ভগবদ্‌গীতা-বিষয়ক প্রশ্ন ও উত্তর

ভগবদ্‌গীতা-বিষয়ক প্রশ্ন ও উত্তর

১। ভগবদ্‌গীতা কোন্ শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃত?

উঃ ভগবদ্‌গীতা মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একটি অংশ। ২৫ অধ্যায় থেকে ৪২ অধ্যায় পর্যন্ত এই ১৮ টি অধ্যায়কে শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা বা গীতোপনিষদ বলা হয়।


২। ১৮ অধ্যায় সমন্বিত ভগবদ্‌গীতাকে বৈষ্ণব আচার্যরা মুখ্যতঃ কয়ভাগে বিভক্ত করেছেন? সেগুলি কি কি?
উঃ ১৮ অধ্যায় ভগবদ্‌গীতাকে মুখ্যতঃ তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম ৬টি অধ্যায় (১ম-৬ষ্ঠ) কে বলা হয় কর্মষটক, মাজের ৬টি অধ্যায় (৭ম-১২শ) কে ভক্তি-ষটক বলা হয় এবং শেষ ৬টি অধ্যায় (৬ষ্ঠ-১২শ) কে ভক্তি-ষটক্ বলা হয় এবং শেষ ৬টি অধ্যায়কে (১৩শ-১৮শ) বলা হয় জ্ঞান-ষটক্।

৩। প্রত্যেক ষটকের মধ্যে ৬টি অধ্যায়ের নাম কি কি?
উঃ কর্মষটক -- (১) বিষাদযোগ, (২) সাংখ্যযোগ, (৩) কর্মযোগ, (৪) জ্ঞানযোগ, (৫) কর্ম-সন্ন্যাস-যোগ, (৬) অভ্যাসযোগ।
ভক্তিষটক -- (১) বিজ্ঞান-যোগ, (২) অক্ষর ব্রহ্মযোগ, (৩) রাজগুহ্য যোগ, (৪) বিভূতি-যোগ, (৫) বিশ্বরূপ-দর্শনযোগ, (৬) ভক্তিযোগ।
জ্ঞানষটক -- (১) প্রকৃতি-পুরুষ বিবেক-যোগ, (২) গুণত্রয় বিভাগ যোগ, (৩) পুরুষোত্তম যোগ, (৪) দৈবাসুর-সম্পদ বিভাগ যোগ, (৫) শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগ যোগ, (৬) মোক্ষ যোগ।

৪। শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতায় কোন্ পাঁচটি বিষয় বা তত্ত্ব মুখ্যতঃ আলোচিত হয়েছে?
উঃ ভগবদ্‌গীতায় জীব, ইশ্বর, প্রকৃতি, কর্ম এবং কাল এই পাঁচটি তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে।

৫। গীতাজ্ঞান কে কাকে কোন্ স্থানে প্রদান করেছিলেন?
উঃ গীতাজ্ঞান ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সখা ও শিষ্য অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যুদ্ধের পূর্ব মুহুর্তে প্রদান করেছিলেন।
৬। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কি হচ্ছে -- তা হস্তিনাপুরে থেকে সঞ্জয় কিভাবে দেখতে পেলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন?

উঃ সঞ্জয় হচ্ছেন ব্যাসদেবের শিষ্য। শ্রীল ব্যাসদেবের কৃপায় সঞ্জয় দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছিলেন -- ফলে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে কি হচ্ছে তা সব তিনি দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তিনি জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে সেই সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন।


৭। যুদ্ধের প্রথম দিকে কৌরব পক্ষের কে সেনাপতি ছিলেন?
উঃ পিতামহ ভীষ্মদেব।

৮। শ্রীকৃষ্ণ ও পঞ্চপাণ্ডবদের শঙ্খের নামগুলি উল্লেখ কর।
উঃ শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খের নাম -- পাঞ্চজন্য, অর্জুনের শঙ্খের নাম -- দেবদত্ত, ভীমের শঙ্খের নাম -- পৌণ্ড্র, যুধিষ্ঠিরের শঙ্খের নাম -- অনন্ত বিজয়, নকুলের শঙ্খের নাম -- সুঘোষ ও সহদেবের শঙ্খের নাম -- মণিপুষ্পক।

৯। যুদ্ধক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের দর্শন করে অর্জুনের কি অবস্থা হয়েছিল?
উঃ যুদ্ধক্ষেত্রে সমস্ত বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের দর্শন করে অর্জুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ হয়েছিল। মুখ শুষ্ক হয়েছিল, শরীর কম্পিত হচ্ছিল। হাত থেকে গাণ্ডীব পড়ে গিয়েছিল এবং চোখ জ্বালা করছিল।

১০। অর্জুন যুদ্ধের পরিণাম সম্বন্ধে কি চিন্তা করছিলেন?
উঃ অর্জুন মনে করেছিলেন যে উপস্থিত বংশের প্রবীণ সদস্যরা নিহত হলে কুলক্ষয় হবে। কুলক্ষয় হলে সনাতন কুলধর্ম বিনষ্ট হবে। সনাতন কুলধর্ম বিনষ্ট হলে সমস্ত বংশ অধর্মে অভিভূত হবে। অধর্মের দ্বারা অভিভূত হলে কুলবধূগণ ব্যাভিচারী হবে। কুলস্ত্রীগণ ব্যাভিচারী হলে বর্ণসঙ্কর অর্থাৎ অবাঞ্ছিত সন্তান উৎপন্ন হবে। বর্ণসঙ্করের উৎপত্তির ফলে কুলে পিণ্ডদান ও তর্পণ ক্রিয়া লোপ পাবে। তার ফলে পিতৃপুরুষরা নরকগামী হবেন।

১১। শ্রীকৃষ্ণের নিকট যথার্থ-জ্ঞানলাভ করার জন্য অর্জুন কি করেছিলেন?
উঃ অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করে
বলেছিলেন- "আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছি- আমার কিসে শ্রেয়ঃ লাভ হয় তা আমি বুঝি না। তাই আপনি কৃপা করে আমাকে শিক্ষা দিন- আমি এখন সর্বতোভাবে আপনার শিষ্য ও শরণাগত।"


১২। গীতায় অর্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের প্রথম শিক্ষা কি ছিল?
উঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন- "অর্জুন তুমি পণ্ডিতের মত কথা বলছ- অথচ যে বিষয়ে শোক করা উচিত নয়, সে বিষয়ে শোক করছ।‌যাঁরা যথার্থ পণ্ডিত তাঁরা কখনোই জীবিত বা মৃত কারো জন্যই শোক করেন না।"

১৩। প্রকৃত জ্ঞান কি?
উঃ প্রকৃত জ্ঞান হচ্ছে সেই জ্ঞান যা জড়দেহ এবং চেতন আত্মার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে এবং পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে আমাদের নিত্যসম্পর্কের কথা বুঝিয়ে দেয়।

১৪। পণ্ডিতেরা কারোর মৃত্যুতে মুহ্যমান হন না কেন?
উঃ যথার্থ পণ্ডিতেরা জানেন যে দেহের মধ্যে দেহী বা দেহের আসল মালিক আত্মা অবস্থান করছেন। দেহের পরিবর্তন হয়- কৌমার থেকে যৌবন, যৌবন থেকে মৃত্যুকালে দেহী (আত্মা) জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে আর একটি নতুন শরীর গ্রহণ করে, ঠিক মানুষ যেভাবে পুরনো কাপড় পরিত্যাগ করে নতুন কাপড় পরিধান করে। তাই পণ্ডিতেরা কারো মৃত্যুতে মুহ্যমান হন না।

১৫। জড়দেহের ছয়টি পরিবর্তন কি কি?
উঃ (১) মাতৃগর্ভে তার জন্ম, (২) বৃদ্ধি, (৩) কিছুকালের জন্য স্থিতি, (৪) বংশবিস্তার, (৫) জ্বরা ও (৬) বিনাশ।



২১। জড়-বিষয়ভোগ চিন্তা কিভাবে মনুষ্যের সর্বনাশের কারন হয়? তা ক্রমান্বয়ে বর্ণনা কর।
উঃ ইন্দ্রয়ের বিষয় সমূহ চিন্তা করলে আসক্তি জন্মে, আসক্তি থেকে কামনার উদয় হয়, কামনা থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়, ক্রোধ থেকে সম্মোহ বা পূর্ণমোহ জাত হয়। সম্মোহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম ঘটে, স্মৃতিবিভ্রমের ফলে বুদ্ধিনাশ হয়। বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে জীবের সর্বনাশ হয়। এইভাবে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয় চিন্তা করার দ্বারা জীবের সর্বনাশ হয়ে থাকে।

২২। কোন্ কর্ম বন্ধনের কারণ হয় এবং কোন্ কর্ম মুক্তির কারণ হয়?
উঃ যদি কর্তব্যকর্ম ভগবানের সন্তুষ্টির জন্য করা হয়, তাহলে সেই কর্ম দ্বারা জীব জড়বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। অন্যথায় কর্ম জীবকে জড়জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করে অর্থাৎ শাস্ত্র নিয়মকে অবমাননা করে যে কর্ম নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য করা হয় সেই কর্ম জীবের বন্ধনের কারণ হয়।
২৩। ভগবানকে খাদ্যদ্রব্য নিবেদন করে এবং নিবেদন না করে ভোজন করার মধ্যে কি পার্থক্য আছে?
উঃ ভগবানকে নিবেদন করে আহার করার ফলে ভক্তরা পাপমুক্ত হ'ন। কিন্তু যে স্বার্থপর মানুষ নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য অন্ন পাক করে ভগবানকে নিবেদন না করে ভোজন করে সে শুধুমাত্র পাপ ভোজন করে।
২৪। যজ্ঞ বলতে কি বোঝায়?
উঃ যজ্ঞ বলতে ভগবান বিষ্ণুকেই বোঝায়। বেদে বলা হয়েছে--'যজ্ঞ বৈ বিষ্ণুঃ' ভগবানের তুষ্টি বিধানের জন্য কার্যকেই যজ্ঞ বলা হয়।
২৫। মানুষের জীবন ধারণের জন্য যজ্ঞ করার প্রয়োজনীয়তা কি?
উঃ প্রাণীগণ জীবনধারণের জন্য অন্নগ্রহণ করে। অন্ন উৎপন্ন হয় বৃষ্টি হওয়ার ফলে, বৃষ্টি হয় যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে। যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় শাস্ত্র বিধি অনুসারে। তাই মানুষের জীবন ধারণ করার জন্য যজ্ঞ করা প্রয়োজন।

Post a Comment

0 Comments