ব্রজলীলা (প্রথম পর্ব)
শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামী'র স্বরচিত গ্রন্থ 'ব্রজলীলা' অবলম্বনে মাত্র ১৯ বছর বয়সী রাশিয়ান এক কৃষ্ণভক্তের মহিমাময় প্রয়াণের রোমাঞ্চকর কাহিনি, যেখানে গুরুদেব ও শিষ্যার মধ্যে এক অলৌকিক ও অত্যুজ্বল দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হয় ।
সর্বাত্মা দাস
ব্রজলীলা ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯১ সালের আগস্টে কৃষ্ণভাবনামৃতের সংস্পর্শে আসেন। ভক্তদের একটি ম্যাগাজিনে তিনি কিভাবে ভক্তসান্নিধ্য লাভ করেন তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। প্রতিবেদনটি তার অপ্রকট হওয়ার ঠিক পূর্বে প্রকাশিত হয়। তিনি লিখেছিলেন, “ভক্তরা সর্বদা ভগবানকে ও তাঁর প্রতিনিধিদের একনিষ্ঠভাবে সন্তুষ্ট করার প্রয়াস করছে। তাঁর বিশেষ প্রমাণটি হল রাশিয়ায় গ্রন্থ বিতরণ ম্যারাথনের সময় ভক্তরা পুরো উদ্যামে গ্রন্থ বিতরণ করছে। শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ হাতে নিয়ে তারা জাগতিক ব্যক্তিদের হৃদয় দ্রবিভূত করতে সম্পূর্ণরূপে আত্মবিশ্বাসী। আমার হৃদয়ও সেরকম একটি গ্রন্থ ম্যারাথনে দ্রবিভূত হয়েছিল। এভাবে একসময় কৃষ্ণভাবনা শুরু করার পর অবশেষে আমার গুরুদেব শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামী মহারাজের শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় লাভ করি।
ভক্ত হওয়ার পূর্বে আমি জীবনের অর্থ অনুসন্ধানের জন্য মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। মাঝে মাঝে আমি মস্কো জাদুঘরে যেতাম এবং সেখানে প্রাচীন সভ্যতা নিয়ে অধ্যয়ন করতাম। অন্য সময় বিভিন্ন শিক্ষনীয় ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলে যেতাম কিংবা থিয়েটারে গিয়ে মঞ্চ নাটক দেখতাম। প্রতিদিন গ্রন্থের দোকানে গিয়ে অনেক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন দর্শনমূলক গ্রন্থ অধ্যয়ন করতাম। শীঘ্রই আমি উপলব্ধি করলাম যে, আমার এমন একজন ব্যক্তির প্রয়োজন যিনি আমাকে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করবেন এবং জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন।
একদিন মস্কোর সাবওয়েতে হরে কৃষ্ণ ভক্তদের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে সাবওয়ে স্টেশনে পৌঁছতেই আমি ২ জন বালককে দেখতে পাই। যারা উৎসাহের সাথে একদল লোককে প্রচার করছিল। তাদের পিছনে পাহাড়সম গ্রন্থ ছিল। অন্যান্য লোকেরাও সেখানে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করছিল। একটি লোক ডোনেশনের জন্য গান গাইছিল। কিন্তু এইসব ছাড়িয়ে আমি শুধুমাত্র ভক্তদের প্রতি আকৰ্ষিত হই। যখন তাদের খুব নিকটে পৌঁছতেই একজন ভক্ত আমার কাছে একটি গ্রন্থ নিয়ে আসল। তিনি বললেন, “অনুগ্রহপূর্বক এই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ গ্রন্থটি নিন। আমাদের গুরুদেব আমাদেরকে এই বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেছেন। এটি আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করবে এবং জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে তুলে ধরবে।” আমি জিজ্ঞেস করি, “এই গ্রন্থটি কোথা হতে এসেছে?” তখন ভক্তটি শ্রীল প্রভুপাদের একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘এই গ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন আমাদের আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল প্রভুপাদ। তিনি ভারত থেকে কৃষ্ণভাবনা পশ্চিমা দেশে নিয়ে এসেছেন।”
আমি গ্রন্থটি শ্রীল প্রভুপাদের তাৎপর্য অনুসারে গ্রন্থটি অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। সেখানে একটি উক্তি বিশেষভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি বলেন, 'যদি কেউ একনিষ্ঠভাবে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ গ্রন্থটি উপলব্ধি করতে আগ্রহী হয়, তবে তিনি অবশ্যই এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের আশ্রয় গ্রহণ করবেন। এটি অধ্যয়নের পর শীঘ্রই আমি ইস্কন মন্দিরে গিয়ে অনেক সুন্দর সব ভক্তদের সান্নিধ্য লাভ করি। তাদের প্রায় অনেকেই আমার মতো শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থের মাধ্যমে আকর্ষিত হয়ে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়। এভাবে আমি উপলব্ধি করলাম, ভক্তরা শ্রীল প্রভুপাদের কৃপা অন্যদের মাঝে বিতরনের মাধ্যমে সুখ আস্বাদন করেন। যদিও তাদেরকে দিনের পর দিন সাবওয়ের মতো নারকীয় স্থানে যেতে হতো, তবুও এর মাধ্যমে যারা গ্রন্থ লাভ করেছেন তাদের হৃদয় ভক্তদের করুনায় দ্রবিভূত হয়েছিল। আমি এমনও দেখেছিলাম যে, নতুন ভক্ত সবেমাত্র যুক্ত হলো তিনিও অনেক অনেক শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ বিতরণ করতো। আমি এই কাহিনিটি সংকীর্তন ভক্তদের মহিমা কীর্তনের উদ্দেশ্যে বলেছি। আমি প্রার্থনা করি, যে সমস্ত ভক্ত গ্রন্থ বিতরণ শুরু করছেন তাদের জন্য এটি অনুপ্রেরণাদায়ক হবে। প্রতিটি দেশে এরকম অনেক পতিত আত্মা আপনার করুণার প্রতীক্ষা করছে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্নিকটে
ব্রজলীলার একটি ভগবদ্গীতা গ্রহণ ও মন্দির পরিদর্শনের পরপরই মস্কোতে একটি বিশাল রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। কৌতুহলবশত তিনি সেই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। রথের সামনে উপস্থিত বহু জনতার সম্মুখে শ্রীমৎ ইন্দ্ৰদ্যুম্ন স্বামী প্রবচন দিয়েছিলেন। তিনি সেই প্রবচনে শুনেছিলেন যে, “জগন্নাথ পতিত জীবদের প্রতি অত্যন্ত কৃপালু এবং যারা তার কাছে প্রার্থনা করেন তাদেরকে তিনি বিশেষ কৃপা প্রদান করেন।' এই বিষয়টি তাকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। তিনি তখন জগন্নাথের কাছে একনিষ্ঠভাবে জগন্নাথের বিশেষ কৃপার জন্য প্রার্থনা করতে শুরু করলেন।
পরদিন ব্রজলীলা মস্কো মন্দির পরিদর্শন করলে তিনি শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামী মহারাজকে ভাগবত প্রবচন দিতে দেখেন। মহারাজ সেসময় শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্য শ্রীপাদ জয়ানন্দ প্রভুর কাহিনি বলছিলেন। লিউকেমিয়াতে আক্রান্ত হয়ে চরম অসুস্থতা সত্ত্বেও জয়ানন্দ প্রভু আমেরিকাতে তার গুরুদেবের সন্তুষ্টি বিধানার্থে রথযাত্রার আয়োজন করেছিলেন। তিনি গভীর মনোযোগ সহকারে জয়ানন্দ প্রভুর পারমার্থিক দৃঢ়তার কথা শ্রবণ করছিলেন। একইসাথে তিনি শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামী মহারাজের প্রতিও অনুরক্ত হন এবং অনুভব করেন যে, ভগবান জগন্নাথ তার প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে তিনি তার প্রতি বিশেষ কৃপা প্রদর্শন করেছেন। কারণ রথযাত্রার পরের দিনই তিনি তার পারমার্থিক গুরুদেবকে প্রাপ্ত হয়েছেন।
কয়েকদিন পর তিনি এই হরে কৃষ্ণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর এবং তখন ইউক্রেনের ইস্কন মন্দিরে চলে যান। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, তিনি অন্য আটজন নারীর সঙ্গে ট্রাভেলিং সঙ্কীর্তন দলের হয়ে শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ বিতরণ করতে লাগলেন। কিন্তু চার মাস পরই লিউকেমিয়া ধরা পড়ায় সেই সেবাটি বন্ধ করতে হয়েছিল এবং তিনি মস্কোতে পুণরায় ফিরে আসেন।
এক বছর পর ব্রজলীলা সেন্ট পিটার্সবার্গের ইস্কন মন্দিরে আসেন। সেখানে সমস্ত ভক্তরা তার উন্নত গুণাবলীতে মুগ্ধ হন, যদিও তিনি ভক্তিজীবনে প্রাথমিক স্তরে ছিলেন। তিনি ছিলেন বিনয়ী এবং সর্বদা অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামীকে প্রসন্ন করার চেষ্টা করতেন। যে কোন ক্ষুদ্র সেবা তিনি গভীর নিষ্ঠার সহিত সম্পূর্ণ করতেন ।
একবার যখন মহারাজ মন্দির পরিদর্শন করে ভক্তের জীবনে প্রার্থনার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করেন, ব্রজ লীলা সেই নির্দেশনা একনিষ্ঠতার সহিত গ্রহণ করেন। এরপর থেকে তাকে সর্বদাই মন্দিরের বিগ্রহের প্রতি প্রার্থনা নিবেদন করতে দেখা যেত। তিনি শুধু নিজের জন্যই প্রার্থনা করতেন না বরং অন্যান্য ভক্তদের পারমার্থিক কল্যাণের জন্যও প্রার্থনা করতেন ।
তার দুরারোগ্য ব্যাধি সত্ত্বেও তিনি অন্য ভক্তদের বিরক্ত করতেন না। যদিও ভক্তরা সর্বোত্তমভাবে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করত। কিন্তু তিনি কারো কাছে সেবা চাইতেন না। তিনি অন্যদের সেবা করতে ভালোবাসতেন। তিনি ছবি আঁকাতেও ভালোবাসতেন । একবার বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীদের ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি রঘুনাথ দাস গোস্বামীর মুখমণ্ডল আঁকেননি। কারণ তিনি রঘুনাথ দাস গোস্বামীর ভাব ও চরিত্র সম্পর্কে উপলব্ধি করেননি। এরপর চৈতন্য চরিতামৃত দৃঢ়তার সহিত অধ্যয়নের পর অবশেষে তিনি রঘুনাথ দাস গোস্বামীর মুখমণ্ডল অঙ্কন করেন ।
রাতে তিনি অসুস্থতার কারণে কাতরাতেন। মাঝে মাঝে সারারাত ঘুমোতে না পেরে শুধু জপ করতেন। একবার তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটি ডায়েরি পড়ে গেলে একজন ভক্ত তা খুজে পায়। সে ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন, তার দেহত্যাগের সময় ঘনিয়ে আসছে, অথচ তিনি কৃষ্ণের জন্য খুব সামান্য সেবা করেছেন। এজন্য তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন।
বৃন্দাবনে বাস
১৯৯২ সালের মে মাসে ব্রজলীলা শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামীর কাছে থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেন। এরকম একজন একনিষ্ঠ ভক্ত শীঘ্রই দেহত্যাগ করতে যাচ্ছেন তা দেখে মহারাজ ব্রজলীলাকে কয়েক মাস পর ব্রাহ্মণ দীক্ষাও প্রদান করেন। মহারাজের প্রথম রাশিয়ান শিষ্যা গান্ধবিকা গিরিধারী দাসী কয়েক মাস তার সেবা করেছিলেন। অবশেষে তিনি অভিলাস করেন ব্রজলীলা যেন শ্রী বৃন্দাবন ধামে দেহত্যাগের প্রস্তুতি নেন এবং তিনি সার্বক্ষণিকভাবে ব্রজলীলার সেবায় নিয়োজিত থাকবেন। শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামী মহারাজ তার এই প্রস্তাবে সম্মত হন। ১৯৯৩ সালে বৃন্দাবনে আগমনের পর গান্ধর্বিকা ও ব্রজলীলা সেখানে অনেক মন্দির পরিদর্শন করেন। বৃন্দাবনে যে সব গোস্বামীগণ মন্দিরের দেখাশোনা করতেন তারা ব্রজলীলার প্রতি স্নেহপরায়ন হন। রাধা-দামোদর মন্দিরে প্রথম পরিদর্শনের সময় মন্দিরের প্রধান পূজারী ব্রজলীলার জন্য রাধা-দামোদরের কাছে বিশেষ প্রার্থনা নিবেদন করবেন বলে জানান। ইমলিতলা পরিদর্শনের সময় এক দীক্ষা অনুষ্ঠান চলছিল । তখন একজন গোস্বামী উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে ঘোষনা করলেন যে, এখানে সবকিছুই এখন পবিত্র হয়ে গেছে। কারণ ইস্কনের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছেন ।
ব্রজলীলা প্রায়ই বৃন্দাবন মন্দিরের বিগ্রহগুলো পরিদর্শন করতেন। যদিও তার কাছে কোন অর্থ ছিল না, তিনি যেকোনভাবে বিগ্রহের জন্য প্রসাদ ও পুষ্পমাল্য নিয়ে যেতেন। এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “মন্দিরে যাওয়ার পথে রাস্তায় কোন অর্থ কুড়িয়ে পেলে তা দিয়ে বিগ্রহের জন্য উপহার সামগ্রী কিনে নিতেন।”
তিনি সর্বদা পরিক্রমায় যেতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু অসুস্থ থাকায় তা সম্ভব ছিল না। প্রায়ই তিনি রাধাকুণ্ডে যেতেন এবং সেখানে তার প্রিয় স্থানগুলোর মধ্যে ছিল রঘুনাথ দাস গোস্বামীর সমাধি ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভজন কুঠির। তিনি সেখানে পরিদর্শনকালে সর্বদা প্রার্থনা মনোভাবে থাকতেন। তিনি নিয়মিত ষড় গোস্বামীদের সমাধি পরিদর্শন করে তাদের কৃপা প্রার্থনা করতেন। তিনি তাদের জীবনাচরিত হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন ।
তার প্রিয় বিগ্রহ ছিল, ইস্কন কৃষ্ণ-বলরাম মন্দিরের বিগ্রহ রাধা-শ্যামসুন্দর এবং সেখানে তিনি দিনের বেশির ভাগ সময় বিগ্রহের সম্মুখে হরিনাম জপ করতেন। তিনি রাতে বিগ্রহের শেষ দর্শন ভালোবাসতেন। ঐ সময় পূজারীরা বিগ্রহের পুষ্পমাল্য বিতরণ করেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, বিগ্রহরা শেষ দর্শনার্থীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কৃপালু হন। যখনই তিনি রাধা-শ্যামসুন্দর বা যে কোন বিগ্রহের কোন মহা-প্রসাদ লাভ করতেন, তা যত ক্ষুদ্র পরিমাণেই হোক সর্বদা তা অন্যদের মাঝে বিতরণ করতেন।
এদিকে ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামী ব্রজলীলাকে সহায়তা করার জন্য ভক্তিবৃঙ্গ গোবিন্দ মহারাজকে অনুরোধ করেন, তিনি মহারাজের সব নির্দেশনা নিজের গুরুদেবের নির্দেশনার মতই গ্রহণ করতেন। তিনি মহারাজের প্রতিও অনুরক্ত ছিলেন। ব্রজলীলার অপ্রকটের কয়েক মাস পূর্বে, শ্রীমৎ ভক্তিবৃঙ্গ গোবিন্দ মহারাজ তাকে একটি সুন্দর গোবর্ধন শিলা প্রদান করেন। তিনি নিজে গোবর্ধন পর্বতে গিয়ে সেই শিলাটি নিয়ে এসেছিলেন এবং সেসাথে বিগ্রহের আরাধনার জন্য সমস্ত উপকরণও নিয়ে এসেছিলেন।
এক রাতে তিনি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। তিনি যে শ্রীবৃন্দাবন ধামের ধ্যানে সর্বদা নিমগ্ন সেটিই এ কাহিনি থেকে উঠে আসে। তিনি স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি বৃন্দাবনে তিন বার জন্ম নিয়েছিলেন। প্রথমবার তিনি ছিলেন একটি গাধা যে কিনা বৃন্দাবনের ধূলোয় ঘাসের অনুসন্ধান করত। একসময় তিনি কিছু খারাপ ঘাস খেয়ে সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তী জন্মটি ছিল একটি কুকুরছানা, যে কিনা পবিত্র বৃন্দাবনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরাত এবং একদিন একটি রিক্সার নিচে তার প্রাণহানি ঘটে। এরপর তৃতীয় জন্মটি ছিল একটি গাভী, যে কিনা সর্বদা ব্রজের চারদিকে ঘুরে বেড়াত। অবশেষে গোবর্ধন পর্বতে এসে পবিত্র পর্বতের ওপর উঠতে গিয়ে থেমে যান, কারণ তিনি জানতে এ পর্বত হল স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি গাভী শরীর নিয়ে গোবর্ধন পর্বত পরিক্রমা শুরু করলেন এবং পথিমধ্যে তার মৃত্যু ঘটে। এর পরে জন্ম সম্পর্কে বলতে বললে, তিনি তখন হেসে উত্তর দেন, “তখনই তো স্বপ্নটিই ভেঙে গেল।”
গুরুদেবের প্রতি আসক্তির জন্য প্রার্থনা বৃন্দাবনে অবস্থানকালে তিনি সর্বদা তার গুরুদেবের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও সুগভীর হওয়ার জন্য প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন, তার দৃঢ় বিশ্বাসের অভাবে গুরুদেব তাকে কখনো কোন পত্ৰ লিখেননি। তিনি সর্বদা তাঁর গুরুদেবের বিরহ অনুভব করতেন। একবার শ্রীমদ্ভাগবত ক্লাস চলাকালীন, তিনি শ্রবণ করেছিলেন যে, গুরুদেবের কৃপা লাভের উদ্দেশ্যে আদি গুরু বলরামের কাছে প্রার্থনা নিবেদনের জন্য এই বৃন্দাবন ধাম হল বিশেষ স্থান। সেদিন সকালে গুরুদেবের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত একনিষ্ঠভাবে শ্রী বলরামের কাছে প্রার্থনা করেন।
রাধাষ্টমীর সময় তার সুযোগ হয়েছিল, রাধাকুণ্ড ও বর্ষানা পরিক্রমায় অংশগ্রহণ করার। এতে তিনি খুবই উৎফুল্ল ছিলেন। অসুস্থ হওয়ায় অন্যান্য সঙ্গীরা ব্রজলীলাকে বর্ষনার পাহাড়ে উঠতে সহায়তা করেছিল। প্রধান বর্ষনা মন্দির, লাল মন্দিরে পৌঁছা মাত্রই রাধারাণীর উৎসব শুরু হয়। সেখানে বেশ ভক্ত সমাগম হয়েছিল।
ব্রজলীলা ধীরে ধীরে বিগ্রহের বেদির সম্মুখে গেলে পূজারী এসে তাকে মহাপ্রসাদের প্রথম অংশটি প্রদান করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে শত শত ব্রজবাসী রাধারাণীর কৃপা গ্রহনের জন্য ঘিরে ধরে। সেখান থেকে কোন মতে মুক্ত হয়ে অবশিষ্ট প্রসাদ পরিক্রমায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে বিতরণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন । পরবর্তীতে ভক্তদের সহায়তায় তাকে বাসস্থানে নিয়ে আসা হলেও পরদিনই অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও গোপাল কৃষ্ণ গোস্বামীর রাশিয়ান শিষ্যদেরকে পরিক্রমায় বৃন্দাবনের সমস্ত মন্দির পরিদর্শনে নিয়ে যান। তিনি ছিলেন পরিক্রমার জন্য যথার্থ ব্যক্তি কেননা বৃন্দাবনের অনেক পবিত্র স্থানের লীলাবিলাস সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন।
সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতি ব্রজলীলার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় তিনি সাধারণত সকাল ৭টা পর্যন্ত ঘুমাতেন। একদিন কক্ষের একটি খোলা তারের মাধ্যমে ইলেকট্রিক শক খেলে তিনি প্রবলভাবে হার্টে ব্যাথা অনুভব করেন। অনতিবিলম্বে তাকে প্রথমে সরত হাসপাতালে এবং পরে মথুরা হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তাররা পরীক্ষা নীরিক্ষা করে দেখেন ব্রজলীলার লিউকেমিয়া প্রায় চরম স্তরে পৌঁছেছে। গান্ধবিকা তাকে পুণরায় বৃন্দাবনের ধর্মশালাতে তাদের পূর্বের বাসস্থানে নিয়ে আসেন। গান্ধবিকা পরবর্তীতে ডাক্তারদের সঙ্গে কেমোথেরাপি দেওয়ার কথা বললে ডাক্তাররা বলেন, তাতে আরো কয়েক মাস বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে।
আমি এ বিষয় নিয়ে মন্দিরের অনেক জ্যেষ্ঠ নারীদের সঙ্গে কথা বললে, তারা সবাই প্রস্তাব করেন চিকিৎসা নেওয়া তার জন্য ভালো হবে না। তবু গান্ধবিকা ব্রজলীলাকে বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করেন, হাসপাতালে ফিরে গিয়ে এর চিকিৎসা নিলে ভালো হবে, কেননা তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তখন তিনি উত্তর দেন, “সবচেয়ে চরম অবস্থা হল ভগবানের ভক্তদের সঙ্গ পরিত্যাগ করা। মৃত্যুর সময় জ্যেষ্ঠ ভক্তদের তত্ত্বাবধানে ভগবানের প্রতি মনকে নিবদ্ধ করে বৃন্দাবন ধামেই যদি মৃত্যু হয় তাতে আমি তো কোন বিপদ দেখি না। আমার প্রয়োজন সেই প্রশিক্ষণ। মৃত্যুর জন্য এই প্রশিক্ষনই যে কোন কেমোথেরাপির চেয়ে অনেক বেশি সহায়ক হবে, আমার এই কেমোথেরাপির প্রতি কোন আস্থা নেই।”
ব্রজলীলার এ মতামতের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামীকে ফ্যাক্স করা হলে মহারাজ ফ্যাক্সের উত্তরে এ বিষয়ে ব্রজলীলার সঙ্গে রাশিয়ায় কথা হয়েছিল বলে জানান । তারা দু'জনেই সিদ্ধান্ত নেন, এভাবে চিকিৎসা নেবেন না।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূরূপে তিনি নিজেকে বিতরণ করেছেন “কোন মূল্য ছাড়া আমাকে নাও, আমাকে গ্রহণ কর।” এই হচ্ছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, যিনি স্বয়ং কৃষ্ণ এবং কৃষ্ণচৈতন্য রূপে নিজেকে বিতরণ করার জন্য অবতরণ করেছেন। তাই তিনি নমো মহাবদান্যায়, পরম দাতা। অন্য কোন অবতারে, এমনকি রামচন্দ্র বা ভগবান কৃষ্ণ অবতারেও তারা এতটা উদার ছিলেন না।
মহারাজ তাকে প্রাকৃতিক আরোগ্য লাভের বিধানগুলো অনুসরণ করার জন্য অনুপ্রাণীত করেছিলেন, আর অবশেষে সবকিছু যদি ব্যর্থ হয় তবে মহারাজ তাকে শ্রীবৃন্দাবনে দেহত্যাগ করার জন্য বলেন। গুরুদেবের উত্তর পাওয়ার ব্রজলীলা নিবিড়ভাবে নিজেকে মৃত্যুর মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন,
“আমি জন্ম মৃত্যুর বেদনাপূর্ণ, অতল ঘূর্ণাবর্তে নিমজ্জিত হচ্ছি। হে প্রভু, হে আশ্রয়হীনের প্রকৃত বন্ধু, হে অপার কৃপার দীপ্তিময় চন্দ্র, দয়া করে, আমাকে রক্ষা করার জন্য অনতিবিলম্বে আপনার কৃপার হস্ত প্রসারিত করুন।”
(শ্রীল রুপ গোস্বামী পদ্যাবলী) [আগামী সংখ্যায় ব্রজ লীলার প্রয়ানের সেই অন্তিম রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলোর বর্ণনা তুলে ধরা হবে। অন্তিম মুহূর্তে ব্রজলীলা তার গুরুদেবের উপস্থিতি প্রগাঢ়ভাবে কামনা করেন এবং অতঃপর সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অলৌকিকভাবে তার গুরুদেব ব্রজলীলার সম্মুখে এসে উপস্থিত হন। তাকে সমস্ত দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। ব্রজলীলার কিছু প্রশ্ন যেগুলো অনেকদিন ধরে নিজের মধ্যে রেখেছিলেন সেই অন্তিম প্রশ্নগুলো গুরুদেবের সম্মুখে উত্থাপন করেন ।]
অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৭ ব্যাক টু গডহেড
0 Comments