শ্রীশ্রীরামচন্দ্রের ২৪টি গুণাবলী

বাল্মীকি কর্তৃক জিজ্ঞাসিত প্রতিটি গুণাবলী কীভাবে ভগবান শ্রীরামের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে নারদ মুনি তা বর্ণনা করেছেন। যিনি আদর্শ মানুষ হতে চান, তাঁর উচিত এই গুণসমূহ লালন করা এবং ভগবান শ্রীরামের মধ্যে এর সবগুলোই ছিল। সেগুলো হলো :

১. গুণবান : সকলের শ্রেষ্ঠ হতে হলে উচ্চবংশে জন্ম, উচ্চ শিক্ষা ও ঐশ্বর্য থাকা প্রয়োজন । এমনকি এর একটি থাকলেও মানুষ অহংকারী হয়ে ওঠে। আর যার মধ্যে সবগুলোই রয়েছে সে যে উদ্ধত হবে তা তো সহজেই অনুমেয়। একজন গুণবান ব্যক্তি হচ্ছেন তিনি যার উচ্চবংশ, ধনসম্পদ ও উচ্চশিক্ষা থাকা সত্ত্বেও তিনি সুশীল বা সকলের প্রতি ভদ্র ও অমায়িক। ভগবান শ্রীরামের মধ্যে এই তিনটিই পূর্ণরূপে ছিল, তবুও তিনি সকলের প্রতি অমায়িক ছিলেন। গুহ (একজন উপজাতি নেতা), সুগ্রীব (একটি বানর) এবং বিভীষণ (একজন রাক্ষস) এর সাথে বন্ধুত্ব করে ভগবান শ্রীরাম এই গুণটি প্রদর্শন করেছিলেন।

২. বীর্যবান : একজন শক্তিশালী ব্যক্তি। খর, দূষণ, রাবণ ও কুম্ভকর্ণের সাথে যুদ্ধে ভগবান শ্রীরাম এই গুণটি প্রদর্শন করেছেন।

9. ধর্মজ্ঞ : ভগবান শ্রীরাম যে ধর্মটি অনুসরণ করেছেন তা হচ্ছে সুরক্ষার ধর্ম, যা তাঁর সম্পূর্ণ শরণাগত ভক্তদের মুক্তি নিশ্চিত করে। কেউ যদি তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করে, তিনি তাদের সুরক্ষা দেন, তাদের সবকিছু সরবরাহ করেন, তাদের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন।

৪. কৃতজ্ঞ : কেউ যদি ভগবান শ্রীরামের প্রতি অতি ক্ষুদ্র সেবাও করে, তিনি তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন। তার চেয়েও তাঁর আরো বড় মহত্ত্ব হচ্ছে তিনি অন্যদের কৃত অসংখ্য অসুবিধা বা অপরাধগুলোকে সত্য না করে তাদের সেবা স্মরণ রাখেন। যারা তাঁর সেবা করে তিনি তাদের প্রতি অত্যন্ত বাধিত হয়ে পড়েন। কাঠবিড়ালীর ক্ষুদ্র সেবাকে তিনি হনুমানের সেবার মতো গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং তাকে তাঁর হস্তের দিব্য স্পর্শ প্রদান করেছিলেন।

৫. সত্যবাক্ : যে ব্যক্তি তার কথা অনুসারে আচরণ করেন তাকে সত্যবাক বলা হয় । শ্রীরামচন্দ্র তাঁর পিতার প্রতি প্রদত্ত প্রতিজ্ঞা পূরণে সর্বদা দৃঢ়নিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর পিতার আদেশ অমান্য করার জন্য তাঁর মাতা ও লক্ষ্মণের প্ররোচনা সত্ত্বেও, তিনি তাঁর বাক্য এবং নীতিতে অবিচল ছিলেন। অধিকন্তু, তাঁর বনবাসকালে ভরত, মাতাগণ, গুরু বশিষ্টসহ আরো অনেকের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি পিতার প্রতি প্রতিজ্ঞা পূরণে অবিচল ছিলেন। তিনি অযোধ্যায় ফিরে না গিয়ে বনেই অবস্থান করেছিলেন।

৬. দৃঢ়ব্রত : যে ব্যক্তি সুরক্ষা প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ তাকে দৃঢ়ব্রত বলা হয়। অন্য অনেক ব্রত থাকা সত্ত্বেও এরূপ ব্যক্তি তার আশ্রিতজনকে সুরক্ষা প্রদান করেন। ভগবান শ্রীরাম দণ্ডকারণ্যের ঋষিদের সুরক্ষা দিয়েছিলেন এবং বানরদের রক্ষণশীল উপদেশকে অগ্রাহ্য করে বিভীষণকে গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া শাস্ত্র গুরু-সাধু প্রদান এবং নিয়মিত অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েও তিনি সুরক্ষা প্রদান করেন।

৭. চরিত্রেণ কো যুক্ত : একজন দৃষ্টান্তমূলক আচরণ, নিখাঁদ চরিত্র এবং ত্রুটিমুক্ত ব্যক্তি, যিনি সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করেন। মহত্বের পরিচয় বীরত্বে নয়, আচরণে। বিভীষণ যখন তাঁর শরণ নিতে এসেছিল, বানর সেনার প্রত্যেক সদস্যের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ভগবান শ্রীরাম তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং তাকে নিজের ভাইয়ের মতো মর্যাদা প্রদান করেছিলেন।

৮. সর্বভূতেষু কো হিত : যে ব্যক্তি কোনোরূপ প্রভেদ না করেই ঐকান্তিকভাবে সকলের কল্যাণের জন্য কাজ করেন ও সকলের মঙ্গল কামনা করেন। তিনি তার ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সমান গুরুত্ব সহকারে অন্যদের সেবা করেন। ভগবান শ্রীরাম গৃধ্র বা শকুনরাজ জটায়ুকে নীচ পাখি বলে দেখেন নি। একজন পুত্র যেভাবে পিতার সেবা করে ঠিক সেই ভাবে তিনি জটায়ুকে সেবা করেছিলেন।

৯. বিদ্বান : যে ব্যক্তি সর্ব বিদ্যায় পারদর্শী। ভগবান শ্রীরাম ৬৪টি কলায় সুনিপুণ ছিলেন। তিনি সকল বেদে বিশারদ ছিলেন, ধনুবিদায় অদ্বিতীয় ছিলেন, সকল যুদ্ধবিদ্যা জানতেন, সকল প্রকার যানে আরোহন করেছিলেন, সুন্দর গান গাওয়া, সকল বাদ্য বাজানো, নৃত্য, ছবি আঁকা প্রভৃতিতে ভালভাবে পারঙ্গত ছিলেন তা-ই নয় বরং তিনি আরো জানতেন যে, কীভাবে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত দক্ষতাটি ব্যবহার করতে হয়।

১০. সমর্থ : যে ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে সুদক্ষ। কেবল জ্ঞান এবং দৃঢ় প্রত্যয়ই যথেষ্ট নয়; সেই সাথে সেগুলোকে দক্ষতার সাথে ও কার্যকরভাবে ব্যবহারের সামর্থ্যও মানুষের থাকা উচিত। কোনো কার্য করার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় অত্যাবশ্যক-দৃঢ় ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্যের দৃঢ়তা; অন্তিম উদ্দেশ্যের পূর্ণতা ও যোগ্যতা। রাবণ এবং তাড়কাকে বধের সময় ভগবান শ্রীরাম এই তিনটি গুণই প্রদর্শন করেছিলেন।

১১. জিতক্রোধ : যিনি ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং প্রয়োজনের সময় একে তার সেবায় আহ্বান করতে পারেন। শ্রীরাম দুইবার এই গুণটি প্রদর্শন করেছেন- এক, যখন সুগ্রীব তার কর্তব্যে অবহেলা করেছিল এবং আবার, হনুমানকে রাবণের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে।

১২. দ্যুতিমান : যে ব্যক্তির সৌন্দর্য স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের ওপরই দ্যুতি বিস্তার করে। বিশ্বামিত্র, জনক, সীতা এবং দণ্ডকারণ্যের ঋষিগণ, সকলেই ভগবান শ্রীরামের রূপের প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলেন।

১৩. অনসূয়ক : যিনি ঈর্ষা থেকে মুক্ত । ভগবান শ্রীরাম কৈকেয়ী বা দশরথের মধ্যে কোনো দোষ দর্শন করেন নি, যদিও তারা তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সাম্রাজ্য থেকে বঞ্চিত করেছিলেন।

১৪. কস্য বিভ্যতি দেবাশ্চ জাতরোষস্য সংযুগে : অসহ্য শত্রুতা ও বিরোধিতা সত্ত্বেও যার সাহস কখনো ব্যর্থ হয় না। খর ও দূষণের ১৪,০০০ রাক্ষস সেনার আক্রমনের মধ্যেও, ভগবান শ্রীরাম কেবল স্মিত হেসেছিলেন। সেই যুদ্ধ জয় করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু মাত্র ৪৮ মিনিটে, তিনি জয়ী হয়েছিলেন।

১৫. আর্য : যিনি সর্বদা ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ থাকেন এবং অধর্ম থেকে দূরে থাকেন। একজন পুত্রের ধর্ম অনুসরণ করার জন্য তিনি বনে গিয়েছিলেন। আদর্শ পতির ধর্ম অনুসরণ করার জন্য তিনি শূর্পনখা থেকে দূরে ছিলেন। শ্রীরামকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনার জন্য জাবালি ঋষি নাস্তিক্যবাদের মাধ্যমে প্ররোচিত করতে চেয়েছিলেন, ভগবান রাম ব্যক্তিগত স্বার্থপূরণে ধর্মকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য তাকে কঠোরভাবে তিরষ্কার করেছিলেন।

১৬. সর্বসমশ্চৈব : যিনি সমদর্শনের অনুশীলন করেন। জন্ম, ধনসম্পদ, পদমর্যাদা বা শক্তির দ্বারা সৃষ্ট কুসংষ্কারের দ্বারা ভগবান শ্রীরাম কখনো বিচ্যুত হন নি ।

১৭. সৎপুরুষ : যিনি নিত্য বা সনাতন। ভগবান শ্রীরাম হচ্ছেন সনাতন বা সৎ পুরুষ। যে সকল জীবেরা তাঁর প্রতি আসক্ত হয় তারাও তাঁর কৃপায় তাদের সৎস্বভাব প্রাপ্ত হয় ।

১৮. প্রতিভা : যিনি প্রতিভাসম্পন্ন। বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর ভাইদের সাথে শ্রীরামের আচরণ এবং সম্পর্ক ভঙ্গ হওয়ার মতো বহু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁদের একতা ধরে রাখা তাঁর প্রতিভাকে প্রমাণ করে। সবচেয়ে বিচলিতকর পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও তাঁর প্রতিভার প্রমাণ ।

১৯. সর্বলোকপ্রিয় : যাকে সকলেই ভালবাসেন। ভগবান শ্রীরামের আচরণ এমন ছিল যে, তাঁর দ্বারা সকলেই আনন্দিত হতো।

২০. সাধু : যিনি সাধুসুলভ ব্যক্তি। তাঁর মনের শুদ্ধতাই হচ্ছে শ্রীরামের সাধুত্ব। তাঁর সমগ্র জীবনে তিনি নিজের কল্যাণের জন্য কাউকে ক্ষতি করার চিন্তাও করেন নি। যে কৈকেয়ী তাঁকে প্রকৃতপক্ষে প্রতারিত করেছিল, এমনকি তার প্রতিও শ্রীরামের কোনো অসৎ ইচ্ছা ছিল না।

২১. প্রিয়প্রয় বৃত্তি : যে ব্যক্তি তার আচরণে সর্বদা প্রসন্ন। যারাই তাঁর দিকে তাকাতো তারা ভগবান শ্রীরামের প্রসন্ন আচরণ এবং সন্তোষজনক আচরণে মুগ্ধ হয়ে যেত।

২২. প্রক্রিত্য কল্যাণীমতি : যিনি উদার এবং শুভকর। শ্রীরাম সকলের হিতকামনা করতেন এবং তা পরিপূর্ণ করার জন্য কর্ম করতেন।

২৩. অনবগিত পরিচয় : যিনি এমন একটি ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখেন যার ফলে শঠ, দুষ্ট এবং অপ্রত্যাশিত উপাদানগুলো তার থেকে দূরে থাকে। ভগবান শ্রীরাম তখনই কথা বলতেন যখন তা আবশ্যক এবং প্রয়োজন হতো। প্রজল্প এবং অপ্রয়োজনীয় হাস্য-পরিহাস থেকে তিনি দূরে থাকতেন। এভাবে, দুষ্ট ও অপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলোকে তিনি তাঁর থেকে দূরে রাখতেন । শূর্পনখা যখন এসে রসিকতা করতে লাগল তিনি তাকে লক্ষ্মণের নিকট পাঠিয়ে ছিলেন।

২৪. বিনয় মধুর বাচিনিয়ম : যিনি বিনীত, মধুর স্বভাবের, সুশৃঙ্খলিত এবং যার বিজ্ঞ পরামর্শযুক্ত বাণী তাকে সকলের প্রিয় করে তোলে। দণ্ডকারণ্যের ঋষিগণ যখন শ্রীরামের ব্যক্তিত্বের মধুরতা দর্শন করলেন, তারা তাদের সকল দুঃখ ভুলে গেলেন এবং তাঁর সৌন্দর্যে মগ্ন হয়ে গেলেন ।

এভাবে ভগবান শ্রীরামের গুণাবলি বর্ণনার ছলে নারদ মুনি ভগবান শ্রীরামের অপ্রাকৃত জীবনী সমন্বিত পুরো রামায়ণ বর্ণনা করেন যা ‘সংক্ষিপ্ত রামায়ণ" বলে পরিচিত। বিশ্বাস করা হয় যে, বালকাণ্ডের ১.১.১ - ১.১.১০০ পর্যন্ত এই ১০০ টি শ্লোক পাঠ করা ২৪,০০০ শ্লোক সমন্বিত সমগ্র রামায়ণ পাঠ করার সমান ।

Post a Comment

0 Comments