জগন্নাথের মূর্তিগুলো হাত-পা বিহীন, বড়বড় চোখের এবং অদ্ভূতদর্শন কেন?


বৈষ্ণবীয় দর্শন মতে, একদা দ্বারকায় মহিষীগণ রোহিনী মাতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে এত সেবা করার পরও তিনি যেন শ্রীদাম-সুদাম, কখনও মা যশোদা-নন্দ বা কখনও ব্রজবাসীগণ বলতে মুর্ছা যান। তার কারণ কি?


তখন মাতা রোহিণী সুভদ্রাকে বললেন তুমি একটু দরজার বাইরে থাকো। এ বর্ণনা তুমি সইতে পারবে না। সুভদ্রাকে বাইরে রেখে মাতা রোহিণী মহিষীদেরকে বলতে লাগলেন কৃষ্ণ বিহনে বৃন্দাবনের তরু-লতা-পশু-পাখি কিভাবে হা-কৃষ্ণ হা-কৃষ্ণ বলে কাঁদছে, কিভাবে মূর্ছা যাচ্ছে নগরবাসীরা। সখাগণ অনাহারে অনিদ্রায় কালাতিপাত করছে। মা যশোদা, পিতা নন্দ প্রতিদিন ছানা-মাখন নিয়ে গোপাল গোপাল বলে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেছেন। কৃষ্ণবিহনে ব্রজগোপীগণ প্রাণান্তপ্রায়। এদিকে ভগিনী সুভদ্রা দেবীকে একটি কক্ষের দ্বারে দেখতে পেয়ে কৃষ্ণ এবং বলরাম তাঁর নিকটে এসে দাঁড়ালেন। কক্ষাভ্যন্তর থেকে ভেসে আসা ধ্বনি, রোহিনী মাতা কর্তৃক বর্ণিত ব্রজবাসীদের কৃষ্ণ-বিরহ কথা শ্রবণ করতে করতে কৃষ্ণ, বলরাম এবং সুভদ্রা বিকারগ্রস্ত হতে লাগলেন।

 তাদের হস্ত-পদ শরীরাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হতে লাগল। চক্ষুদ্বয় বিস্ফোরিত হতে লাগল।


এমতাবস্থায় সেখানে নারদ মুনি উপস্থিত হয়ে সেই রূপ দর্শন করলেন। তখন নারদ মুণি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট প্রার্থনা করলেন, হে ভগবান, আমি আপনার যে রূপ দর্শন করলাম, যে ভক্ত বিরহে আপনি স্বয়ং বিকারগ্রস্ত হয়ে থাকেন, সেই করুণার মূর্তি জগতবাসীর কাছে প্রকাশ করুন। নারদ মুণির প্রার্থনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, দারুবৃক্ষ (জগন্নাথ) রূপে শ্রীক্ষেত্র বা পুরীতে আমি এই রূপে আবির্ভূত হবো।


 পুরীর রথযাত্রা উৎসব হচ্ছে বড় ভাই বলরাম বা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন যাত্রার স্মারক। তিন জনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় হল এই রথ তিনটি।


জগন্নাথ কথাটির অর্থ “জগতের নাথ” বা “জগতের প্রভু”। তিনি হলেন একজন হিন্দু দেবতা। জগন্নাথদেব হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণু বা তাঁর অবতার কৃষ্ণের একটি বিশেষ রূপ। তাঁকে তাঁর দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে পূজা করা হয়। ওড়িশা রাজ্যের পুরী শহরে জগন্নাথদেবের প্রধান মন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দির হিন্দুধর্মের চারধামের মধ্যে অন্যতম। পুরীতে প্রভু জগন্নাথদেবের পূজা বিধান দ্বাদশ যাত্রার মাধ্যমে হয়ে থাকে। সেই যাত্রা গুলি যথাক্রমে – ১/ স্নান যাত্রা, ২/ গুন্ডিচা যাত্রা ,৩/ শয়ন যাত্রা, ৪/ দক্ষিণায়ন যাত্রা , ৫/ পার্শ্ব পরিবর্তন যাত্রা, ৬/ দেবউত্থাপন যাত্রা, ৭/ প্রাবরণ যাত্রা, ৮/ পুষ্যাভিষেক যাত্রা , ৯/ উত্তরায়ণ যাত্রা , ১০/ দোলযাত্রা, ১১/ দমন যাত্রা ও ১২/ চন্দন যাত্রা। এর মধ্যে চন্দন যাত্রা বেশি দিন চলে । এই যাত্রা ৪২ দিন ধরে এক নাগাড়ে চলে। প্রথম ২১ দিন বাহির চন্দন ও শেষ ২১ দিন ভিতর চন্দন যাত্রা চলে। চন্দন যাত্রার পরই উল্লেখযোগ্য পার্বণ হলো


স্নান যাত্রার পর আসে গুন্ডিচা যাত্রা , অর্থাৎ রথযাত্রা। স্নান যাত্রায় স্নান করার ফলে প্রভু জগন্নাথদেব , বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর জ্বর আসে , তাই কিছুদিন বিশ্রাম নেবার পর সুস্থ্ হয়ে উঠলে গুন্ডিচা মাসীর বাড়ি যাবার উদ্দেশে রথে ওঠেন। তাই প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় শুরু হয় রথযাত্রা । পুরীর মন্দির থেকে গুণ্ডিচা মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ২ কিমি। সেই জন্য সেই শুরু থেকে পুরীতে তিনটি আলাদা আলাদা রথ বানানো হয়। পুরীর রথ তিনটি সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি হয়। তবে যে সে কাঠ হলে চলবে না । ফাঁসি ও ধাউসা গাছের কাঠ দিয়েই নির্মাণ করা হয় এই রথগুলি।


কথিত আছে প্রতি বছর নাকি মহানদীর স্রোতে ভেসে আসে রথ নির্মাণের প্রয়োজনীয় কাঠ। পুরীর কাছে এক স্থানে সেই কাঠগুলি মহানদী থেকে তুলে ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়। এরপর দসাপাল্লা নামে একটি স্থান থেকে একদল বিশেষ কাঠমিস্ত্রি এসে রথ নির্মাণ করে। দসাপাল্লা আগে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। এখানকার কাঠের মিস্ত্রিরা অত্যন্ত দক্ষ। রথযাত্রার শুরুর সময় থেকেই দসাপাল্লার কাঠমিস্ত্রিরাই রথ নির্মাণ করেন। রথের ছাউনি তৈরি হয় কাপড় দিয়ে এতে প্রায় ১,২০০ মিটার মত কাপড় লাগে বলে জানা যায়।


বলরামদেবের রথের নাম “তালধ্বজ”। ১৪ টি চাকা যুক্ত এই রথে নাঙ্গলধ্বজ চিন্হিত থাকে। এই ১৪ টি চাকা সপ্ত স্বর্গ ও সপ্ত লোকের প্রতীক। রক্তলাল ও সবুজ কাপড়ে মোড়া হয়ে থাকে রথটি । রথটির উচ্চতা ৪৪ ফুট, রথের শীর্ষে থাকে অনন্ত নাগ। হরিহর, লাটম্বর , গজন্তক, প্রলম্বারি, ত্রিপুরারি, রুদ্র, গনেশ , স্কন্দ হলেন এই রথের ওপর পার্শ্ব দেবতা। এই রথের সারথি হলেন দারুক। এই রথটি টানে চারটি কালো ঘোড়া । ঘোড়া গুলোর নাম হল , তীব্র , ঘোর , দীর্ঘশ্রব ও স্বর্ণলাল। রুদ্র ও সাত্যকি , মতান্তরে নন্দ ও সুনন্দ হলো এই তালধ্বজ রথের দুই দ্বারপাল। ব্রহ্মা ও শিব ও এই রথে থাকেন । রথের পতাকার নাম “উচ্ছনি”। রথের রশির নাম “বাসুকি”। রথের অধীশ্বর হলেন বলরাম দেব।


সুভদ্রা দেবীর রথের নাম “দেবদলন” বা “দর্পদলন” নামে পরিচিত। লাল ও কালো কাপড়ে মোড়ানো হয়। এই রথটি ১২ টি চাকা যুক্ত। চাকা গুলি বছরের ১২ টি মাসকে নির্দেশ দেয়। রথটির উচ্চতা প্রায় ৪৩ ফুট। পদ্মধ্বজ চিন্হ থাকে সুভদ্রা দেবীর রথে। জয়দুর্গা বা বনদুর্গা হলেন এই রথের রক্ষক। রথের সারথী হলেন অর্জুন । এই রথে অধিষ্ঠিত পার্শ্ব দেবীদের নাম হল যথাক্রমে সুমেধা, চামরহস্তা, বিমলা, চামুণ্ডা, ভদ্রকালী, হরচন্দ্রিকা, মঙ্গলা, বারাহী,কাত্যায়নী, জয়দুর্গা ও কালী। অন্য মতে আবার দেবীদের নাম ভিন্ন আছে , চণ্ডী মঙ্গলা, বারাহী, চামুন্ডা, উগ্রতারা, বনদুর্গা, শূলিদুর্গা, শ্যামাকালী ও বিমলা। দেবদলন রথের দেবী হলেন ‘ভূ’ ও ‘শ্রী’। এই রথটি রোচিকা, মোচিকা, জিতা ও অপরাজিতা নামে চারটি খয়েরি রঙের ঘোড়া টানে। রথের রশির নাম “স্বর্ণচূড়”। রথের মাথায় উড়ে “নাদম্বিকা” পতাকা। রথের অধীশ্বরী সুভদ্রা দেবী।


প্রভু জগন্নাথদেবের রথের নাম “নন্দীঘোষ”। লাল ও হলুদ কাপড়ে মোড়ানো হয় রথটি। রথে মোট ১৬টি চাকা যুক্ত থাকে। চন্দ্রের ১৬ কলা জগন্নাথদেবের রথের চাকায় সংখ্যা তত্ত্বে মিশে আছে। নন্দীঘোষের উচ্চতা ৪৫ ফুট ।রথের রক্ষক গরুড় । মা বিমলা ও মা বিরজা নন্দীঘোষের শক্তি। এই রথের পার্শ্ব দেবতা মোট ৯ জন। তারা হলেন – রাম , লক্ষণ, হনুমান , নারায়ণ , কৃষ্ণ, গোবর্ধন , চিন্তমনী , রাঘব ও নৃসিংহ। এই রথটি ৪ টি সাদা ঘোড়ায় টানে । ঘোড়া গুলির নাম যথাক্রমে – শঙ্খ, বলাহ, শ্বেত ও হরিদাস। রথের সারথি হলেন মাতলি। রথে ২ জন দ্বারপাল হলেন জয় ও বিজয়। মতান্তরে তারা হলেন ব্রহ্মা ও ইন্দ্র। রথের রশির নাম ” শঙ্খচূড়” । রথের অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন “যোগমায়া” এবং রথের পতাকার নাম “ত্রৈলোক্যমোহিনী”। এই পতাকায় হনুমান বিরাজ করে থাকেন । রথের অধীশ্বর হলেন প্রভু জগন্নাথদেব। পুরাণে বর্ণিত আছে  রথে বসে থাকা অবস্থায় প্রভু জগন্নাথদেবের দর্শন করলে নাকি আর পুনর্জন্ম হয় না।


পুরীর রথযাত্রার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে নিয়ে নানা মুনির নানা মত দেখা যায়। পদ্মপুরাণ মতে, রথযাত্রায় শ্রীবিষ্ণুর মূর্তিকে রথারোহণ করানোর কথা বলা হয়েছে। আর পুরীর জগন্নাথদেবের মূর্তি যে শ্রীকৃষ্ণ তথা শ্রীবিষ্ণুররই আরেকটি রূপ তা সকলেই স্বীকার করেন। তবে স্কন্দপুরাণে কিন্তু প্রায় সরাসরিভাবে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার কথা রয়েছে। তবে উড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় আজকের উড়িশা নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তিকালে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন। সেই থেকে রাজপরিবারের নিয়ম অনুসারে যিনি রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন, তিনি প্রভু জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর রথের সামনে এসে পুষ্পাঞ্জলি দেন এবং সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথের সামনে ঝাঁট দেন। ঝাঁট দেওয়ার পরই পুরীর মন্দির থেকে বাইরে আসেন প্রভু জগন্নাথ এবং রথে ওঠানো হয়। পুরির রথযাত্রার এইসব উপাচার “পোড়া পিঠা” নামে পরিচিত।


এরপরই শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। এই রথযাত্রা উৎসব উপলক্ষে পুরীতে হাজার হাজার ভক্তদের সমাগম হয়। সেই জন্য রথের দড়ি টানার জন্য ভক্তদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। কারণ এই কাজে সবচেয়ে পূণ্য অর্জন করা যায় বলে ভক্তরা বিশ্বাস করেন। বাংলায় রজ্জুতে সর্পভ্রমের প্রবাদ আছে। প্রতিবেশী দেশ উড়িষার পুরীর এই রথের দড়ি কিন্তু সত্যিই সাপের কথা বলে। কথিত আছে “বাসুকি”, “স্বর্ণচূড়” ও ” শঙ্খচূড়” নাগই নাকি রথের দড়ি হিসেবে নিজেকে নিবেদন করে। সেজন্য ভক্তরা বিশ্বাস করেন, রথের দড়ি ধরলে নাগেদের কৃপা লাভ হয় । তবে যারা দড়ি ধরার সুযোগ পান না, তাদেরও পূণ্য অর্জনের উপায় আছে। পুরীর রথ চলার সময়, রাস্তায় যে চাকার দাগ পরে, তাও পবিত্র হিসেবে গন্য করা হয়। তিনটি রথের তিনটি দাগ, গঙ্গা , যমুনা , সরস্বতী – এই তিন পবিত্র নদীর সমান বলে মনে করা হয়। যারা রথের দড়ি ধরার সুযোগ পান না, তারা যদি চাকার এই তিনটি দাগের ধুলি মাথায় দেন , তাহলে গঙ্গা ,যমুনা ,সরস্বতী নদীতে স্নান করার পূণ্য লাভ করেন ।


বলরাম , সুভদ্রা ও জগন্নাথদেব রথে চেপে ভক্তগণ আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে রশি টেনে গুণ্ডিচা মাসীর বাড়ি নিয়ে আসেন। গুণ্ডিচা মন্দির হল সেই পবিত্র ক্ষেত্র যেখানে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আহুতি প্রদান করেছিলেন। এখানেই নাকি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অশ্বমেঘ যজ্ঞ করেছিলেন। তাই সেই যজ্ঞের বেদি জগন্নাথদেবের প্রিয় স্থান । তার আর একটা কারণ হল এই দিব্য স্থানই জগন্নাথ দেবের জন্ম আবাস স্থল রূপে গণ্য। তাই বছরে একবার জগন্নাথদেব তার প্রিয় দাদা ও বোনকে নিয়ে গুণ্ডিচা মন্দিরে আসেন। তারপর গুন্ডিচা মন্দিরের ভেতরে দুই ভাই বোনের থাকার স্থান হয়। এই গুন্ডিচা মন্দিরে দশমী তিথি পর্যন্ত পূজা পান । ৯ দিন পর “পুনর্যাত্রা” বা উল্টো রথে চেপে আবার মূল মন্দিরে ফিরে যান। পুনর্যাত্রা বা উল্টোরথ যাত্রা মিলিয়ে সমগ্র যাত্রাকে বলা হয় ” নবদিনাত্মিকা” উৎসব। একাদশীর দিন মূল মন্দিরে ফিরে এসে প্রভু জগন্নাথ সহ বলরাম ও সুভদ্রা দেবী সোনার সাজে সোনা বেশে অধিষ্ঠিত হন, এবং তখন সকল ভক্তদের জন্য মদিরের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়.. 


আমার শাস্ত্র নিয়ে চর্চা আলোচনা করতে ভীষণ ভালো লাগে তাই এই তথ্য গুলো উইকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ করেছি...


সকল কে রথযাত্রার শুভেচ্ছা ভালোবাসা ও আন্তরিক অভিনন্দন জানাই...জয় জগন্নাথ 🙏

Post a Comment

0 Comments