আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম- শ্রীমৎ লোকনাথ স্বামী মহারাজ




আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম

- শ্রীমৎ লোকনাথ স্বামী মহারাজ


মহারাষ্ট্রের একটি ছোট্ট গ্রাম আরাবেদ। ভারতের আরও লক্ষ লক্ষ গ্রামের সঙ্গে এই গ্রামের পার্থক্য খুব একটা নেই। এই আরাবেদ গ্রামেই আমার জন্ম হয়েছিল। হাই স্কুলের শিক্ষা শেষ করবার পর, আমাদের পরিবার আমাকে মুম্বাইয়ের এক কলেজে কেমিস্ট্রি অর্থাৎ রসায়ন নিয়ে পড়বার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে মুম্বাইয়ে পাঠিয়ে দিল। কিন্তু সেখানে আমার কলেজের পড়াশুনা সম্পূর্ণ হল না। ১৯৭১ সালের, মার্চ মাসের শেষের দিকে এমন কিছু ঘটল, যা আমাদের পরিবারের, আমাকে নিয়ে সযত্নে লালিত পরিকল্পনার সফল রূপায়ণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। সেবারই প্রথম, কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ, তাঁর বিদেশী শিষ্যদের নিয়ে ভারত ভ্রমণে আসছেন। আমি মুম্বাইয়ে (তখন বোম্বে) পৌঁছবার ঠিক কিছুদিন আগেই তাঁরা সেখানে পৌঁছে গেছেন।‌ এখন তাঁরা ক্রস ময়দানে এক পারমার্থিক সভার আয়োজন করতে চলেছেন। সেই পারমার্থিক সভা বা প্যান্ডেল প্রোগ্রামের কথা ভক্তগণ চারিদিকে ব্যাপকভাবে প্রচার করছেন। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে, রাস্তার ধারে বড় বড় বিজ্ঞাপনের বোর্ডে সেই সভার কথা জানিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। সেইসব বিজ্ঞাপনে শ্রীল প্রভুপাদের ভক্তদের আমেরিকান, কানাডিয়ান, ইউরোপীয়ান, আফ্রিকান এবং জাপানীজ সাধুরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।




সে ছিল এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। ইতিপূর্বে, যখনই 'সাধু' শব্দটি কারোর প্রতি প্রয়োগ করা হতো, তখন বুঝতে হতো যে সেই ব্যক্তিটি ভারতীয়। এক্ষেত্রে অন্য কোন বিবেচনার বিষয় ছিল না। কিন্তু সেইসব বিজ্ঞাপনগুলি সারা পৃথিবী থেকে আগত সাধুদের কথা বলছিল। নিঃসন্দেহে প্রত্যেক বোম্বেবাসীর কাছে সেটি ছিল এক অভিনব ঘটনা, এবং তা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। আগ্রহান্বিত হয়ে, আমি সেই, যথেষ্ট ভালোভাবে আয়োজিত হরেকৃষ্ণ উৎসবে গিয়েছিলাম। হরেকৃষ্ণ সাধুগণই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। তাঁদের হাঁটা, চলা, কথা বলা, নৃত্য, কীর্তন সবকিছুই আমার কাছে প্রশংসনীয় বলে মনে হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কি, আমি তাঁদের সবকিছুই পছন্দ করছিলাম এবং বলতে গেলে আমি প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার সময়ে সেই পারমার্থিক উৎসবে উপস্থিত হচ্ছিলাম। আমি কেবলমাত্র দেখতাম আর শুনতাম। যদিও আমি ইংরেজি জানতাম, কিন্তু আমি খুব একটা স্বচ্ছন্দ ছিলাম না, আর বিদেশীদের সঙ্গে কথা বলা আমার পক্ষে বেশ কঠিনই ছিল। আমার কাছে স্বল্প যা কিছু অর্থ ছিল তা দিয়ে আমি কয়েকটি পুস্তিকা আর কয়েকটি পত্র পত্রিকা কিনেছিলাম। শ্রীল প্রভুপাদ প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রবচন দিতেন। কৃষ্ণভাবনামৃত সম্বন্ধীয় বহু বিষয়ে তিনি আলোচনা করতেন এবং অনেক যুক্তি প্রদর্শন করতেন। কিন্তু সে যুক্তিটি আমার মধ্যে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল, যার ফলে আমি তাঁর ও তাঁর সংঘের প্রতি অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে আকর্ষিত হয়েছিলাম, সেটি ছিল এক সহজ যুক্তি-- তুমি যদি পরমেশ্বর ভগবানের সেবা কর, তাহলে সাথে সাথে সমান্তরালভাবে তুমি প্রত্যেককে এবং অন্যান্য সমস্ত কিছুর সেবা করছ। গাছে জল দিলে তখন কি ঘটে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর সাদৃশ্য প্রদান করেছিলেন। কেবলমাত্র গাছের গোড়ায় জল দিলেই গাছের সমস্ত স্তরে, পাতায়, শাখায়, ফলে, ফুলে জল দেওয়া হয়ে যায়।

শ্রীল প্রভুপাদ আমার কাজকে সহজ করে দিলেন। "আমার এই তো সুযোগ", আমি ভাবলাম। আমি সবসময়েই অন্যোর সেবা করতে চাইতাম, আর তাই আমার জীবনের বিভিন্ন স্তরে আমি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার অথবা উকিল হওয়ার মনস্থ করতাম। যখনই আমি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতাম, আমি ভাবতাম কি করে অন্যের সেবা করা যায়। যদিও জীবনের এতগুলো বছর ধরে আমি প্রধানত সেবার কথাই চিন্তা করতাম, কিন্তু আমি জানতাম না, ঠিক কোথা থেকে শুরু করতে হবে। আমি কোন সম্পদের অধিকারী ছিলাম না যা দিয়ে সকলের সেবা করতে পারব। কিন্তু এখন শ্রীল প্রভুপাদ, সকল সৃষ্টির উৎস ভগবানের সেবার সহজ পন্থার মাধ্যমে সমগ্র সৃষ্টিকে সেবা করার উপায় প্রদর্শন করে আমার পথ পরিষ্কার করে দিয়েছেন। শ্রীল প্রভুপাদের এই কথাটি আমাকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল।

এরপর, নির্দিষ্ট সূচী অনুযায়ী এগারদিন ব্যাপী হরেকৃষ্ণ উৎসব শেষ হয়ে গেল। আমার সবকিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। আমি বোম্বের সেই কলেজে যেতে শুরু করলাম। আমি আমার গ্রামের কয়েকজন লোকের সঙ্গে একসাথে বোম্বেতে একটি ঘরে থাকতাম। সেইসব লোকেদেরকে আমার বাড়ীর লোকেরা বলে রেখেছিল আমার উপর নজর রাখতে। কেননা, বেশ কয়েকবৎসর আগে একবার আমি আমার পড়াশুনা ফেলে আমাদের গ্রামের নিকটবর্তী একটি শহরের আশ্রমে যোগদান করার জন্য চলে গিয়েছিলাম। আমি প্রায় আশ্রমে যোগদানও করেছিলাম, কিন্তু যে কোন উপায়েই হোক কৃপাময় ভগবানের অদৃশ্য হাত আমাকে ফিরিয়ে এনেছিল যাতে পরে আমি শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। ঐ ঘটনার পর থেকে আমার বাড়ির লোকেদের ভয় ছিল বা তারা অনুমান করতেন যে আমি যে কোন সময় আবার কোথাও চলে যেতে পারি। আর সেইজন্যই তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা গ্রামবাসীদেরকে আমার উপর নজর রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু তারা আমার উপর কতটা নজর রাখতো? প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিনই সন্ধ্যাবেলা আমি হরেকৃষ্ণ উৎসবে চলে যেতাম, কিন্তু কেউই তা লক্ষ্য করতো না। আমার বৃহদাকার কেমিস্ট্রি বইয়ের ভিতর হরেকৃষ্ণ পত্রিকা ও পুস্তিকা রেখে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তা পাঠ করে যেতাম। আমার সঙ্গে একই ঘরে থাকা আমার গ্রামবাসীরা মনে করতো আমি কত মনোযোগ দিয়ে কেমিস্ট্রি পড়ছি। তারা ঘুনাক্ষরেও টের পেত না যে আমি নিজেকে রাসায়নিক বিশ্লেষণের সমাধানের মধ্যে রাখার পরিবর্তে, জীবনের সমস্যাসমূহের চূড়ান্ত সমাধানের অনুসন্ধান করেছিলাম।

আমার ঘরের সঙ্গীরা যখন বেরিয়ে যেত, আমি দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি আটকে, দু'হাত তুলে হরেকৃষ্ণ কীর্তন আর নৃত্য করতাম, আমার পূর্ণ সন্তুষ্টি পর্যন্ত। আমি মঞ্চে ভক্তদের যেভাবে নৃত্য ও কীর্তন করতে দেখেছিলাম, আমি তার অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম। এইভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে, আমি কৃষ্ণভাবনামৃতের পন্থাসমূহ-- কীর্তন, নৃত্য এবং যে সামান্য সংখ্যক পত্রিকা আমার কাছে ছিল, তা বার বার পাঠ করার মাধ্যমে-- অনুসরণ করতাম। আমি জানতাম যে হরেকৃষ্ণ ভক্তগণ বোম্বের কোথাও বাস করে। কিন্তু উৎসবের পর সেই স্বল্প সংখ্যক ভক্তগণ বিরাট বোম্বে নগরীর মধ্যে কোথায় যে মিলিয়ে গেল, আমি তাঁদের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলাম।

এরপর, একবছর পার হয়ে গেছে। সেবার ১৯৭২ সনের মার্চ মাসে, বোম্বের জুহু বীচে আরেকটি উৎসবের আয়োজন করল ইসকন। ইতিমধ্যে ভক্তগণ জুহুতে কিছু জমি কিনেছিল এবং সেবারের উৎসবটি তাদের জায়গাতেই হয়েছিল। আবার সংবাদপত্র এবং অন্যান্য সংবাদ-মাধ্যমে বিজ্ঞাপন বের হলো এবং ভগবানের অহৈতুকী কৃপায় সেই উৎসবের সংবাদ আমার কাছে এসে পৌঁছাল। আমি এই সংবাদটির জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম। এবং সেটি পেয়ে আমি দারুণ খুশী হলাম। স্বাভাবিকভাবেই আমি প্রতিদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতাম। এবার আমি অনুষ্ঠান শুরু হরার অনেক আগেই যেতাম। সেখানে গিয়ে বই চেয়ে নিয়ে আমি তা পড়তাম। কীর্তনের সময় আমি আন্তরিকভাবে তাদের সঙ্গে কীর্তন করতাম। বিদেশী ভক্তগণ ভারতীয় ধূতি আর কূর্তা পরে কীর্তন করতেন আর এই ভারতীয় ছাত্রটি বিদেশ থেকে রপ্তানী করা প্যান্ট আর শার্ট পরে একসাথে কীর্তন করতো। ঘটনাচক্রে, একদিন প্রসাদের সময়, আমি যখন গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, সেই সময় ভক্তগণ আমাকেও তাঁদের সঙ্গে প্রসাদ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আমি তাঁদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখবার জন্য কৌতূহলী ছিলাম তাই আমি সেই সুযোগের সুবিধাটি গ্রহণ করে তাঁদের সঙ্গে প্রসাদে যোগদান করি। তাঁরা সকলেই ছিলেন সুন্দর ভক্ত। আর সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা সকলেই ছিলেন বিদেশী, যে বিষয়টি আমাকে অভিভূত করতো।

জুহুর উৎসব শেষ হয়ে যাবার বেশ কিছুদিন পর, একদিন আমি বসে বসে ইসকনের সদস্য হবার জন্য একটি আবেদনপত্র লিখলাম। ইতিমধ্যেই আমি ভক্তদের সঙ্গে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং আমার ধারণা ছিল, এরকম কোন সংঘে যোগদান করার জন্য আবেদনপত্র পূরণ করা প্রয়োজন। আমার আবেদনপত্রটি আমি বোম্বে, ইসকন অধ্যক্ষকে সম্বোধন করে লিখলাম। আমি লিখলাম যে আমি চারটি আবশ্যিক নিয়ম-- আমিষ আহার বর্জন, কোন নেশা না করা, অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ এবং জুয়া না খেলা-- অনুসরণ করতে রাজি আছি। আমি এও উল্লেখ করলাম যে আমি উজ্জ্বল আরতি, উদ্দাম কীর্তন এবং সুস্বাদু প্রসাদ গ্রহণ করতে পছন্দ করি। (এই কথাগুলি অবশ্য আমি ওঁদের প্রচার পুস্তিকা থেকে গ্রহণ করেছিলাম।) আবেদনপত্রটি লেখা হয়ে গেলে আমি সেই টাইপ করার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে টাইপ করালাম। ইসকন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, তাই আমি ভেবেছিলাম যে সব কিছু রীতিনীতি মেনে করাটাই ঠিক।

এরপর আমি জুহুরর হরেকৃষ্ণ আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম যে, আশ্রমের অধ্যক্ষ কে? তাঁর দর্শন পাওয়া মোটেই কঠিন হল না। তাঁর নাম গিরিরাজ দাস। তিনি আমার আবেদনপত্রটি সম্পূর্ণ পড়লেন এবং তৎক্ষণাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর আমাকে গ্রহণ করলেন। তখনই তিনি সকল আশ্রমিকদের ডেকে আমাকে একজন নতুন ভক্তরূপে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

আমি খুব তাড়াতাড়িই আমার নতুন জীবনযাত্রায় মানিয়ে গেলাম। এখন আমার এক নতুন বাড়ি, নতুন বেশ, নতুন সঙ্গী আর নতুন কার্যকলাপ-- সবকিছুই আমার কাছে নতুন। তৎসত্ত্বেও আমি খুব দ্রুত এসবে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম এবং পছন্দ করলাম। যদিও ভক্তগণ প্রায় সকলেই ছিলেন বিদেশী, কিন্তু আমার মনে হতো আমি পুরোপুরি নিজের বাড়িতেই আছি। আমি এই জীবনকেই আমার জীবনের ব্রতরূপে গড়ে তুলতে সঙ্কল্পবদ্ধ ছিলাম।

এভাবেই ভক্তগণের সঙ্গে একটি সপ্তাহ দ্রুত অতিবাহিত হয়ে গেল। একদিন আমার বড় দাদা আমার সেই বোম্বের বাড়ীর একসঙ্গে থাকা একজনকে নিয়ে মন্দিরে এসে উপস্থিত। আমার ফেলে আসা জিনিসপত্রের মধ্য ইসকনের জুহুর ঠিকানা সমন্বিত একটি হ্যান্ডবিল তাঁরা খুঁজে পেয়েছিলেন। সেটি পেয়েই তাঁদের সন্দেহ হয়, এবং এখানে চলে আসেন। এইভাবে তাঁরা আমাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। আমি যে ভক্তদের সঙ্গে যোগদান করেছি, এটা তাঁদের কাছে বড় একটা আশ্চর্যের বিষয় ছিল না, বরং এরকমটি যে ঘটতে পারে সেটা তাঁরা কিছুদিন ধরেই আঁচ করছিলেন আর এখন তাঁদের সেইসব ভয় দূর হয়ে গেছে।

আমার বড়দাদা চাইছিলেন যে আমি একবার যেন বাড়িতে ঘুরে আসি, বিশেষতঃ আমার মায়ের জন্য। আমি যদি না যাই, তাহলে মা হয়তো মারা যাবেন, বড়দাদা বললেন। কিন্তু তিনি আমাকে নিশ্চয়তা প্রদান করলেন যে আমার আবার এখানে ফিরে আসার ব্যাপারে বাড়ী থেকে কেউই বাধা দেবে না। আমি সর্বদা আমার বড়দাদাকে শ্রদ্ধা করতাম আর মন্দিরে এসে সেই দাদা প্রকৃতপক্ষে আমার কাছে যেন প্রার্থনাই করছিলেন, যাতে একটিবারের জন্য আমি বাড়ি ফিরে যাই, কেননা এটি আমার স্নেহশীলা মায়ের জীবন মরণের প্রশ্ন এবং আমি শীঘ্রই ফিরে আসতে পারব। শেষ পর্যন্ত, গিরিরাজ প্রভুর অনুমতি নিয়ে আমার নতুন বেশ ধূতি আর কূর্তা পরে আমি বড়দাদার সঙ্গে বাড়ির দিকে রওনা হই।

আমি আমার গ্রামে ফিরে আসার পর, আমাদের গ্রামের মানুষেরা বলাবলি করতে লাগলো যে যদিও আমি খুব ভালো ছেলে ছিলাম, কিন্তু এখন আমার মধ্যে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। আগের থেকে আমার পার্থক্যটি ছিল এই যে, এখন আমি ধুতি আর কুর্তা পরি, হরেকৃষ্ণ কীর্তন করি আর অভক্তদের সঙ্গ এড়িয়ে চলি। এগুলিকে গ্রামের মানুষেরা খুবই আশ্চর্যের এবং অস্বাভাবিক বলে মনে করছিল। আমার বাবা আমাকে আমার নতুন বেশ ধুতি ও কুর্তা না পরার জন্য এবং তিলক না কাটার জন্য অনুরোধ করলেন। অথচ তিনি স্বয়ং আমারই মতো বেশ, ধুতি আর কুর্তা পরিধান করেন এবং কখনও কখনও কপালে তিলক ধারণ করেন। কেননা তিনি ছিলেন ভগবান বিটঠলদেবের ভক্ত আর ভগবান বিটঠলদেব হচ্ছেন ভগবান বিষ্ণু বা কৃষ্ণেরই এক রূপ। হরেকৃষ্ণ ভক্তরা যেভাবে কপালে তিলক ধারণ করেন, ভগবান বিটঠলদেবের ভক্তরাও তেমনিভাবে তিলক ধারণ করেন। বিশেষ বিশেষ উৎসবের সময় আমার বাবা কপালে তিলক ধারণ করতেন, কিন্তু তিনি চাইছিলেন না যে আমি তাঁকে অনুকরণ করি, কেননা তিনি লোকে কি বলবে সে বিষয়েই বেশী চিন্তিত ছিলেন। (এই যদি ভারতীয় অভিভাবক বা পিতা-মাতার প্রতিক্রিয়া হয়, তাহলে বিদেশী ভক্তদের পিতা-মাতাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হতো, তা আমি সহজেই অনুমান করতে পারি।) এইভাবে আমার পিতা-মাতা তাঁদের সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে আবার হরেকৃষ্ণ ভক্তদের কাছে ফিরে যাওয়া থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করছিলেন। এমনকি তাঁরা আমাকে নিয়ে একজন জ্যোতিষীর কাছেও গিয়েছিলেন এটা জানার জন্য যে, কোন্ উপায়ে আমার "আরোগ্য" সম্ভব এবং আর কতদিন আমি এইরকম "অদ্ভুত ধরনের জীবন" যাপন করব। তাঁরা বাস্তবিকভাবেই খুব চিন্তিত ছিলেন।

এক সপ্তাহেরও বেশী দিন অতিবাহিত হয়ে গেল, কিন্তু ইসকন ভক্তদের কাছে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে বড়দাদার সঙ্গে আমার যে মূল চুক্তি হয়েছিল (মৌখিক), সে ব্যাপারে দেখলাম আমাদের পরিবারের কারোরই কোন হেলদোল নেই। আমার পিতা-মাতা কেবলই বলে যেতে লাগলেন যে কিছু আত্মীয় স্বজন ও অন্য কারো কারো এখনও আমাকে দেখতে আসা বাকী, তাই তাঁরা না আসা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে আমার চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমার বাবা-মা আমাদের কয়েকজন আত্মীয়দের তালিকা করেছিলেন, যারা আমার সঙ্গে কথা বলে যে করেই হোক আমাকে সাধু জীবন থেকে বের করে আনবে। আমার বাবা-মা আমাকে সর্বতোভাবে আটকাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হরেকৃষ্ণ ভক্তদের কাছে ফিরে যাবার ব্যাপারে আমার মন অচঞ্চল ছিল।

একদিন আমি দেখলাম আমার বোন কাঁদছে। যাকে বলে অঝোরে কান্না। সবাই যখন তাকে জিজ্ঞাসা করল, তার কি হয়েছে, সে কাঁদছে কেন? সে উত্তরে বললো "দেখ, আমাদের বাড়ীর অন্যান্য ছেলেরা কি সুন্দর এক সঙ্গে বসে তাস খেলছে, কিন্তু আমার ভাই রঘুনাথ (আমার বাড়ীর নাম) ওদের সঙ্গে গিয়ে বসছে না।" এই ছিল তার কান্নার কারণ। সে খুব দুঃখ অনুভব করেছিল এই দেখে যে আমি অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে বসে তাস খেলার পরিবর্তে ঘরে বসে আমার জপমালায় ভগবানের পবিত্র নাম জপ করতে ব্যস্ত রয়েছি।

আমাদের পরিবার যখন বুঝতে পারল যে, যে জীবনকে আমি আঁকড়ে ধরেছি, তাকে আমি কখনই ত্যাগ করব না, তখন তাঁরা প্রস্তাব দিলেন যে, "ঠিক আছে, তুমি তোমার সাধু জীবন চালিয়ে যেতে পার, কিন্তু সেটি তোমাকে এই গ্রামে বসে করতে হবে।" তাঁরা বললেন যে তাঁরা সেখানে একটি ছোট মন্দির বানিয়ে দেবেন, আর আমি সেখান থেকে আমার ভক্তি-জীবনের অনুশীলন করতে পারব। আমি তাঁদের সে পরিকল্পনাটিও প্রত্যাখ্যান করলাম, কেননা আমি ভক্তসঙ্গ করতে চাইছিলাম। যথার্থ সঙ্গ ছাড়া পারমার্থিক জীবন চালিয়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। ভক্তসঙ্গ ব্যতীত কে সর্বতোভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলন করতে পারে? ভারত ইতিমধ্যেই অনেক ভন্ড সাধুদের দ্বারা ভারাক্রান্ত। আমি আরেকটি ভন্ড সাধুতে পরিণত হতে চাই না। আমি হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের কৃষ্ণসেবায় নিজেকে যুক্ত করতে চাই। শ্রীল প্রভুপাদ ইতিমধ্যেই আমার পথ পরিষ্কার করে রেখেছেন। তিনি আমাকে আমার জীবনের উদ্দেশ্য প্রদান করেছেন। তাঁর আশ্রয়ে আমি সর্বতোভাবে সন্তুষ্ট। আমি আমার আত্মাকে শ্রীল প্রভুপাদ ও ভগবান কৃষ্ণের কাছে বিক্রি করেছি। তাই অবশেষে, আমার পরিবার অবশ্যম্ভাবী বাস্তবকে মেনে নিতে বাধ্য হলেন। প্রায় একমাস পরে আমি বোম্বের হরেকৃষ্ণ আশ্রমের দিকে আবার ফিরে চললাম।

যেহেতু আমি বেশ দীর্ঘদিন আমার গ্রামে অবস্থান করেছিলাম, তাই আমি ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না, গিরিরাজ প্রভু ও আশ্রমের অন্যান্য ভক্তগণ, আমি ফিরে গেলে আমার প্রতি কিরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন। কিন্তু আমি আশ্চর্যভাবে দেখলাম যে আমি ফিরে গেলে তাঁরা আমাকে দারুণভাবে অভ্যর্থনা করলেন, ঠিক আগের মতোই। বরং আমাকে আবার ফিরে আসতে দেখে তাঁরাই আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। কেননা তাঁদের অভিজ্ঞতা হলো এই যে, অধিকাংশ ভারতীয় ভক্তরা কেবল আসে আর যায়। তারা প্রতিজ্ঞা করে যায় বা কথা দিয়ে যায় যে, তারা খুব শীগগির ফিরে আসবে। কিন্তু আর আসে না। কদাচিৎ একজন, দু'জন হয়তো ফিরে আসে। তাই ভক্তগণ আমাকে ফিরে আসতে দেখে অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু আমার গুরুদেব কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ও পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণের অহৈতুকী কৃপায় পুনরায় ভক্তগণের মাঝে ফিরে আসা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।

যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে আমার ইসকনে যোগদান আমার বাড়ীর লোকদের জীবনকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছিল এবং আমাদের ছোট্ট গ্রামের সংহতি নষ্ট করেছিল। কিন্তু এই নঞর্থক ফল, ক্ষণস্থায়ী ছিল। যে বৎসর আমি ইসকনে যোগদান করি, সেই বৎসর থেকে আমি এবং আরও অনেক ইসকন ভক্ত অনেকবারই আমাদের গ্রাম আরাবেদে ভ্রমণ করে কৃষ্ণভাবনামৃতের দর্শন ও শিক্ষা প্রচার করেছি। তার ফলস্বরূপ এখন শুধু আমার পরিবারই নয়, আমার গ্রামের সকলেই ইসকনকে এক খাঁটি পারমার্থিক আন্দোলনরূপে গ্রহণ করেছে।

পরবর্তী সময়ে আমাদের গ্রামের আরও অনেকেই পূর্ণ সময়ের ভক্তরূপে ইসকনে যোগদান করেছেন এবং আমার এক আত্মীয়ও শ্রীল প্রভুপাদের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। আমার বোন তার ছেলেকে বৃন্দাবনের গুরুকুলে পড়িয়েছে এবং এখন সেই ছেলে স্নাতক হয়ে আমেরিকার এক ইসকন মন্দিরে সেবা করছে। আমার বাবা যদিও এখন প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু বেঁচে থাকতে আমি যতবার তাঁকে দেখতে গিয়েছি, তিনি তিলকের কথা জিজ্ঞাসা করতেন এবং গর্বের সঙ্গে তাঁর কপালে তিলক ধারণ করতেন। আমার পরিবারের সকলেই এবং গ্রামের অনেক পরিবারই, এমনকি আমার গ্রামের বন্ধুরাও এখন নিয়মিতভাবে জপমালায় হরেকৃষ্ণ জপ করেনএবং ইসকনের চারটি আবশ্যিক নিয়ম পালন করে। এখন আর এই কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলন শুধু আমাদের গ্রামেই সীমাবদ্ধ নেই, তা পার্শ্ববর্তী চারদিকের গ্রামগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। বেশ কয়েক বৎসর আগে, আমার গ্রাম আরাবেদে একটি ইসকন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে এবং এখন সেই কেন্দ্রের সম্প্রসারণ ও আরও উন্নতিকরণের পরিকল্পনার কাজ চলছে। আমার সমগ্র গ্রামটি, আরাবেদ, এখন হরেকৃষ্ণ আন্দোলনকে ভালোবাসে।

Post a Comment

0 Comments