শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ কেন পড়বেন?
গীতা অধ্যয়ন ছেড়ে মাঠে ফুটবল খেলা ভালো এবং বাড়িতে তুলসী বৃক্ষ না লাগিয়ে বেগুনের চারা রোপণ করো। স্বামী বিবেকানন্দের এই উক্তিগুলো বর্তমান যুবসমাজে আধ্যাত্মিক বিড়ম্বনা সৃষ্টির কারণ। তারা স্কুলে, ক্লাবঘরের দেওয়ালে এই উক্তিগুলো লিখে রাখেন। এই শিক্ষা গীতাজ্ঞান প্রচারের মস্তবড় এক প্রতিবন্ধক। শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা আছে এবং সে ব্যাপারে যুবসমাজকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। কিন্তু গীতা পাঠ বন্ধ করে খেলাধুলা করবার জন্য উৎসাহিত করা বা গীতা পাঠকে অবজ্ঞা করার কোন যুক্তি হয় না। শরীর নির্বাহের সাথে সাথে আত্মজ্ঞান উপলব্ধিরও প্রয়োজন আছে। প্রকৃত পক্ষে দুর্লভ মনুষ্য জন্ম লাভ করে আত্মজ্ঞান বিহীন সুস্থ শরীর লাভের প্রচেষ্টা, পশু হওয়ার বাসনা ছাড়া আর কিছু নয়। সে যাইহোক ছাত্র-ছাত্রী তথা শিক্ষানুরাগী জনগণ যেন এসব কথায় বিচলিত না হয়ে গীতা শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং অনুশীলনের মাধ্যমে মনুষ্য জীবনকে সার্থক করার চেষ্টা করেন।
শিক্ষাকে কেবলমাত্র অর্থ উপার্জন ও দৈহিক সুখ প্রাপ্তির মধ্যে সীমিত না রেখে জ্ঞানের প্রকৃত উদ্দেশ্য-জড়-জগতের দুঃখ দুর্দশা থেকে চরম মুক্তিলাভ করার উপায় অনুসন্ধান করতে হবে।
সাধারণ লোকেরা মনে করেন যারা ধর্ম কর্ম করে বা বয়স্কলোক তাঁরা ভগবদ্গীতা পাঠ করবেন। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা, ভগবদ্গীতায় বর্ণিত জ্ঞান কেবলমাত্র ধর্মপরায়ণ ও হিন্দুদের জন্য উদ্দিষ্ট নয়, তা হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, যুবক, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলের জন্য। এই গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে জীবন যাপন করলে এই জীবনে এবং পরবর্তী জীবনেও জীবের আত্যন্তিক ও দিব্য শাশ্বত আনন্দ লাভ হবে।
জড়জগতের প্রতিটি জীবই দুঃখ ও দুর্দশায় জর্জরিত। ধনী, দরিদ্র, মূর্খ, পণ্ডিত নির্বিশেষে সবাই যে দুঃখে মর্মাহত তাতে কোন সন্দেহ নেই, এমনকি স্বর্গলোকের দেবতাদেরও পর্যন্ত দুঃখ লাভ করতে হয়। কিন্তু এই জড় জগৎটিই দুঃখের আসল কারণ নয়, জীবের কৃষ্ণবিস্মৃতিই হচ্ছে তার দুঃখের মূল কারণ। ভগবানের কৃপায় জীব এই জগতে দুর্লভ মনুষ্য শরীর লাভ করে এবং যার দ্বারা যথার্থ সাধনা করে জীব নিজেকে বন্ধন মুক্ত করে ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে পারে।
শ্রীল প্রভুপাদ এই জড় জগৎকে একটি ছুরির সঙ্গে তুলনা করেছেন। ঠিক যেমন একজন ডাকাত ছুরির দ্বারা মানুষকে মেরে ফেলে কিন্তু একজন ডাক্তার সেই ছুরির দ্বারা অপারেশন করে রোগ ভালো করতে পারেন। একটি ব্লেড যদি কোনো শিশুর হাতে দেওয়া হয়, শিশুটি (অজ্ঞতার ফলে) তার হাত কেটে ফেলবে কিন্তু একজন বয়স্কলোক যে সঠিকভাবে ব্লেডটি ব্যবহার করতে পারে, সে তাকে প্রয়োগ করে সুন্দরভাবে তার দাঁড়ি কামাতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ছুরি বা ব্লেডের কোন দোষ নেই, কিন্তু সেগুলির প্রয়োগের উপর নির্ভর করে তার সুফল পাবেন না কুফল পাবেন। তদ্রুপ এই জড় জগতে মানুষ যথার্থভাবে জীবনযাপন করার উপায় না জানার ফলে, সে কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দুঃখ দুর্দশা ভোগ করছে। কিন্তু যথার্থ আত্মজ্ঞান লাভ করে সঠিকভাবে জীবনযাপন করলে যে কর্ম তার বন্ধনের কারণ, সেই কর্মই তার মুক্তির কারণ হতে পারে। ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন কিভাবে আমরা এই জড়জগৎ রূপক ছুরিকে ব্যবহার করতে পারব এবং জীবনে সুফল লাভ করতে পারব।
অনেক পিতামাতা মনে করেন যে, তাদের ছেলেমেয়েরা গীতা পাঠ করলে বৈরাগী হয়ে ঘরবাড়ী, কাজকর্ম পরিত্যাগ করে চলে যাবে; কিছুলোকের মতে ধর্মগ্রন্থ মানুষকে পঙ্গু করে দেয়। আসলে তাদের এসমস্ত ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বরঞ্চ গীতা পাঠের ফলটি সম্পূর্ণ বিপরীত। গীতাজ্ঞান লাভ করবার পূর্বে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে তিনি তার স্বধর্মকে পরিত্যাগ করে ভিক্ষা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করবেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ থেকে ভগবদ্গীতার জ্ঞান লাভ করার পর কর্তব্য পালনের জন্য তিনি ঘোর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তাই ভগবদ্গীতার শিক্ষা মানুষকে কর্তব্যবোধ থেকে বিচ্যুত করে না।
গীতাগ্রন্থে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে বর্ণনা করেছেন কিভাবে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করা সম্ভব। প্রথম অধ্যায়ে সৈন্যসজ্জা দেখে অর্জুন আত্মীয়-স্বজনের প্রতি আসক্তিবসতঃ তাদের সম্ভাব্য মৃত্যুতে বিষাদ গ্রস্ত হয়েছিলেন। তাকে বিষাদ থেকে মুক্ত করে কর্তব্যে নিযুক্ত করার জন্য ভগবান দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে শুরু করেছেন তাঁর শিক্ষা। সর্বপ্রথমে তিনি (শ্রীকৃষ্ণ) জীবের স্বরূপ যে এই জড় শরীর নয়, চিন্ময় আত্মা তা বর্ণনা করেছেন। আত্মার মৃত্যু হয় না, আত্মা নিত্য, শাশ্বত, অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না। ভেজানো যায় না বা আগুনে পোড়ানো যায় না। এইভাবে সাংখ্যযোগে বিশ্লেষণাত্মক জ্ঞানের দ্বারা জীবের স্বরূপ নির্ধারণ করে জীবাত্মার অমরত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন যা শ্রবণ করে অর্জুনের স্বজন মৃত্যুজনিত দুঃখের অবসান হয়েছিল। সেই সাংখ্যযোগের দ্বিতীয় ভাগে ভগবান বুদ্ধিযোগের কথা বলেছেন এবং তৃতীয় অধ্যায়ে নিষ্কাম কর্মযোগের কথা বর্ণনা করেছেন। নিষ্কাম কর্মযোগ হচ্ছে কর্তব্যকর্ম করে তার ফল ভগবানকে অর্পণ করা। যাতে জীব, পাপ ও পুণ্য থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে।
এইভাবে ক্রমান্বয়ে বর্ণনা করার পর ভগবান অষ্টাদশ অধ্যায়ে কিভাবে সমস্ত ধর্ম পরিত্যাগ করে তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করলে জীবের সর্বতো মঙ্গল হবে তা শিক্ষা দিয়েছেন। এই গীতাজ্ঞান বিজ্ঞান ভিত্তিক, বাস্তবজ্ঞান-যা জীবনে প্রয়োগ করলে জীবের অশেষ কল্যাণ সাধিত হবে।
তাই আমাদের উচিত অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যথার্থ বৈষ্ণব বা সদ্গুরুর নিকট এই জ্ঞান গ্রহণ করা। ভাগবতে প্রহ্লাদ মহারাজ বলেছেন- 'কৌমারং আচরেৎ প্রাজ্ঞঃ' - কৌমার অবস্থা থেকে ভাগবত ধর্ম অনুশীলন করা বুদ্ধিমানের কাজ।
0 Comments