বারুণী পুজা এর  মাহাত্ম্য

বারুণী স্নান :- স্কন্দ পুরাণ অনুসারে চৈত্রমাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে শতভিষা নক্ষত্র যোগ হলে সেই তিথি বারুণী নামে পরিচিত। এই তিথিতে স্নান করলে বহুশত সূর্যগ্রহনের জন্য গঙ্গাস্নানের যে ফল সেই ফল লাভ করা যায়। হিমালয় কন্যা গঙ্গার অপর নাম হল বারুণী। বারুণী স্নান বলতে এখানে গঙ্গা স্নানেরই প্রতিরুপ।বাঙলা সনের প্রতি চৈত্র মাসের শতভিষা নক্ষত্রযুক্ত মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে এই স্নান অনুষ্ঠিত হয়। শাস্ত্র মতে কোন বছর যদি ঐদিনটি শনিবার হয় তবে ঐ বারুণী স্নান অসাধারণত্ব লাভ করে মহা বারুণী স্নান রুপ লাভ করে।এই স্নান টি বস্তুত্ব হিন্দু ধর্মীয় একটি পূন্য স্নান উৎসব।জীব জগতের পঙ্কের মধ্যে পথ চলতে গিয়ে পাপাচারে পূর্ণ্,ক্লেদাক্ত মুনস্যকুল এই পূণ্য স্নানের মধ্যমে পাপ মুক্ত হয়। দক্ষিণ জনপদের এই কপিলমুনিতে ঠিক কবে থেকে বারুণী মেলার আয়োজন হয়ে আসছে তা হিসেব করা খুব কঠিন।জনস্রুতি এমন পুন্যত্মা কপিল কালের কোন এক সময় সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য কপোতাক্ষের পাড়ে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির স্থাপন করেন এবং তিনি সেখানে ধ্যান মগ্ন অবস্থায় আদ্যা শক্তির সাক্ষৎ পান। গভির ধ্যানের দ্বারা তিনি সেখানে গঙ্গাকে কপতাক্ষের সঙ্গমে একত্রিত করেন।সময়টি ছিল চৈত্র মাসের শতভিষা নক্ষত্রযুক্ত মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী।আর এখানেই স্থাপন করেছিলেন বারুণী স্নানঘাট।
২য় পর্ব
সব তীর্থ বার বার পণ তীর্থ একবার।
পণতীর্থ ধামের পরিচিতি : সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার অন্তর্গত জাদুকাটা নদীর তীর। পবিত্র এ স্থানটি সনাতন ধর্মালম্বীদের কাছে তীর্থস্থান হিসেবে বিশেষ মাহাত্ম্য বহন করে। স্থানটি পণতীর্থ ধাম হিসেবে সর্বজন পরিচিত। শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ মহাবিষ্ণুর অবতার শ্রীল অদ্বৈত আচার্য ঠাকুরের আবির্ভাব স্থল বা লীলাভূমি এই পণতীর্থ ধাম। অদ্বৈত আচর্য ঠাকুরের মূল আবির্ভাব ভূমি বাদাঘাট ইউনিয়নের নবগ্রামে। নব গ্রাম ছিল লাউড় রাজ্যের (প্রাচীন শ্রীহট্টের একটি রাজ্য) লাউড়ের গড় এলাকা। কিন্তু নব গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বহু আগে। বর্তমানে অদ্বৈত আচার্য ঠাকুরের যে মন্দিরটি রয়েছে তা যাদুকাটা নদীর তীরবর্তী লাউড়ের গড়ের পাশের রাজারগাঁও গ্রামে। যদিও অদ্বৈত আচার্যের স্মৃতিচিহ্ন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে তবুও স্থানটি সনাতন ধর্মালম্বীদের কাছে মহা তীর্থ স্থান।

স্থানটি সম্পর্কে অদ্বৈত প্রকাশ, অদ্বৈত মঙ্গল ও ভক্তিরাকরসন সহ বহু বৈষ্ণবীয় গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিকে বলা হয় মহা বারণী। “বারুণী যোগেতে স্নান বহু ফলপ্রদ। ” অদ্বৈত প্রকাশ গ্রন্থ ২য় অধ্যায়। তাই প্রতিবছর বারুণী যোগে জাদুকাটা নদীর তীরে বহু লোকের সমাগম হয় স্নানযাত্রা মহোৎসবে। সব তীর্থ বার বার স্নানে যে পূণ্য লাভ হয় পণতীর্থ একবার স্নানে সেই পূণ্য লাভ হয়ে থাকে। কারণ সেখানে সপ্ত গঙ্গা একসাথে প্রবাহিত হয় উক্ত তিথিতে। তাই সব তীর্থ স্নান করলেও পণতীর্থে স্নান আবশ্যক। তাই বলা হয় সব তীর্থ বার বার পণতীর্থ একবার। তীর্থগণও পণ করে গিয়েছিলেন পৃথিবী যতদিন বর্তমান থাকবে ততদিন প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে তীর্থগণের আগমন ঘটবে এ স্থানে। সেই থেকে আজ অবধি উক্ত তিথিতে সপ্ত গঙ্গা প্রবাহিত হন।

পণতীর্থ নামকরণের মাহাত্ম্য: ‘অদ্বৈত প্রকাশ’ গ্রন্থে পণতীর্থের মাহাত্ম্য সম্পর্কে বলা হয়েছে অদ্বৈত আচার্য প্রভুর বৃদ্বা জননী নাভাদেবী একদিন রাত্রে স্বপ্নে দর্শন করেন যে, তিনি সমস্ত তীর্থ জলে স্নান করছেন। ভোর বেলা স্বপ্ন ভেঙ্গে ধর্মশীলা নাভাদেবী স্বপ্নের কথা চিন্তা করে বড়ই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কারণ চলার মত এই অযোগ্য দেহ নিয়ে কিভাবে তিনি গঙ্গা স্নান করতে যাবেন। অদ্বৈত আচার্য প্রভু মায়ের এই বিমর্ষতার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁর মা তাঁকে স্বপ্নের কথা জানান এবং এই চলার অযোগ্য এই দেহ নিয়ে তীর্থ যাত্রা তাঁর জন্য বড়ই দুষ্কর সে কথাও জানান। যার জন্যই তিনি বিমর্ষ। মায়ের তীর্থ স্নান করার অভিলাষ এবং বিমর্ষতার কথা চিন্তা করে অদ্বৈত আচার্য ঠাকুর পণ করলেন যে, এই স্থানেই তিনি সমস্ত তীর্থ অর্থাৎ সপ্ত গঙ্গার আর্বিভাব করাবেন এবং মায়ের অভিলাষ পূর্ণ করবেন। অদ্বৈত আচার্য প্রভুর অপ্রাকৃত শক্তির বলে তীর্থ সমূহকে আকর্ষণ করে লাউড়ের এক ক্ষুদ্র পাথরের অপর একটি ঝরণার ধারায় তীর্থ পরিপূর্ণ হয়ে গেল। আর তাতে তাঁর মা জননী স্নান করে পরিতৃপ্ত হলেন। শুধু সপ্তগঙ্গা নয় যাঁর হুহুংকারে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এ ধরাধামে আসতে বাধ্য হন। এজন্য অদ্বৈত আচার্য প্রভু গৌর আনা গোঁসাই নামে পরিচিত। অদ্বৈত আচার্য প্রভু পণ (প্রতিজ্ঞা) করে সপ্ত গঙ্গার আনয়ন করেছিলেন বলেই স্থানটির নাম হল পণতীর্থ। অদ্বৈত আচার্য প্রভু কি জয়।

 “পণতীর্থ ধামের মাহাত্ম্য”

* পণতীর্থের পরিচয় :

পণতীর্থ হচ্ছে শ্রীঅদ্বৈত আচার্যের প্রকটভূমি (যদিও অদ্বৈত আচার্যের স্মৃতিচিহ্ন নদীগর্ভে বিলনি হয়ে গেছে)। এই স্থানটি অদ্বৈত প্রকাশ, অদ্বৈত মঙ্গল ও ভক্তিরত্মাকরসন বহু বৈষ্ণব গ্রন্থে এক মহান তীর্থস্থান রূপে পরিগণিত হয়েছে।

অদ্বৈত প্রকাশ গ্রন্থে লাউড়কে কারণ সাগরের আবির্ভাব রূপে বর্ণনা করা হয়েছে- “শ্রী লাউড় ধাম কারণ রত্মাকর হয়”। এই স্থানটি বর্তমান যাদুকাটা নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। নদীর পূর্বপাড়ে রয়েছে রাজারগাঁও (নবগ্রাম)। যেখানে একটি ছোট মন্দির রয়েছে। নদীর পশ্চিম তীরে রয়েছে ইস্কনের একটি বৃহৎ ও নয়নাভিরাম মন্দির। সেখানে স্থাপিত হয়েছে, শ্রীশ্রী রাধা-মদনগোপাল বিগ্রহ, শ্রীজগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রা মহারাণীর বিগ্রহ এবং অদ্বৈত আচার্য্যর বিগ্রহ। এখানে মধুকৃষ্ণা এয়োদর্শীতে বিশাল অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়।

* পণর্তীথের ইতিহাস :

“অদ্বৈত প্রকাশ” গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, একদিন রাত্রিতে অদ্বৈত প্রভুর জননী নাভাদেবী স্বপ্নে দর্শন করেন যে, তিনি সমস্ত তীর্থ জলে স্নান করছেন। প্রভাতে ধর্মশীলা নাভাদেবী স্বপ্নের কথা স্মরণ করে ও তীর্থ গমনের বিবিধ অসুবিধার বিষয় চিন্তা করে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন, এমন সময়ে পুত্র অদ্বৈতাচার্য সেখানে উপস্থিত হয়ে মাতার বিমর্ষতার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁর মাতা তাঁকে স্বপ্ন দর্শনের কথা অবহিত করেন এবং তীর্থযাত্রায় অপারগতার কথা প্রকাশ করে বিমর্ষ হয়। তিনি মাকে বিষন্ন দেখে পণ (প্রতিজ্ঞা) করলেন যে, এই স্থানেই সকল তীর্থের আবির্ভাব করাবেন।

অদ্বৈতাচার্য অপ্রাকৃত শক্তির বলে তীর্থসমূহকে আকর্ষণ করে লাউড়ের এক ক্ষুদ্র পাথরের অপরে একটি ঝর্ণার জলের ধারায় তীর্থ পরিপূর্ণ হয়ে গেল। অদ্বৈত জননী তাতে স্নান করে পরিতৃপ্ত হলেন।

মাতার বিস্ময় দৃষ্টে অদ্বৈত আরও বলেছিলেন-

“প্রভু কহে- দেখ মাতা সদা জল ঝরে,

শঙ্গ আদি ধ্বনি কৈলে বহুজল পড়ে।”

“আশ্চর্য দেখিয়া মাতা নমস্কার কৈলা;

ভক্তি করি স্নান করি দানাদিক সমাপিলা।

তদবধি পণাতীর্থ হইল বিখ্যাত

বারণী যোগেতে স্নান বহু ফলপ্রদ।”

-অদ্বৈত্য প্রকাশ-2য় অধ্যায়।

প্রায় পাঁচশ বছর পূর্বে এইরূপে লাউড়ে এক তীর্থের উৎপত্তি হয়। অদ্বৈতের ন্যায় তীর্থসমূহও পণ করেছিলেন যে, প্রতি বারুণীতেই এস্থলে তাঁদের আবির্ভাব হবে। এই পণ শব্দ হতেই পণতীর্থ নাম হয়েছে। পণতীর্থে বারুণী যোগে বহুলোকের সমাগম হয়।

এই তীর্থের একটা আশ্চর্য সংবাদ এই যে, শঙ্খধ্বনি বা উলুধ্বনি করলে অথবা করতালি দিলে, পর্বত হতে তীব্রবেগে জলরাশি পতিত হয়।

* বারুণীস্থান :


* পথ পরিচিতি :

বাসযোগে বাংলাদেশের যেকোন স্থান হতে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে এসে রিক্সায় মণিপুরী নদীঘাট পার হয়ে অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, পায়ে হেটেও পণাতীর্থে নদীর অপর পার্শ্বে ইসকন মন্দিরে আসা যায়।

আপনাদের সকলকে এই পণতীর্থ ধামে আসার ও স্নানযাত্রায় অংশগ্রহণ করার জন্য বিনম্র চিত্তে আহব্বান জানাচ্ছি। হরেকৃষ্ণ।

Post a Comment

0 Comments