'বালগোপাল ও রস খানের গল্প'
সৈয়দ ইব্রাহিম খাঁ ছিলেন জন্মসূত্রে আফগান। ষোড়শ শতকের মুঘল শাসনকালে তাঁর জন্ম।
শোনা যায়, একবার কাবুলের একটি পানের দোকানে সৈয়দ ইব্রাহিম খাঁ প্রথমবার শ্রীকৃষ্ণের ছবি দেখেন— একটি তৈলচিত্র। ঘন জঙ্গলের মধ্যে বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিভঙ্গমুরারী। রস খাঁ বিমোহিত। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ছবির দিকে।
পরক্ষণেই তিনি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কে এই বালক? জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে খালি পায়ে?
ইব্রাহিমের মনে হয় এই বালককে এক জোড়া জুতো উপহার দেওয়া উচিত। পরদিন একজোড়া জুতো নিয়ে তিনি উপস্থিত সেই পান দোকানে। জিজ্ঞাসাবাদ করেন, ছবির বালকটিকে তিনি কোথায় পাবেন? দোকানি বেশ অবাক হয়। নেহাতই হতবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বলে ঠাওর করে তাকে। পান দোকানি রসিকতা করে বলে, এই বালক তো এখানে থাকে না, ব্রজভূমে গেলে হয়তো পেয়ে যাবেন।
ইব্রাহিম বেরিয়ে পড়েন ব্রজধামের উদ্দেশ্যে। শহর-গ্রাম-নদী-জঙ্গল পেরিয়ে দিন-রাত হাঁটতে থাকেন। ব্রজবালককে খুঁজে বার করবেনই। মাঝেমধ্যেই পথচারীদের ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, শ্যাম নামের কোনও বালককে তারা চেনে কি না! পরনে বাসন্তী রঙের ধুতি, মাথায় ময়ূরের পালক। সে খালি পায়ে, মাঠে-জঙ্গলে বাঁশি বাজিয়ে ফেরে। কেউ কি দেখেছে সেই বালককে? এই প্রশ্ন শুনে কেউ উত্তর না দিয়ে চলে যায়, কেউ বা তাকে ভুল রাস্তা বলে। সবাই ভাবে পাগল বুঝি। তবু আশা ছাড়েন না ইব্রাহিম। গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে, উদ্বৃত্ত-উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে দিন কাটে।
ভক্তের কষ্ট দেখে আর থাকতে পারেন না শ্রীকৃষ্ণ। রাখাল বালকের বেশে দেখা দেন আর বলেন, তুমি যাকে খুঁজছ, তাকে পাবে বৃন্দাবনে।
ভারি খুশি হয়ে, জুতোখানি হাতে বৃন্দাবনের বাঁকে বিহারী মন্দিরে পৌঁছে যান ইব্রাহিম। কিন্তু মন্দিরের পূজারীরা একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বীকে কিছুতেই ঢুকতে দেন না মন্দিরে। অগত্যা মন্দিরের বাইরেই বসে থাকেন তিনি। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, শুধু সেই বালকের অপেক্ষা। একদিন সকালে ঘুম ভেঙে শুনতে পান ঘুঙুরের শব্দ, সঙ্গে এক ছোট ছেলের হাসির আওয়াজ। কিন্তু আশেপাশে তো তেমন কেউ নেই। অবশেষে পিছনে তাকিয়ে দেখেন, হাসিমুখে দাঁড়িয়ে বংশীবিহারী।
ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন ইব্রাহিম। তাঁর সারা শরীর জুড়িয়ে যায়। তার পরেই মনে পড়ে সেই ছবিতে দেখা পদ্মের মতো পা দুখানির কথা। তাকিয়ে দেখেন বালকের পা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ইব্রাহিমের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়, অপরিসীম কষ্টে ভরে যায় তার মন। দেখেন নরম পা দুখানিতে কাঁটা বিঁধে রক্ত ঝরছে। পরম যত্নে সেই কাঁটা তুলে, পরনের কাপড় দিয়ে রক্ত মুছে দেন ইব্রাহিম। তার পর পরিয়ে দেন সেই জুতোজোড়া।
বংশীধারীকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন তার পায়ে জুতো নেই। বালকরূপী শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ‘তুমি যে আমাকে আদুর পায়ে কল্পনা করেছিলে, তাই আমি সেভাবেই ছুটে এসেছি গোকুল থেকে। তুমি আমাকে যে রূপে দেখবে, আমি সেই রূপেই দেখা দেব।‘ একথা শুনে ইব্রাহিমের সমগ্র সত্তা ভরে যায় এক অনির্বচনীয় আনন্দে।
ইব্রাহিম বলেন, ‘হে প্রভু, তুমিই সেই পরমেশ্বর যার মধ্যে বিলীন হয়ে আছে এই পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম। তুমিই আমার ইষ্টদেবতা।‘
ইব্রাহিম খানের শ্রীকৃষ্ণ প্রেম সঞ্চারিত হয়েছিল তাঁর কাব্যে। এই ভক্তিরস থেকেই সৃষ্টি করেন অসামান্য সব কবিতা। তাই পরবর্তীকালে রস খাঁ নামেই তিনি পরিচিত হন জনমানসে।
হরে কৃষ্ণ
0 Comments