পূজায় পশুবলি কি পাপ?


পূজায় পশুবলি কি পাপ?




বাংলাদেশ ও নেপালে বিভিন্ন পূজা-পার্বণে নিরীহ পশু বলি দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। শুধু কি তাই তথাকথিত ধর্মীয় বিধি ছাড়াও মানুষ ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য নিরীহ পশুদের হত্যা ও ভক্ষণ করে। জনমনে এ নিয়ে অনেক বিতর্ক পরিলক্ষিত হয় । কেউ শাস্ত্রে তো তা অনুমোদন করা হয়েছে তবে এই এত আপত্তি কিসের? পশুবলির ফলে পরজন্মে কি হয়? যজ্ঞে পশু আহুতি কেন দেওয়া হয়? বেদে কেনইবা কর্মকান্ডের অনুমোদন দেয়া হয়েছে? পশুবলি সম্বন্ধে শিব-দুর্গার কি অভিমত প্রভৃতি বিষয়ে নিম্নের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে শ্রীল প্রভুপাদের শিক্ষা, মহাভারত ও মনুসংহিতা অবলম্বনে আলোচনা করা হয়েছে।

পশুবলি কি হিংসাত্মক কার্য?

শ্রীমদ্ভাগবতের (১১/৫/১৪) শ্লোকে নারদ মুনি বসুদেবকে উপদেশকালে পশু বলি দেওয়াকে হিংসাত্মক কার্য বলেছেন
যেত্বনেবং বিদোহসন্তঃ স্তব্ধাঃ সদভিমানিনঃ।
পশূন্ দ্র্হ্যন্তি বিশ্রদ্ধাঃ প্রেত্য খাদন্তি তে চ তান্ ।।
সেই সমস্ত পাপাচারী মানুষ যথার্থ ধর্মনীতি বিষয়ে অজ্ঞ হলেও নিজেদের সম্পূর্ণ ধার্মিক মনে করে। তাই নির্বিচারে ঐ সব নিরীহ পশু যারা তাদের উপরে পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে থাকে তাদের উপর হিংসাত্মক আচরণ করে থাকে। তাদের পরজন্মে, এই সমস্ত পাপাচারী মানুষগুলিকে সেই পশুগুলোই আবার হত্যা করে ভক্ষণ করে থাকে।

এ জন্মে পশুবলির ফল
পরজন্মে কি হতে পারে?
শ্রীল প্রভুপাদ বৃন্দাবনে ৭ এপ্রিল, ১৯৭৬ সালে এক প্রবচনে বলেন যখন আমি মাংস খাই, মামসহঃ, এর অর্থ, “এই প্রাণীটিও আবার আমাকে খাবেতুমি তার থেকে বাঁচতে পারবে না। জীবনের জন্য জীবনসর্বত্র এটি হলো আইন। যদি তুমি কাউকে হত্যা কর অবশ্যই তোমাকেও হত্যা করবে। তুমি তথাকথিত রাষ্ট্রের আইন থেকে বাঁচতে পার, কিন্তু প্রকৃতির আইন থেকে বাঁচতে পারবে না।
মনুসংহিতার (৫/৫৫) সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে পশুদের নিষ্ঠুর মনিবেরা যারা নির্দোষ প্রাণীদের হত্যা করে নিঃসন্দেহে পরজন্মে তারা একই পদ্ধতিতে নিহত হবে।
মাংস ভক্ষয়িতামুত্র যস্য মাংসম্ ইহাদম্যহম্।
এতন্ মাংসস্য মাংসত্বম্্ প্রবদন্তি মনীষিণঃ ।।
“ ‘
এখানে যে পশুটির মাংস আমি এখন ভক্ষণ করছি, পরজন্মে সে আমার মাংস আহার করবে।এই জন্যই পশুদেহ ভক্ষণকে মাংসরূপে সমস্ত জ্ঞানগর্ভ শাস্ত্রকারেরা বর্ণনা করছেন।
শ্রীমদ্ভাগবতে (ভাগবত ৪/২৫/৭-৮) প্রাণিহত্যা কারীদের এই ভয়ানক দুর্ভাগ্যের কথা একদা যজ্ঞাদিতে নিবেদনের নামে এইভাবে যথেচ্ছা পশুহত্যাকারী রাজা প্রাচীনবর্হিকে শ্রীনারদ মুনি বর্ণনা করেছিলেন-
হে প্রজাপালক রাজা! আপনি যজ্ঞস্থলে যে সমস্ত পশুদের নির্দয়ভাবে বলি দিয়েছেন গগনমার্গে সেই সমস্ত পশুদের দেখুন। আপনি যে তাদের পীড়ন করেছেন তা স্মরণ করে, এই সমস্ত পশুরা আপনার মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে। আপনার মৃত্যুর পর তারা ক্রোধে উদ্দীপ্ত হয়ে লৌহময় শৃঙ্গের দ্বারা আপনার দেহ ছিন্নভিন্ন করবে।মৃত্যুর অধিপতি যমরাজের গ্রহলোকে তাঁর ব্যবস্থাধীনে পশুহননকারীদের জন্য এই ধরনের শাস্তিবিধান রয়েছে।

যজ্ঞে পশু আহুতি কেন দেওয়া হয়?

মধ্বাচার্য পশুবলি সম্পর্কে নিম্নরূপ মন্তব্য করেছেন

যজ্ঞেষ্বালাভনং প্রোক্তম দেবতোদ্দেশতঃ পশোঃ।
হিংসা নাম তদন্যত্র তস্তাৎ তাং নাচরেদ্ বুধঃ ।।
যতো যজ্ঞে মৃতা ঊর্ধ্বং যান্তী দেবে চ পৈতৃকে।
অতো লাভাদ্ আলভনম্ স্বর্গস্য ন তু মারণম্।।

এই বিবৃতি অনুযায়ী বেদশাস্ত্রাদি অনেক ক্ষেত্রে ধর্মানুষ্ঠানে পশু বলিদানের বিধান দেওয়া আছে পরমেশ্বর ভগবান বা কোনো বিশেষ দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে। অবশ্য যদি কেউ খেয়ালখুশি মতো বৈদিক অনুশাসনাদি যথাযথভাবে হিংসাত্মক কাজ বলেই গণ্য হয় এবং কোনো বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষেই তা মেনে নেওয়া উচিত হবে না। যদি পশুবলি যথাযথভাবে পালিত হয়, তাহলে বলি প্রদত্ত পশুটি যজ্ঞাহুতির মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ পিতৃপুরুষ ও দেবতাদের স্বর্গধামে চলে যায়। সুতরাং সেই ধরনের পশুবলি যথার্থ পশু হত্যা নয় তবে বৈদিক মন্ত্রাবলীর শক্তি দর্শনের জন্য সেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। যার মাধ্যমে বৈদিক মন্ত্রাবলী উচ্চারণের শক্তির মাধ্যমে সেই যজ্ঞপশুটি তৎক্ষণাৎ এক সমুন্নত মর্যাদা সম্পন্ন স্তরে উন্নীত হয়ে যায়।
অশ্বমেধ-যজ্ঞ বা গোমেধ-যজ্ঞ অবশ্যই পশুবধের জন্য অনুষ্ঠান করা হত না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন যজ্ঞবেদীতে সেই পশুবলির ফলে পশুদের নতুন জীবন দান করা হত। বৈদিক মন্ত্রের অভীষ্ট ফল প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করার জন্যই কেবল তা করা হত। যথাযথভাবে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করার ফলে অনুষ্ঠানকারী নিশ্চিতভাবে পাপের ফল থেকে মুক্ত হন। কিন্তু কোন অক্ষম ব্যক্তি অনুপযুক্ত বিধিতে এই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করলে তাকে অবশ্যই পশুহত্যার জন্য দায়ী হতে হয়। কলহ এবং কপটতার এই যুগে এই প্রকার যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার মতো সুদক্ষ কোন ব্রাহ্মণ না থাকায় এই সমস্ত যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। কলিযুগের একমাত্র যজ্ঞ হচ্ছে ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কর্তৃক প্রবর্তিত হরিনাম-যজ্ঞ। কিন্তু তা বলে পশুহত্যা করে সেই পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য হরিনাম-যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা উচিত নয়।
(
শ্রীমদ্ভাগবত (১/৮/৫২ তাৎপর্য)


Post a Comment

0 Comments