বৈষ্ণব ধর্মের ঐতিহ্যের ইতিহাস---------
"আমাদের আলোচনার শিরোনাম হল বৈষ্ণব ধর্মের ঐতিহ্যের ইতিহাস। অর্থাৎ বৈষ্ণব ধর্মের যে পরম্পরাগত ইতিহাস রয়েছে সেই পরম্পরা বা ঐতিহ্যটি কি সেটি আমরা জানার চেষ্টা করব।
সমস্ত ধর্ম আচরণের মধ্যে ভক্তিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। আবার ভক্তির মধ্যে শুদ্ধভক্তিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। শুদ্ধভক্তির মধ্যেও প্রেমভক্তি শ্রেষ্ঠ। ভক্তিপথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রদর্শিত যে প্রেমভক্তি সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। মহাপ্রভু সেই প্রেমভক্তি দয়া করে আমাদের প্রদান করেছেন। ধর্মের পথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সেই দানটি কেন সর্বশ্রেষ্ঠ সেটি আমাদের বিচার করতে হবে। এইজন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে–
চৈতন্যচন্দ্রের দয়া করহ বিচার।
বিচার করিলে চিত্তে পাবে চমৎকার ॥
এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সেই চমৎকার পন্থাটি বা শিক্ষাটি হচ্ছে–
আরাধ্যো ভগবান্ ব্রজেশতনয়স্তদ্ধাম বৃন্দাবনং।
রম্যা কাচিদুপাসনা ব্রজবধূবর্গেণ যা কল্পিতা ॥
শ্রীমদ্ভাগবতং প্রমাণমমলং প্রেমা পুমর্থো মহান্।
শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভোর্মতমিদং তত্রাদরঃ ন পরঃ ॥ (চৈতন্যমত্তমঞ্জুষা)
আরাধ্য ভগবান হচ্ছেন ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর ধাম হল বৃন্দাবন। ব্রজবধু ব্রজগোপিকারা যে ভাবে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেছিলেন সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। সমস্ত পুরুষার্থ বা সিদ্ধির চরম সিদ্ধি হচ্ছে কৃষ্ণপ্রেম। আর তার প্রমাণ হচ্ছে অমল পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবত। এটিই হচ্ছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মত। আমাদের সাদরে সেটিই গ্রহণ করা উচিত। আর কোনো কিছু গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। এই পথে এগোনোর সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হল–
শুদ্ধভকত-চরণরেণু ভজন-অনুকূল। (শরণাগতি, ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)
ইতিহাস মানে হচ্ছে ধারাবাহিক বিবরণ। অর্থাৎ কালক্রমে যা ঘটেছে তার বিবরণ। ইতিহাস আর পুরাণের মধ্যে পার্থক্য কি? ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে হয় বা ক্রমপর্যায়ে তার বিবরণ হয়। কিন্তু পুরাণ বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন জায়গার ঘটনা। যেমন সত্যযুগের কোনো ঘটনা, তার পরেই কলিযুগের কোনো ঘটনা হতে পারে। তবে সেই ঘটনাগুলি ভগবান এবং তার ভক্তের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত।
আমরা বৈষ্ণব ঐতিহ্যের ইতিহাস নিয়ে যখন আলোচনা করব তখন মনে রাখতে হবে যে ইতিহাস মানে ক্রমে ক্রমে বা কালক্রমে যা ঘটে তার বিবরণ। সেই অনুসারে আমরা যখন বিচার করতে যাই তখন দেখতে পাই যে সৃষ্টির শুরু থেকেই এই বৈষ্ণবধর্ম বিদ্যমান। এই জ্ঞানটি ভগবান কৃষ্ণ সৃষ্টির শুরুতেই প্রথমে ব্রহ্মাকে দান করলেন। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সৃষ্টির শুরুতেই বৈষ্ণব ধর্মের সৃষ্টি হল। কৃষ্ণ প্রথমে ব্রহ্মাকে যে তত্ত্বটি দান করলেন সেটা বৈষ্ণব তত্ত্ব। আর ব্রহ্মার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বলেই ব্রহ্মা হলেন আমাদের আদি গুরু। আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, এই বৈষ্ণবধর্ম কেবল ব্রহ্মার মধ্য দিয়েই শুরু হয়নি। এই বৈষ্ণবধর্ম অনাদি। এই জগৎ সৃষ্টির আগেও এই ধর্ম বর্তমান ছিল। চিৎ-জগতে সকলেই বৈষ্ণব, তাহলে দেখতে পাই এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বেও বৈষ্ণবধর্ম ছিল। এই জগৎ সৃষ্টি কিভাবে হল? ভগবান অর্থাৎ গর্ভোদকশায়ী শ্রীবিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে একটা পদ্ম উদ্ভুত হয়, সেই পদ্মে রয়েছেন ব্রহ্মা এবং সেই ব্রহ্মা থেকেই এই জগতের সৃষ্টি হল।
এইভাবে প্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ডে রয়েছেন এক একজন গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু এবং তাঁর নাভিপদ্ম থেকে এক-একজন করে ব্রহ্মার সৃষ্টি হয়েছে। আবার কারণসমুদ্রে শায়িত আছেন কারণোদকশায়ী বিষ্ণু বা মহাবিষ্ণু। তাঁর নিঃশ্বাসের ফলে যে বুদবুদের সৃষ্টি হচ্ছে, সেই এক একটি বুদবুদ হল এক-একটি ব্রহ্মান্ড এবং সেই প্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ডে ভগবান প্রবেশ করে তাঁর স্বেদবারির দ্বারা নির্গত জলে ব্রহ্মান্ডের অর্ধেকটা পূর্ণ করে সেই জলের উপর তিনি শয়ণ করলেন, তাই তার নাম হল গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু।
গর্ভ-উদক, উদক মানে হল জল। সেই গর্ভ-উদকের জলে শয়ণ করে আছেন বলেই তিনি গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু। সেই বিষ্ণুর নাভি থেকেই একটি পদ্ম উদ্ভুত হল। সেই পদ্মের কোরকে বসে আছেন ব্রহ্মা এবং সেই ব্রহ্মা থেকেই সমস্ত জগতে জীবের সৃষ্টি হল। এইভাবে ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি হয়েছে। ব্রহ্মা সবকিছুর সৃষ্টি কার্য সাধিত করেন এবং এই ব্রহ্মাকে সৃষ্টির আদিতে স্বয়ং ভগবান দিব্যজ্ঞান দান করেছিলেন।
তেনে ব্রহ্ম হৃদা য আদিকবয়ে মুহ্যন্তি যৎসূরয়ঃ। (ভাগবত ১/১)
এই দিব্যজ্ঞান হল বৈষ্ণব হওয়ার জ্ঞান। বৈষ্ণব শব্দের মূল হলেন বিষ্ণু। এই বিষ্ণুর যারা সেবক বা ভক্ত, তারাই হলেন বৈষ্ণব। অতএব সৃষ্টির আদিতেই বৈষ্ণব ধর্মের উদ্ভব হল। আর প্রথম বৈষ্ণব হলেন ব্রহ্মা, তাঁর থেকে প্রথম প্রজাপতিদের এবং কুমারদের সৃষ্টি হল। তারপরে নারদমুনি, এই নারদমুনি হলেন শুদ্ধ বৈষ্ণব এবং সমস্ত জীবের গুরুদেব। জীবকে বিষ্ণুভক্তি দান করেন বলেই তিনি হচ্ছেন না-র-দ। এইভাবে নারদমুনির কৃপাতেই সমস্ত জীব বৈষ্ণব হওয়ার শিক্ষা লাভ করেছেন। আমরা তাই দেখতে পাই শ্রীমদ্ভাগবতে প্রায় সকলেই নারদমুনির সান্নিধ্যে এসেই বিষ্ণুভক্তি লাভ করেছেন। যেমন প্রহ্লাদ মহারাজ, ধ্রুব মহারাজ, মৃগারি সবাই নারদমুনির কাছ থেকে বিষ্ণুভক্তি লাভ করেন। নারদমুনি যে বিষ্ণুভক্তি দান করেন, সেট হচ্ছে শুদ্ধ বৈষ্ণব ধর্ম। ভক্তি আবার অনেক রকমের হয়।
সেগুলি সাধারণত তিনটি পর্যায়ে পড়ে–১) কর্মমিশ্রা ভক্তি, ২) জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি এবং ৩) শুদ্ধভক্তি।
১) যতক্ষণ পর্যন্ত কর্মের প্রতি আসক্তি আছে ততক্ষণ পর্যন্ত হল কর্মমিশ্রা ভক্তি। এবং শুদ্ধভক্তির লক্ষণ হল–
অন্যাভিলাষিতাশূন্যং জ্ঞানকর্মাদ্যনবৃতম্।
আনুকূল্যেন কৃষ্ণানুশীলনং ভক্তিরুত্তমা ॥
(ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ১/১/১১)
এই উত্তম ভক্তিটি হল অন্য অভিলাষ শূণ্য। অন্য অভিলাষ মানে জড় জগৎকে ভোগ করার বাসনা এবং জড় জগৎকে ত্যাগ করার বাসনা। ভোগ এবং ত্যাগ এই দুটি বাসনার থেকে মুক্ত হতে হবে। তবে যেখানে কৃষ্ণসেবা ব্যতীত অন্য কিছু অভিলাষ আছে। যেমন কৃষ্ণের শরণাগত হয়ে কৃষ্ণের আনুগত্য মানা হল কিন্তু তবুও জড় সুখভোগের বা ইন্দ্রিয় তৃপ্তির বাসনা রয়েছে, তাহলে সেটি হল কর্মমিশ্রা ভক্তি। এই কর্মমিশ্রা ভক্তির স্তরে রয়েছেন স্বর্গের দেবতারা, আর কর্মী হল যারা ভগবানকে মানে না। তারা শুধু জড় জগৎকে ভোগ করতে চায়। তারা ভক্ত নয়, আর কর্মমিশ্রা ভক্ত হল–যারা ভগবানকে মানছে এবং জড় জগৎকে ভোগ করার বাসনাও রয়েছে এই স্তরের ভক্তরা হল কনিষ্ট স্তরের ভক্ত। যেমন দেবতারা নারায়ণকে মানে কিন্তু আবার ভোগ করেও চলেছে। কিন্তু তবুও যখন অসুরদের দ্বারা দেবতারা বিপদে পড়ে তখন ভগবান তাদের রক্ষা করার জন্য আবির্ভূত হন। এমন কি ইন্দ্রের ছোট ভাই হিসেবেও ভগবান বামনদেবরূপে এসে তাদের রক্ষা করেছেন। কিন্তু তবুও তাদের ভোগবাসনা রয়ে গেছে। তারা স্বর্গসুখ ভোগ করতে চায়। তাই তারা ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও শুদ্ধভক্ত নয়। তারা কর্মমিশ্রা ভক্ত আর যারা এই জড় জগতের ভোগবসনা ত্যাগ করে মুক্ত হতে চায় তার হচ্ছে জ্ঞানী এবং যে সমস্ত ভক্তের এই মুক্ত হওয়ার বাসনা রয়েছে তারাও শুদ্ধ ভক্ত নয় এদিক থেকে বিচার করে দেখলে দেখা যায় অনেক বৈষ্ণবেরাও এই জ্ঞানমিশ্রা ভক্ত। যেমন মহাপ্রভু যখন উত্তরপ্রদেশে গিয়েছিলেন মধ্বাচার্যের যারা অনুগামী তত্ত্ববাদী তাদের সঙ্গে তাঁর যে আলোচনা হয়, তাতে তাদের বক্তব্য হল মুক্তিই হল ভক্তির একমাত্র লক্ষণ। এই মুক্তি মানে কৈবল্য বা সাযুজ্য মুক্তি নয়। তারা সামীপ্য, সারুপ্য, সালোক্য এবং সার্ষ্টি এই চার রকমের মুক্তি কামনা করে বৈকুন্ঠে ভগবানের কাছে ফিরে যেতে চায়। মহাপ্রভু সেই তত্ত্ববাদীদের যিনি আচার্য বা মহান্ত তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন–শাস্ত্রে বলা হচ্ছে ভক্তকে মুক্তি দেওয়া হলেও সে মুক্তি চায় না। ভগবান কপিলদেব বলেছেন যে–
সালোক্যসার্ষ্টিসামীপ্যসারূপ্যৈকত্বমপ্যুত।
দীয়মানং ন গৃহ্নন্তি বিনা মৎসেবনং জনাঃ ॥
(ভাগবত ৩/২৯/১৩)
অর্থাৎ তাদের মুক্তি দেওয়া হলেও তারা তা গ্রহণ করতে চায় না। তাহলে ভক্তকে ভগবানের সেবা ছাড়া যে কোন মুক্তি দিলেও সে যদি তা গ্রহণ না করে তাহলে সেই মুক্তি কেন আমাদের লক্ষ্য হবে?
মহাপ্রভু দ্বিতীয় শ্লোকে বলেন–
মুক্তি স্বয়ং মুকুলিতাঞ্জলি সেবতেহস্মান্।
ধর্মার্থকামগতয়ঃ সময়প্রতীক্ষাঃ ॥
(শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত ১০৭ শ্লোক)
মুক্তিদেবী মুকুলতাঞ্জলি হয়ে ভক্তের কাছে প্রার্থনা করে তাকে যেন সেবা করার সুযোগ দান করা হয়।
তাহলে এখানে মুক্তিদেবী করোজোড়ে যদি ভক্তের কাছে প্রার্থনা করে যে আমাকে সেবা করার সুযোগ দান করুন, তাহলে ভক্ত হয়ে সেই মুক্তি কেন গ্রহণ করবেন? মহাপ্রভু তাদের বোঝালেন তোমরা ভক্তির মাধ্যমে মুক্তির আকাক্সক্ষা করছো, এটা প্রকৃতপক্ষে ভক্তির লক্ষন নয়। তাহলে ভক্তির উদ্দেশ্য কি? ভক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রেম।
ভগবানের প্রতি প্রেম অর্জন করাই হচ্ছে ভক্তির একমাত্র উদ্দেশ্য এবং সেই প্রেমভক্তি হচ্ছে শুদ্ধভক্তির চরম স্তর। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভক্তি তিন রকমের। যথা কর্মমিশ্রা, জ্ঞানমিশ্রা ও শুদ্ধভক্তি এবং এই শুদ্ধভক্তির চরম স্তরই হল প্রেমভক্তি। এই প্রেমভক্তি দান করতেই মহাপ্রভু এসেছেন। প্রেমভক্তি লাভের উপায় হচ্ছে শুদ্ধ চিত্তে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন করা।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥
এই শুদ্ধভক্তি অত্যন্ত অপূর্ব বস্তু এবং এই শুদ্ধভক্তি যে কোন ব্যক্তি লাভ করতে পারে।
যেই ভজে সেই বড় অভক্তহীন ছার।
কৃষ্ণভজনে নাহি জাতিকুলাদি বিচার ॥
(চৈঃ চঃ অন্ত ৪/৬৭)
এখানে বলা হচ্ছে–যেই ভজে সেই বড়। এখানে কোন রকম উপাধির বিচার নেই।
সর্বোপাধিবিনির্মুক্তং তৎপরত্বেন নির্মলম্।
হৃষীকেণ হৃষীকেশ-সেবনং ভক্তিরুচ্যতে ॥
(নারদ পঞ্চরাত্র)
সেটি সমস্ত উপাধি-মুক্ত। মহাপ্রভু সেই সম্বন্ধে বলেছেন যে–
নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো
নাহং বর্ণী ন চ গৃহপতির্নো বনস্থো যতির্বা।
কিন্তু প্রোদ্যন্নিখিলপরমানন্দপূর্ণামৃতাব্ধে-
র্গোপীভর্তুঃ পদকমলয়োর্দাসদাসানুদাসঃ ॥ (পদ্মাবলী ৭৪)
আমি ব্রাহ্মণ নই, ক্ষত্রিয় রাজা নই, বৈশ্য বা শুদ্র নই, ব্রহ্মচারী নই, গৃহস্থ নই, বানপ্রস্থ নই, সন্ন্যাসীও নই। আমার একমাত্র পরিচয় হচ্ছে গোপীভর্তা যে কৃষ্ণ, সেই গোপীজনবল্লভ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের দাসের অনুদাসের দাস। আর সেটিই হল বৈষ্ণবের প্রকৃত পরিচয়।
কিবা বিপ্র, কিবা ন্যাসী, শুদ্র কেনে নয়।
যেই কৃষ্ণ তত্তববেত্ত্বা সেই গুরু হয় ॥
চৈঃ চঃ মধ্য ৮/১২৮)
এই যে শুদ্ধ বৈষ্ণবের দৃষ্টান্তগুলি তার মধ্যে একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত নিয়ে এখন আলোচনা করা হবে।
বৃত্রাসুর আপাতদৃষ্টিতে একটা অসুর হলেও তিনি ছিলেন এক মহান বৈষ্ণব। তাহলে দেখা যাচ্ছে অসুরও বৈষ্ণব হতে পারে। অসুরও যদি বৈষ্ণব হয় তাহলে তিনি আমাদের প্রনম্য। বৃত্রাসুর পূর্বজন্মে ছিলেন চিত্রকেতু। চিত্রকেতু সারা পৃথিবীর রাজা। লক্ষ লক্ষ তাঁর মহিষী কিন্তু একটিও পুত্র নেই। ভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে তার প্রতিটি স্ত্রী ছিল বন্ধ্যা। পুত্রহীন হওয়ায় যেহেতু তার কোন উত্তরাধিকারী ছিল না, তাই চিত্রকেতু দুঃখে অত্যন্ত মুহ্যমান ছিলেন। এমতাবস্থায় একদিন অঙ্গিরা ঋষি এলেন এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চিত্রকেতু মহারাজ, আপনি কেমন আছেন? মহারাজ বললেন–আমার সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আমি পুত্রহীন। তাই আমার মনে কোন সুখ নেই। তখন অঙ্গিরা ঋষি বললেন–ঠিক আছে আমি একটি যজ্ঞ করব। সেই যজ্ঞের ফলে তুমি একটি পুত্র সন্তান লাভ কবে, কিন্তু সেই পুত্র তোমার সুখ এবং দুঃখ দুইয়েরই কারণ হবে। তখন চিত্রকেতু ভাবলেন যে আমার যদি একটি পুত্র সন্তান হয় তবে অত্যন্ত সুখের কথা, তা নিয়ে একটু দুঃখ এলেও তখন মেনে নেওয়া যাবে। যথাসময়ে তার মহিষী কৃতদ্যুতির গর্ভে পুত্র সন্তান হল। তারফলে রাজা সর্বক্ষণ তার মহিষী কৃতদ্যুতি ও পুত্রকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। এতে তাঁর অন্য মহিষীরা খুব ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা সেই সন্তানকে বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলে। রাজা অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে ক্রন্দন করতে থাকেন। তখন নারদ মুনি অঙ্গিরা ঋষির সঙ্গে ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত হন। তখন রাজা অত্যন্ত কাতরভাবে নারদ মুনির কাছে প্রার্থনা করেন যে এখন ‘আমার এই পুত্রটিকে পুনর্জীবিত করুন।’ নারদমুনি তখন রাজার অনুরোধে পুত্রটিকে পুনর্জীবিত করে তাকে জিজ্ঞাসা কারলেন–তুমি কেন তোমার পিতা-মাতাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ? তারা তোমার জন্য কত কষ্ট পাচ্ছে। তখন সেই পুত্রটি বলল–আমি বহুজন্ম এখানে এসেছি। কোন জন্মে মানুষ হয়েছি, কোন জন্মে পশু হয়েছি, কোন জন্মে পাখি হয়েছি। আপনি কোন জন্মের পিতা-মাতার কথা বলছেন? এইভাবে চিত্রকেতু তখন বুঝতে পারলেন যে, এই জীবন কত অনিত্য, এই দেহটি নশ্বর, এবং জীব সর্বক্ষণ একদেহ থেকে আরেক দেহে দেহান্তরিত হয়। এইভাবে চিত্রকেতুর প্রাথমিক জ্ঞান লাভ হল এবং তখন নারদমুনি চিত্রকেতুকে বিষ্ণুমন্ত্র দান করলেন। সেই মন্ত্র জপ করার ফলে চিত্রকেতু ভগবানের কৃপা লাভ করলেন। তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম শুদ্ধভক্ত নারদমুনির কৃপাতে চিত্রকেতু ভক্ত হলেন। এইভাবে ভক্তের কৃপাতেই ভক্তি লাভ করা যায়। তাই ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেছেন–
শুদ্ধভক্ত চরণরেণু ভজন অনুকূল।
এইভাবে চিত্রকেতু কৃষ্ণ নাম জপ করার ফলে ভক্ত হলেও তার কিছু জড়-জাগতিক কাম-বাসনা ছিল। ফলে তার এই মন্ত্রের প্রভাবে সাতদিনের মধ্যেই তিনি বিদ্যাধরদের রাজা হলেন। গন্ধর্ব-বিদ্যাধরেরা হলেন দেবতা, তারা উচ্চস্তরের জীব। তাদের রাজা হয়ে চিত্রকেতু তার মহিষীদের নিয়ে ব্রহ্মান্ডে ভ্রমণ করেছিলেন। একদিন দেখলেন, শিব পার্বতীকে কোলে করে বসে আছেন কৈলাসে এবং তাঁর চারপাশে সমস্ত মুনি ঋষিরা বসে আছেন, তা দেখে চিত্রকেতু খারাপ মন্তব্য করলেন যে, এ কি রকম আচরণ! মহাদেব এত মহান উন্নত স্তরের জীব, অথচ তিনি এই সাধু সমাবেশে তাঁর পত্নীকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। এইভাবে শিবের সমালোচনা করার ফলেই পার্বতী চিত্রকেতুকে অভিশাপ দিলেন, তুমি অসুর যোনি প্রাপ্ত হবে।
এই সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, চিত্রকেতু যদিও পার্বতীকে অভিশাপ দিতে পারতেন, অভিশাপের প্রতি অভিশাপ দিতে পারলেও চিত্রকেতু তা করেন নি। এইটি হল বৈষ্ণবের লক্ষণ। বৈষ্ণব সর্বদাই সবকিছুই ভগবানের কৃপারূপে গ্রহণ করে নেন। বৈষ্ণব কোন কিছুর প্রতিবাদ করেন না। চিত্রকেতুও প্রতিবাদ করলেন না। মাথা পেতে অভিশাপ অঙ্গীকার করে চিত্রকেতু সেখান থেকে চলে গেলেন। পরবর্তীকালে পার্বতীর অভিশাপের ফলে চিত্রকেতু বৃত্রাসুর রূপে জন্মগ্রহন করলেন। তিনি এতই প্রভাবশালী বা বীর্যবান ছিলেন যে তিনি স্বর্গরাজ্যও অধিকার করে নিলেন। দেবতাদের পরাস্ত করে ত্রিভুবন জয় করলেন। দেবতারা পর্যন্ত তাঁর কাছে হেরে গেলেন। এমনই বৈষ্ণবের ক্ষমতা। বৈষ্ণবের শক্তি সমস্ত শক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠশক্তি। দেবতাদের রাজা ইন্দ্র পর্যন্ত পরাজিত হলেন এবং কিভাবে বৃত্রাসুরকে বধ করে পুনরায় ইন্দ্র তাঁর রাজ্য ফিরে পেতে পারেন সেই উপদেশ প্রাপ্ত হলেন। জানা গেল যে, দধীচি মুনির কাছ থেকে যদি তাঁর অস্থি পাওয়া যায় অর্থাৎ দধীচি মুনির দেহের হাড়গুলি দিয়ে যদি একটা বজ্র তৈরী করা যায়, তবে সেই বজ্র দিয়েই বৃত্রাসুরকে বধ করা যাবে। তখন দেবতাদের সঙ্গে ইন্দ্র গেলেন দধীচি মুনির কাছে। দধীচি মুনি সব কথা শুনে তাঁর দেহস্থ অস্থি দিয়ে বজ্র তৈরী করতে সম্মত হলেন। এখানে আমরা আরেকটি মহান দৃষ্টান্ত দেখতে পাচ্ছি, যাঁরা ভগবৎ ভক্ত, তাঁরাই এরকম ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন। দধীচি বললেন–ঠিক আছে, এই দেহটি নশ্বর, আজকে না হোক কালকে, নয়তো একশত বৎসর পরে নষ্ট হবে। সুতরাং, দেহটি দিয়ে যদি কোনও ভাল কাজ হতে পারে তবে তাই হোক। এই বলে তিনি তাঁর দেহটি দান করলেন। তার অস্থি দিয়ে বজ্র তৈরী হল এবং তা দিয়ে ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে সংহার করলেন। আমরা দেখতে পাই বৃত্রাসুর যদিও জানতে পারলেন যে, তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু তবুও তিনি একটুকুও ভয়ে ভীত হননি। অথচ কি সুন্দরভাবে ঐ সময় ভগবানের মহিমা কীর্তন করে যাচ্ছেন। তিনি বললেন, ভগবান যেটা করবেন সেটা হবেই। ভগবান যদি ইন্দ্রকে রাজা বানান এবং তার ফলে যদি আমার মৃত্যু হয় তা হোক, ভগবানের বিধান আমি মেনে নেবো, এবং ভগবানের চরণাশ্রয় করেই আমি সবসময় থাকবো। এইভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি ভগবানের যিনি ভক্ত তিনি যেকোন অবস্থাতেই থাকুক না কেন, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। একজন অসুর পর্যন্তও ভগবানের শুদ্ধভক্ত হতে পারেন। এখানে আমরা দেখছি একদিকে বৃত্রাসুর অপরদিকে ইন্দ্র। এই দুইজনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন বৃত্রাসুর। ইন্দ্র তার নিজের সুখ ভোগের জন্য অন্যকে তা দেহটি পর্যন্ত ত্যাগ করতে বলছে। এটাই হল কর্মমিশ্রা ভক্তের দৃষ্টান্ত।
কামমিশ্রা ভক্তরা নিজেদের সুখভোগের জন্য সবকিছু করতে পারে। তাদের চিন্তাধারা হল, ঠিক আছে দধীচি মুনি দিয়ে দিক জীবনটা, কিন্তু আমি তো সুখভোগ করব। কিন্তু যে শুদ্ধভক্ত সে কোন কিছুর পরোয়া করে না। সেইটি হচ্ছে বৃত্রাসুরের মাহাত্মা। এমনি হচ্ছে শুদ্ধ ভক্তের প্রভাব এবং মহিমা। আমরা যে পথটি অবলম্বন করছি সেইটি হচ্ছে দৃষ্টান্ত।
ভক্ত সর্বদা গুরুত্ব দেন কৃষ্ণের ইচ্ছার উপর। তিনি যদি আমার দেহটা চান তবে আমি তা দিয়ে দেবো। শুদ্ধভক্ত সর্বদা সেটাকে ভগবানের কৃপা এবং আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। বৃত্রাসুর অসুর হলেও দেহের প্রতি তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি ভাবলেন যদি আমি অসুর যোনিও লাভ করি তাতে তো ক্ষতি নেই, কিন্তু যেন কৃষ্ণকে কখনও না ভুলে যাই। এইটি হচ্ছে ভক্তের একমাত্র কামনা।
অসুর শব্দের দুইটি অর্থ, একটি হচ্ছে যারা ভগবৎ বিদ্বেষী। দ্বিতীয়টি হল দেবতাদের যারা বিরোধী। কিন্তু তিনি ভগবৎ বিদ্বেষী নাও হতে পারেন। সুরদের অর্থাৎ দেবতাদের বিরোধী বলেই তিনি অসুর।
জ্ঞানমিশ্রা ভক্তের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। যেমন ভীষ্মদেব এবং কুমাররাও একটা স্তরে জ্ঞানমিশ্রা ভক্ত। জ্ঞানমিশ্রা ভক্তরা সবসময় যে জ্ঞানমিশ্রা ভক্ত তা নয়। একটা স্তরে তারা জ্ঞানমিশ্রাভক্ত। তার পরে তারা শুদ্ধভক্তের স্তরে আসতে পারে। যারা মুক্তি কামনা করে তারা জ্ঞানমিশ্রা ভক্ত। ভীষ্মদেব জ্ঞান-মিশ্রা ভক্ত হওয়ার কারণ তিনি শাস্ত্রের নীতির উপর বেশি জোর দিয়েছেন। কৃষ্ণভক্তির কাছে তাদের ন্যায়নীতিটা বড় বলে প্রতিপন্ন হয়। এখানে ভীষ্মদেব পান্ডবদের পক্ষ অবলম্বন করছেন না কেন? তার কারণ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হচ্ছে যার অন্ন খাবে তার পক্ষ অবলম্বন করা। যেহেতু তিনি দুর্যোধনের অন্ন খেয়েছেন, তাই তিনি দুর্যোধনের পক্ষ অবলম্বন করেছেন। কিন্তু অন্তিম সময়ে আবার শুদ্ধভক্তের পন্থা অবলম্বন করেছেন। তার দৃষ্টান্ত হল–ভীষ্মদেব যখন যুধিষ্ঠির মহারাজকে তাঁর শরশয্যা অবস্থায় উপদেশ দিচ্ছিলেন তখন দ্রোপদী মুচকি হাসলেন। তার মুখের হাসি দেখে ভীষ্মদেব জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি হাসলে কেন? তখন দ্রোপদী বললেন, যে যখন কৌরবরা আমায় অপমানিত করেছিল, তখন আপনার এই উপদেশ ও তত্ত্বজ্ঞান কোথায় ছিল? তখন ভীষ্মদেব বললেন, সেই সময় যেহেতু আমি দুর্যোধনের অন্ন খেয়েছিলাম তাই আমার চিন্তাধারা দূষিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই শরশয্যায় শয়নের ফলেই আমার শরীর থেকে সেই সমস্ত দূষিত রক্ত বের হয়ে গেছে। সেইজন্য এখন আমি সেই চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে গেছি। অর্থাৎ ভীষ্মদেব আগে জ্ঞানমিশ্রা ভক্তের স্তরে ছিলেন। পরে শুদ্ধভক্তের স্তরে উন্নীত হয়েছেন।
0 Comments