মাছের কাছ থেকে শিক্ষা

 মাছের কাছ থেকে শিক্ষা




বৈদিক শাস্ত্রে এবং বিভিন্ন আচার্যরা বিভিন্ন বিষয় বুঝাতে গিয়ে তারা বিভিন্ন উদাহরণ টেনে আনেন। আজকে আমরা মাছ থেকে কিছু শিক্ষা নিতে পারি।  অবশ্যই মাছের ব্যাখ্যা যথোপযুক্ত নয় । কোন জড়জাগতিক ব্যাখ্যাই পূর্ণ আধ্যাত্মিক সত্যের ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম নয় ।  কিন্তু আমাদের বর্তমান চেতনা জড়জাগতিক বিষয়ের দ্বারা সীমাবদ্ধ ।  তাই এই ব্যাখ্যা কিছুটা সাহায্য করতে পারে ।  তাই কখনো কখনো আধ্যাত্মিক আচার্যগণ খুব ছোট কিছুর উদাহরণ দাও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়ে থাকেন যা আমাদের কৃষ্ণভাবনামৃত এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অবহিত করবে । নিম্নে তা বর্ণনা করা হলো 


১) শ্রীল প্রভুপাদ সবসময় একটি উদাহরণ দিত -- মাছকে যদি জল থেকে উঠিয়ে ডাঙ্গায় তুলে তাকে ভাল ভাল খাবার, আরাম আয়েস করার জন্য চেয়ার, ইন্দ্রিয়তৃপ্তির সবরকম ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে কি মাছ কি সুখী হবে?? না মাছ সুখী হবে না। মাছের কষ্ট হবে এবং সেই মৃত্যুর দিকে ঢলে পরবে। মাছ কখনই ডাঙ্গায় সুখী হতে পারবে না, তাকে সুখী করার যতরকম প্রচেষ্ঠা করা হোক না কেন। মাছ জলে থেকেই সুখী আর জলেই সে সুখ পেয়ে থাকে আর তার স্বাভাবিক জীবন যাপন করে থাকে।


এখান থেকে আমরা শিক্ষা পাই, জীব কখনই এই জড়জগতে সুখী হতে পারে না। কারন জীবের আলয় বা বাসস্থান হলো চিন্ময় জগতে বা গোলক বৃন্দাবনে। গীতায় এই জগতকে বলা হয়েছে দুখের জগত। জীব কখনই এই জগতে সুখী হতে পারে না। জীব সুখ পাওয়ার জন্যই যতই প্রচেষ্টা করুন না কেন। জীব কখনই সুখী হতে পারে না। আমরা যে সুখ অনুভব করি তা মাত্র দুখের সাময়িক নিবৃত্তি। সাময়িকভাবে দুঃখটা নিবৃত্ত করার জন্য আমরা সব রকম ইন্দ্রিয়তৃপ্তির ব্যবস্থা করে থাকি। তাই আমরা যদি প্রকৃত সুখি হতে চাই তাহলে আমাদের আলয় গোলক বৃন্দাবনে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সেখানে যেতে হলে আমাদের কৃষ্ণভাবনাময় জীবন যাপন করতে হবে বা অভ্যাস করতে হবে তাহলে আমরা প্রকৃত সুখ  ও আনন্দ লাভ করতে পারব।


২) জলে অনেক খাবার থাকা সত্ত্বেও মাছ বঁড়শি খাবারে ঠোকর মারতে থাকে। এরপর মাছ সেই বঁড়শি ফাদে আটকে কষ্ট পেয়ে মারা যায়। 


এখান থেকে আমরা কি শিক্ষা পাই - আমাদের ৫টি ইন্দ্রিয় আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে জিহবা। আর জিহবার বিষয় হলো রস। রস আস্বাধনের মাধ্যমে জীব এই জড় জগতে বন্ধন হয়ে আছে। মাছ যেমন জিহবার ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রন না করতে পেরে মৃত্যুর ফাদে পরতে হয়েছে তেমনি এই কলি যুগের মানুষ জিহবার ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রন না করার ফলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। 


জেলে বড়শির অগ্রে থাকা টোপের সাহায্যে মাছ ধরে, সে বাঁচার জন্য যুদ্ধ করার ইচ্ছাই তাকে মৃত্যুর দিকে ডেকে আনে - যা একটি নির্মম পরিহাস ।


কিন্তু মাছ  যুক্তি প্রদর্শন করতে পারে এই বলে যে, বড়শির টোপ  দেখতে তার আহারের মতো । অবশ্য মাছ  আগে থেকে বুঝতে পারে না যে, সে ফাঁদে ধরা পড়তে যাচ্ছে । মানুষের ক্ষেত্রেও এই ধরনের ব্যাপার ঘটতে পারে । মানুষ জানে না যে সে কিরকম ফাঁদে পড়ে আছে, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি সহজেই সেই ফাঁদে আটকে পরে তার আধ্যাত্মিক জীবন নষ্ট করে। 


মানুষের চেতনা নির্ভর করে সে কি খায়। আমাদের আহার যদি শুদ্ধ না থাকে তাহলে আমাদের চেতনা কুলষিত হয়ে থাকবে। আর কুলষিত মনে আমাদের পাপ কার্য করতে উদ্ধব করবে যার ফলে জীব দুখ কষ্ট জর্জিত থাকবে। তাই বৈদিক শাস্ত্রে আমাদের আহার শুদ্ধি করতে বলছে। 


আহারশুদ্ধৌ_সত্ত্বশুদ্ধিঃ_সত্ত্বশুদ্ধৌ_ধ্রূবা_স্মৃতিঃ।


#__স্মৃতিলম্ভে_সর্বগ্রন্থীনাং_ব্রিপমোক্ষঃ''।।


(#ছান্দোগ্য_উপনিষদ-৭/২৬)


অর্থাৎ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে খাদ্যসামগ্রী শুদ্ধ হয় এবং তা আহার করার ফলে জীবের সত্তা শুদ্ধ হয়। সত্তা শুদ্ধ হবার ফলে স্মৃতি শুদ্ধ হয় এবং তখন সে মোক্ষ লাভের পথ খুজে পায়''।


জিহবার লালসায় যে ইতি অতি ধায় শিশ্নধন পরায়ন কৃষ্ণ নাহি পায় - চৈতন্য মহাপ্রভু


আমরা এই জিহবা বেগ দমন করতে পারব, বেশি বেশি কৃষ্ণ প্রসাদ খাওয়ার মাধ্যমে, আর কৃষ্ণ কথা বলার মাধ্যমে। 


৩) জলের উপরে ভেসে থাকা মাছকে সহজেই ঈগল ধরে ফেলতে পারে কিন্তু গভীর জলে মাছকে ঈগল ধরতে পারে না ।


এখান থেকে আমরা শিখতে পারি - আমরা যদি কৃষ্ণভাবনামৃতের গভীরে না যাই তাহলে ঈগল সদৃশ মায়া আমাদের আক্রমন করবেই। আমরা যখন আমরা শাস্ত্রের গভীরে যাব এর মর্মার্থ যখন আমরা হৃদায়াঙ্গম করব তখন আমাদের মায়া স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু আমরা বৈদিক শাস্ত্রগুলো গভীরভাবে না পড়ি তখন মায়া দ্বারা আমরা অধপতিত হতে পারি।

 


৪) একজন আচার্য ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীদেরকে একটি পুকুরের মাছের সাথে তুলনা করেছেন। মাছেরা পুকুরের বর্জ্যগুলো আহার করে। পুকুর(গৃহস্থরা) হচ্ছে একটি স্থান যেখানে জাগতিক লোকেরা স্বভাবতই বর্জ্য বা বিষ্ঠাসদৃশ(অনর্থসমূহ) বস্তুসমূহ ধৌত করে। কিন্তু মাছেরা (ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীরা) সেই বর্জ্যসমূহ (অনর্থসমূহ) আহার করে এবং পুকুরকে পরিষ্কার রাখেন। সাধুরা সর্বত্র পরমসত্যের বাণী প্রচার করেন। এবং আধ্যাত্মিক বাস্তবতার জাগরণের জন্য সকলকে দিব্য জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করেন। এটি হচ্ছে ব্রহ্মচারী আশ্রমের প্রধান লক্ষ্য।

 

৫) একজন মাছ স্রোতের বিপরীতে যেতে পারে কিন্তু হাতি স্রোতের বিপরীতে যেতে পারে না। কারন মাছ জলের প্রতি শরনাগত হয়েছে।

 

 কৃষ্ণের শক্তিতে একটি মৎস্য হও

এই জড়জগতে মানুষেরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে কঠোর সংগ্রাম করছে, কিন্তু ভক্তেরা এরকম সংগ্রাম করেন না। আসলে কৃষ্ণের আশ্রয়ে থাকার কারণে, ভগবানের সেবার সঙ্গে যুক্ত যে সমস্ত তথাকথিত জাগতিক কাজও আমাদের করতে হয়, তাও আনন্দময় হয়ে ওঠে! এটি ঠিক নদীতে সাঁতার কাটার মতন। যখন আপনি নদীতে সাঁতার কাটেন, যদি খুব প্রবল স্রোত থাকে, তবে তা আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু নদীতে তাকালে আপনি দেখতে পাবেন, সেখানে অনেক মাছ সাঁতার কাটছে।

তীব্র স্রোত সত্ত্বেও অনেক মাছ স্রোতের বিপরীতে সহজেই সাঁতার কাটে। তাই যখন আমরা সবকিছুকেই কৃষ্ণের শক্তি রূপে দেখতে শিখি এবং কৃষ্ণের শক্তিতে মাছের মতন হই, তখন আমরাও সহজেই স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতরে যেতে পারব।

সাধারন মানুষের কাছে যা কিছু খুব কষ্টসাধ্য, প্রতিকূল পরিবেশ, কঠিন সমস্যা বলে মনে হয়, একজন ভক্তের কাছে তা ভক্তিযোগেরই একটি অংশ। যখন কোন বিপদ আসে, ভক্তেরা সেটাকে কৃষ্ণের অনুকম্পা হিসেবে বিবেচনা করেন। “এই পরিস্থিতি আমাকে আরও গভীরভাবে কৃষ্ণের শরণাগত হতে, এবং কৃষ্ণ ছাড়া যে আমার আর কোনও আশা নেই, তা উপলব্ধি করতে বাধ্য করছে।"

-------শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজ

 

 

৬) একটা একুরিয়ামে অনেক মাছ থাকে, তাদের সেটা নিজস্ব জগৎ তারা সেখানে বাস করে, খাওয়া দাওয়া করে বিচরন করে, সমস্ত কার্যকলাপগুলো করে । কিন্তু মাছেরা জানে না বাইরে থেকে তাদের কেউ দেখছে, তাদের জন্য খাবার সাপ্লাই দিচ্ছে, তাদের কেউ নিয়ন্ত্রন করছে।


শিক্ষা - আমাদের এই জগতটাকে একুরিয়ামের সাথে তুলনা করা হয়। যা ক্ষনস্থায়ী। এখানে আমরা মাছেদের মতো বিচরন করছি, খাচ্ছি ঘুমাচ্ছি। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না আমাদের কেউ দেখছে। আমাদের কেউ নিয়ন্ত্রন করছে। আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস সাপ্লাই দিচ্ছে। একটা দেশের জন্য যেমন একটা সরকার আছে। তেমনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে চালনার জন্য একজন ভগবান আছেন যিনি আমাদের পালন করছে। তাই আমাদের তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। তাই নাস্তিকদের মতো আমাদের মনে করা উচিত না কেউ আমাদের নিয়ন্ত্রন করছে না কেউ আমাদের দেখছে না। তাহলে সেটি ভুল। 

 

 

৭) মাছ সন্তানদের দর্শনের মাধ্যমে প্রতিপালন করেন - অনেকেই বলে থাকে ভগবান আমাদের কিভাবে প্রতিপালন করে থাকে তখন অনেক উদাহরন দিয়ে থাকে, কচ্ছপ যেরকম ধ্যানের মাধ্যমে, পাখি যেরকম স্পর্শের মাধ্যমে তেমনি মাছ দর্শনের মাধ্যমে তাদের সন্তানদের প্রতিপালন করে থাকে। ভগবান জগন্নাথ, জগতের নাথ যিনি তাঁর দৃষ্টির মাধ্যমে সমস্ত জীবকে প্রতিপালন করে থাকে। ভগবানের আরেক নাম অনিমেষ। যার চোখের পলক পরে না, ঠিক মাছের মতো। তিনি এই চোখ দিয়ে যেমন সমস্ত জীবদের প্রতিপালন করেন আবার সেই চোখ দিয়ে যারা ভক্ত তাদের গুণগুলো দর্শন করেন। 


সংকীর্তন মাধব দাস

Post a Comment

0 Comments