মোহ মায়ায় বিভ্রান্ত হয়ে যেন পথভ্রষ্ট না হই


অনেকদিন আগে এক কৃষ্ণভক্ত রাজা ছিলেন।

তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ও সাত্ত্বিক মনের মানুষ ছিলেন। ভক্তি, ভালবাসা আর শ্রদ্ধা দিয়ে তিনি শ্রীকৃষ্ণের পুজোয় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তার পুজার নিষ্ঠায় এবং অটল ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একদিন তাকে দর্শন দিলেন।ভগবান বললেন ,,হে রাজা !! আমি তোমার ভক্তিতে অত্যন্ত প্রীত হয়েছি প্রিয়।হে বৎস !! তোমার কোন মনোবাঞ্চা থাকলে আমায় বলো।আমি তোমার জন্য কি করতে পারি ??

রাজা বললেন ,,হে প্রভু !! হে প্রাণনাথ !! তোমারকৃপায় আমি সমস্ত কিছু প্রাপ্ত হয়েছি।আমার প্রজারাও সকলে আমার রাজ্যে অত্যন্ত সন্তোষ জীবন যাপন করছে। আর আজ তোমার দর্শনে আমি এতটাই পরিপুর্ণ হয়ে গেছি যে ,,আমার আর চাওয়ার কিছুই নেই প্রভু।শ্রীকৃষ্ণ বললেন ,, তবুও তোমার যদি কিছু চাওয়ার থাকে তো আমাকে বলো রাজা,আমি তোমাকে তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। তখন রাজা বললেন ,, হে প্রভু !!তুমি যদি সত্যই আমার ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে আমাকে কিছু দিতে চাও,তবে আমার মনে একটি বাসনা আছে।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন ,,তোমার সকল বাসনাই আমি পুর্ণ করব রাজা। তুমি নিশ্চিন্তে চাইতে পার।রাজা তার প্রজাদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন, তিনিবললেন, প্রভু যেরূপ তুমি আমায় দর্শন দিয়েছ, আমি চাই তুমি আমার সকল প্রজাদেরও দর্শন দাও। তারাও তোমার দর্শনকৃপা লাভ করুক।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাজার এরূপ কথায় অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন ,,না রাজা !! তোমার এমন অভিপ্রায় একদম অনুচিত। সকলকে দর্শন দেওয়া একদম ঠিক হবেনা প্রিয়,তা সম্ভবও নয়। তুমি বোঝার চেষ্টা কর, তুমি অন্যকিছু চাও।রাজা কিছুতেই মানতে রাজী নয়।তিনি জোর করতে লাগলেন ভগবানকে তিনি যেন তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন।

অবশেষ ভগবান তাঁর ভক্তের কাছে নিজ প্রতিজ্ঞা পালনের স্বীকৃতি দিতে সম্মত হলেন।

তিনি বললেন ,, ঠিক আছে বৎস, তুমি তোমার সকল প্রজা আর অনুগতদের পাহাড়ের কাছে নিয়ে এস।আমি পাহাড়ের চূড়া থেকে তাদের সকলকে দর্শন দেব।রাজা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে বারংবার ধন্যবাদ দিতে লাগলেন। এরপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্ধান হলেন।

রাজা তার রাজ্যের সকল প্রজাদের অবহিত করলেন, তারা যেন পরদিন সকালে পাহাড়ের কাছে প্রভুকে দর্শনের জন্য জড়ো হয়।

পরদিন প্রত্যেকে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।যেতে যেতে পথে তারা সকলে এক তাম্রমুদ্রার পর্বত (তামার মুদ্রা দিয়ে তৈরী পর্বত) দেখতে পেল। আর তা দেখে কিছু লোক ওই তাম্রমুদ্রা সংগ্রহের জন্য পর্বতের দিকে দৌড়াতে লাগল।

তাদের দৌড়াতে দেখে রাজা বিচলিত হয়ে গেলেন, তিনি তাদের সাবধান করতে লাগলেন ,,যেওনা তোমরা !!যেখানে তোমরা তোমাদের জীবনের থেকেও মুল্যবান পরমেশ্বর ভগবানকে স্বচক্ষে দর্শনকরার সৌভাগ্য লাভ করছ, সেখানে সামান্য কিছু তাম্রমুদ্রা দেখে নিজেদের লোভের শিকার হয়োনা। কিন্তু তবুও ওই লোকগুলো নিজেদের সংযত করে রাখতে পারল না। তারা দৌড়াতে লাগল আর মনে মনে ভাবতে লাগল, শ্রীকৃষ্ণের দর্শন তো কোন না কোন সময় হবে,একবার যখন দেখা দিতে চেয়েছে, তখন নাহয় অন্যসময় দেখা করে নেওয়া যাবে,পুরো জীবনটাই তো পড়ে আছে।কিন্তু এগুলিযদি এখন ছেড়ে যাই, তবে ফিরে এসে নাও পেতে পারি।

এমন অজস্রভাবে পড়ে থাকা তাম্রমুদ্রা গুলি পাওয়ার সৌভাগ্য আর কখনও নাও আসতে পারে,কে বলতে পারে, ফিরে আসার পর হয়ত দেখব, এই পর্বতটাই অদৃশ্য হয়ে গেছে। সুযোগ যখন এসেছে,তখন তাকে কাজে লাগানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। রাজা কিছুটা হতাশ হয়ে বাকি নাগরিকদের সাথে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলেন।

কিছুদূর যাওয়ার পর এবার তারা স্বর্ণমুদ্রার পর্বত দেখতে পেল। বাকি যারা ছিল, তারা এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়ে গেল যে, তাদের জীবনে আর কোন অভাব থাকবেনা,বরং আয়েস করেই সারা-জীবন কাটাতে পারবে ভেবে সেই স্বর্ণমুদ্রা পর্বতের দিকে দৌড়াতে লাগল। এখন বাকি রইল শুধু রাজা আর রাণী। রাজা তার সহধর্মিণীকে দুঃখের সাথে বললেন,,দেখেছ রাণী !! এরা কত লোভী হয়ে গেছে ?? সামান্য স্বর্ণমুদ্রা আর তাম্রমুদ্রা দেখেএরা নিজেদের সংবরণ করতে পারলনা।

তারা বুঝলনা যে ,,শ্রীকৃষ্ণের দর্শনই জীবনের একমাত্র চূড়ান্ত লক্ষ্য। তাঁর দর্শনের সাথে এই তুচ্ছ কিছু মুদ্রার তুলনা কি চলে ?? মহারাণী রাজার কথায় সায় দিলেন। অতঃপর তারা দুজনেই সামনে এগোতে লাগলেন। কিছুদূর যাওয়ারপর হঠাৎ তাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ভালো করে লক্ষ্য করার পর দেখতে পেলেন, অদূরে একটি বহুবর্ণ হীরকের পর্বত।যার আলোয় তাদের চোখ ঝাপ্সা হয়ে যাচ্ছিল।

এখন মহারাণীও নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তিনি সেই পর্বতে দৌড়ে গেলেন,আর তার শাড়ির আঁচলে, থলেতে হীরে ভরতে লাগলেন। রাজা অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে গেলেন। তিনি তখন রাণীকে ওই অবস্থায় ফেলে রেখে একাই হেঁটে চললেন। এদিকে শ্রীকৃষ্ণ তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

রাজাকে দেখতে পেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন ,, কি প্রিয় !! কোথায় তোমার সব প্রজা ?? আমি যে তাদের দর্শন দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছি !!রাজা লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছেন।

রাজার এমন দশা দেখে শ্রীকৃষ্ণের দয়া হল। তিনি রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে লাগলেন ,, ও রাজা !! তুমি ব্যথিত হয়োনা।এটা আমিই করেছি।তোমাকে এটা বোঝাতে চেয়েছিলাম যে,যারা জাগতিক ধাতব পদার্থ তথা মোহনীয় বস্তুকে অধিক প্রাধান্য দেয়, যারা জড় জগতে কেবলমাত্র বিলাসিতার হেতু আত্মসংবরণ করতে পারেনা,তারা সর্বদাই আমার কৃপা,আমার দর্শন এবং আমার সংযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে।

 হিতোপদেশঃ - 

আমাদের সকলেরই মনে রাখা উচিত যে মোহ মায়ায় বিভ্রান্ত হয়ে যেন পথভ্রষ্ট না হই।

Post a Comment

0 Comments