মুচি ও ব্রাহ্মণ (শ্রীল প্রভুপাদের গল্পে উপদেশ)

মুচি ও ব্রাহ্মণ
(শ্রীল প্রভুপাদের গল্পে উপদেশ)





নারদ মুনি প্রায় প্রতিদিনই পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করার জন্য একবার বৈকুন্ঠে গমন করেন। একদিন তিনি যখন কোন একটি পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন এক বিজ্ঞ ব্রাহ্মণের সঙ্গে তার পরিচয় হল। ব্রাহ্মণ প্রতিদিন তিন বেলা স্নান করেন এবং তার আচার আচরণ সমস্ত কিছুই অত্যন্ত সুন্দর। ব্রাহ্মণ নারদমুনিকে প্রশ্ন করলেন, “হে মুনিবর, আপনি নিশ্চয়ই ভগবান নারায়নের কাছে চলেছেন?”
আপনি কি দয়া করে তার কাছে জানতে পারবেন যে, “কবে আমি মুক্তি লাভ করতে পারব?”
নারদ মুনি বললেন, “ঠিক আছে আমি পরম প্রভুর কাছে অবশ্যই আপনার প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইব।”
এরপর পথে যেতে যেতে নারদ মুনির সাথে এক মুচির দেখা হল।
নারদ মুনিকে দর্শন করে মুচি জানতে চাইল, “প্রভু, আপনি কি বৈকুন্ঠে পরম প্রভু স্বয়ং নারায়ণের কাছে যাচ্ছেন?”
নারদ মুনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি বৈকুন্ঠে পরম প্রভু নারায়ণের দর্শনে যাচ্ছি।”
তা শুনে মুচি বিনীতভাবে নারদমুনিকে অনুরোধ করল, “তাহলে প্রভু, আপনি কি কৃপা করে আমার হয়ে তার কাছে জিজ্ঞাসা করবেন যে, কবে আমি এই জন্ম মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করব?”
নারদ মুনি তাকেও কথা দিলেন, “ঠিক আছে, আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তর জেনে আসব।”
এবারে নারদ মুনি বৈকুন্ঠে পৌছে ভগবান নারায়ণের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে প্রণাম নিবেদন করলেন। ভগবান নারায়ন নারদকে দেখে বড়ই প্রীত হলেন।
বিভিন্ন কথা বলার পর নারদ মুনি এবার ভগবানের কাছে সেই ব্রাহ্মণ ও মুচির জিজ্ঞাসিত প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে জানতে চাইলেন, “হে ভগবান, আমি বৈকুন্ঠে আসার পথে এক পন্ডিত ব্রাহ্মণ ও এক মুচি আমাকে আপনার থেকে এই প্রশ্নের উত্তর জেনে যেতে বলেছেন যে, “তারা কবে তাদের জাগতিক বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি প্রাপ্ত হবে? এখন আপনি বলুন তাদেরকে আমি কি উত্তর দেব?”
প্রশ্ন শুনে ভগবান স্মিত হেসে বললেন, “ও আচ্ছা এই কথা! মুচি এই জন্মেই শরীর ত্যাগের পর আমার কাছে এই বৈকুন্ঠে চলে আসবে।” এই কথা বলে ভগবান চুপ করে থাকলেন। আর কিছু বললেন না।
কিন্তু নারদ মুনি ভগবানকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে ভগবান, সেই পন্ডিত ব্রাহ্মণের কি হবে?”
ভগবান বললেন, “ওহ, তাকে সেখানে আরও অনেক জন্ম থাকতে হবে। সে যে কবে এই বৈকুন্ঠে আসতে পারবে তা আমিও জানি না।”
স্বয়ং নারায়ণের কাছে এই উত্তর শুনে নারদ মুনি অবাক হলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, “একজন মুচি, সে এই জন্মে বৈকুন্ঠ ধাম প্রাপ্ত হবে। আর এ ব্রাহ্মণ, যাকে কিনা, আমার নিষ্ঠাবান মনে হল, সে কবে মুক্তি লাভ করবে তার কোন ঠিক নেই।”
কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে নারদ মুনি ভগবানকে প্রশ্ন করলেন, “হে প্রভু আপনি বলেছেন মুচি এই জন্মেই বৈকুন্ঠ ধাম প্রাপ্ত হবে, কিন্তু ব্রাহ্মণের বেলায় তা হবে না কেন? আমি এই রহস্য কিছুতেই বুঝতে পারছি না।”
নারদ মুনির প্রশ্ন শুনে নারায়ণ স্মিত হেসে জবাব দিলেন, “সেটা তুমি এখনই বুঝতে পারবে না। মর্তে ফিরে গেলে বুঝতে পারবে।
তারা যখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে কৃষ্ণ বা নারায়ণ তাঁর ধামে কি করছিলেন, তখন তুমি বলবে যে, ভগবান তাঁর ধামে বসে একটি সূচের ছিদ্র দিয়ে একটি হাতিকে একবার প্রবেশ করিয়ে বিপরীত দিক দিয়ে বাহির করছিলেন।”
নারদমুনি বললেন, “ঠিক আছে।”
এবার নারদ মুনি যখন মর্তে ফিরে আসলেন এবং সেই ব্রাহ্মণের সাথে দেখা হল। ব্রাহ্মণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “হে মুনিবর, ভগবানের সাথে কি আপনার দেখা হয়েছিল?”
নারদমুনি - হ্যাঁ
ব্রাহ্মণ- আপনার সাথে যখন ভগবানের দেখা হল, তখন তিনি কি করছিলেন?
নারদমুনি- তিনি একটি সূচের ছিদ্র দিয়ে একটি হাতিকে একদিক দিয়ে প্রবেশ করিয়ে অন্য দিক দিয়ে বের করছিলেন।
নারদ মুনির এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ গম্ভীরভাবে বলল, “হে প্রভু, আমি আপনাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি, কিন্তু আজ আপনি আমাকে এসব কি আবোল তাবোল বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। সূচের ছিদ্রপথ দিয়ে কি হাতিকে প্রবেশ করানো সম্ভব? এসব যুক্তিহীন কথা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”
ব্রাহ্মণের কথা শুনে নারদ মুনি বুঝতে পারলেন, এই ব্যক্তি কেবল পুঁথিগত জ্ঞানেই পন্ডিত, কিন্তু ভগবানের প্রতি তার আন্তরিক শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস নেই। এরপর নারদ মুনির সাথে সেই মুচির দেখা হল। সে একটি বিরাট বটগাছের নিচে বসে তার কাজ করছিল।
নারদ মুনিকে দর্শণ করেই তাঁকে প্রণাম করে জানতে চাইল, “হে প্রভু, আপনার সাথে কি পরমেশ্বর ভগবানের সাক্ষাৎ হয়েছিল? তিনি তখন কি করছিলেন?”
নারদ মুনি মুচিকেও সেই একই জবাব দিল, “আমার সাথে যখন ভগবান নারায়ণের দেখা হল তখন তিনি একটি সূচের ছিদ্রপথের একদিক দিয়ে একটি হাতিকে প্রবেশ করিয়ে অন্য পাশ দিয়ে বের করছিলেন।”
নারদ মুনির এই কথা শুনে মুচি আনন্দে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলে উঠল, “আহ! ভগবানের কতই না লীলার প্রকাশ। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি আমাদের চিন্তার অতীত লীলার প্রকাশ ঘটিয়ে আমাদের আনন্দ বিধান করেন।”
নারদ মুনি তখন মুচির কাছে জানতে চাইলেন, “তুমি তাহলে বিশ্বাস কর যে, ভগবান একটি সূচের মধ্যে দিয়ে একটি হাতিকে প্রবেশ করাতে পারেন?”
“কেন নয়? আমি তা অবশ্যই বিশ্বাস করি।” মুচি জবাব দিল।
“এই বিশ্বাসের কারণটি কি? নারদ মুনি প্রশ্ন করলেন।
মুচি বলল, “আমি যে বটগাছটির নিচে বসে আছি, এই গাছটি থেকে অসংখ্য বট ফল মাটিতে ঝরে পড়ছে। আর প্রতিটি ফলের মধ্যে রয়েছে শত শত বীজ। সেই সব বীজের মধ্যেই রয়েছে এই রকম বিরাট মহীরুহ বা বিশাল বটগাছ।
এরকম একটি ছোট্ট বীজের মধ্যে যদি এতবড় একটি বিরাট বটগাছ থাকতে পারে, তাহলে একটি সূচের ছিদ্রপথ দিয়ে ভগবান যে একটি হাতিকে প্রবেশ করাবেন তাতে সমস্যা কোথায়? তার পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। তাই আপনার কথা বিশ্বাস না করার তো কোন কারণ থাকতে পারে না?”
নারদ মুনি তখন হৃদয়ঙ্গম করলেন কেন ভগবান নারায়ন বলছিলেন যে, মুচি এ জন্মেই দেহত্যাগের পর বৈকুন্ঠপ্রাপ্ত হবে আর সেই বাহ্যিকভাবে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের কেন জন্মে জন্মে মুক্তি লাভ হবে না। মুচির কথা শুনে নারদ মুনি ভাবলেন যে এই হচ্ছে ভগবানের প্রতি প্রকৃত ভালবাসা এবং বিশ্বাস। এটি কোন অন্ধ বিশ্বাস নয়, বরং এ বিশ্বাসের পেছনেও রয়েছে পূর্ণ যুক্তি বা কারণ, রয়েছে অচলা ভক্তি।
হিতোপদেশঃ
এই গল্পটি থেকে শিক্ষা লাভ করি যে, ভগবানের কার্যকলাপ নিয়ে কখনও কোন সন্দেহ করা উচিত নয়। কেননা ভগবান সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। তিনি ইচ্ছে করলেই যে কোন কিছুই করতে পারেন, যা আমাদের জড় জাগতিক মানুষের কাছে বোধগম্য হয় না। আমরা সীমাবদ্ধ। কিন্তু ভগবান সীমাবদ্ধ নন।
তিনি অসমর্দ্ধো। অর্থাৎ কেউ তার সমান হতে পারে না। আমাদের কাছে ভগবানের কার্যকলাপসমূহ অচিন্তনীয়। ঠিক যেমন বটগাছের ফলের মধ্যে অসংখ্য বটগাছ নিহিত আছে, তেমনি ভগবানের প্রতি আমাদের ঐকান্তিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার মধ্যে রয়েছে ভগবানের অপার করুণাময় কৃপা, যা লাভ করলে আমাদের আর কিছুই চাওয়ার থাকে না।
তাই যাঁরা ভক্ত, তারা সবসময়ই ভগবানের সকল ধরনের কার্যকলাপকে সম্ভব বলে মনে করেন। কিন্তু যারা প্রকৃত ভক্ত নয়, তারা এই জাগতিক সীমাবদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে ভগবানকে বিচার করার চেষ্টা করে, তাঁর বিভিন্ন কার্যকলাপকে ‘অসম্ভব’ বরে সন্দেহ করে।

Post a Comment

0 Comments