*অমৃতের_আস্বাদন।(পর্ব -১)(জুলাই ১৯৭৬ - জানুয়ারী ১৯৭৭)*



কলকাতায় সে সময়টা ছিল  আমার জীবনের সবচাইতে  কঠিন  সময়।  আমি আমার পারিপার্শ্বিক জগতের  সঙ্গে    নিজেকে একেবারেই  খাপ খাওয়াতে  পারছিলাম  না। আর  যে  পারমার্থিক  জীবনের  জন্য  আমার হৃদয় আকুল হয়ে উঠেছিল, সেই জীবনটাও গ্রহণ করতে পারছিলাম না। আমি  জানতাম  যে, পারমার্থিক জীবনে  প্রবেশ করতে হলে গুরুদেবের  আশ্রয়ের প্রয়োজন , যিনি আমার  হাত  ধরে  আমাকে  এক জ্ঞানময় এবং আনন্দময় মুক্তির পথে নিয়ে  যাবেন। কিন্তু আমি এত চেষ্টা ও অনুসন্ধানের পরেও তাঁকে  খুঁজে পেলাম না, এখনও আমি সর্বান্তঃকরণে তাঁর প্রতীক্ষা করছি। আনন্দময়ী মা'র আশ্রমের অভিজ্ঞতা আমার  মনে এই আশার সঞ্চার করেছিল যে, সত‍্যিই যদি আমার গুরুদেব থেকে থাকেন তাহলে  তিনি  এসে আমার  কাছে নিজেকে প্রকাশ করবেন।
একদিন সন্ধ্যাবেলা আমার বাড়িতে আমার পুরানো বন্ধু  প্রসূন এসে উপস্থিত হল। তাকে দেখে আমার খুব ভাল লেগেছিল ।  দেখেছিলাম তার মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। আগে তার মাথাভর্তি  লম্বা চুল এবং সব সময় শার্ট প্যান্ট পরে থাকত; কিন্তু  এখন এর মস্তক মুন্ডিত এবং পরনে সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবী।আমি জানতাম  যে, সে জার্মানিতে ইস্কনে যোগদান  করে  কৃষ্ণভক্ত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার এই পরিবর্তন দেখে আমি অত‍্যন্ত আশ্চর্য হয়েছিলাম। তার মুখের অপূর্ব সুন্দর, শান্ত  এবং স্নিগ্ধ ভাব এক  জ্যোতির মতো প্রতিভাত হচ্ছিল।

আমি যখন শুনেছিলাম যে, প্রসূন ও তার জার্মান বান্ধবী কর্ণেলিয়া, ইস্কনে যোগদান  করেছে, তখন আমি ততটা গুরুত্ব দিইনি,কেননা জার্মানীতে থাকাকালে হামবুর্গের ইস্কন মন্দিরে  আমাদের একটা খুব খারাপ অভিজ্ঞতা  হয়েছিল।  একদিন যখন আমি ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসছিলাম, তখন  একাদল শ্বেতঙ্গ যুবক যুবতীদের চোখে  পড়েছিল, যাদের পরনে ছিল  ভারতীয় পোশাক - ধুতি, কুর্তা এবং শাড়ী।  তারা রাস্তায় কীর্তন করতে করতে নাচছিল।  সেই দৃশ‍্য আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। এইভাবে বিদেশীদের ভারতীয় পোশাক  পরে ভারতীয় সংস্কৃতি অনুশীলন করতে দেখে আমার দেশের  কথা মনে পড়ে গিয়েছিল এবং বুক গর্বে ভরে উঠেছিল। তাদের একজন কিছু  বই আর ম‍্যাগাজিন বিক্রি করছিল এবং তার কাছ থেকে আমি একটি ব‍্যাক টু গড্ হেড  মায়াজিন কিনেছিলাম। মজাইজিনের কাছে এসেছি।  তার  সঙ্গে আমি কথা বলতে শুরু করেছিলাম এবং সে আমাকে  বলেছিল  যে, তারা  শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামী এবং ইউনিভার্সিটির সন্নিকটে আলটোনা ’- তে তাদের মন্দিরে যেতে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল।  আমি সেখানে গিয়েছিলাম এবং সহজেই তাদের সঙ্গে  বন্ধুত্ব হয়েছিল। আমার সেই অভিজ্ঞতার কথা আমি  প্রসূনকে  জানিয়েছিলাম এবং আমারা দুজনে কয়েকবার সেই মন্দিরে গিয়েছিলাম। একদিন যখন আমরা সেখানে বসে একজন আমেরিকান ভক্তের সঙ্গে  কথা বলছিলাম , তখন  আর একজন ভক্ত সেই আলোচনায়  আমাদের  আধিপত্য  করতে দেখে এবং অন‍্য ভক্তটিকে একাগ্রভাবে আমাদের  কথা শুনতে দেখে একটু বিরক্ত হয়েছিল এবং সোজা  আমাদের কাছে এসে কোন  রকম ভূমিকার অবতারণা না করেই বলেছিল  যে, বুদ্ধদেবের প্রদর্শিত পন্থাটি ভুল, আর  রামকৃষ্ণ ছিল একজন প্রতারক।  বুদ্ধদেব, রামকৃষ্ণ কে নিয়ে আমরা কোন আলোচনাই করছিলাম  না, কিন্তু  ধর্মাবলম্বী একজন সাধুকে এভাবে আচরণ করতে দেখে আমরা বেশ  মর্মহত হয়েছিলাম ।  প্রসূন  বিস্মিতভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল, এবং আমি নীরবে ইঙ্গিত করছিলাম  সেখান  থেকে চলে যেতে।   আমরা তাই করেছিলাম, তারপর কখনও  আর আমরা সেখানে যাইনি।। (চলবে......)

Post a Comment

0 Comments