে ফিরলেন না। তিনি তপস্যায় বসলেন শিবের। শিবের কাছে তিনি চাইলেন দ্রোণের মৃত্যু শিব তাঁকে বললেন- ‘ঠিক আছে তুমি বাড়ি গিয়ে একটা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ কর। সেই পুত্রেষ্টি যজ্ঞতে যে পুত্র জন্মগ্রহণ করবে সেই পুত্রই দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর কারণ হবে। সেই পুত্রেষ্টি যজ্ঞ থেকে তিনটি সন্তানের জন্ম হয়, একটি ছেলে, একটি মেয়ে, আর একটি শিখণ্ডি।
এখন প্রশ্ন আসে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ থেকে কন্যা কি করে আসে? এর আবার কাহিনী রয়েছে যে যখনই পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আহুতি করবেন ব্রাহ্মণগন তখন দ্রুপদ রাজার মাথাই একটা বুদ্ধি এল যে এই গুরুদেব দ্রোণাচার্যের একটা কতরনাক শিষ্য আছেন, তাঁর যে সর্জ, বীর্য তা সে দেখেছে, তারমত রাজাকে সে পরাস্ত করে বন্দী করেছিল। তো সেই অর্জুন থাকলে দ্রোণাচার্যকে বধ করা কঠিন হয়ে যাবে তাই অর্জুনকে তাঁর পক্ষে আনার জন্য একটা কন্যা সন্তান চাইল তাই সেই যজ্ঞ থেকে পুত্র ধ্রষ্টাদ্যুম্না, পুত্রী দ্রপদি জন্মগ্রহণ করেন।
সেই পুত্রকে নিয়ে সেই গুরুকুলে হাজির হয়েছে দ্রোণের কাছে। সেখানে গিয়ে সে নিবেদন করেছে যে ‘আমার এই পুত্রকে অস্ত্র শিক্ষা প্রদান করে তাঁকে শিক্ষিত করে তুলুন। আর দ্রোণাচার্য তাঁকে গ্রহণ করে তাঁকে শিখিয়েছেন। আর সেটাই হচ্ছে দ্রোণাচার্যের বড় ভুল যেখানে আজকে শিষ্য দুর্যোধন সেই ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে। প্রভুপাদ বলেছেন- দ্রোণাচার্যের কোন ভুলছিল না, দ্রোণাচার্য ছিলেন ব্রাহ্মণ, উধার, তিনি জানতেন তাঁর কর্তব হচ্ছে শিক্ষা প্রদান করা। কিন্তু দুর্যোধন সেই ভুলা দরে বলেছেন- আপনি না অনাকে শিক্ষা প্রদান করে সবথেকে বুদ্ধিমান করে তুলেছেন। দেখুন আজকে সে আপনার বিরুদ্দে দাঁড়িয়েছে আপনি জানতেন না? আমি আপনার কত অনুগত শিষ্য তাহলে আমাকে কেন সব থেকে বুদ্ধিমান শিষ্য করলেন না?
তাই এখানে দুর্যোধন বলেছেন আপনার শিষ্য ও দ্রুপদের পুত্র যাথে গুরুদেব একটু কিপ্ত হন। দুর্যোধন আরও বলেছেন ৪, ৫ এবং ৬ নং শ্লোকে
অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জুনসমা যুধি।
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ।।(১/৪)।।
ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশিরাজশ্চ বীর্যবান্ ।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ।।(১/৫)।।
যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্যবান্ ।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব এব মহারথাঃ ।।(১/৬)।।
অনুবাদঃ সেই সমস্ত সেনাদের মধ্যে অনেকে ভীম ও অর্জুনের মতো বীর ধনুর্ধারী রয়েছেন এবং যুযুধান ও দ্রুপদের মতো মহাযোদ্ধা রয়েছেন। সেখানে ধৃষ্টকেতু,চেকিতান, কাশিরাজ,পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ ও শৈব্যের মতো অত্যন্ত বলবান যোদ্ধারাও রয়েছেন। সেখানে রয়েছেন অত্যন্ত বলবান যুধামন্যু, প্রবল পরাক্রমশালী উত্তমৌজা,সুভদ্রার পুত্র এবং দ্রৌপদীর পুত্রগণ। এই সব যোদ্ধারা সকলেই এক-একজন মহারধী।
চার প্রকারের সৈন্য ছিল মহারধী, অতিরধী, রধী এবং অর্ধরধী।
মহারধী মানে একজন ১০ হাজার সৈন্যের সাথে লড়তে পারেন।
অতিরধী মানে ১০ হাজারের কম কিন্তু ১ হাজারের বেশি।
রধী মানে একজন একজনের সঙ্গে।
আর অর্ধরধী মানে একজন একজনের সঙ্গেও নয়। মানে আমরা যেমন টিভি তে দেখি অস্ত্র নারানারি করছেন তেমন।
৩ নং শ্লোকের সঙ্গে ৪-৬ নং শ্লোকের মিল, ৩ নং শ্লোকে তিনি গুরুদেবকে কোঁচা দিয়েছে আর ৪-৬ নং শ্লোকে বলেছেন- ‘শুধু তাই নয় গুরুদেব আপনি আরও ভীম ও অর্জুনের শ্রেষ্ঠ ছাত্র বলে ভাবতেন দেখুন তারা আজ আপনার বিরুদ্দে দাঁড়িয়েছেন। কি বুদ্ধি আপনার, আমি আপনার চরনে এসে দাড়িয়ে আছি কিন্তু আপনি ভাবতেন ওরা আপনার শ্রেষ্ঠ ছাত্র। কে ভাল ছাত্র দেখুন।‘
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত সুন্দর করে পাণ্ডব পক্ষরা সৈন্য রচনা করেছে এতে দুর্যোধন কি প্রতিক্রিয়া হবে?
অস্মাকন্ত বিশিষ্টা যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম।
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে।।(১/৭)।।
অনুবাদঃ হে দ্বিজোত্তম! আমাদের পক্ষে যে সমস্ত বিশিষ্ট সেনাপতি সামরিক শক্তিপরিচালনার জন্য রয়েছেন, আপনার অবগতির জন্য আমি তাঁদের সম্বন্ধে বলছি।
দুর্যোধন এখানে কথা ঘুরিয়েছেন, বলছে- ‘গুরুদেব ওদের কথা ছাড়ুন এখন আমি আমাদের সৈন্যবল
কে কে আছে বলছি, দেখন আমাদের দলেও কেউ কম নেই কিন্তু’
তিনি এরম বলেছিল দ্রোণাচার্যকে খুশি করার জন্য।
ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ।
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তিস্তথৈব চ।।(১/৮)।।
অনুবাদঃ সেখানে রয়েছেন আপনার মতোই ব্যক্তিত্বশালী-ভীষ্ম,কর্ণ, কৃপা, অশ্বত্থামা,বিকর্ণ ও সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা, যাঁরা সর্বদা সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে থাকেন।
এরকম বলে তিনি দ্রোণাচার্যকে খুশি করল এবং যুদ্ধ করতে আগ্রহ করে তুললো।
বিকর্ণ কোন যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি ছিলেন দুর্যোধনের একভাই, কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে তাঁর নাম কেন একানে তুলে ধরেছেন?
আচার্যগন বলছেন- বিকর্ণ একটু ধার্মিক প্রকৃতির ছেলে ছিলেন।
-সমাপ্ত-
তৃতীয় দিন
গীতা-মহিমা
গীতাধ্যায়নশীলস্য প্রাণায়মপ্রস্য চ।
নৈব সন্তি হি পাপানি পূর্বজন্মকৃতানি চ।।
কেউ যদি আন্তরিকভাবে এবং অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ভগবদগীতা পাঠ করে, তা হলে ভগবানের করুণায় তাঁর অতীতের সমস্ত পাপকর্মের ফল তাঁকে প্রভাবিত করে না।
যুদ্ধক্ষেত্রে দুপক্ষের সেনা রয়েছে, কৌরবদের পক্ষে রয়েছেন একাদশ অক্সহেনি আর পাণ্ডবদের পক্ষে রয়েছেন সাত অক্সহেনি।
অন্যে চ বহুবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ।
নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সর্বে যুদ্ধবিশারদাঃ।।৯।।
অনুবাদঃ এ ছাড়া আরও বহু সেনানায়ক রয়েছেন, যাঁরা আমার জন্য তাঁদের জীবন ত্যাগকরতে প্রস্তুত। তাঁরা সকলেই নানা প্রকার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং তাঁরা সকলেই সামরিক বিজ্ঞানে বিশারদ।
দুর্যোধনের এই কথা থেকে আমারা বুঝতে পারি যে, পাপি দুর্যোধনের পক্ষ নেওয়ার জন্য তাঁদের সকলের মৃত্যু অবদারিত ছিল।
অপর্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্ ।
পর্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্ ।।১০।।
অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমস্থিতাঃ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষস্ত ভবন্তঃ সর্ব এব হি।।১১।।
অনুবাদঃ আমাদের সৈন্যবল অপরিমিত এবং আমরা পিতামহ ভীষ্মের দ্বারা পূর্ণরূপেসুরক্ষিত, কিন্ত ভীমের দ্বারা সতর্কভাবে সুরক্ষিত পান্ডবদের শক্তি সীমিত। এখন আপনার সকলে সেনাব্যূহের প্রবেশপথে নিজ নিজ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থিত হয়েপিতামহ ভীষ্মকে সর্বতোভাবে সাহায্য প্রদান করুন।
এই শ্লোকের কিছু গুড় অর্থ আছে-
দ্রোণ এবং ভীষ্ম, দুর্যোধনের দলে যুদ্ধ করছে কিন্তু তারা পাণ্ডবদের খুব স্নেহ করতেন তাই দুর্যোধনের সন্দেহ যে এরা আমার দলে রয়েছে ঠিক কিন্তু এরা পুরপুরি আমাদের দলের সম্রতক না, তাই এদের উপর আমার সন্দেহ আছে।
ভীষ্মদেবকে তিমিঙ্গিল বলা হয়েছে, তিমি মাছ যেমন বাকি মাছকে গিলে খেতে পারে ঠিক তেমনি ভীষ্মদেব একা পুরো যুদ্ধক্ষেত্রকে গিলে শেষ করে দিতে পারে। তিনি এই জগতে ছিলেন মাত্র ৪৫৬ বছর।
তস্য সঞ্জনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ।
সিংহনাদং বিনদ্যাচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্ ।।১২।।
অনুবাদঃ তখন কুরুবংশের বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম দুর্যোধনের হর্ষ উৎপাদনেরজন্য সিংহের গর্জনের মতো অতি উচ্চনাদে তাঁর শঙ্খ বাজালেন।
ভীষ্ম, দুর্যোধনের সন্দেহের প্রতিউত্তর দিলেন খুব জোরে শঙ্খ বাজিয়ে। তিনি মুখে কিছু বলেন না কিন্তু তাঁর উত্তর তিনি দিয়েছেন।
ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ ।
সহসৈবাভ্যহন্যস্ত স শব্দস্তুমুলোহভবৎ।।১৩।।
অনুবাদঃ তারপর শঙ্খ, ভেরী, পণব,আনক, ঢাক ও গোমুখ শিঙাসমূহ হঠাৎ একত্রে ধ্বনিত হয়ে এক তুমুল শব্দের সৃষ্টি হল।
ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ।
মাধবঃ পান্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদ্ধমতুঃ।।১৪।।
অনুবাদঃ অন্য দিকে, শ্বেত অশ্বযুক্ত এক দিব্য রথে স্থিত শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন উভয়ে তাঁদের দিব্য শঙ্খ বাজালেন।
এখানে সঞ্জয় খুব উৎসাহের সাথে বিস্তারভাবে পাণ্ডবদের শঙ্খের কথা বলেছেন।
শ্বেত অশ্বযুক্ত সেই দিব্য রথ যার নাম অজেয় রথ, অর্জুনকে অগ্নিদেব দিয়েছিলেন। ত্রিভুবানে অপরাজেয় এই রথ।
অর্জুনের রথ ছিল দিব্য, শঙ্খ ছিল দিব্য, তুনির (যেখানে অস্ত্র রাখা হয়) দিব্য।
সেই তুনিরে কোনদিন অস্ত্র শেষ হবে না।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সঞ্জয় এখানে মাধব বলে সমদন করেছেন, এটি একটা লক্ষনিয় বিষয়।
মাধব কথা অর্থ হচ্ছে নিজি লক্ষ্মীদেবির স্বামী। ভগবান যে পক্ষে যোগদান করে সোভাগ্য লক্ষ্মীও সেই দলে থাকে। কেননা লক্ষ্মীদেবী তাঁর পতির অনুগামী। এখানে সঞ্জয় ইঙ্গিত দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন যে পাণ্ডবদের জয় হবে।
আমাদের মায়াপূরেও রাধামাধব রয়েছে। প্রভুপাদ যখন এই রাধামাধব প্রতিষ্ঠা করে ১৯৭২ সালে, তখন আমাদের main gate এর পাশে ভজন কুটির, ওইটুকু জায়গা ছিল। আর এই যে TOVP, গৌরনগর, অভয়নগর, গঙ্গানগর- এগুল সব প্রভুপাদ তখন থেকে plan- নকসা করে দিয়ে গেছেন। প্রভুপাদের এক শি্ষ্য জিজ্ঞেসা করেছিলেন- প্রভুপাদ আমাদেরতো মাত্র ১০ কাটা জমি, আপনার এই প্লান কিকরে হবে, নাকি এই প্লান খাতায় থেকে যাবে? প্রভুপাদ বলেছিলেন আমি তোমাদের দিয়েছি রাধামাধব, মাধবের সেবা মন দিয়ে, ঠিকটাক ভাবে করলে লক্ষ্মী এসে এই মায়াপুর নিজে তৈরি করবে।
পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ।
পৌন্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্মা বৃকদরঃ।।১৫।।
অনুবাদঃ তখন, শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য নামক তাঁর শঙ্খ বাজালেন, অর্জুন বাজালেনতাঁর দেবদত্ত নামক শঙ্খ এবং বিপুল ভোজনপ্রিয় ও ভীমকর্মা ভীমসেন বাজালেন পৌন্ড্র নামক তাঁর ভয়ংকর শঙ্খ।
এই শ্লোকে সঞ্জয়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর অর্জুনকে বিশেষ নামে ডেকেছেন। এখানে কৃষ্ণকে হৃষীকেশ বলেছেন, হৃষীকেশ মানে- হৃষী অর্থাৎ ইন্দ্রিয় , এই একাদশ ইন্দ্রিয়কে যে পরিচালনা করে তিনি হলেন হৃষীকেশ। আর অর্জুনকে বলেন ধনঞ্জয়। ভীমকে বলেছেন বৃকদর, ভীমের উদরে একটা বৃকদর নামক অগ্নি বাস করত, তাঁর কখন পেত ভরত না, সে প্রচুর খেত।
পঞ্চ পাণ্ডবেরা যখন একাচক্রতে অগেতবাসে এসেছিলেন, তখন তারা পাঁচ ভাই ভিক্ষা করত এবং তাঁর মা রান্না করতো, তারা এক ব্রাহ্মণের গৃহে বাস করত। একদিন মা কুন্তী দেখে সেই ব্রাহ্মণের গৃহে কান্নার রোল বসেছে। কুন্তীদেবী গিয়ে তাঁদের কান্নার কারণ জানতে চাইল, তারা বলে, তাঁদের গ্রামে এক বক রাক্ষস বাস করে, আর সে যখন তখন এসে গ্রামে ডুকে পরত, মানুষ খেয়ে ফেলত, আর খুব উৎপাত করতো। তাই গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করল যে ‘হে বক রাক্ষস এভাবে তুমি আসবে না, আমরা প্রতিদিন তোমার জন্য খাবার পাতাবো।‘ তখন রাক্ষস তাঁদের কথাই রাজি হয়। তো খাওয়ার জন্য একটা condition করা হয়েছিল যে তাঁর জন্য এক গরুগাড়ি খাবার যাবে, দুটো গরু যাবে, আর গাড়ির চালক যাবে, আর সেই রাক্ষস তাঁদের সবাই ক খাবে যারা যাবে।
এভাবে চলছিল, তো অইদিন ছিল ওই ব্রাহ্মণের পালা, ব্রাহ্মণের বাড়িতে ৩জন থাকে। তো সেই ৩ জনের মধ্যে কে যাবে সেই নিয়ে কান্নাকাটি চলছে। তখন কুন্তীদেবী বলল ‘আমার তো পাঁচ ছেলে, তাই আমার এক ছেলেকে আমি পাটিয়ে দিচ্ছি’ তখন ব্রাহ্মণ বলল ‘টা কি করে হয়ই আপনারা তো অতিথি, আমরা আপনাকে পাঁটাতে পারিনা’। কুন্তীদেবী বললেন ‘সেরম কিছু ভাবেন না আমার একটা ছেলে আছে সে সব ঠিকটাক করে দিয়ে আসবে, আপনাদের চিন্তা করতে হবে না’। পাঁচ ভাই ভিক্ষা করতে যাচিল কুন্তীদেবী সবাইকে যেতে বলল কিন্তু ভীমকে বলল ‘তুমি থাক, তমাক একটা কাজ করতে হবে’ ভীম- ‘কি কাজ মা?’ কুন্তী মাতা- ‘এক গরুরগাড়ি খাবার নিয়ে তমাক যেতে হবে জঙ্গলে’ তো ভীম কথাই যেতে হবে শুনেনই, শুনেছে এক গরুর গাড়ি খাবার। আর শুনেই খুব খুশির সাথে কাজ করতে চাইল। কুন্তীদেবী বলল ‘শোন মন দিয়ে, একটা বক রাক্ষস এখানে বাস করছে, তাঁর জন্য এক গরুর গাড়ি খাবার পাঁটাতে হয় প্রতিদিন। আজকে তুমি খাবার নিয়ে যাবে আর সেই বক রাক্ষসকে বধ করে চলে আসবে’। ভীম- ‘হ্যাঁ কোন ব্যাপার না’। ভীম রাস্তাই যেতে যেতে সব খাবার নিজেই খেয়ে নিয়েছে। তাই ভীমের যেতে যেতে অনেক দেরী হয়ে গেছে। এদিকে বক রাক্ষসের কিদায় পেত বেথা করছে। ভীম পৌঁছে বলছে ‘এই বক রাক্ষস কোই তুই বেরিয়ে আয়’। বক রাক্ষস বলছে ‘কেরে তুই এমনিতেই দেরী করে এসচিস, তাঁর উপর আবার নাম ধরে ডাকছিস’। ভীম তাঁকে একটা গাছ চুরে মেরে বলল ‘আগে brush কর তারপর খাওয়া দাওয়া হবে’। বক রাক্ষস অবাক হয়ে গেছে। বক রাক্ষসও রেগে গাছ তুলে ভীমের দিকে চুরে মারে। এভাবে গাছ তুলে তুলে যুদ্ধ করতে করতে পুরো জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে গেছে। শেষে ভীম বক রাক্ষসকে বধ করেছে। আর একদিকে বাড়ি এসে যুধিষ্ঠির, ভীমকে দেখতে না পেয়ে খুব অস্তির হয়ে পড়ে। কুন্তীদেবী তখন সব কুলে বলল। যুধিষ্ঠির তখন বলল- মা, তুমি মা হয়ে কিকরে ভীমকে রাক্ষসের কাছে পাটালে? তখন কুন্তী মাতা বলে – তুমি চিন্তা কর না ভীমের উপর আমার আশীর্বাদ আছে। যুধিষ্ঠির মহারাজ আর থাকতে পারলেন না, তিনি অর্জুনকে পাটালেন। অর্জুন জঙ্গলে পৌঁছাবার আগেই ভীমকে রক্ষা করার জন্য এবং রাক্ষসকে বধ করার জন্য একটি নাগবান চারলেন। কিন্তু সেই বানের আগেইতো ভীম সেই রাক্ষসকে বধ করে দিলেন। সেই নাগবান, নাগ রূপে থেকে গেল।
তো এভাবে সঞ্জয় ইঙ্গিত দিল যে যুদ্ধ পাণ্ডবরাই জিতবে।
-সমাপ্ত-
চতুর্থ দিন
গীতা-মাহাত্ম্য
গীতা সুগীতা কর্তব্যা কিমন্যৈঃ শাস্ত্রবিস্তরৈঃ।
যা স্বয়ং পদ্মনাভস্য মুখপদ্মাদ্ বিনিঃসৃতা।।৩।।
যেহেতু ভগবদগীতার বাণী স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী, তাই এই গ্রন্থ পাঠ করলে আর অন্যকোন বৈদিক সাহিত্য পড়বার দরকার হয় না।
অর্জুনের ১০টা নাম শাস্ত্রে পাওয়া যায়, তাঁর বিভিন্ন কীর্তির জন্য-
• সবসময় নির্মল কাজ করতেন বলে তাঁর নাম ছিল অর্জুন।
• হিমালয় পর্বতের উত্তর ফাল্গুনি নকত্রে তাঁর জন্ম হয়েছে বলে আরেক নাম ফাল্গুনি।
• দুরদশ শত্রু বিজয়কারি বলে তাঁর আরেক নাম ছিল জিষ্ণু।
• দেবরাজ ইন্দ্র প্রিত হয়ে তাঁকে কিরীট প্রদান করেছিলেন মস্তকে দারণ করার জন্য, তাই তাঁর নাম ছিল কিরীটী।
• শ্বেতাত যুক্ত রথে যুদ্ধ করেছিলেন বলে তাঁর আরেক নাম ছিল শ্বেতবাহন।
• যুদ্ধ কালে কখন কোন বিবতস কাজ করেনি বলে তাঁর নাম ছিল বিবতসু।
• যুদ্ধ স্তলে বীরগনদের না হারিয়ে নিবৃত হতেন না তাই তাঁর নাম ছিল বিজয়।
• কৃষ্ণ বর্ণ ছিলেন বলে তাঁর পিতা নাম দিয়েছিলেন কৃষ্ণ।
• দুই হাতেই ধ্নুক চালাতে তিনি পারদর্শী ছিলেন বলে তাঁর নাম ছিল সব্যসাচী।
• সমস্ত জনগণকে জয় করে, সমস্ত রাজনদের জয় করে ধন সংগ্রহ করেছিলেন বলে তাঁর নাম ধনঞ্জয়।
অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ।।১৬।।
কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখন্ডী চ মহারথঃ।
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ।।১৭।।
দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্বশঃ পৃথিবীপতে।
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মুঃ পৃথক্ পৃথক্।।১৮।।
অনুবাদঃ কুন্তীপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামক শঙ্খ বাজালেন এবং নকুল ও সহদেব বাজালেন সুঘোষ ও মণিপুষ্প নামক শঙ্খ। হেমহারাজ!তখন মহান ধনুর্ধর কাশীরাজ, প্রবল যোদ্ধা শিখন্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন,বিরাট, অপরাজিত সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, সুভদ্রার মহা বলবান পুত্র এবং অন্য সকলে তাঁদের নিজ নিজ পৃথক শঙ্খ বাজালেন।
সঞ্জয় এই শ্লোকে যুধিষ্ঠিরকে রাজা বলেছেন, কেননা তিনি জানতেন কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিরই রাজা হবেন।
স ঘোষো ধার্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ।
নভশ্চ পৃথিবীং চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন্ ।।১৯।।
অনুবাদঃ শঙ্খ-নিনাদের সেই প্রচন্ড শব্দ আকাশ ও পৃথিবী প্রতিধ্বনিত করে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হৃদয় বিদারিত করতে লাগল।
কৌরব পক্ষের সবাই যখন একসঙ্গে শঙ্খ বাজিয়েছিলেন তখন তুমুল শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল,আর কিছু হয়ই নি কিন্তু যখন পাণ্ডবেরা সবাই শঙ্খ বাজিয়েছিলেন তখন কৌরব পক্ষের সকলের হৃদয় কম্পিত হয়েছিল। শঙ্খ ধনী শুনেয় অনেকে মারা গিয়েছিল কৌরব পক্ষের।
অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ।
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পান্ডবঃ।
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে।।২০।।
অনুবাদঃ সেই সময় পান্ডুপুত্র অর্জুন হনুমান চিহ্নিত পতাকা শোভিত রথে অধিষ্ঠিত হয়ে. তাঁর ধনুক তুলে নিয়ে শর নিক্ষেপ করতে প্রস্তুত হলেন। হে মহারাজ!ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সমরসজ্জায় বিন্যস্ত দেখে, অর্জুন তখন শ্রীকৃষ্ণকে এই কথাগুলি বললেন
অর্জুনের রথের উপরের পতাকাই হনুমান চিহ্নিত ছিল, কেননা রামায়নে হনুমান রামকে যুদ্ধে জিতে সাহায্য করেছিলেন। এটি তাঁদের একটি জয়ের লক্ষণ ছিল।
বদরিনাথ এর ওখানে একটি জায়গা আছে হনুমান চটি বলে, পঞ্চ পাণ্ডব বনবাস কালে এই বদ্রিকা আশ্রমে গিয়েছিল। একদিন সেখানের গঙ্গায় ভেসে আসছে শতদল পদ্ম, যেগুলো অপূর্ব সুন্দর আর সেই পদ্ম দেখে দ্রপদি আকৃষ্ট হয়েছিল। তখন যুধিষ্ঠির ভীমকে পাটাই সেই পদ্ম কোথা থেকে আসছে দেখার জন্য। ভীম পদ্মের সরোবর দেখার জন্য উপরের দিকে যাচিল, যেতে যেতে সে দেখে একটি বৃদ্ধ বানর তাঁর লম্বা লেজটি রাস্তার উপর রেখে বসে আছে। পঞ্চ পাণ্ডবদের একটা রীতি ছিল, যে তারা কোন প্রাণীকে ডিঙ্গিয়ে জেতেন না। তখন ভীম বল- ‘এই বানর তোমার লেজটা গুটিয়ে নাও।‘ সেই হনুমান কোন প্রতিউত্তর করেনি। ভীম ২-৩ রেগে গিয়ে বলল- ‘কি হল, এতা সরাও, তুমি জান আমি কে? আমি হচ্ছি ভীম‘। সেই হনুমান ছিল অত্যন্ত বৃদ্ধ, সে তাঁর চোখের পাতা তুলে বলল- ‘কে তুমি? তোমার যদি অসুবিধা থাকে, আমি অনেক বৃদ্ধ, আমি সরাতে পারব না, তুমি নিজে সরিয়ে চলে যাও।‘ ভীম অনেক অপমানিত বোধ করে, বাম হাতে লেজটা তুলে গেছে। সে লেজ দরে দেখে সেই লেজ রডের মত শক্ত আর অনেক বাড়ি। ভীম এক হাতে সেটি তুলতে পারল না, দুই হাতে ও পারল না। তখন ভীম তাঁর ভুল বুঝতে পেরে হাত জোর করে ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন- ‘হে প্রভু আপনি কে? এখানে বানর রূপে কেন বসে আছেন?’ তখন সেই বানর তাঁর আসল রুপ দেখাল। বানরটি বলল- ‘আমি তোমার বড় ভাই হনুমান, আমি ও পবন পুত্র আর তুমিও পবন পুত্র। বল ভাই আমি তোমার জন্য কি সাহায্য করতে পারি?’ তখন ভীম বলল- ‘এই ১২বছর বনবাসের পড় আমাদের যুদ্ধ আছে। আমি চাই আপনি যেমন ভগবান রামচন্দ্রকে জিতে সাহায্য করেছিলেন, আমাদেরও সাহায্য করুন’ হনুমান বলল- ‘অবশ্যই! ভগবান যে রথটা চালাবে যাতে অর্জুন যুদ্ধ করবে সেই রথের পতাকাই আমার ছবি রাখবে। যখন তোমাদের পক্ষের সবাই শঙ্খ বাজাবে তখন তোমাদের সাথে আমিও চিৎকার করব, যাতে কৌরব পক্ষের সবার হৃদয় কম্পিত হয়।‘
অর্জুন উবাচ
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত।
যাবদেতান্নিরীক্ষেহহং যোদ্ধুকামানবস্থিতান্ ।।২১।।
কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে।।২২।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে অচ্যুত! তুমি উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে আমার রথ স্থাপন কর, যাতে আমি দেখতে পারি যুদ্ধ করার অভিলাষী হয়ে কারা এখানে এসেছে এবং এই মহা সংগ্রামে আমাকে কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে।
অর্জুন এখানে ভগবানকে অচ্যুত বলেছেন কারণ ভগবান অর্জুনের রথের সারথি হলেও, তিনি ভগবানের পথ থেকে চ্যুত নন। তিনি তাঁর স্থানে অচ্যুত।
যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্র সমাগতাঃ।
ধার্তরাষ্ট্রস্য দুর্বদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ।।২৩।।
অনুবাদঃ ধৃতরাষ্ট্রের দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন পুত্রকে সন্তুষ্ট করার বাসনা করে যারা এখানে যুদ্ধ করতে এসেছে, তাদের আমি দেখতে চাই।
সঞ্জয় উবাচ
এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্।।২৪।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন-হে ভরত-ভংশধর!অর্জুন কর্তৃক এভাবে আদিষ্ট হয়ে, শ্রীকৃষ্ণ সেই অতি উত্তম রথটি চালিয়ে নিয়ে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে রাখলেন।
ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ সর্বেষাং চ মহীক্ষিতাম্ ।
উবাচ পার্খ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি।। ২৫।।
অনুবাদঃ ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ পৃথিবীর অন্য সমস্ত নৃপতিদের সামনে ভগবান হৃষীকেশ বললেন, হে পার্থ! এখানে সমবেত সমস্ত কৌরবদের দেখ।
তত্রাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পিতৃনথ পিতামহান্।
আচার্যান্মাতুলান্ ভ্রাতৃন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা।
শ্বশুরান্ সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি।। ২৬।।
অনুবাদঃ তখন অর্জুন উভয় পক্ষের সেনাদলের মধ্যে পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, শশুর, মিত্র ও শুভাকাঙ্খীদের উপস্থিত দেখতে পেলেন।
তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্বান্ বন্ধুনবস্থিতান্।
কৃপয়া পরায়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীৎ।।২৭।।
অনুবাদঃ যখন কুন্তীপুত্র অর্জুন সকল রকমের বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনদের যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থিত দেখলেন, তখন তিনি অত্যন্ত কৃপাবিষ্ট ও বিষণ্ণ হয়ে বললেন।
অর্জুন উবাচ
দৃষ্ট্বেমং স্বজনং কৃষ্ণ যুযুৎসুং সমুপস্থিতম্।
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখং চ পরিশুষ্যতি।।২৮।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে প্রিয়বর কৃষ্ণ! আমার সমস্ত বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়- স্বজনদের এমনভাবে যুদ্ধাভিলাষী হয়ে আমার সামনে অবস্থান করতে দেখে আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ হচ্ছে এবং মুখ শুষ্ক হয়ে উঠছে।
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্যশ্চ জায়তে।
গান্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিদহ্যতে।।২৯।।
অনুবাদঃ আমার সর্বশরীর কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হচ্ছে, আমার হাত থেকে গান্ডীব খসে পড়ছে এবং ত্বক যেন জ্বলে যাচ্ছে।
ন চ শক্নোম্যবস্থাতুং ভ্রুমতীব চ মে মনঃ।
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব।।৩০।।
অনুবাদঃ হে কেশব! আমি এখন আর স্থির থাকতে পারছি না। আমি আত্মবিস্মৃত হচ্ছি এবং আমার চিত্ত উদভ্রান্ত হচ্ছে। হে কেশী দানবহন্তা শ্রীকৃষ্ণ! আমি কেবল অমঙ্গলসূচক লক্ষণসমূহ দর্শন করছি।
ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।।৩১।।
অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ! যুদ্ধে আত্মীয়-স্বজনদের নিধন করা শ্রেয়স্কর দেখছি না। আমি যুদ্ধে জয়লাভ চাই না, রাজ্য এবং সুখভোগও কামনা করি না।
অর্জুন আতিয় স্বজনদের সবাইকে দেখে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ল এবং যুদ্ধ করতে চাইল না, তাঁর মদ্দে বৈরাগ্য ভাব চলে এল।
জীবন যুদ্ধে আমরা যখন ভক্তি কুরতে চাইব তখন ঠিক এভাবে আমাদের বিপক্ষে আমাদের আতিয় স্বজনেরা থাকবে, যারা আমাদেরকে ভক্তি করতে দেবে না। তখন আমাদের কি করণীয় তা আমরা এই অর্জুনের পরিস্থিতি থেকে জানতে পারব।
কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা।
যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ।।৩২।।
ত ইমেহবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্তা ধনানি চ।
আচার্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ।।৩৩।।
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা।
এতান্ন হস্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধূসূদন।।৩৪।।
অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে।
নিহত্য ধার্তরাষ্ট্রন্নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দন।।৩৫।।
অনুবাদঃ হে গোবিন্দ! আমাদের রাজ্যে কি প্রয়োজন, আর সুখভোগ বা জীবন ধারণেই বা কী প্রয়োজন, যখন দেখছি-যাদের জন্য রাজ্য ও ভোগসুখের কামনা, তারা সকলেই এই রণক্ষেত্রে আজ উপস্থিত? হে মধুসূদন! যখন আচার্য,পতিৃব্য,পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও আত্মীয়স্বজন, সকলেই প্রাণ ও ধনাদির আশা পরিত্যাগ করে আমার সামনে যুদ্ধে উপস্থিত হয়েছেন, তখন তাঁরা আমাকে বধ করলেও আমি তাঁদের হত্যা করতে চাইব কেন? হেসমস্ত জীবের প্রতিপালক জনার্দন! পৃথিবীর তো কথাই নেই, এমন কি সমগ্র ত্রিভুবনের বিনিময়েও আমি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত নই। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের নিধন করে কি সন্তোষ আমরা লাভ করতে পারব?
পাপমেবাশ্রয়েদস্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ।
তস্মান্নার্হা বয়ং হস্তুং ধার্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্ ।
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব।।৩৬।।
অনুবাদঃ এই ধরনের আততায়ীদের বধ করলে মহাপাপ আমাদের আচ্ছন্ন করবে। সুতরাং বন্ধুবান্ধব সহ ধৃতরাষ্ট্রেরপুত্রদের সংহার করা আমাদের পক্ষে অবশ্যই উচিত হবে না। হে মাধব, লক্ষীপতি শ্রীকৃষ্ণ!আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে আমাদের কী লাভ হবে? আর তা থেকে আমরা কেন করে সুখী হব?
শাস্ত্র ৬ প্রকার লোকে মারলে পাপ হয়ই না
• যে বিষ প্রয়োগ করে।
• যে ঘরে আগুন লাগাই।
• যে মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে আক্রম করে।
• যে ধন সম্পদ লুট করে।
• যে অনের জমি দকল করে।
• যে বিবাহিত স্ত্রীকে হরন করে।
এই ৬ টি কাজ কৌরবরা করেছিল তাই কৌরবদের মারলে অর্জুনের কোন পাপ হত না। কিন্তু অর্জুন যেহেতু ভক্ত ছিল তাই তাঁর পক্ষে তাদেরকে মারা অত্যন্ত কঠিন ছিল।
যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্।।৩৭।।
কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্তিতুম্।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দন।।৩৮।।
অনুবাদঃ হে জনার্দন! যদিও এরা রাজ্যলোভে অভিভুত হয়ে কুলক্ষয় জনিত দোষ ওমিত্রদ্রোহ নিমিত্ত পাপ লক্ষ্য করছে না, কিন্তু আমরা কুলক্ষয় জনিত দোষ লক্ষ্য করেও এই পাপকর্মে কেন প্রবুত্ত হব?
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ।
ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোহভিভবত্যুত।।৩৯।।
অনুবাদঃ কুলক্ষয় হলেও সনাতন কুলধর্ম বিনষ্ট হয় এবং তা হলে সমগ্র বংশ অধর্মে অভিভুত হয়।
অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলুস্ত্রয়ঃ।
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ।।৪০।।
অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ! কুল অধর্মের দ্বারা অভিভুত হলে কুলবধূগণ ব্যভিচারেপ্রবুত্ত হয় এবং হে বার্ষ্ণেয়! কুলস্ত্রীগণ অসৎ চরিত্রা হলে অবাঞ্চিত প্রজাতি উৎপন্ন হয়।
সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিন্ডোদকক্রিয়াঃ।।৪১।।
অনুবাদঃ বর্ণসঙ্কর উৎপাদন বৃদ্ধি হলে কুল ও কুলঘাতকেরা নরকগামী হয়।সেইকুলে পিন্ডদান ও তর্পণক্রিয়া লোপ পাওয়ার ফলে তাদের পিতুপুরুষেরাও নরকে অধঃপতিত হয়।
দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণস্করকৈঃ।
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ।।৪২।।
অনুবাদঃ যারা বংশের ঐতিহ্য নষ্ট করে এবং কার ফলে অবাঞ্চিত সন্তানাদি সৃষ্টি করে, তাদের কুকর্মজনিত দোষের ফলে সর্বপ্রকার জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প এবং বংশের কল্যাণ-ধর্ম উৎসন্নে যায়।
উৎসন্নকুলধর্মাণাং মনষ্যাণাং জনার্দন।
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম।।৪৩।।
অনুবাদঃ হে জনার্দন!আমি পরম্পরাক্রমে শুনেছি যে, যাদের কুলধর্ম বিনষ্ট হয়েছে, তাদের নিয়ত নরকে বাস করতে হয়।
অহো বত মহৎ পাপং কর্তুং ব্যবসিতা বয়ম্।
যদ্ রাজ্যসুখলোভেন হস্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ।।৪৪।।
অনুবাদঃ হায়! কী আশ্চর্যের বিষয় যে, আমরা রাজ্যসুখের লোভে স্বজনদের হত্যা করতে উদ্যত হয়ে মহাপাপ করতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছি।
যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ।
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ।।৪৫।।
অনুবাদঃ প্রতিরোধ রহিত ও নিরস্ত্র অবস্থায় আমাকে যদি শস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা যুদ্ধে বধ করে, তা হলে আমার অধিকতর মঙ্গলই হবে।
সঞ্জয় উবাচ
এবমুক্তার্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ।
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ।।৪৬।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- রণক্ষেত্রে এই কথা বলে অর্জুন তাঁর ধনুর্বাণ ত্যাগ করে শোকে ভারাক্রান্ত চিত্তে রথোপরি উপবেশন করলেন।
-সমাপ্ত-
পঞ্চম দিন
গীতা-মাহাত্ম্য
মলিনে মোচনং পুংসাং জলস্নানং দিনে দিনে।
সকৃদ্ গীতামৃতস্নানং সংসারমলনাশনম্।।
“প্রতিদিন জলে স্নান করে মানুষ নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে পারে, কিন্তু কেউ যদি ভগবদগীতার গঙ্গাজলে একটি বারও স্নান করে, তা হলে জড় জীবনের মলিনতা একেবারেই বিনষ্ট হয়ে যায়।”
সঞ্জয় উবাচ
তং তথা কৃপয়াবিষ্টমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্।
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ।।১।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন-অর্জুনকে এভাবে অনুতপ্ত, ব্যাকুল ও অশ্রুসিক্ত দেখে, কৃপায় আবিষ্ট হয়ে মধুসূদন বা শ্রীকৃষ্ণ এই কথাগুলি বললেন।
শ্রীভগবানুবাচ
কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্।
অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন।।২।।
অনুবাদঃ পুরুষোত্তম শ্রীভগবান বললেন-প্রিয় অর্জুন, এই ঘোর সঙ্কটময় যুদ্ধস্থলে যারা জীবনের প্রকুত মূল্য বোঝে না, সেই সব অনার্যের মতো শোকানল তোমার হৃদয়ে কিভাবে প্রজ্বলিত হল? এই ধরনের মনোভাব তোমাকে স্বর্গলোকে উন্নীত করবে না, পক্ষান্তরে তোমার সমস্ত যশরাশি বিনষ্ট করবে।
ভগবান এখানে অর্জুনকে বকা দিয়েছেন। এখানে লেখা আছে শ্রীভগবান উবাচ। ভগবান এর সংজ্ঞা প্রভুপাদ এই শ্লোকের তাৎপর্যে দিয়েছেন- ভগবান তাকেই বলা হয়, যার মধ্যে সমগ্র ঐশ্বর্য, সমগ্র যশ, সমগ্র বীর্য, সমগ্র শ্রী, সমগ্র জ্ঞান, সমগ্র বৈরাগ্য পূর্ণ মাত্রাই বর্তমান আছে তাঁকে বলা হয়ই ভগবান।
দেবদেবীরা হচ্ছে ঈশ্বর, তারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ যেমন বৃষ্টির ঈশ্বর, বায়ুর ঈশ্বর, আলোর ঈশ্বর , মাটির ঈশ্বর। ঈশ্বরের উপরে হচ্ছে মহেশ্বর বা শিব। মহেশ্বরের উপরে পরমেশ্বর অর্থাৎ নারায়ণ, বিষ্ণু, রাম, নরসিংহদেব। আর পরমেশ্বরের উপরে হচ্ছে পরাতপরশ্বর ভগবান কৃষ্ণ।
আমরা শাস্ত্র না পড়ে বলি সব ভগবান এক কিন্তু না, এতা উচিত না। কৃষ্ণ হচ্ছে একমাত্র ভগবান। ভগবান কে তা জানতে গেলে গীতা পড়তে হবে।
কৃষ্ণের তিনটে স্বরূপ রয়েছে- দ্বারকার কৃষ্ণ যিনি হচ্ছে পূর্ণ, মথুরার কৃষ্ণ যিনি হচ্ছে পূর্ণতর, বৃন্দাবনের কৃষ্ণ যিনি হচ্ছে পূর্ণতম। আর মহাপ্রভু এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরম্পরা ধারাই তিনি পূর্ণতম ব্রজেন্দ্র নন্দন পূর্ণতম কৃষ্ণের সেবা করার পন্থা প্রদান করেছেন।
আমাদের আরাধ্য দেবতা হচ্ছে ব্রজেন্দ্র নন্দন কৃষ্ণ এবং সেই কৃষ্ণই গীতাই অর্জুনকে জ্ঞান প্রদান করছে।
এখানে ভগবান যে ধর্মের কথা প্রতিষ্ঠা করতে যাছেন তা হল সনাতন ধর্ম। সনাতন মানে হচ্ছে আত্মা, আমাদের এই দেহটা সনাতন্ না কারণ দেহটা নষ্ট হবেই। দেহের বেতর একটা আত্মা আছে সেটি হচ্ছে সনাতন। সনাতন কথার অর্থ হচ্ছে নিত্য বা যা কখন নষ্ট হয় না।
ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।৩।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! এই সম্মান হানিকর। ক্লীবত্বের বশবর্তী হয়ো না। এই ধরনের আচরণ তোমার পক্ষে অনুচিত। হে পরন্তপ!হৃদয়ের এই ক্ষুদ্র দুর্বলতা পরিত্যাগ করে তুমি উঠে দাঁড়াও।
অর্জুন উবাচ
কথং ভীষ্মমহং সংখ্যে দ্রোণং চ মধুসূদন।
ইষুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজার্হাবরিসূদন।।৪।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন-হে অরিসূদন! হে মধুসূদন! এই যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্ম ও দ্রোণের মতো পরম পূজনীয় ব্যক্তিদের কেমন করে আমি বাণের দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব।
পরন্তপ অর্থাৎ শত্রুকে হত্যা করা, তাই অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন যে এই যুদ্ধেতো সবাই তাঁর আত্মীয়, গুরুজন, পূজনীয়। সে কাকে শত্রু বলে হত্যা করবে। গুরজনদের সামনে কথা কাটাকাটি করাটাও উচিত না তাহলে সে কীভাবে তাঁদের সাথে যুদ্ধ করবে? তুমি অনেক শত্রু, রাক্ষসকে বধ করেছ কিন্তু তুমি কি তোমার গুরুদেব সন্দিপনি মুনিকে বধ করতে পারবে? তাহলে কেন তুমি আমাকে এই কাজ করতে বলছ।
গুরুনহত্বা হি মহানুভাবান্
শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে।
হত্বার্থকামাংস্তু গুরুনিহৈব
ভুঞ্জীয় ভোগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্।।৫।।
অনুবাদঃ আমার মহানুভক শিক্ষাগুরুদের জীবন হানি করে এই জগৎ ভোগ করার থেকে বরং ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করা ভাল। তাঁরা পার্থিব বস্তুর অভিলাষী হলেও আমার গুরুজন। তাঁদের হত্যা করা হলে, যুদ্ধলব্ধ সমস্ত ভোগ্যবস্তু তাঁদের রক্তমাখা হবে।
অর্জুন হাত জোর করে কৃষ্ণকে বলছেন “আমার গুরুজন ও শিক্ষাগুরুকে আমি হত্যা করতে পারব না। এদেরকে হত্যা করে যদি আমি রাজ্য ভোগ করি তাহলে তা রক্তমাখা হবে এবং পাপ হবে।“
এই কথা গুল বলার সময়ই অর্জুন আর ক্ষত্রিয় ছিল না কেননা ক্ষত্রিয়রা কোনদিনও পাপের কথা চিন্তা করে না তারা তাঁদের কর্ম করে।
এই একই অবস্থা আমাদেরও হয়, আমরাও ভক্তিজীবনে এসে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা যে আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে যাব নাকি আত্মীয়দের কথা শুনব।
ন চৈতদ্ বিদ্মঃ কতরন্নো গরীয়ো
যদ্ বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ।
যানেব হত্বা ন জিজীবিষামস্
তেহবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্তরাষ্ট্রাঃ।।৬।।
অনুবাদঃ তাদের জয় করা শ্রেয়, না তাদের দ্বারা পরাজিত হওয়া শ্রেয়, তা আমি বুঝতে পারছি না। আমরা যদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হত্যা করি, তা হলে আমাদের আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করবে না। তবুও এই রণাঙ্গনে তারা আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে।
কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসম্মুঢ়চেতাঃ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রুহি তন্মে
শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্।।৭।।
অনুবাদঃ কার্পণ্যজনিত দুর্বলতার প্রভাবে আমি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছি এবং আমার কর্তব্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়েছি। এই অবস্থায় আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, এখন কি করা আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর, তা আমাকে বল।এখন আমি তোমার শিষ্য এবং সর্বতোভাবে তোমার শরণাগত। দয়া করে তুমি আমাকে নির্দেশ দাও।
কার্পণ্য দোষ অর্থাৎ কৃপণতা। অর্জুন এখানে বুঝতে পেরেছেন যে আমারা যদি শুধু আত্মীয় স্বজন, ঘর বাড়ি, দেশ সমাজ, জাতি নিয়ে থাকি সেটা কেবলমাত্র স্বার্থপরতা ও কৃপণতা। আমি, আমার এই শব্দগুলি হল স্বার্থপরদের ভাষা।
শ্রেয় হচ্ছে মঙ্গল ও অনেক কষ্টের ফলে পাওয়া যাই, যা চিরন্তর জীবের সঙ্গে থাকে যেমন কৃষ্ণময় জীবন আর প্রেয় হচ্ছে কনিক কালের জন্য খুশি ও স্বল্প চেষ্টাই পাওয়া যাই। এবং আমরা ছতকাল থেকে শুনছি ভগবান যা করে মঙ্গলের জন্য করে তাই শ্রেয় কেবল ভগবানই করতে পারে।
এখানে আরেকটি উদ্দেশ্য ফুটে উঠেছে অর্জুনের মাধ্যমে সেটি হল শিষ্যত্ব বা দীক্ষা গ্রহনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জীবনে শ্রেয় লাভ করা যা আমার এই মৃত্যুর পর আমাকে একটি আনন্দময় জীবন ও ভগবানের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে।
ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাদ্
যচ্ছোকমুচ্ছোষণমিন্দ্রিয়াণাম্।
অবাপ্য ভুমাবসপত্নমৃদ্ধং
রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্।।৮।।
অনুবাদঃ আমার ইন্দ্রিয়গুলিকে শুকিয়ে দিচ্ছে যে শোক, তা দূর করবার কোন উপায় আমি খুঁজে পাচ্ছি না। এমন কি স্বর্গের দেবতাদের মতো আধিপত্য নিয়ে সমৃদ্ধশালী, প্রতিদ্ধন্দ্বিতাবিহীন রাজ্য এই পৃথিবীতে লাভ করলেও আমার এই শোকের বিনাশ হবে না।
একজন কবি বলেছিলেন –
আমি সুখের লাগিয়া এই ঘর বাঁধিনু
অনলে পুরিয়া গেল।
আমি সুখের জন্য এই ঘর বেধেছি কিন্তু সব পূরে ছারকার হয়ে যাছে। আমারা সুন্দর সুন্দর বাড়ি ঘর বানিয়ে উপরে লিখছি শান্তি ভিল্লা, শান্তি কুঞ্জ, আনান্দ ভিল্লা, আনন্দ নিকেতন। কিন্তু সেই বাড়ির বেতরে গেলে শান্তি বা আনন্দ কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তিন প্রকার দুঃখ আমাদের লাভ করতে হয়ই এই জগত থেকে মানসিক দুঃখ, জীবজন্তু থেকে দুঃখ এবং দেবতাদের থেকে দুঃখ।
আমাদের এই দুঃখ থেকে নিস্তার পেতে গেলে আমাদের কৃষ্ণের চরণে আশ্রয় গ্রহন করতে হবে।
-সমাপ্ত-
ষষ্ঠ দিন
এক রাজা ঘোষণা করেছিলেন যে সামনে পূর্ণিমা তিথিতে সে অকাতরে দান করবে, প্রজারা যে যা চাইবে সে তাঁকে দান করবে। তো গ্রামের প্রচুর লোক এসছে দান নেওয়ার জন্য , সবাই যা চেয়েছে রাজা দিয়েছেন। গ্রামের এক বৃদ্ধ লোক তিনি দান নিতে যাচ্ছেন না, গ্রামের সবাই তাঁকে জিজ্ঞেসা করছেন কেন সে যাচ্ছে না। সেই লোক বলছিলেন সে এই রাজার রাজ্যে খুব সুখী আছেন, রাজার সুদক্ষ পরিচালনায় সে খুব সুখী, তাঁর রাজার কাছ থেকে আর কিছু চাওার নেই। কিন্তু গ্রামের সবাই টাও জোর করে তাঁকে নিয়ে যায় রাজার কাছে। রাজার সামনে সেই লোক গেলেন, এবং রাজা বলেনবলুন আপনি কি চান, আমি প্রতিজ্ঞা করছি আপনি যা চাইবেন আমি দেব। তখন সেই লোক বলল সে রাজার পরিচালনায় খুব খুশি এবং রাজার রাজ্যে বাস করে সে ধন্য হয়েছে কিন্তু যেহেতু রাজা প্রতিজ্ঞা করেছে তাই সে রাজাকে অনুরোধ করলেন যাতে রাজা তাঁকে বন্ধু হিসাবে ভেবে তাঁর ঘরে একদিন পদার্পণ করেন। রাজা বলেন ঠিক আছে। তখন গ্রামের লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেসা করলেন কেন সে রাজাকে তাঁর ঘরে নিয়ে যেতে চাইল, সে বলল রাজার চরণ ধুলি সে তাঁর বাড়িতে নিতে চাই। কিছুদিন পর মন্ত্রী রাজাকে মনে করাছিল যে সে একজন লোকে বন্ধু রূপে স্বীকার করেছিলেন এবং তাঁর বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছিলেন। রাজা বলল সব ঠিক করতে সে যাবে। রাজা যাবে বলে সেই লোকটির বাড়িটি প্রাসাদে পরিণত করলেন এবং তাঁর বাড়ির আসেপাশে সবকিছু সুন্দর করে দিলেন। তারপর রাজা তাঁর বাড়িতে গেলেন। রাজা তাঁর বাড়ি ঘুরে চলে গেলেন। কিন্তু প্রাসাদ এবং সব ধন সম্পদ সব লোকটিকে দিয়ে গেলেন। লোকটি রাজার সাথে বন্ধুত্ব করে সবকিছু পেয়ে গেলেন। সেরম আমাদের ও ভগবানের কাছ থেকে এমন কিছু চাইতে হবে যাতে আমারা লাভবান হয়।
সঞ্জয় উবাচ
এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপ।
ন যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তুষ্ণীং বভূব হ।।৯।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন-এভাবে মনোভাব ব্যক্ত করে গুড়াকেশ অর্জুন তখন হৃষীকেশকে বললেন, “হে গোবিন্দ! আমি যুদ্ধ করব না’, এই বলে তিনি মৌন হলেন।
তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ।।১০।।
অনুবাদঃ হে ভরতবংশীয় ধৃতরাষ্ট্র! সেই সময় স্মিত হেসে, শ্রীকৃষ্ণ উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে বিষাদগ্রস্থ অর্জুনকে এই কথা বললেন।
পরের শ্লোকটি থেকে ভগবদগীতার জ্ঞান শুরু হবে ।
শ্রী ভগবান উবাচ
aśhochyān-anvaśhochas-tvaṁ prajñā-vādānśh cha bhāṣhase
gatāsūn-agatāsūnśh-cha nānuśhochanti paṇḍitāḥ ।।১১।।
অনুবাদ- পরমেশ্বর ভগবান বললেন- তুমি প্রাজ্ঞের মত কথা বলছ, অথচ যে বিষয়ে শোক করা উচিত নয় সে বিষয়ে শোক করছ। যারা যথার্থই পণ্ডিত তারা কখনই জীবিত অথবা মৃত কারই জন্যই শোক করেন না।
এক গুরুদেব এক জায়গায় তাঁর শিশ্যদের গীতার জ্ঞান দিচিল। এক অহংকারী লোক সেখানে গিয়ে বললেন গুরুদেব আমাকে কিছু জ্ঞান দিন তো। গুরুদেব বললেন এক্কাজ কর তুমি এক গ্লাস জল এবং এক কলসি জল নিয়ে আসো। লোকটি তা নিয়ে গুরুদেবকে দিল। গুরুদেব সেই ভর্তি গ্লাসসের উপর কলসির জল ডালতে লাগলো, সব জল মাটিতে পড়ে গেল। গুরুদেব জিজ্ঞেসা করল, তুমি বুঝলে। লোকটি বলল ভর্তি গ্লাসসে জল ডালে তাতে কি আর জল ধরবে? গুরুদেব বলল না ধরবে না ঠিক সেই রকম তোমারও পণ্ডিতের মতো জ্ঞান উপছে পরছে, আমি তোমাকে জ্ঞান দিলে সেটি তুমি রাখবে কোথায়? গ্লাসসের মতো তোমার মনটাও খালি করতে হবে।
na tvevāhaṁ jātu nāsaṁ na tvaṁ neme janādhipāḥ
na chaiva na bhaviṣhyāmaḥ sarve vayamataḥ param ।।১২।।
অনুবাদ- এমন কোন সময় ছিল না যখন আমি, তুমি ও এই সমস্ত রাজারা ছিলনা এবং ভবিষ্যতেও কখনও আমাদের অস্তিত্ বিনষ্ট হবে না।
দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তিধীরস্তত্র ন মুহ্যতি।।১৩।।
অনুবাদঃ দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোন দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পন্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না।
দেহী মানে হচ্ছে আত্মা। আত্মার কোন পরিবর্তন হয়ই না কিন্তু দেহের হয়।
মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।
আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।।১৪।।
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের ফলে অনিত্য সুখ ও দুঃখের অনুভব হয়। সেগুলি ঠিক যেনশীত ও গ্রীষ্ম ঋতুর গমনাগমনের মতো। হে ভরতকুল-প্রদীপ!সেই ইন্দ্রিয়জাত অনুভুতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সেগুলি সহ্য করার চেষ্টা কর।
যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ।
সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে।।১৫।।
অনুবাদঃ হে পুরুষশ্রেষ্ঠ (অর্জুন)! যে জ্ঞানী ব্যক্তি সুখ ও দুঃখকে সমান জ্ঞান করেন এবং শীত ও উষ্ণ আদি দ্বন্দ্বে বিচলিত হন না, তিনিই মুক্তি লাভের প্রকৃত অধিকারী।
সমাপ্ত
0 Comments