গল্পে উপদেশ
একজন বিশেষ শাস্ত্র জ্ঞান সম্পন্ন পন্ডিত তার এক শিষ্যের বাড়ী থেকে নিজের আশ্রমের অভিমুখে রওনা হলেন। বৈশাখ মাসের মধ্যাহ্ন সময়ে ভীষণ রৌদ্রের মধ্য দিয়ে তিনি মাঠ পার হচ্ছেন। তিনি দেখলেন মাঠের মধ্যে অনেক তরমুজ আছে। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন-“এই গরমের সময়ে যদি একটি তরমুজ নেওয়া যায়, তাহলে অপরাহ্নে গিরীধারীর ভোগ নিবেদন ভালই হবে।” চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন জন-প্রাণী শূণ্য মাঠ। কোথাও কেহ নেই। মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগলেন-“পরের দ্রব্য না বলিয়া লইলে চুরি করা হয়।” তিনি কাকে বলে নেবেন, কেউ তো নাই সেখানে। এইসব আদি অন্ত চিন্তা করতে লাগলেন। যদি তরমুজের জায়গায় উপযুক্ত মূল্য বেঁধে রেখে তরমুজ নেওয়া যায়, তাহলে চুরি করা হবে না। তাই তিনি একটি তরমুজ নিয়ে সেখানে উপযুক্ত মূল্য বেঁধে রাখলেন। তরমুজটি নিয়ে আশ্রমের দিকে চললেন। পথের মধ্যে দেখলেন, একজন লোক শুকর চরাচ্ছে। তিনি যখন এদের অতিক্রম করে বেশ কিছুদূর চলে গেছেন, তখন ঐ লোকটি চিৎকার করে বলতে লাগল- “আমার শোরের বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, আমার শোরের বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, আমার শোরের বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।” বলতে বলতে ঐ সাধুর দিকে ছুটে চলল। গ্রামে কয়েকজন লোকজন ছুটে এলেন। শুনলেন শুকর-ওয়ালার কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত। কিন্তু কোন লোক বিশ্বাস করলেন না। তাঁরা বললেন- “ইনি আমাদেরই গাঁয়ের লোক। আমরা জানি ইনি একজন সাধু-মহাত্মা ব্যক্তি। এই রূপ কার্য্য ইহার দ্বারা কখনই সম্ভব নয়।” শুকর-ওয়ালা বলল- “ঐ ব্যাগটির মধ্যে আমার শোরের বাচ্চা আছে।” গ্রামবাসীরা বললেন-“পন্ডিতমহাশয়, আপনার ব্যাগটি জাড়–ন তো। দেখি ব্যাগে কি আছে। তিনি সকলের কথা শুনে ব্যাগটি কাঁধ থেকে নামিয়ে মুখটি খোলার সঙ্গে সঙ্গে দুইটি শুকরের বাচ্ছা গঁদ গঁদ করে বেরিয়ে এল। সমস্ত লোক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। “এ কি আশ্চর্য্য। পন্ডিতের নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। তিনি তো সাধু ব্যক্তি। এরূপ কাজ ইহার দ্বারা অসম্ভব।” শুকর-ওয়ালাকে তাঁর বাচ্চা নিয়ে চলে যেতে বললেন এবং পন্ডিত মহাশয়কেও তার আশ্রমে ফিরে যেতে বললেন। কিন্তু তিনি চলতেও পারছেন না এবং কিছু বলতেও পারছেন না। ধীরে ধীর কিছুদূর গিয়ে চিন্তা করলেন-“এই জীবন আর রাখব না। আমার জীবনে এত অপমান অপযশ কোনদিন আসে নাই। এই মিথ্যা অপবাদ সহ্য করা যায় না। তাই আমি এখনই দেহত্যাগ করব।” সেই সময় একজন সন্ন্যাসী এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন-“আপনি এত বিষন্নভাবে কোথায় যাচ্ছেন?” তিনি তার মনের দুঃখের কথা সব খুলে বললেন সেই সন্ন্যাসীকে। সন্ন্যাসী বললেন- “আপনি জানেন না। আপনি কলির রাজত্বে বাস করে তাঁর আইন অমান্য করে চলেছেন। সেই জন্যই আপনি এত দুঃখ পাচ্ছেন। ক্ষেত থেকে তরমুজ তুলবেন ভাল কথা, কিন্তু ওখানে মূল্য বেধে না রেখে যদি গাছের গোড়াটি ছিড়ে দিতেন, তাহলে এই অপমান আপনার কখনই হত না। আপনি বাস করবেন কলির রাজ্যে, আচরণ করবেন সত্যের এ কখনও সম্ভব নয়। আপনি আমার প্রতি একবার তাকিয়ে দেখুন তো?” পন্ডিত মহাশয় তাকিয়ে দেখলেন- সাক্ষাৎ কলি মহারাজ। কলি মহারাজ বললেন-“আমি জানি, আপনি সাধু-মহাত্মা ব্যক্তি। আপনি প্রাণত্যাগ করবেন না। আমার রাজ্যে কোন লোক নিষ্কলঙ্ক থাকতে পারে না। কারও পবিত্র জীবন থাকে না। তাই আমি আপনাকে এইভাবে একটি কলঙ্ক দিলাম। আপনার জীবনে কোন কলঙ্ক নাই। আপনি একজন মহান পুরুষ।”
। হিতোপদেশ।
কলি মহারাজ প্রথমে তার অধর্মের জাল বিস্তার করেন। সকলকে সেই জালের মধ্যে আবদ্ধ করবার জন্য। যদি কেউ সেই জালের মধ্যে আবদ্ধ না হয়ে নিষ্কপটে হরিনাম করবেন কলি মহারাজ সেই হরি-নাম পরায়ণ সাধুকে মাথায় করে রাখেন। আর হরিবিমুখ ব্যক্তিকে তার ভান্ডারে যতরকম পাপ ও অধর্ম আছে তা তাদের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া তার একটি প্রধান কার্য। যাঁরা প্রচুর পরিমানে হরিনাম করবেন তাঁরা এই সব স্বচ্ছ আয়নার মত দেখতে পারবেন। তাঁহার সাক্ষ্য দিয়েছেন নামাচার্য হরিদাস ঠাকুর। কলি মহারাজ এইবার বিশেষ কলিযুগে বিশেষভাবে তার অধর্মের জাল বিস্তার করে সকলকে ছেকে তুলেছেন তার অধর্মের ঝুলির মধ্যে। কেবল প্রণাম করে ছেড়ে দিয়াছেন প্রকৃত হরিনাম পরায়ন সাধুদিগকে। যাঁরা কলির পীড়নের হাত হতে বাঁচতে চান তাঁরা সদ্গুরুর চরণাশ্রয় পূর্বক নিষ্কপটে হরিনাম করবেন। নতুবা কলি মহারাজের দুর্বিসহ যাতনা হতে নিস্তারের কোনও উপায় নেই, রাস্তা নেই।
0 Comments