আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম - শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ

আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম - শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ



আমেরিকার উইসকন্ সিন প্রদেশের মিলওয়েকি শহরে ১৯৪৯ সালের ৯ই এপ্রিল এই বরেণ্য মহা-মানবের জন্ম হয় এক খ্রিষ্টীয় ধর্মযাজক পরিবারে। জন্ম তিথিটিও ছিল রামনবমীর পরবর্তী পুর্ণ কামদা একাদশী তিথি---জন্মেই মহাপুরুষ লক্ষণ বিশিষ্ট যে শিশুটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করাল বিভীষিকা দেখতে হয়েছিল আতঙ্কিত দুচোখ ভরে---হিটলারের নাৎসীবাহিনী তখন পৃথিবীজুড়ে এক নারকীয় যুদ্ধলীলা শুরু করেছিল, যা ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া সহ বিশ্বের তাবৎ দেশকে দমিয়ে দিয়েছিল, জিজ্ঞাসা উঠেছিল পৃথিবীর কোণে কোণে---তবে কেন এই মানব জীবন?
হ্যাঁ, কোটিপতির সন্তান এবং ঐশ্বর্যের বরপুত্র শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজের অশৈশব আকর্ষণ ছিল ধনে---তবে, জাগতিক নয়, পারমার্থিক চিন্ময়ানন্দ ধনে; মেধা যার তীক্ষ্ণ---তার সহজাত প্রবণতা অবশ্যই দর্শনতত্ত্ব ও অধ্যাত্ম জ্ঞানে। তাই ছেলেবেলাতেই পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী দর্শনশাস্ত্র ও খ্রিষ্টীয় বাইবেল গ্রন্থে ছিল তার পরম অনুরাগ। মাত্র এগার বছর বয়সে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন কঠিন চর্মরোগে; সেই সময় ঈশ্বরানুরাগ এবং পিতৃ উপদেশ ঈশ্বরের নাম জপ করার ঐশ্বর্য মহাবলে তিনি রোগমুক্ত হন।



প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে মেধাবী শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি হন সেন্ট জন্স অ্যাকাডেমী কলেজে। সেকালে এই কলেজটির নামডাক ছিল সারা আমেরিকা জুড়ে। তিনি প্রথম থেকেই তাঁর অস্বাভাবিক মেধার গুণে শিক্ষকদের দৃষ্টি কাড়েন; এবং বরাবরই পরীক্ষায় ভাল ফল করেন; স্নাতক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ সংখ্যামান অর্জন করে প্রথম স্থানাধিকারী হন। আমেরিকায় কোন কলেজের ছাত্র যদি বিশেষ ভালো ফল করে, তবে তাকে স্নাতকোত্তর উচ্চশিক্ষা জীবনে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। যেমন, বিনামূল্যে আবাসিক আশ্রয়, খাদ্য সামগ্রী, বইপত্র এবং আনুষঙ্গিক খরচের জন্য উচ্চহারে ছাত্র বৃত্তি।
শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ জনস্ একাডেমীর শিক্ষা শেষে বিখ্যাত ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চহারে মাসিক সম্মানীয় বৃত্তি সহ ভর্তি হন। কিছুদিন ক্লাস করার পর একদিন ক্লাসে এক অতিথি অধ্যাপকের কাছে ভগবান বুদ্ধের জীবন-দর্শন শুনে তাঁর অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে; মন বিবাগী হয়ে উঠল; জাগতিক শিক্ষার প্রতি সমস্ত আকর্ষণই হারিয়ে ফেললেন। মনের ক্ষুধা তখন 'অথাতো ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা' হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক ভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ল একজন পথপ্রদর্শক গুরুর---'গুরু কৃপা হি কেবলম্।' ইতিপূর্বে ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থাদি পড়ে তিনি চাক্ষুষ ভারত দর্শনে অভিলাষী ছিলেন, এতদিনে একদিকে গুরুর সন্ধান আর অপর দিকে প্রকৃত অ্যাধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধানে তিনি ভারতবর্ষে পাড়ি জমাবেন বলে মনস্থির করলেন।
কিন্তু তিনি মহাপুরুষের লক্ষণ চিহ্নিত দিব্যদেহী, তাঁর কাছে তো স্বয়ং গুরুই পৌঁছে যান। এই সময় জগতগুরু শ্রীলঙ্কা অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ পাশ্চাত্যের দেশে দেশে গৌরবাণী বিতরণ করছেন; খবর পৌঁছে গেল শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজের কাছে; ছুটে এলেন তিনি সেই ভারতীয় স্বামীজীর দর্শনে সানফ্রান্সিস্কোতে। শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ তখন জগতকে যে চৈতন্য শিক্ষা দিচ্ছিলেন, তার সারাৎসার ছিল---
পরশমণির সঙ্গে কি দিব তুলনারে
পরশ ছোঁয়াতে হয় সোনা।
আমার সোনার গৌরাঙ্গের সনে নাচিয়া গাহিয়া
রতন হইলা কতজনা॥
মুগ্ধ হলেন শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী, সানফ্রান্সিসকোর রথযাত্রা উৎসবে যোগদান আজ তাঁর সর্বৈব সার্থক হয়েছে---অন্তরে অন্তরে এই অনুভূতি নিয়েই তিনি আত্মহারা হলেন ভগবৎ ভাবনায়। মনের সায় পেলেন ভগবৎ প্রেমিক। ছুটে এলেন অন্তরের অধ্যাত্ম বুভুক্ষায় মন্ট্রিলে---যেখানে শ্রীল প্রভুপাদ যেন অপেক্ষা করেছিলেন তাঁরই জন্য। দর্শনে দর্শনে অন্তরের আলেখ্যে কত কথাই না হল সুজন রসিকী আলাপে। পেলেন দীক্ষা শ্রীল প্রভুপাদের কাছ থেকে ১৯৬৮ সালে। আশ্চর্য নামকরণও হল তাঁর---'জয়পতাকা দাস ব্রহ্মচারী।' সুদর্শন জয়পতাকা দাস ব্রহ্মচারী অচিরেই শ্রীল প্রভুপাদের অন্তরঙ্গ পার্ষদ হয়ে ওঠেন। বেশ কিছুদিন প্রভুপাদের সঙ্গের সঙ্গী হন সেবকরূপে; পরবর্তীকালে পূজারীর ভূমিকায় গোবিন্দ সেবায় নিয়োজিত হন; এরপর শ্রীল প্রভুপাদের ইচ্ছাতে মন্ট্রিল মন্দিরের অধ্যক্ষ হন। এবার গুরুর আদেশে কানাডার টরেন্টোতে এবং আমেরিকার চিকাগো শহরে দুটি শ্রীকৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠাকল্পে বিশেষভাবে এগিয়ে আসেন।
১৯৭০ সালে, শ্রীৎ জয়পতাকা স্বামীর জীবনে বিশেষ স্মরণীয় বছর, কেননা এ সময় শ্রীল প্রভুপাদের আজ্ঞায় তাঁর বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের দেশ ভারতবর্ষে পাড়ি জমান। একদিকে শ্রীল প্রভুপাদের আদেশে মায়াপুর ও বৃন্দাবনে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের জন্য প্রয়োজনাদি জমি জায়গার ব্যবস্থা করা, আর অন্য মনে অজস্র কৌতূহল তাঁর জীবনে যেন অনাবিল শান্তির ফল্গুস্রোত বয়ে যাচ্ছে ভারতে পুণ্য ধূলিতে পা রেখে।
সেই বছরেই কলকাতার পথে পথে শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তন এবং ইসকনের 'আজীবন সদস্য' সংগ্রহে তাঁর কৃষ্ণভাবনাময় জীবনের এক বিশেষ পর্ব শুরু হয়। ১৯৭০ সালেই শুভ রাধাষ্টমীর দিন শ্রীল প্রভুপাদের কাছ থেকে সন্ন্যাস দীক্ষা লাভ করে হলেন শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী। কলকাতার ৩সি এলবার্ট রোডের শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ মন্দিরের অধ্যক্ষতার দায়িত্ব পেয়ে সগৌরবে তিনি একের পর এক বিশাল প্যাণ্ডেল অনুষ্ঠানের কর্মসূচী হাতে নিয়ে কলকাতায় হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের পরম বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তনম্ ঘোষণা করেন। সেই সময়ে প্রভুপাদের ভাগবত বক্তৃতা শুনতে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার দর্শকের সমাবেশ হত এক একটি সভাতে।
এরপরই ১৯৭১ সালে শ্রীধাম মায়াপুরে ইসকনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় গড়ে তোলার সুমহান দায়িত্ব নিয়ে মায়াপুরে পাড়ি দিলেন শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী। শ্রীল প্রভুপাদের স্বপ্ন ছিল মায়াপুরকে বৈদিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলার। তাই সুযোগ্য শিষ্য শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামীকে বলেছিলেন, "জয়পতাকা স্বামী, আমি তোমাকে ভগবানের ধাম দিলাম, এখন তুমি এর উন্নতি বিধান কর।"
সেই থেকে শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মায়াপুর সহ ভারত এবং বিশ্বজুড়ে প্রভুপাদের গড়ে তোলা হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের কৃষ্ণভাবনাময় প্রচারকার্যে এগিয়ে আসেন। একই সঙ্গে ইসকন পরিচালক মণ্ডলী জি.বি.সি-র সদস্য ও ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাষ্টের ট্রাষ্টি নিযুক্ত হন। পূর্বভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় প্রভুপাদের গ্রন্থ প্রচারকার্যে বিশেষ অবদান রাখেন। ইসকন ফুড রিলিফের ভারত শাখায় তিনি কো-অর্ডিনেটরের পদে নিযুক্ত হন, এবং মায়াপুর ও বৃন্দাবনের ট্রাষ্টী মনোনিত হন।
এরপর ১৯৭৭ সালে শ্রীল প্রভুপাদের ইচ্ছা আশীর্বচনে অন্যান্য গুরুভ্রাতাদের সঙ্গে তিনিও "আমার আজ্ঞায় গুরু হইয়া কর এই ভিক্ষা। বল কৃষ্ণ ভজ কৃষ্ণ কর কৃষ্ণ শিক্ষা" ---কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার আন্দোলনে আচার্য হয়ে দীক্ষা দানের অধিকারে ধন্য হন। আজ আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, প্রভৃতি পৃথিবীর প্রায় দেশেই রয়েছে তাঁর অগনিত ভক্ত ও শিষ্য।
১৯৭৮---ভয়ঙ্কর বন্যার প্লাবনে পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে যখন চরম দুর্গতি, তখন তিনি আর্ত মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন বন্যাদুর্গত গ্রামবাসীদের কাছে প্রয়োজনীয় আহার্যসামগ্রী নিয়ে। ভারতের মানুষদের প্রতি তাঁর এই নিঃস্বার্থ পরোপকার সেবায় কৃতজ্ঞতায় এদেশের কয়েকজন বিচক্ষণ ব্যক্তি তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য হাজার হাজার গ্রামবাসীর স্বাক্ষর সম্বলিত আবেদন পত্র পেশ করেন ভারত সরকারের কাছে। ভারত সরকারও তাঁকে ভারতীয় নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেন।
আজ নিরলস ভাবে তিনি সারা বিশ্বে হরিনাম প্রচার করছেন; বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে তুলেছেন শ্রীকৃষ্ণমন্দির; পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় শ্রীল প্রভুপাদের অপ্রাকৃত কৃষ্ণগ্রন্থাবলী প্রণয়নে বিশেষ সাড়া জাগিয়ে চলেছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি প্রচার মাধ্যমে তিনি বহু প্রশংসিত। কৃষ্ণভাবনাময় আন্দোলনের প্রভাবে গড়ে ওঠা বিশ্ববৈষ্ণব সমাজে তাঁর খ্যাতি তুঙ্গে।
নদীয়া গোদ্রুমে নিত্যানন্দ মহাজন।
পাতিআছে নামহট্ট জীবের কারণ॥
---সেই নামহট্ট যা আজ শুধু বাংলা, উড়িষ্যা, অসমে নয়, বিশ্বের বহু প্রান্তেই তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ঘরে ঘরে কৃষ্ণশিক্ষার আসর গড়ে তুলেছে। আজ না হলেও, আগামীতে হরেকৃষ্ণ নামহট্ট সংঘকে এভাবে গ্রামের ঘরে ঘরে গড়ে তোলা এবং সুস্থ সমাজ জীবনে ও কৃষ্ণভাবনাময় সংসার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর মহান অবদান গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে---একথা নিশ্চিত বলা যায়।
তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈষ্ণব শাস্ত্রাদির ইংরেজী অনুবাদ এবং ভাষ্য প্রদান করেছেন। সেগুলি হল শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের 'বৈষ্ণব কে?' এবং শ্রীল প্রভুপাদের 'বৃন্দাবন ভজন'। তাঁর দিব্যভাবনায় যাবতীয় ব্রত কর্মের মধ্যে আছে ত্রিতাপক্লিষ্ট মানুষের অমৃত জীবনের সন্ধান, তাই ছোট বড় সমস্ত ভক্তের তিনি পরম শ্রদ্ধার পাত্র।

Post a Comment

0 Comments