আমার যথার্থ কতৃপক্ষ কে?

 আমার যথার্থ কতৃপক্ষ কে?


১৯৯৬ সালে টাইম ম্যাগাজিন একটি জরিপ করেছে । সেখানে উঠে এসেছে পৃথিবীর মানুষ ২টি জিনিস সম্পর্কে না জেনেও খুব ভাল জানে । এক হলো ডাক্তারি আরেকটা ধর্ম সম্পর্কে ।

যেমন বন্ধুদের মাঝে আড্ডা হচ্ছে এর মধ্যে একজন বন্ধু যদি বলে আমার পেট ব্যাথা করছে!! ব্যাস অন্যান্য বন্ধুগুলো ডাক্তারী করা শুরু করে দেয় (যদিও বা কেউ এম বি বি এস পাস করেনি)। কেউ বলবে গ্যাস হয়েছে গ্যাস্ট্রিকের ঔষুধ খেলে ভাল হবে, কেউ বলল পেইন কিলার খেলে ভাল হবে, কেউ বলবে এমোডিস খেলে ভাল হবে । তখন সে বন্ধু বিভ্রান্তে পড়ে যায় আসলে কি করবে । তবে বুদ্ধি মানের কাজ হবে অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গেলে এর সমাধান করা ।

আরেকটি হলো ধর্ম সম্পর্কে না জেনেও কথা বলা । এই ধর্ম নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়ে যায় বন্ধুদের মাঝে অথচ এর সমাধান হলো যিনি ধর্ম বিশারদ তাঁর কাছ থেকে শোনা ।

আমরা যখন কোন সমস্যায় পরি তখন যিনি এই সমস্যার সমাধান দিতে পারেন তাঁর কাছে যাই। ঠিক আমাদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে, আমরা যে বিষয় সমস্যা সেই বিষয়ে যিনি ডিগ্রি অর্জন করেছেন তাঁর কাছে যাই । যেমন আমার যদি গনিতের সমস্যা থাকে তাহলে আমি একজন গনিতবিশারদের কাছে যাব যিনি গনিত নিয়ে পারাদর্শী তাঁর কাছে যাব, আমরা কোন ইংরেজি টিচারের কাছে যাব না । আবার অনেক গনিত বিশারদের মাঝে আমরা খোজ করি কে সবচেয়ে ভাল গনিত করায় তাঁর খোজ নিয়ে সেই গনিতবীদের কাছে যাই ।

এখন প্রশ্ন হলো আমরা যথাযথ ধর্ম সম্পর্কে জানতে চাইলে কার কাছ থেকে জানব, কে আমার যথার্থ কতৃপক্ষ হবে। অনেকে বলে থাকে যার তাঁর থেকে শুনলেই তো হয়। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে ৪ বেদ, ১০৮টি উপনিষদ, ১৮ পুরাণ, ইতিহাস (রামায়ন, মহাভারত), বিভিন্ন সংহিতা এবং আরো অনেক শাস্ত্র । আর এসব বৈদিক শাস্ত্রে প্রায় ১০০ কোটি উপরে শ্লোক আছে । তাই আমরা যদি যার তাঁর থেকে শুনি তাহলে আমরা সকলেই বিভ্রান্ত হবো ।

তাই আমাদের বর্তমানে সমগ্র মানব সমাজে বিশেষ করে হিন্দুদের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে এই বিষয়টি । তাই আমাদের এখন যথার্থ কতৃপক্ষের দরকার । তা নাহলে আমাদের হিন্দুদের মধ্যে এতো বিভ্রান্তি এত কুসংস্কার, এক বর্ণের মানুষ আরেক বর্ণকে দেখতে পারে না, গুরুবাদ, এমন আরো অনেক মহা সমস্যা ।

আর এই সমস্যার কারনে আমাদের মাঝে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। আর অনেকে নিজের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য বা নিজের মতকে প্রতিষ্ঠার জন্যে পবিত্র বৈদিক শাস্ত্রকে বিকৃত করে দেয় যার ফলে আমাদের মাঝে আরো বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় যার কারনে হিন্দুরা এখন আর ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট না, এমনকি মা বাবাদের যে ছেলে মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করাবে সেই বিষয়ে কারো ধ্যান নেয় তাই একটা জেনারেশন এই হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে না জেনেই তারা বলছে সনাতন ধর্ম একটা ঝামেলার ধর্ম, এটা কুসংসস্কারেভর্তি হয়ে গেছে, অনেকে নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে, অন্য ধর্মে ধর্মান্তিরিত হয়ে যাচ্ছে, এমনকি এই হিন্দু শাস্ত্রকে নিয়ে কেউ কোন কটাক্ষ করে বললেও আমাদের হিন্দুদের কোন গায়ে লাগে না ।

তাই আমাদের যথার্থ কতৃপক্ষ ধরতে হবে যিনি এই ধর্ম সংকট বা বিভ্রান্ত থেকে আমাদের মুক্তি দিবেন । এর সমাধান ভগবান আমাদের নিজেই দিয়ে গেছেন । কিন্তু তাঁর আগে আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে এই বৈদিক শাস্ত্রকে । যদি আমরা এই বৈদিক শাস্ত্রকে বিশ্বাস না করি তাহলে আমাদের এর সমস্যার সমাধান হবে না ।

অনেকে প্রশ্ন করে থাকবে এই বৈদিক শাস্ত্রকে কেন আমরা বিশ্বাস করব?

তাদের জন্য বলব আমরা এই জগতে আমার জীবনের ঝুকি যেখানে বেশি তাদের আমরা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি (যেমন ডাক্তার দেখানো, বাসে উঠা) কিন্তু যেখানে জীবনের কোন ঝুকি নাই সেই শাস্ত্রকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি না । তাই আমাদের কোন ঝুকি ছাড়াই শাস্ত্রকে বিশ্বাস করতে পারি ।

কেন বৈদিক শাস্ত্র বিশ্বাস করব?

কারন বৈদিক শাস্ত্রগুলো মানুষের দ্বারা রচিত না এটা স্বয়ং ভগবানের কাছ থেকে সরাসরি এসেছে (গীতা ১৫/১৫) ।

মানুষ কোন শাস্ত্র রচনা করতে পারে না কারন মানুষের ৪টি দোষে (ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা, করনাপাটব) কম বেশি দোষিত হয়ে থাকে । কিন্তু ভগবানের সেই ৪টি দোষ থাকে না কারন ভগবান হচ্ছে চিন্ময়। আর জীব হচ্ছে ভগবানের অধীন ।

ভগবানকে কোন কালের দ্বারা বন্দি করা যায় না তিনি অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানে (গীতা ৪র্থ অধ্যায়)। কিন্তু জীব কাল দ্বারা বন্দী তাই তারা কোন শাস্ত্র রচনা করতে পারে না ।

আরেকটি কারন হলো মায়া ভগবানকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না স্বয়ং ভগবান মায়াকে নিয়ন্ত্রিত করে (গীতা ৭/১৩-১৪) । কিন্তু জীব মায়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তাই সে কোন শাস্ত্র রচনা করতে পারে না । 

উপরোক্ত কারনে আমরা বৈদিক শাস্ত্রকে বিশ্বাস করব তার কারন স্বয়ং ভগবান আমাদের বিভ্রান্ত নিরসনের জন্য এই সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র গুলো প্রনয়ন করেছে ।

এবার আসি আমাদের যথার্থ কতৃপক্ষ কে বা কার কাছ থেকে এই ধর্মের গূঢ় রহস্য বুঝতে পারব

এর সমাধান ভগবান পদ্মপুরাণে দিয়েছেন –

সম্প্রদায়বিহীনাযেমন্ত্রাস্তেনিস্ফলামতাঃ ।

অতঃকলৌভবিষ্যন্তিচত্বারঃসম্প্রদায়িনঃ ।।

শ্রীব্রহ্মরুদ্রসনকবৈষ্ণবক্ষিতিপাবন ।

চত্বারস্তেকলৌভব্যহিউৎকলেপুরুষোত্তম ।।

রামানুজম্শ্রীহীস্বীচক্রেমাধ্বাচার্যংচতুর্মুহষ্ ।

শ্রীবিষ্ণুস্বামিনোরুদ্রোনিম্বাদিত্যংচতুঃসনঃ ।।

উপরোক্ত শ্লোকগুলিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, কেউ যদি প্রামাণিক চতুঃসম্প্রদায় অর্থাৎ শ্রী, ব্রহ্ম, রুদ্র ও কুমার সম্প্রদায়ের কোনো একটির সংঙ্গে গুরু-পরম্পরা ধারায় যুক্ত না হন, তাহলে যে মন্ত্রই তিনি জপ করুন না কেন, তা নিস্ফল হবে । পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই ব্রহ্মান্ডে প্রথমে বৈদিকজ্ঞান প্রদান করেন শ্রী (লক্ষ্মীদেবী), ব্রহ্মা, রুদ্র (শিব) এবং চতুষ্কুমারকে (সনক, সনাতন, সনন্দ, সনৎকুমার), আর বর্তমানের কলিযুগে এই বৈদিক বাণী বাহিত হচ্ছে চারজন সম্প্রদায়-আচার্যবর্গের মাধ্যমেঃ রামানুজাচার্য(শ্রীসম্প্রদায়), মধ্বাচার্য(ব্রহ্মসম্প্রদায়), বিষ্ণুস্বামী(রুদ্রসম্প্রদায়) এবং নিম্বার্কস্বামী(কুমারসম্প্রদায়) । 

এই চারটি সম্প্রদায় হচ্ছে ভগবদনুমোদিত প্রমাণিক সংস্থা যাদের বেদের জ্ঞান নির্ভেজাল, অবিমিশ্রভাবে প্রদান করে থাকেন, কেননা এই জ্ঞানের উৎস হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং, যিনি সমস্ত রকম ত্রুটি, ভ্রান্তি, অপূর্ণ তার উর্ধ্বে । সুতরাং ঐ চারটি সম্প্রদায়ের যে কোন একটি হতে আগত গুরুদেব হচ্ছেন একজন যথার্থ প্রামাণিক সদগুরু বা যথার্থ কতৃপক্ষ ।

আরেকটি হলো যখন শাস্ত্র থেকে আমরা কোন সিধান্ত পাব না তখন আমাদের মুনি ঋষি বা মহাজনদের শরনাগত হতে হবে তারাই সে সমস্ত সমস্যার সমাধান করবে তাই শাস্ত্রে ১২ জন মহাজনের কথা বলেছে –

ব্রহ্মা, নারদ, শিব, চতুশকুমার, দেবহুতি পুত্র কপিল, মনু, প্রহ্লাদ মহারাজ, জনক মহারাজ, পিতামহ ভীষ্ম, বলি মহারাজ, শুকদেব গোস্বামী, যমরাজ । (ভাগবত ৬/৩/২০-২১)

এই ১২ জন মহাজন ধর্মের গূঢ় রহস্য জানেন । 

তাই আমাদের বৈদিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে গুরু পরম্পরার মাধ্যমে যা ভগবান স্বীকৃত দিয়েছে । কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো অসম্প্রদায়িক কতগুলো সংস্থা আছে যাদের বৈদিক শাস্ত্রের কোন স্বীকৃতি দেয় নাই, তারা নিজের মনগত পান্ডিত্যের দ্বারা শাস্ত্রকে বিচার করতে যায়, যার দরুন আমাদের হিন্দু সমাজে ধর্ম নিয়ে এত বিভ্রান্ত, তারা অসম্প্রদায়িক কিছু সংস্থা থেকে বেদের জ্ঞান লব্ধ করে বেদান্ত হওয়ার চেষ্ঠা করছে যার ফলে হিন্দুসমাজে কোন পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে না বরং সনাতন ধর্মটা দিনদিন বিলুপ্তের পথে, তাই আমরা সিধান্ত গ্রহন করব এই সকল মহাজন আর মুনি ঋষিদের থেকে, আমরা কোন শাস্ত্র সিধান্ত কোন কবি সাহিত্যিক বা মানুষের বানানো কোন গুরু বা ভগবান থেকে নয় । যদি আমরা এই সকল অসম্প্রাদয় থেকে সিধান্ত গ্রহন করি যাদের ভগবান শাস্ত্রে কোন স্বীকৃত দেয় নাই তাহলে আমাদের কোন সমস্যার সমাধান হবে না বরং দিন দিন আরো জটিল থেকে জটিল হবে ।

তাই সিধান্ত আপনার, আপনার যথার্থ কতৃপক্ষ কে হবেন, শাস্ত্রে অনুমোদিত ব্যক্তিদের নাকি বৈদিক শাস্ত্রে যাদের অনুমোদন করে নাই তাদের ।

Post a Comment

0 Comments