শ্রীজগন্নাথের আবির্ভাবের সপ্তম শতকের ইতিহাস...

শ্রীজগন্নাথের আবির্ভাবের সপ্তম শতকের ইতিহাস...



সীমন্তদ্বীপে শ্রীজগন্নাথের সঙ্গে নীলাচলনাথের কোন পার্থক্য নেই, উভয়ে অভিন্ন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ঐতিহাসিক তথ্য সহকারে এই সত্য তাঁর নবদ্বীপ ধাম মাহাত্ম্য গ্রন্থে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই গ্রন্থে নিম্নোক্ত কাহিনী উল্লেখ হয়েছেঃ

সপ্তম শতাব্দীতে উড়িষ্যা প্রদেশে রক্তবাহু নামে এক যবন রাজার আবির্ভাব হয়। এই রক্তবাহু ছিল অত্যন্ত পাপপরায়ণ, অধার্মিক ও সেই সাথে অনেক মন্দির সহ বহু পবিত্র বিগ্রহ ধ্বংস করেছিল এবং উড়িষ্যার ধার্মিক জনগনের হৃদয়ে ত্রাস সঞ্চার করেছিল। যখন পুরীতে শ্রীজগন্নাথের ভক্তগণ রক্তবাহুর আসুরিকতা ও ধ্বংসকীর্তির কথা অবগত হলেন, তখন তাঁরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। তৎক্ষণাৎ তাঁরা শ্রীজগন্নাথের নিকটে গিয়ে প্রার্থনা জানালেন,“হে আরাধ্য প্রভু! আমরা এই জেনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি যে রক্তবাহু নামে একজন মহাদুষ্কৃত সমস্ত মন্দির এবং মন্দিরের দেববিগ্রহগুলি ধ্বংস করছে। এখন সে এইদিকে আসছে। যে কোন মুহুর্তে সে এখানে চলে আসতে পারে এবং আপনার মন্দির আক্রমণ করতে পারে। যদি এমন ঘটে, তাহলে আমরা আমাদের জীবন ত্যাগ করতে বাধ্য হব, কেননা আমরা কখনই আপনার প্রতি বিরুদ্ধতামূলক কোন কর্ম সহ্য করতে পারব না। হে সর্বশক্তিমান প্রভু! অনুগ্রহ করে আপনার দিব্য বিগ্রহ ও এই শ্রীমন্দিরকে সর্বতোভাবে সুরক্ষিত করে আমাদেরকে এই মহাবিপদ হতে রক্ষা করুন।”

তাঁর ভক্তগণের দ্বারা প্রার্থিত হয়ে, শ্রী জগন্নাথ ঐ রাত্রে প্রধান পুরোহিতকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে এই কথাগুলি বললেন,“প্রিয়ভাজন পূজারী, আমার প্রতি তোমাদের শুদ্ধ প্রেমানুরাগ ও ভক্তি দর্শন করে আমি সম্পূর্ণরূপে অভিভূত হয়েছি। তোমরা আমাকে নিজের প্রাণাধিক ভালবাস। এই হচ্ছে শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ। প্রকৃতপক্ষে কেউই আমার দিব্য মূর্তি বা আমার মন্দিরের ক্ষতি করতে সমর্থ নয়। নিশ্চিতভাবেই সে সম্বন্ধে আমার উদ্বিগ্ন হবার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। আমি কেবল আমার প্রিয় ভক্তগণের সঙ্গে অবস্থান করি, যেখান থেকে আমি সকল দুষ্কৃতকে দূরে রাখতে পারি। কিন্তু আমার ভক্তগণকে আশীষ প্রদান ও তাঁদের সঙ্গে প্রীতিবিনিময় করার উদ্দেশ্যে আমি অনেক সময় এই ধরণের ক্লেশ স্বেচ্ছায় স্বীকার করে থাকি। এইভাবে আমার প্রতি আমার ভক্তগণের প্রেমানুরাগ আরো বহু গুণে বর্ধিত হতে থাকে। যেহেতু ভক্তদের এমনটাই অভিলাষ, আমি আমার প্রতি তাঁদের প্রেমভক্তি আরো সুগভীর রূপে প্রতিষ্ঠিত করি সেইজন্য আগামীকাল তোমরা আমার, শ্রীবলরাম ও সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহসমূহ নিয়ে মন্দির হতে নিষ্ক্রামণ করে বাংলার উদ্দেশ্যে যাত্রা কর। তোমরা এজন্য জঙ্গলের পথ ধরবে, তার ফলে তোমরা সহজেই রক্তবাহুকে এড়াতে পারবে। সে প্রধান সড়ক দিয়ে আসছে। তোমরা ভীত হয়ো না, আমি সদা-সর্বদা তোমাদের রক্ষা করব!”

ভগবান তখন স্বপ্ন হতে অন্তর্হিত হলেন এবং পূজারীর নিদ্রা ভঙ্গ হল। তৎক্ষণাৎ তিনি সেই বার্তা সকলকে জানালেন, যা ভক্তগণকে আলোড়িত করল। তাঁরা সকলে অবিলম্বে ভগবানের যাত্রার যথোচিত আয়োজন করতে তৎপর হলেন।

জগন্নাথ পুরীতে ভগবানের সেবার চিরাচরিত প্রথা হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ভক্তদের উপর বিভিন্ন ধরণের সেবা ভার অর্পণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাহ্মণগণ বিগ্রহসমূহের সেবার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, অন্য ভক্তগণ ভগবৎ-প্রীতি বিধানের উদ্দেশ্যে রান্না করেন। স্নানযাত্রাদি উৎসবে শবর নামে অভিহিত ভক্তগণ শ্রীশ্রীজগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রাদেবীর মূর্তিসমূহ এক স্থান হতে অন্য স্থানে বহন করে থাকেন।

যখন শবরদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছাল যে ভগবান মন্দির ত্যাগ করে বাংলার উদ্দেশ্যে গমন করতে ইচ্ছা করেছেন, তখন অবিলম্বে তাঁরা পরদিন প্রভাতে যাত্রা করার সকল প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত সম্পন্ন করলেন। পরদিন প্রভাতে অরণ্যের পথ ধরে যাত্রা শুরু হল; তাঁরা সারাদিন হাঁটলেন এবং সূর্য অস্তাচলে যাবার ঠিক পূর্বে তাঁরা একটি উপযুক্ত স্থানে থামলেন। সেখানে তাঁরা জঙ্গল হতে ফুল, পাতা ও ফলমূল সংগ্রহ করে বিগ্রহসমূহের পূজা ও ভোগ নিবেদন করলেন। পরিশেষে তাঁরা তাঁদেরকে শয়ন দিলেন এবং ভগবানের ভুক্তাবশিষ্ট মহাপ্রসাদ গ্রহণ করে তাঁরা নিজেরাও বিশ্রাম নিলেন। পরদিন প্রভাতে শ্রীবিগ্রহের পূজা নিষ্পন্ন হওয়ার পর শবরগণ আবার বিগ্রহসমূহ নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। এইভাবে এগারো দিন ধরে চলার পর দ্বাদশ দিনে তাঁরা নবদ্বীপ ধামের একটি দ্বীপ, সীমন্তদ্বীপে এসে উপনীত হলেন।

সেই রাত্রে, শ্রীজগন্নাথ প্রধান শবরের নিকট স্বপ্নে আবির্ভূত হলেন এবং সর্বতোভাবে অপ্রাকৃত ঐ ক্ষেত্রে অবস্থানের জন্য তাঁর অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। তৎক্ষণাৎ শবর ভক্তগণ সেখানে চিরস্থায়ীভাবে ভগবানের অধিষ্ঠানের যথোচিত বন্দোবস্ত করার জন্য সকল উদ্যোগ গ্রহণ করলেন।

ভগবানের সঙ্গে সেইখানেই শবরগণ থেকে গেলেন এবং পুরুষানুক্রমে তাঁরা ভগবানের সেবা করে যেতে লাগলেন। তাঁদের শুদ্ধ প্রেমভক্তি-বশতঃ তাঁরা সকলে মুক্তি লাভ করে চিদাকাশে শ্রীজগন্নাথের নিত্য চিন্ময় ধামে ফিরে গেলেন। আজও পর্যন্ত জগন্নাথ মন্দিরের সন্নিকটে ‘শবর-ডাঙ্গা’ নামে শবরদের গ্রাম আছে। কালক্রমে শ্রীমূর্তিসমূহ ও মন্দির লোকদৃষ্টির অন্তরালে চলে যায়। কিন্তু প্রভু শ্রীজগন্নাথ কখনো সেই স্থান ত্যাগ করেননি...........

Post a Comment

0 Comments