রাধারাণীকে নারদ মুনির প্রথম দর্শনঃ


একবার নারদ মুনি যখন তাঁর বীণা বাদন করতে করতে সারা ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণ করছিলেন তখন একসময় তিনি শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভের জন্য গোলোক বৃন্দাবনে গেলেন। কিন্তু তিনি দেখলেন যে সেখানে প্রতিটি লীলা কেমন বিবর্ণ মনে হচ্ছে। তিনি কারণ জানতে ধ্যানে বসলেন, এবং জানতে পারলেন যে ভগবান তাঁর নিয়ে জড় জগতে অবতরণ করেছেন। নারদ মুনি ভগবানকে জড় জগতে দর্শন করতে চাইলেন, সেজন্য তিনি ভৌম বৃন্দাবনে এলেন। প্রথমে তিনি নন্দ মহারাজের আলয়ে আগমন করলেন। সেখানে ভগবানকে তিনি একটি শিশু রূপে দর্শন করলেন, তিনি তখন একটি সুন্দর শৈল্পিক শৈলী পূর্ণ সোনার খাটে নরম শয্যায় শয়ন করে ছিলেন। সমস্ত গোপরমণীরা কৃষ্ণের অপূর্ব সুন্দর রূপ নির্নিমেষে দেখছে এবং দিব্যানন্দ অনুভব করছে। প্রভু তাঁর নয়নের কোন দিয়ে অপাঙ্গে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রত্যেককে আনন্দ দান করছেন। তাঁর মুখের চারদিকে বিন্যস্ত অলকাবলী, নীলাভ কৃষ্ণ কুঞ্চিত কেশদামে তাকে অত্যন্ত সুন্দর দেখাচ্ছিল। নারদ মুনি তাঁর আরাধ্য প্রভুকে এমন নগ্ন শিশু রূপে দর্শন করে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। নারদ মুনি নন্দ মহারাজকে বললেন, “মহারাজ, কেউ আপনার পুত্রের অনস্ত মহিমা অবগত নয়। এমনকি ব্রহ্মা, শিব, ইঞ্জ আদি মহা মহা দেবগণও তাঁর নিত্য সান্নিধ্য লাভের বাসনা করেন। এই শিশুর চরিত্র প্রত্যকের সুখের কারণ হবে। ভক্তগণ তাঁর রম্য কার্যকলাপের কথা পরম প্রেমে শ্রবণ কীর্তন করতে থাকবে। আপনি এই জগৎ ও স্বর্গাদি লোকের প্রতি সমস্ত কামনা বাসনা ত্যাগ করুন এবং কেবল এই শিশুর প্রতি আপনার প্রেম বিকশিত করুন।


নারদ মুনি এরপর নন্দালয় থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন “কেমন করে শ্রীহরি এই জড়জগতে লীলাবিলাস করতে আবির্ভূত হয়েছেন? নিশ্চয়ই তাঁর নিত্য লীলাসঙ্গিনী এই ব্রজের কোথাও গোপীরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন আমার প্রভুর লীলাবিলাসে সহায়তা করার জন্য। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আজ আমি তাঁকে দর্শন করতে প্রত্যেক ব্রজবাসীর গৃহে যাব।”


এই রকম চিন্তা করে, নারদ মুনি ব্রজের প্রত্যেক গৃহ পরিদর্শন করলেন। যেখানেই তিনি গেলেন, সেখানেই ব্রজবাসীদের দ্বারা তিনি সুন্দরভাবে আপ্যায়িত ও পূজিত হলেন।


অবশেষে নারদ মুনি বৃষভানু রাজার গৃহে উপনীত হলেন। নারদ, মুনি তাকে বললেন, “আপনি আপনার ধার্মিকতার জন্য সারা জগতে সুপ্রসিদ্ধ। আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি অত্যন্ত ঐশ্বর্যশালী, বহু ধনসম্পদের অধিকারী। অনুগ্রহ করে আমায় বলুন আপনার কোন পুত্র বা কন্যা সন্তান আছে কি না। আমি তাঁদের দেখতে ইচ্ছা করি।” একথা শুনে বৃষভানুদেব তাঁর অত্যন্ত প্রভাময় কাস্তি বিশিষ্ট তাঁর পুত্রকে নিয়ে এলেন এবং নারদ মুনিকে প্রণাম করতে বললেন। এই বালকটির অনন্যসুন্দর রূপ দর্শন করে নারদ মুনি খুব খুশি হলেন।

পরম স্নেহে তিনি বার বার বালকটিকে আলিঙ্গন করতে লাগলেন। এবং বৃষভানুকে বললেন, “আপনার পুত্র কৃষ্ণ ও বলরামের একজন অত্যন্ত প্রিয় সখা হবে। তাঁদের সাথে সে দিবা রাত্র খেলা করবে। সে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। দয়া করে এর ভালভাবে যত্ন নিন। " মুনি প্রস্থান করতে উদ্যোগ নিচ্ছিলেন, তখন বৃষভানু মহারাজ বললেন, “এই বালকের একটি ছোট বোনও রয়েছে। কিন্তু সে স্বর্গবাসীদের মতো সুন্দর হলেও সে দৃষ্টিশক্তি, বাক্‌শক্তি ও শ্রবণশক্তি রহিত। হে মুনিবর কৃপাপূর্বক তাঁকে আপনার দিব্য দর্শন দান করে তাকে সুস্থ স্বাভাবিক করে দিন। অনুগ্রহণ করে ভিতরে এসে কন্যাটিকে আশীষ দান করুন।"


নারদ মুনি খুব কৌতূহলী হয়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি রাজা বৃষভানুর কন্যাকে ভূমিতে খেলা করতে দেখলেন। তৎক্ষণাৎ নারদ মুনি তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। এই শিশু কন্যাকে দর্শন করে তাঁর মহানন্দে অন্তর আপ্লুত হয়ে উঠল--ঠিক যেমন নন্দরাজ তনয় কানাইকে দর্শন করে তাঁর যেমন হয়েছিল। তিনি দিব্যানন্দে এতই বিহ্বল হয়ে পড়লেন যে মুহুর্তের জন্য তাঁর বাহ্যচেতনা বিলুপ্ত হয়ে গেল, এবং একটি প্রস্তর স্তম্ভের মতো স্থির, নিশ্চল হয়ে রইলেন। যখন তাঁর বাহ্য চেতনা ফিরে এলে, তিনি নয়ন মেললেন এবং এতই বিস্ময়াতিত্ব ত হয়ে পড়লেন যে তিনি কোন কথা উচ্চারণ করতে পারলেন না--বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। দেবর্ষি নারদ ভাবলেন, ব্রহ্মলোক, রুদ্রলোক, ইন্দ্রলোক-সহ আমি ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই ভ্রমণ করেছি। কিন্তু আমি কখনও এমন মহাবিস্ময়কর রূপশ্রীযুক্ত কন্যা দর্শন করিনি। আমি হিমালয়-দুহিতা পার্বতীকে দর্শন করেছি। তাঁর সৌন্দর্য জড় জগতের প্রত্যেককে আনন্দিত করে। কিন্তু তাঁর সৌন্দর্য এই কন্যাকে স্পর্শও করতে পারবে না। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সৌন্দর্য এমনকি এই কন্যার ছায়ারও সমতুল্য হবে না। আমি বিষ্ণুর মোহিনীরূপ দর্শন করেছি, যা শিবকেও বিমোহিত করেছিল। কিন্তু সেই মোহিনীর রূপ এই অসামান্যা অঙ্গ সৌন্দর্যের সমতুল্য নয়। এই কন্যার প্রকৃত স্বরূপ তত্ত্ব উপলব্ধি করা আমার সামর্থ্যের অতীত। ইনি শ্রীহরির পরম প্রিয় লীলাসঙ্গিনী। কেউ তাকে জানতে সক্ষম নয়। কেবল এই কন্যাকে দর্শন করেই আমি গোবিন্দের প্রতি কত প্রেম অনুভব করছি। প্রভুর প্রতি এত প্রীতি প্রেম আমি ইতিপূর্বে আর কখনো অনুভব করিনি। আমি অবশ্যই কোন নিভৃত স্থানে গিয়ে এই কন্যার গুণমহিমা কীর্তন করব এবং তাঁকে প্রার্থনা ও প্রণাম নিবেদন করব।” নারদ মুনি এইভাবে তাঁর প্রার্থনা নিবেদন করতে লাগলেন, “হে দেবী! আপনি মহাযোগ স্বরূপিনী, আপনি গোলোক বিহারী শ্রীহরির প্রধান লীলাসঙ্গিনী। আপনি অনুক্ষণ দিব্য রসানুভূতির অপূর্ব দিব্যানন্দে নিমগ্না। আমার মহা সৌভাগ্যবলে আমি আপনার দর্শন লাভ করেছি। আপনি সর্বক্ষণ আপনার প্রাণবল্লভ শ্যামসুন্দরের অনুধ্যানে আবিষ্টচিত্ত, এবং এইভাবে অন্তরে নিয়ত অপ্রাকৃত দিব্যানন্দ আস্বাদনে নিরতা।


আপনার অনুপম সুন্দর ও মধুরিমাপূর্ণ মুখাবয়ব আপনার স্ব-স্বরূপানন্দ আস্বাদনের সুখতে অভিব্যক্ত করছে। আপনি অন্তরে সর্বদাই আনন্দময় ও চির পরিতৃপ্ত। আপনি মহাবিষ্ণুর জন্মদাত্রী।আপনি এই মহাবিশ্বের প্রকাশ, পালন ও মহাপ্রলয়ের কারণ। আপনি। বিশুদ্ধসত্ত্ব স্বরূপিনী পরাশক্তি। আপনিই ব্রহ্ম গায়ত্রী এবং শ্রুতি সমূহের জননী। এমনকি ব্রহ্মা রুদ্রাদি মহা মহা দেবগণও আপনার স্বরূপতত্ত্ব অবগত নন। যোগীন্দ্র ও মুনীন্দ্রগণ ধ্যানে আপনাকে জানতে

পারে না। গোবিন্দের ইচ্ছা শক্তি, জ্ঞান ও ক্রিয়া শক্তি আপনার অংশ মাত্র। আপনি হ্লাদিনী শক্তি, আনন্দরূপিনী এবং ঈশ্বরী এতে কোনো সন্দেহ নেই। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন নামক অরণ্যে নিত্যকাল আপনার সঙ্গে লীলাবিলাসে নিরত। যদি আমাকে যোগ্য বিবেচনা করেন, তাহলে কৃপাপূর্বক আমাকে আপনার কিশোরী রূপ প্রদর্শন করুন।”


নারদ মুনি রাধারাণীকে প্রণিপাত করলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের সৌন্দর্যের গুণগান করতে শুরু করলেন। শ্রীমতী রাধারাণী যখন তাঁর প্রিয়বর শ্যামসুন্দরের রূপগুণের মহিমা শ্রবণ করলেন, তখন তিনি তাঁর পরিপূর্ণতম স্বরূপে প্রকটিত হন। তাছাড়া, নারদ মুনির ন্যায় একজন মহাভক্তের নিকট থেকে কৃষ্ণ গুণমহিমা শ্রবণ তাঁর কাছে আরো বেশি প্রীতিকর। সুতরাং নারদ মুনি যখন শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গ সৌন্দর্যের মহিমাগান করতে শুরু করলেন, তখন তা শ্রবণ করতে করতে রাধারাণী তাঁর পরমাকর্ষণীয় চতুর্দশ-বর্ষীয়া কিশোরী-রূপ পরিগ্রহ করলেন। সেই সময়ে সেখানে শ্রীরাধিকার সকল সখীগণ আবির্ভূতা হলেন এবং রাধারাণীকে পরিবেষ্টন করে দাঁড়ালেন। তাঁরা ছিলেন সুন্দর বেশভূ যায় সুসজ্জিতা ও নানা আভরণে সুশোভিতা। এই শোভা দর্শন করে নারদ মুনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন- তিনি প্রার্থনা স্তুতি করতে অসমর্থ হলেন। তিনি দিব্যভাবোচ্ছ্বাসে এতই বিহ্বল হয়ে পড়লেন যে তাঁর শ্রীমুখ থেকে আর কোন শব্দই নির্গত হল না।


সখীগণ তখন জল নিয়ে এসে রাধারাণীর চরণকমল প্রক্ষালন করলেন এবং নারদ মুনিকে স্বাভাবিক চেতনায় ফিরিয়ে আনার জন্য সেই জল তাঁর মস্তকে সিঞ্চন করলেন। সখীগণ তখন নারদ মুনির প্রতি সদয় হলে তাঁকে বললেন, “হে মহা মুনি! আপনি অবশ্যই মহা ভক্তি অনুরাগ সহকারে ভক্তবাঞ্ছা পূরণে সদা উৎসুক ভগবান শ্রীহরির সেবা করেছেন। সেইজন্যই আজ আপনি শ্রীহরি বল্লভা শ্রীমতী রাধারাণী লীলামহিমা


রাধারাণীর পরমাদ্ভূত নিতা কিশোরী রূপ দর্শন করতে সমর্থ হয়েছেন। এমনকি ব্রহ্মা, রুদ্র, ঋষিগণ, সিদ্ধগণ, মহামুনিগণ এবং অন্যান্য ভাগবতগণও শ্রীরাধিকার এই রূপ দর্শনে সমর্থ হননি। তাঁকে দর্শন করা দূরে থাক, তাঁরা এমনকি তাঁর সম্বন্ধে অবগতও নয়। আজ তিনি আপনাকে তাঁর এই কিশোরী রূপের দর্শন দান করিয়াছেন। আপনি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। হে ব্রাহ্মণ! ধৈর্য্য ধারণ করুন, উঠুন। শ্রীমতী রাধারাণীকে পরিক্রমা করুন এবং বার বার প্রণাম নিবেদন করুন। রাধারাণীর এই পরমাকর্ষক রূপ ক্ষণস্থায়ী বিদ্যুৎ চমকের মতো। এখন তাঁর এই কিশোরী রূপ অন্তর্হিত হবে। গোবর্দ্ধন পর্বতের পাদদেশে কুসুম সরোবরের তীরে একটি অশোক বৃক্ষ আছে। সেই অশোক বৃক্ষে সর্বদাই ফুল ফোটে। এই ফুলের মধুর সৌরভ বনের চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হয়। এবং সমগ্র স্থানটি সুরভিত হয়ে ওঠে। নিশীথে এই অশোক তরু তলে আবারও আপনি আমাদের দর্শন লাভ করবেন। পরে, উপযুক্ত সময় এলে, আপনি সখীগণ পরিবৃত রাধারাণীকে দর্শন করতে পারবেন।"


এই বলে গোপীকাগণ ও কিশোরীতনু রাধারাণী সেই স্থান থেকে অন্তর্হিতা হলেন, এবং পুনরায় রাধারাণী তাঁর শিশুরূপ পরিগ্রহ করলেন। তখন মহারাজ বৃষভানু কক্ষে ফিরে এলেন। তিনি বিস্মিত হয়ে দেখলেন যে নারদ মুনি বার বার শিশুকন্যাকে প্রণাম নিবেদন করছেন। তিনি মুনিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মুনিবর! আপনি আমার শিশুকন্যাকে কেন প্রণাম করছেন?” নারদ মুনি মহারাজ বৃষভানুকে আশ্বস্ত করে বললেন যে এই শিশুর সবই কুশল, উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ নেই। এর পর তিনি প্রাসাদ হতে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

Post a Comment

0 Comments