🇳🇪 শ্রীমৎ গৌরগোবিন্দ স্বামী মহারাজের অপ্রাকৃত জীবন শৈলী 

শ্রী শ্রীমৎ গৌরগোবিন্দ স্বামী মহারাজ ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দের ২রা সেপ্টেম্বর ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশের জগন্নাথ পুরী ধামের অনতিদূরে অবস্থিত জগন্নাথপুর গ্রামে আবির্ভূত হন। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল শ্রীব্রজবন্ধু মানিক। শ্রীব্রজবন্ধু গদাই গিরি গ্রামে শৈশব থেকেই কৃষ্ণের প্রতি ভক্তিমূলক সেবার মধ্য দিয়ে বড় হতে থাকেন। তাঁর মাতামহ ছিলেন একজন পরমহংস বৈষ্ণব, যাঁর একমাত্র কাজ ছিল স্থানীয় গোপাল জীউ বিগ্রহের সম্মুখে 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র' কীর্তন করে ক্রন্দন করা। তিনি ব্রজবন্ধুকে শিক্ষা দেন কিভাবে হাতের আঙ্গুলের দাগ গণনা করে করে 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র' জপ অনুশীলন করতে হয়।


শৈশব কালে ব্রজবন্ধু তাঁর মামাদের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র' ও শ্রীনরোত্তম দাস ঠাকুর রচিত ভজন কীর্তনাদি গান গেয়ে ভ্রমণ করতেন। যে পরিবারে শ্রীল গৌর গোবিন্দ স্বামী মহারাজ আর্বিভূত হয়েছিলেন সেই গিরি পরিবার শ্রীল শ্যামানন্দ প্রভুর সময় থেকে উড়িষ্যায় বিখ্যাত কীর্তনীয়া রূপে পরিচিত ছিল। তিনশ' বছর পূর্বে উড়িষ্যার রাজা গদাইগিরির এই কীর্তন দলকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন- "যখনই সম্ভব হবে তাঁরা যেন শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে কীর্তন পরিবেশন করেন- যা জগন্নাথ মন্দিরের প্রাচীন নথিতে উল্লেখ আছে। উড়িষ্যায় তাঁরাই ছিলেন কীর্তনের গুরু।"


ছয় বছর বয়স থেকেই ব্রজবন্ধু গোপাল বিগ্রহের সেবা করতেন। নিজের হাতে মালা গাঁথতেন, প্রদীপ জ্বালিয়ে তালপত্রে লিখিত মন্ত্র পাঠ করে তাঁকে উপসনা করতেন। তিনি কখনো গোপালকে নিবেদন না করে কোন কিছুই গ্রহণ করতেন


না।


আট বছর বয়সে তিনি সমগ্র ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত এবং শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তার অর্থও ব্যাখ্যা করতে পারতেন। রাত্রে

অনেক গ্রামবাসীরা তাঁর উড়িয়া ভাগবত, রামায়ণ এবং মহাভারত আবৃত্তি পাঠ শুনতে আসতেন। এইভাবে জীবনের শুরু থেকেই তিনি 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র' জপ, বৈষ্ণবশাস্ত্র অধ্যয়ন এবং তাঁর ইষ্টদেব গোপালের সেবায় নিমগ্ন ছিলেন। প্রভাত যে ভাবে দিনের সূচনা প্রদান করে, ঠিক তেমনি ভগবানের প্রতি এই স্বাভাবিক আসক্তি তাঁর ভবিষ্যৎ ভক্তি জীবনের সূচনা প্রদান করেছিল।


১৯৫৫ খ্রীষ্টাব্দে পিতার দেহান্তর প্রাপ্তির পর ব্রজবন্ধুর ওপর পরিবার প্রতিপালনের দায়িত্ব পড়ল। তাঁর মায়ের নির্দেশে যখন তিনি গৃহস্থ জীবনে প্রবেশ করেছিলেন তখন দায়িত্বের বোঝা আরও বেড়ে গিয়েছিল। বিবাহ অনুষ্ঠানের সময়ই শ্রীব্রজবন্ধুর তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী বাসন্তীদেবীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। অর্থাভাবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পড়াশুনা করতে পারেননি। তা সত্ত্বেও রাত্রে অধ্যয়ন করে প্রাইভেট পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন। মাত্র দুই মাসের প্রস্তুতিতে তিনি উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে স্নাতকত্ব ডিগ্রী (বি.এ. ডিগ্রী) লাভ করেন, এবং পরে বি.এড. ডিগ্রী কোর্সও সম্পূর্ণ করেন। অনেক দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও গোপালের প্রতি ভক্তিমূলক সেবা তিনি কোনভাবেই অবহেলা করেননি। প্রতিদিন তিনি ভোর ৩.৩০ মিনিটে উঠে 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করতেন, তুলসীপূজা করতেন এবং তাঁর পরিবারকে ভগবদ্গীতা পাঠ করে


শোনাতেন।


তাঁর গৃহস্থ জীবনে তিনি স্কুল শিক্ষক হিসাবে কার্য করতেন। যখনই তিনি সুযোগ পেতেন তখনই তাঁর ছাত্রদের নিকট কৃষ্ণ সম্বন্ধে এবং ভক্তিজীবনের নীতি নিয়ম সম্বন্ধে বলতেন। ত্রিশ বছর পর তাঁর কয়েকজন ছাত্র তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।


১৯৭৪ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই এপ্রিল তাঁর কৃষ্ণের প্রতি গভীর অনুরাগই তাঁকে সাংসারিক জীবন ত্যাগ করতে আমন্ত্রণ জানাল। ৪৫ বছর বয়সে তিনি তাঁর গৃহ এবং আত্মীয়- স্বজনদের ত্যাগ করে পারমার্থিক সিদ্ধির অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। হাতে কেবল ভগবদ্‌গীতা এবং ভিক্ষাপাত্র ধরে এক বছর যাবৎ তিনি সারা ভারত পরিভ্রমণ করে গঙ্গাদি পবিত্র বহুতীর্থ দর্শন করেন। তিনি এই রকম একজন ব্যক্তিকে খুঁজছিলেন যিনি তাঁকে 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রে'র উপলব্ধি লাভে সাহায্য করতে পারেন। হিমালয়ে বহু যোগী মায়াবাদী সন্ন্যাসীদের সাথে মিলিত হয়ে বহু দার্শনিক তর্কবিতর্কের পর সেখান থেকে পায়ে হেঁটে তিনি রাধাকৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবনে এসে চিন্তা করতে লাগলেন যে শ্রীকৃষ্ণের এই প্রিয়তম ধামে নিশ্চয়ই তাঁর ইচ্ছা পূরণ হবে।


বৃন্দাবনে আসার দুই সপ্তাহ পরে একদিন তিনি দেখলেন এক বিশাল সাইনবোর্ডে যেখানে লেখা আছে "International Society for Krishna Consciousness, Founder-Acharya - His Divine Grace A.C. Bhaktivedanta Swami Prabhupada." তারপর তিনি কয়েকজন বিদেশী ভক্তের সাথে মিলিত হয়েছিলেন, যাঁরা তাঁকে একটি ' Back to Godhead' পত্রিকার কপি দিয়েছিলেন। যখন তিনি পত্রিকাটির যেখানে ভগবান কৃষ্ণের প্রতি অপ্রাকৃত ভালবাসা ও তাঁর মহিমার কথা বর্ণিত হয়েছে পড়লেন, তখন এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল প্রভুপাদের সাথে মিলিত হবার জন্য তাঁর হৃদয় উৎকণ্ঠিত হল। শেষে যাঁর জন্য ব্রজবন্ধু দীর্ঘদিন ধরে প্রতীক্ষা করছিলেন তাঁর সেই নিত্য পারমার্থিক গুরুদেবের সাথে মিলিত হলেন।


যখন ব্রজবন্ধু শ্রীল প্রভুপাদের কক্ষে প্রবেশ করে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন তখন শ্রীল প্রভুপাদের প্রথম প্রশ্নই ছিল "তুমি কি সন্ন্যাস গ্রহণ করেছ?" ব্রজবন্ধু উত্তর দিলেন যে তিনি এখনও সন্ন্যাস নেননি। শ্রীল প্রভুপাদ বললেন, "তাহলে আমি তোমাকে সন্ন্যাস দেব"। তাঁর হৃদয়ের কথা শ্রীল প্রভুপাদ জানতেন বুঝতে পেরে ব্রজবন্ধু তাঁর নিত্য পারমার্থিক গুরুদেবের পাদপদ্মে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করলেন।


১৯৭৫ খ্রীষ্টাব্দে বৃন্দাবনে ইস্কনের শ্রীশ্রীকৃষ্ণ-বলরাম মন্দিরের শুভ উদ্বোধন দিবসে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে সন্ন্যাস প্রদান করে নতুন নামকরণ করলেন গৌরগোবিন্দ স্বামী। তারপর শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে উড়িষ্যার প্রচারের জন্য পাঠালেন এবং ভুবনেশ্বরে অনুদান পাওয়া জমিতে একটি মন্দির নির্মাণ করতে বললেন।


সেই সময় জায়গাটিতে ভীষণ জঙ্গল ছিল এবং মশা, সাপ ও বিছায় ভরপুর ছিল। জায়গাটি শহর থেকে দূরে থাকায় দিনের বেলায়ও ডাকাতের ভয়ে কোন লোকজন সেখানে যেত না। কিন্তু শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী শ্রীল প্রভুপাদের ইচ্ছাকেই তাঁর জীবনসর্বস্ব বলে গ্রহণ করেছিলেন এবং তা পূরণ করার জন্য নির্ভীকভাবে দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়ে সবকিছু করতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। কখনো কখনো এক চা ব্যবসায়ীর গুদাম ঘরে থাকতেন, আবার কখনো কখনো রাস্তা নির্মাণ শ্রমিকদের সাথে কোন রকমে একটি ছোট ঘরে থেকে তিনি শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থগুলি উড়িয়ায় অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন।


কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী সারা ভুবনেশ্বরে বাড়িতে বাড়িতে, অফিসে অফিসে, কখনও পায়ে হেঁটে এবং কখনও স্থানীয় ছাত্র শচীনন্দন দাস, পরবর্তীতে যিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য হন, প্রায়ই তারই সাইকেলের পিছনে চেপে ঘুরতেন। এইভাবে তিনি কিছু অনুদান সংগ্রহ করে সেই প্রদত্ত জমিতে নিজের হাতে একটি কুঁড়েঘর নির্মাণ করেন।


১৯৭৭ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিকে শ্রীল প্রভুপাদ ভুবনেশ্বরে এসেছিলেন। যদিও শ্রীল প্রভুপাদের থাকার জন্য সুন্দর আরামদায়ক সরকারী অতিথিশালার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রীল প্রভুপাদ তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বলেছিলেন "আমার শিষ্য গৌরগোবিন্দ যেখানে আমার জন্য কুঁড়ে ঘর নির্মাণ করেছে আমি সেখানে থাকব।” শ্রীল প্রভুপাদ ভুবনেশ্বরে ১৭ দিন ছিলেন এবং সেই সময় তিনি নিত্যানন্দ প্রভুর শুভ আবির্ভাব তিথিতে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এটাই ছিল শ্রীল প্রভুপাদের প্রতিষ্ঠিত শেষ প্রকল্প। শ্রীল প্রভুপাদের অপ্রকটের অব্যবহিত পরেই ১৯৭৮ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী মায়াপুরে যান। একদিন মন্দিরে কীর্তন চলাকালীন তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে ভূমিতে পড়ে যান। ইক্ষনের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ভক্ত তাঁকে ধরাধরি করে তাঁর কক্ষে নিয়ে আসেন। যখন ডাক্তার এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছিলেন তখন তাঁরা অসুস্থতার কোন কারণ খুঁজে পাননি। একজন ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন হয়ত ভূতে ধরেছে। শেষ পর্যন্ত শ্রীল প্রভুপাদের গুরুভ্রাতা একজন শুদ্ধ ভক্ত অকিঞ্চন দাস বাবাজী মহারাজ বর্ণনা করে বললেন যে শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামীর মধ্যে ভাবের লক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে যা ভগবানের প্রতি ভালোবাসার এক অতি উন্নত অবস্থা। বহু দিন ধরে তিনি এভাবে বাহ্য চেতনার ঊর্ধ্বে ছিলেন।


যখন শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী ভুবনেশ্বরে ফিরে এসেছিলেন তখন তিনি আরও গভীরভাবে তাঁর গুরুদেবের উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত হন। কয়েকজন বিদেশী ভক্তকে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে সাহায্য করার জন্য কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই এত কৃষ্ণসাধন করতে সক্ষম ছিল না। তারা তাঁর সর্বদা অনুদ্বিগ্ন তথা অবিরক্তিকর অনুভব করে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল। দিনে কেবল একবার মাত্র আহার করতেন এবং কখনো ঘুমাতেন না বললেই চলে। দিবা রাত্রি তিনি শুধু প্রচার, জপ ও নোটবুকে


লেখালেখি কাজে নিয়োজিত ছিলেন।


১৯৯১ খ্রীষ্টাব্দে, সঙ্কল্পবদ্ধ প্রচেষ্টার ১৬ বছর পর শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী এক সুবৃহৎ শ্রীশ্রীকৃষ্ণ-বলরাম মন্দির উদ্বোধনের মাধ্যমে তাঁর পারমার্থিক গুরুদেবের নির্দেশ পূর্ণ করেন। যে মন্দির এখন হাজার হাজার লোককে কৃষ্ণভাবনায় আকৃষ্ট করছে। শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী বলতেন, "ভুবনেশ্বরে আমি একটি ক্রন্দন বিদ্যালয় খুলেছি। যতক্ষণ আমরা আকুলভাবে কৃষ্ণের জন্য না কাঁদছি ততক্ষণ আমরা তাঁর কৃপা লাভ করতে পারি না।" এই বাণী তাঁর প্রকটকালীন শেষ দশ বছর তিনি সারা


বিশ্বে জোর দিয়ে প্রচার করেছিলেন।


যদিও শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী সর্বদাই বিনয়ী, মিতভাষী, কিন্তু ভাগবত পাঠের সময় তিনি যেন সিংহের মতো গর্জন করতেন এবং শিষ্যদের হৃদয় থেকে ভুল ধারণা ও মিথ্যা অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতেন। কখনো কখনো তিনি শ্রীল প্রভুপাদের তাৎপর্য থেকে মূল দার্শনিক যুক্তিগুলো পড়ে শোনাতেন, তারপর শিশুর মতো হেসে বলতেন এখানেই কৃষ্ণপ্রেমের বিষয় নিহিত রয়েছে। কিন্তু আরও ব্যাখ্যার প্রয়োজন। তারপর তিনি একই বাক্যের সারাংশ প্রায় দুই-তিন ঘন্টা ধরে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে শিষ্যদেরকে স্তম্ভিভূত করে দিতেন। কোন একটা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, "দেখ! কৃষ্ণ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, কেন না আমি চাইছি বিষয়টা সম্পূর্ণ করতে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা অসীম।"


তাঁর এই প্রবচনের সময় তিনি অবশ্যই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এবং অন্যান্য আচার্যদের উত্তম প্রার্থনাগুলি যাতে নিহিত আছে আনন্দ, বিনম্র এবং আত্মসমর্পণ ভাব, ভক্তিভাবে কীর্তন করে প্রত্যেককে অনুপ্রাণিত করতেন, যা তারেদ হৃদয় স্পর্শ করত। কৃষ্ণকথাই ছিল তাঁর জীবন সর্বস্ব। তিনি প্রায়ই বলতেন, "কৃষ্ণকথা বিহীন দিনটি এক দুর্দিন।"


শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামীর শাস্ত্রজ্ঞান ছিল অগাধ, তিনি সমস্ত কিছুই বৈদিক সাহিত্যের প্রমাণ সহ বর্ণনা করতে সক্ষম ছিলেন। কখনো কোন শিষ্যকে প্রশ্ন করতেন যদি সেই শিষ্য শাস্ত্র উদ্ধৃিতি সহ উত্তর দিতে না পারত তৎক্ষণাৎ তিনি বলতেন, "এটা প্রতারণা। এই রকম প্রতারক হয়ো না। একজন বৈষ্ণব সব সময় শাস্ত্র কর্তৃপক্ষ থেকে উদ্ধৃতি দেবেন।"


এইভাবে শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী সর্বদা নির্ভয়ে প্রচার করতেন। তিনি শাস্ত্র সিদ্ধান্তের সত্যতা সম্পর্কে কারোর সঙ্গে কোন আপস করেননি। তিনি বলতেন, "যে কৃষ্ণকে দর্শন করতে পারেনি সে অন্ধ, সে হয়তো কৃষ্ণ সম্বন্ধে বলতে পারে, কিন্তু সেগুলি তার মানসিক জল্পন-কল্পনা মাত্র। তাই তার কথার কোনও মূল্য নেই।


প্রকৃত সাধু কখনোই শাস্ত্র প্রমাণ ছাড়া কিছু বলেন না।" ১৯৯৬ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসের শেষের দিকে শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী


একান্ত ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের সময় উল্লেখ করেছিলেন যে, "শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত


সরস্বতী ঠাকুর বলতেন, এই জড় জগৎ কোন ভদ্র লোকের থাকবার জায়গা নয়।


যেহেতু তিনি এই কথা আলোচনা করতে করতে বিরাগ জাত হওয়ায় অসময়ে এই


জগৎ ত্যাগ করেছিলেন। আমিও তাই করতে পারি, কিন্তু আমি তা জানি না, কেননা


আমি কেবল গোপালের ওপর নির্ভরশীল, তিনি যা চান আমি তাই করব। পরের


দিন শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী গদাই গিরিতে গোপালকে দর্শন করতে যান। আর এই


কথা শীঘ্রই শিষ্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পরল, যাঁরা অনুভব করেছিলেন গোপাল যেন


তাঁদের গুরুদেবকে তাঁদের কাছ থেকে সরিয়ে না নেন। চারদিন ধরে তিনি হাজার


হাজার লোকের মধ্যে আরও শক্তিশালীভাবে প্রচার করেন, যাঁরা শ্রীল প্রভুপাদের


শতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে ভুবনেশ্বরে উপস্থিত হয়েছিলেন। তারপর তিনি ইস্কন্


কর্তৃপক্ষের বাৎসরিক সমাবেশ উপলক্ষে শ্রীধাম মায়াপুরে যান।


১৯৯৬ খ্রীষ্টাব্দে ৯ই ফেব্রুয়ারী শ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের শুভ আবির্ভাব দিবসে দু'জন বরিষ্ঠ ভক্ত শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামীর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য অনুরোধ করেন। পূর্বে তাঁর সঙ্গে তাঁদের কখনই সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু তাঁরা তাঁর কিছু গ্রন্থ অধ্যয়ন করার পর সেই সময় খুব আগ্রহী হয়েছিলেন তাঁর থেকে কিছু শ্রবণ করার জন্য। যেন দৈবের ব্যবস্থানুসারে তাঁরা সন্ধ্যা ৬ টায় তাঁর কক্ষে প্রবেশ করে বিনম্র সহকারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কেন জগন্নাথ পুরীতে অবস্থান করেছিলেন?" তখন তিনি মনোহর হাসি হেসে মহাপ্রভুর লীলার গোপনীয় রহস্য বর্ণনা করতে শুরু করলেন। আর ঐ প্রশ্নের উত্তরে তিনি অত্যন্ত আবেগের সাথে রাধাকৃষ্ণের বিরহ বেদনা অনুভব বর্ণনা করছিলেন, যখন কৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এই কথাসমূহ রেকর্ড করা হয়েছিল যা " The embankment of separation" (বিপ্রলম্ভ ভাবে শ্রীগৌরাঙ্গ) গ্রন্থে অষ্টম অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছে। কৃষ্ণের অমৃতময় বিষয় বর্ণনা করতে করতে ক্রমশ উল্লেখ করলেন দীর্ঘ বিরহের পর শেষে রাধাকৃষ্ণের মিলিত হওয়ার কথা। তিনি আরও বর্ণনা করেছিলেন "কৃষ্ণ কিভাবে রাধারাণীকে দেখে তাঁর মহাভাব প্রকাশরূপ বিষ্ফারিত নয়ন প্রকটিত করেন যা জগন্নাথ রূপে পরিচিত। তখন অশ্রুপূর্ণ নয়নে গদ্গ স্বরে তিনি বললেন- তারপর কৃষ্ণের নয়ন যুগল যখন রাধারাণীর নয়ন যুগলের ওপর পতিত হল অর্থাৎ নয়নে নয়নে মিলন হলো- রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের আবেগে অভিভূত হয়ে তিনি হাত জোড় করে বললেন আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি আর কিছু বলতে পারছি না। আর এই আবেগ তাড়িত কণ্ঠে তাঁর অন্তিম নির্দেশ প্রদান করলেন "নাম কর, নাম কর"।


সমস্ত ভক্তরা কীর্তন করতে লাগলেন, যেই তাঁদের গুরুদেব বিছানায় শয়ন করলেন, শ্বাস-প্রশ্বাস খুব ধীর এবং গভীর হয়ে আসল। নিকটস্থিত একজন সেবক গোপাল জীউয়ের একটি আলেখ্য তাঁর হাতে দিল। তখন শ্রীল গৌরগোবিন্দ স্বামী তাঁর আরাধ্য বিগ্রহের আলেখ্যের দিকে প্রণয়পূর্ণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিৎকার করলেন "গোপাল!" এবং চিন্ময় জগতে যাত্রা করলেন তাঁর ইষ্টদেবের সাথে মিলিত হবার জন্য।

Post a Comment

0 Comments