"বিদুর পত্নী ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ"...

  'দরিদ্র বিদুরের প্রীতির বশে একদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দ্বারে উপস্থিত হলেন। ভগবান এসে আমার দ্বারে দাড়িয়েছেন দেখে বিদুর পত্নী আনন্দে আত্মহারা হয়ে দেখলেন। বহু আকাঙ্খিত মহালয় এসেছে, দরিদ্রের পর্ণ কুটীরে ভগবানের রাতুল পদচিহ্ন। কিন্তু মহামান্য অতিথির সম্মাণ করবো কোনো উপকরণ দিয়ে.? আমার গৃহে তেমন কিছুই নেই।

  'প্রার্থনা করলেন, হে দীনদয়ার্ভ্রনাধ.! হে রাজ রাজেশ্বর.! ক্ষমা করো প্রভু, তোমার পূজার আয়োজন আমার কাছে নেই। তুমি দয়া করে আমার কুটিরে এসেছো, তোমার নয়নের প্রসাদ এই পর্ণ কুটির ধন্য। কিন্তু তোমার সম্বর্ধনার যোগ্য উপহার এই দরিদ্রের কুটিরে কিছুই নেই। আছে শুধু হৃদয়ভরা প্রীতি আর নয়নভরা অশ্রু। বিদুর পত্নীর আঁখিদুটি এই ব্যাথার ক্রন্দনে ভরে গেলো।

  'হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কুটিরে কয়েটা কলা আছে। ছুঁটে গিয়ে কলা গুলি নিয়ে এলেন। আর প্রেমাশ্রুপুরিত নয়নে বললেন, হে প্রভু, হে করুণাময়, আজ তোমার এই আগমন রূপ মহাসম্পদের আশায় আমি কতোদিন কতোরাত অপেক্ষা করেছিলাম। তোমর অরবিন্দু নয়নের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিপাত্ররূপ মহাধনে ধনী করলে এই কাঙ্গালকে। হে কমল নয়ন, অরশনে, অর্ধাশনে যে ভাবে তোমার ইচ্ছা তুমি সেই ভাবেই রেখো, কিন্তু তোমার এই শ্রীচরণে স্মরণরূপ মধুপান থেকে যেনো মূহূর্তের জন্যও বঞ্চিত কর না।

  'এসব বলতে বলতে একটা করে কলার খোসা ছাড়ায় আর দেওয়ার পাত্র অভাবে গোবিন্দের শ্রীহস্তে দিতে লাগলেন। বিদুর পত্নী প্রেমাবেশে তখন জ্ঞানশূন্য। নয়ন দিয়ে নয়, তিনি প্রেমপূত মন দিয়ে শ্রীকৃৃষ্ণ দর্শন করেছেন, সেই প্রেমাবেশে মনের ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছেন। তাই কলার খোসা ছাড়িয়ে কলাটা ফেলে দিয়ে খোসাটা গোবিন্দের হাতে দিতে লাগলেন। আর ভাবগ্রাহী জনার্দন তখন হাসিমূখে ভক্তের কৃষ্ণ প্রীতিরস আম্বদন করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে কলার বাকলটাই খেয়ে নিলেন। প্রীতিরস মিশ্রিত বাকলই ভগবানের কাছে অমৃত।

  'মহাতৃপ্তির সঙ্গে খেতে লাগলেন মহালোভীর মতো। রসিক শেখর গোবিন্দ সর্বদা প্রেমের লোভী, প্রেমের কাঙ্গাল। ভক্তের প্রেমে বশীভূত হয়ে যে কি সুখ, কি যে মাধুর্য্য তা আম্বাদনের জন্য তিনি সর্বদা লোলুপ।

এমন সময় বিদুর হয়ে দেখলেন, সেই পরমকাঙ্খিত মহার্ঘধন আজ কৃপা করে আমার ঘরে এসেছেন। কিন্তু আমার পত্নী এ কি করছে.? কলার খোসা খেতে দিচ্ছে গোবিন্দকে.? বিদুর পত্নীকে ভর্তসনা করতে লাগলেন। বাহ্যজ্ঞান ফিরে পেয়ে চমকে উঠলেন বিদুর পত্নী। চৌদ্দভুবনেশ্বর, যার চরণ স্মরণ মাত্র আনন্দিত হয় তাঁকে আমি কি দিচ্ছি.? যার বদনে মা যশোদা ক্ষীর, ননী, অমৃত দ্রব্য দিয়েও তৃপ্তি পান না তাঁকে কি না আমি কলার খোসা খাওলাম। এই ভেবো দুঃখে, কষ্টে, লজ্জায় বিদুর পত্নী ক্রন্দন করতে করতে বারংবার ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন।

  'শ্রীকৃষ্ণ বললেন, বিদুর তুমি ভর্তসনা করছো কেনো.? তুমি জানো বিদুর.! আমি কি অমৃতরস আস্বাদন কছিলাম.? আমার ভক্তের হাতের দেওয়া বস্তুর যে কুদি অপূর্ব স্বাদ তা আমি রাজভোগেও পাই না বিদুর.! বিদুর ভক্তের এই অনুরাগটি পাওয়ার জন্য আমি কাঙ্গালের মতো ত্রিভবন ঘুরে বেড়াই। যদি একবার কেউ, হা কৃষ্ণ, হা গোবিন্দ, বলে ডাকে আমি তখনই তাঁর হয়ে যাই। কিন্তু হায়.! এ জগতের মানুষ কি করছে, দু'দিনের অনিত্য, ক্ষণভঙ্গুর মায়ার সংসারে পুতুর খেলায় ব্যস্ত। সংসারের জন্য যে ভালোবাসে, তাঁর জন্য ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলে কিন্তু যে নিত্য, চিরস্থায়ী, যার সাথে জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক, যে আমাদের হতে চায় সেই গোবিন্দের জন্য একফোঁটাও চোখের জল আসে না, কি অদ্ভূত জীব আমরা.? 

আর সেই জন্যই

'পুনরপি জননম্ পুনরপি মরণম্

পুনরপি জননী  জঠরে শয়নম্।

ইহ সংসারে বহু দুস্তারে

কৃপায়াহ পারে পাহী মুরারে।।

'এই দোলায় দুলছি। আর কিছু আছে যারা মনের দুয়ারে শুস্ক রসহীন জ্ঞান অনুশীলন করে তাঁরা তত্ত্বযন্ত্র অদ্বয়তত্তকে না জেনেও অনেক কিছু জেনে যাচ্ছেন। জ্ঞান কাও পার হয়ে রাজ্যে প্রবেশ করতে তাঁরা অক্ষম। আর যতক্ষণ না ভক্তি রাজ্যে প্রবেশ করতে পারছে, ততক্ষণ ষড়ৈশ্বর্যশালী অবিচিন্ত্য সর্বশক্তিমান রসস্বরূপ ভগবানকেও জানতেও পারবে না।

ভক্তিরেব এনং নয়তি ভক্তিরেব এনং

দর্শয়তি ভক্তিবশঃ পুরুষঃ ভক্তিরেব গরীয়সী। 


শ্রী গোকুলেন্দ্র  কৃষ্ণ দাস

ইস্কন নাগপুর মহারাষ্ট্র ভারত

Post a Comment

0 Comments