বণিকের চার স্ত্রী (গল্পে উপদেশ)

আসলে আমাদের সকলের জীবনেই এইরকম চার স্ত্রী আছে





একসময় খুব ধনী এক বণিক ছিলো। সে সারাজীবন বহু ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা অর্জন করেছে। তার কোনকিছুরই অভাব ছিলোনা। তার চারজন স্ত্রী ছিল, কিন্তু সকল স্ত্রীকে সে সমানভাবে ভালোবাসতো না। সে ৪র্থ স্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতো। এই স্ত্রীকে সে দামী পোশাক, গয়না-অলংকার দিয়ে সজ্জিত করতো এবং সবসময় শুধুমাত্র তার সুখভোগের কথাই ভাবতো। যদিও ৩য় স্ত্রীকে নিয়েও সে সবার কাছে গর্ব করতো কারণ ৩য় স্ত্রী ছিলো তার কাছে এক মহা অহংকারের বস্তু। সময় পেলে সে ২য় স্ত্রীকেও সময় দিতো, কোন বিপদে আপদে পরামর্শ করতো। প্রকৃতপক্ষে, ২য় স্ত্রীকেও সে ভালোবাসতো। পক্ষান্তরে, ১ম স্ত্রীকে সে মোটেই খেয়াল করতো না, তার যত্ন নিতো না; তাকে ঠিকমতো ভরণপোষণ দিতো না। কাজেই অযত্ন-অবহেলায় ১ম স্ত্রী একেবারে শুকিয়ে গেলো, দু্র্বল হয়ে অতি কষ্ট পেতে থাকলো। তার দুঃখের সীমা ছিলোনা।
একবার, বণিক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লো। সে মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পারলো। তাই তার ভিতর চিন্তা এলো যে সে এতোদিন সবার সাথে বিলাস-বৈভবে জীবন কাটিয়েছে। সবার সেবা যত্ন সে পেয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর পর সে একা থাকবে কি করে? কে থাকবে তার পাশে? এসব ভাবতে ভাবতে সে ঠিক করলো যে সে ৪র্থ স্ত্রীকে নিয়েই মৃত্যুর পর থাকবে। যেহেতু সারাজীবন এই স্ত্রীর জন্য সে অনেক কিছু করেছে, তার এই স্ত্রী পরকালে সাথে গেলে বেশ আনন্দে কাল যাপন করতে পারবে। তাই, সে ৪র্থ স্ত্রীর কাছে গিয়ে আর্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, "হে আমার প্রিয়তমা, আমি আর মনে হয় বেশিদিন বাঁচবোনা। এই জগতে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিলে তুমি। তোমাকে কতই না ভালোবেসেছি জীবনভর! তোমাকে সর্বপ্রকারে সুখী করার চেষ্টা করেছি। তাই, আমি মৃত্যুর পর তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাই। তুমি নিশ্চয়ই আমার সাথে যাবে এ আমার বিশ্বাস।" তার কথা শেষ হলে ৪র্থ স্ত্রী বললো, "শোন প্রিয়, তুমি কেবল আমার জগতের সাথী। তোমার মৃত্যুর পর তোমার সাথে যাওয়া আমার ধর্ম নয়।"
এই কথা শুনে বণিক খুব মর্মাহত হলো। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। যাহোক, সে এই একই প্রস্তাব নিয়ে তার ৩য় স্ত্রীর কাছে গেলো। সে সব কথা শেষ করলে তার ৩য় স্ত্রী আরো খারাপ উত্তর দিলো। ৩য় স্ত্রী বললো, "আমি তোমাকে জগতে শক্তি সাহস জোগিয়েছি ঠিকই, কিন্তু আমি তোমার মৃত্যুর পর তোমার সাথে যেতে পারবো না। আমার এখনো যৌবন আছে। সবাই আমাকে পছন্দ করবে। তাই তুমি মৃত্যুবরণ করলে আমি উপযুক্ত পাত্র দেখে আরেকটা বিয়ে করবো। আমি তোমার সাথে যাবো না।"
এই কথার পর বণিকের মন একেবারে দমে গেলো। সে কোন উপায় না পেয়ে তার ২য় স্ত্রীর কাছে গিয়ে একই প্রস্তাব করলো। ২য় স্ত্রী খুব সহানুভূতিশীল ছিলো। সে বিনয়ের সাথে বললো, " আমি তোমার প্রতি সারাজীবন বিশ্বস্ত ছিলাম এবং তোমার বিপদে সঙ্গ দিয়েছি। কিন্তু তোমার মৃত্যুর পর তোমার পাশে থাকার সাধ্য আমার নেই। আমি বড়জোড় শ্মাশান পর্যন্ত তোমাকে নিয়ে যেতে পারি। "
এসব কথা শুনে বণিক আশাহীন হয়ে বিমর্ষ হয়ে গেলো। তার চোখদিয়ে অঝোরে জল এলো। তার মনে কোন সাহস ছিলোনা যে ১ম স্ত্রীর কাছে যাবে। কারণ, সারাজীবন কোন খেয়ালইতো তার রাখেনি! একটুও ভালোবাসেনি। কিন্তু পাশের ঘরের এককোণ বসে ছিলো তার ১ম স্ত্রী। সে না খেতে পেয়ে বেশ জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ বণিকের কানে একটি কণ্ঠস্বর এলো। কণ্ঠটি বললো, "আমি যাবো তোমার সাথে। জীবনে মরণে আমি যে তোমার সাথী! আমি তোমার অনন্তকালের বন্ধু।" এই কথা শোনার পর বণিক অত্যন্ত অনুতপ্ত হলো। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে গেলো। দুচোখ বেয়ে অশ্রুপাত হতে লাগলো।
গল্পের তাৎপর্য ও উপদেশ

আসলে আমাদের সকলের জীবনেই এইরকম চার স্ত্রী আছে।
৪র্থ স্ত্রী হলো আমাদের দেহ, যাকে আমরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। যেটাকে সবসময় নানা দ্রব্য দ্বারা তৃপ্ত করতে চেষ্টা করি। কিন্তু মৃত্যুর পর (সাথে সাথেই) এই দেহ আমাদের সঙ্গ দেয়না।
৩য় স্ত্রী হলো আমাদের টাকাপয়সা, ধনসম্পদ ইত্যাদি, যা মৃত্যুর পর অন্য কারো হয়ে যায়।
২য় স্ত্রী হলো আমাদের স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন। যারা মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত সঙ্গ দেয়।
আর প্রথম স্ত্রী আর কেউ নয়, আমাদের আত্মা। যা মৃত্যুর পরও সাথে থাকে। কিন্তু আমরা আত্মতত্ত্বের যত্ন না নিয়ে অনেক অবহেলা করি। কখনো আত্মাকে আপন সত্তা বা স্বরূপ ভাবিনা।
তাই সকলের উচিত আত্মতত্ত্বের সন্ধানে ব্রতী হওয়া, আত্মজ্ঞান লাভ করা। নয়তো সবকিছুই বৃথা।

Post a Comment

0 Comments