কোনো সন্ন্যাসী গুরু তাঁহার এক উদাসীন শিষ্যকে একখানা গীতা প্রদান করিয়া সর্বক্ষণ গীতা পাঠ করিবার উপদেশ দিয়াছিলেন। শিষ্যটি বিন্ধ্যগিরির একটি গহ্বরে অবস্থান করিয়া গীতা পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন। গহ্বরস্থ একটি মূষিক-শিশু প্রতিদিন আসিয়া ঐ গীতার পাতাগুলি কাটিতে আরম্ভ করিল। সাধকটি মূষিক-শিশুর অত্যাচারে অত্যন্ত উৎপীড়িত হইয়া উহার প্রতিকারের জন্য নিকটবর্তী গ্রাম হইতে একটি বিড়াল-শাবক লইয়া আসিলেন। বিড়াল-শিশুটিকে প্রতিপালন করিবার জন্য দুগ্ধ আবশ্যক হইল। কিন্তু কোথায় দুগ্ধ পাওয়া যাইবে, কে-ই বা প্রতিদিন দুগ্ধ প্রদান করিবে ইহা বিবেচনা করিয়া তাঁহার একটি গাভী সংগ্রহ করিবার বাসনা বলবতী হইল। ভগবদিচ্ছা-
ক্রমে এক সদাশয় ব্যক্তি সাধুকে একটি গাভী দান করিলেন। এখন গাভীটির রক্ষণাবেক্ষণের চিন্তা সন্ন্যাসীর হৃদয় অধিকার করিল। গাভীটি যাহাতে শীত-গ্রীষ্মে ও বর্ষাপাতে নিরাপদে থাকিতে পারে তজ্জন্য সন্ন্যাসী বহু পরিশ্রম করিয়া একটি গোশালা নির্মাণ করিলেন। অতঃপর গরুটিকে কে পালন করিবে, কেই-বা তাহাকে তৃণ-জল দিবে, নিজের সাধন-ভজনের ক্ষতি করিয়া গাভীটিকে প্রতিপালন করিতে গেলেও পরকাল নষ্ট হইবে-এইরূপ চিন্তা করিয়া উক্ত সন্ন্যাসী একটি গোরক্ষক নিযুক্ত করিলেন। গোরক্ষকটি গাভীটির যত্ন করিতে লাগিল। গোরক্ষকটিকেই বা কে খাওয়াইবে ও তাহার কাজ-কর্মই বা কে দেখাশুনা করিবে, এই চিন্তা করিয়া সন্ন্যাসী মহাশয় অবশেষে বিবাহ করিয়া ফেলিলেন। ক্রমে সংসার বৃদ্ধি হইল; অনেক জমি- জমা, লোক জন বৃদ্ধি পাইল, বিশাল অট্টালিকা উঠিল। সন্ন্যাসী তখন গীতার অনুশীলন পরিত্যাগ করিয়া ঘোর সংসারী হইয়া পড়িলেন।
বহুকাল অতিবাহিত হইবার পর তাঁহার গুরুদেব শিষ্যের সন্ধান করিতে করিতে সন্ন্যাসীর অট্টালিকার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সন্ন্যাসীর বিষয়-বৈভব, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন প্রভৃতি দর্শন করিয়া শিষ্যকে জিজ্ঞসা করিলেন-"এ সব কী?” শিষ্য তখন গুরুদেবের নিকট করজোড়ে আদ্যোপান্ত নিবেদন করিয়া বলিলেন-"প্রভো, ইহা আপনার সেই গীতার (?) সংসার।"হরিভজনকারী যুক্ত-বৈরাগ্যের ছলনা করিয়া অভাবের মাত্রা বৃদ্ধি করিবেন না। সাধক বদ্ধজীব ও সিদ্ধ মহাভাগবত-এক শ্রেণির নহে। সাধক জীব সন্ন্যাসী হউন, আর গৃহস্থই হউন, "যাবন্নির্ব্বাহ-প্রতিগ্রহ" অর্থাৎ হরিভজনের অনুকূল যতটুকু বিষয় স্বীকার করা প্রয়োজন, কেবল ততটুকুই করিবেন-কমও করিবেন না, বেশিও করিবেন না; কম ও বেশি-উভয়ের দ্বারাই পরমার্থ হইতে বিচ্যুতি ঘটে। যাঁহারা হরিভজনের উদ্দেশ্যে গৃহ ত্যাগ করিয়া মঠাদিতে বাস বা ব্রহ্মচর্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস-আশ্রম স্বীকার করিয়াছেন, তাঁহারা যদি হরিভজনের অনুকূল গ্রহণ করিবার ছলনায় নিজের মনকে ফাঁকি দিয়া বা কপটতা করিয়া আজ এক জিনিষের অভাব, কাল আর এক জিনিষের অভাব- এইরূপ ভাবে বিষয়ে বা দ্রবিণে মুগ্ধ হইয়া পড়েন, তবে তাঁহাদিগেরর 'গীতার সংসার' (?) হইয়া পড়িবে। অতএব সাধু সাবধান! হরিভজনের অনুকূল বস্তু সংগ্রহের ছলনায় যেন সাধক জীব মায়ার কবলে কবলিত না হন। বিষয় গ্রহণের জন্য ইন্দ্রিয়সমূহ সর্বদাই সতৃষ্ণ হইয়া রহিয়াছে। সিদ্ধ সাধু বা মুক্ত মহাপুরুষ মহাভাগবতের শত শত উপদেশ শ্রবণ করিবার ছলনা করিয়াও দুষ্ট-দুর্দান্ত বহির্মুখে মন বা রুচি কপট-কুটিনাটিকে আশ্রয় করিয়া হরি-ভজনের আনুকূল্য করিবার ছলে ভোগ্য বিষয় সংগ্রহ করে। শাস্ত্র-অধ্যয়ন বা বিদ্যাভাস করিবার ছলনায় আমরা জড়বিদ্যার মোহে মুগ্ধ হইয়া পড়ি। সংসারে থাকিয়া যুক্ত-বৈরাগ্য অবলম্বনপূর্বক হরিভজন করিবার ছলনায় দেহের আরাম-প্রিয়তা ও স্ত্রী পুত্রাদিতে অত্যন্ত আসক্ত হই। সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী, সদগৃহস্থ বা বনবাসী হইয়া হরিভজন করিবার ছলনায় লাভ-পূজা প্রতিষ্ঠা-প্রাপ্তির আশায় মুগ্ধ বা প্রভুত্ব-কামনায় অভিভূত হইয়া থাকি! এই বিপদে সর্বক্ষণ একমাত্র প্রকৃত সাধুসঙ্গে অবস্থান পূর্বক তাঁহাদিগের পূর্ণ বৃত্তি আনুগত্যে ও তাঁহাদিগের নিকট স্ব-স্ব অনর্থগুলি অকপটে নিবেদন করিয়া তৎ-প্রতীকারের জন্য সুতীক্ষ্ণ-দৃষ্টি, প্রচেষ্টা ও তাঁহাদের কৃপা যাজ্ঞা করা একান্ত কর্তব্য।---সূত্র : উপখ্যানে উপদেশ (শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদ)
0 Comments