-: মানবজন্ম সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক :-
শ্লোক: 1
ন তে বিদুঃ স্বার্থগতিং হি বিষ্ণুং
দুরাশয়া যে বহিরর্থমানিনঃ ।
অন্ধাঃ যথান্ধৈরুপনীয়মানা-
স্তেহপীশতন্ত্র্যামুরুদাম্নি বদ্ধাঃ ।।
(ভাগবত ৭/৫/৩১)
অনুবাদঃ- যারা জড় জগৎকে ভোগ করার বাসনার দ্বারা আবদ্ধ এবং তাই যারা তাদেরই মত বিষয়াসক্ত অন্ধ ব্যক্তিকে তাদের নেতা বা গুরুরূপে বরণ করেছে, তারা বুঝতে পারে না যে, জীবনের প্রকৃ্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবৎ-ধামে ফিরে যাওয়া এবং ভগবান শ্রীবিষ্ণুর সেবায় যুক্ত হওয়া। অন্ধের দ্বারা পরিচালিত হয়ে অন্ধরা যেমন প্রকৃ্ত পথের সন্ধান না জেনে অন্ধকূপে পতিত হয়, তেমনই জড় বিষয়াসক্ত ব্যক্তিরা অন্য বিষয়াসক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সকাম কর্মরূপ অত্যন্ত দৃঢ় রজ্জুর বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং সংসারচক্রে বারবার আবর্তিত হয়ে ত্রিতাপ দুঃখ ভোগ করতে থাকে।
শ্লোক: 2
অশিতিং চতুরশ্চৈব লক্ষাংস্তাঞ্জীব জাতিষু
ভমদ্ভিঃ পুরুষৈঃ প্রাপ্যং মানুষ্যং জন্মপর্যায়াৎ ।
তদপ্যভলতাং জাতঃ তেষামাত্মাভিমানিনাম্
বরাকাণামনাশ্রিত্য গোবিন্দচরণদ্বয়ম্ ।।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ)
অনুবাদঃ- ক্রমবিকাশের ক্রমিক পর্যায়ে চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমণ করার পর জীব মনুষ্য-দেহ লাভ করে। এত দুর্লভ এই মনুষ্য জন্ম পেয়েও গণ্ডমূর্খ ব্যক্তিরা শ্রীগোবিন্দের চরণকমল যুগলের আশ্রয় গ্রহণ না করে তা হেলায় নষ্ট করে।
শ্লোক: 3
লব্ধা সুদুর্লভমিদং বহুসম্ভবান্তে
মানুষ্যমর্থদমনিত্যমপীহ ধীরঃ ।
তূর্ণং যতেত ন পতেদনুমৃত্যু যাব-
ন্নিঃশ্রেয়সায় বিষয়ঃ খলু সর্বতঃ স্যাৎ ।।
(ভাগবত ১১/৯/২৯)
অনুবাদঃ- বহু জন্ম-মৃত্যুর পর জীব এই মনুষ্যদেহ লাভ করে, যা অনিত্য হওয়া সত্ত্বেও জীবকে পূর্ণসিদ্ধি লাভের সুযোগ প্রদান করে। অতএব ধীর ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে অবিলম্বে এই পূর্ণসিদ্ধি লাভের জন্য প্রযত্ন করা এবং কখনই জন্ম-মৃত্যুর চক্রে পতিত হওয়া উচিত নয়। ইন্দ্রিয় ভোগের বিষয় তো জঘন্যতম প্রজাতিদের মধ্যেও সুলভ, পক্ষান্তরে কৃষ্ণভাবনামৃত শুধু মানব-জীবনেই লাভ করা সম্ভব।
শ্লোক: 4
নৃ্দেহমাদ্যং সুলভং সুদুর্লভং
প্লবং সুকল্পং শুরুকর্ণধারম্ ।
ময়ানুকূলেন নভস্বতেরিতং
পুমান্ ভবাব্ধিং ন তরেৎ স আত্মহা।।
(ভাগবত ১১/২০/১৭)
অনুবাদঃ- সমস্ত প্রকার সুফলের মূলস্বরূপ সুদুর্লভ এই মনুষ্যজন্ম প্রকৃ্তির নিয়মে সুলভে লাভ করা যায়। এই মনুষ্যদেহ এক সুপরিকল্পিত নৌকার মতো, গুরুদেব হচ্ছেন সুদক্ষ কর্ণধার এবং পরমেশ্বরের বাণী হচ্ছে অনুকূল বায়ু। এত সুযোগ সত্ত্বেও যে মানুষ এই মনুষ্য-জন্মের সদ্ব্যবহার করে না সে আত্মঘাতী।
শ্লোক: 5
আহারনিদ্রাভয়মৈথুনং চ
সামান্যমেতদ্ পশুভির্নরাণাম্ ।
ধর্মোঃ হি তেষামধিকো বিশেষো
ধর্মেণ হীনাঃ পশুভিঃ সমানাঃ ।।
(হিতোপদেশ)
অনুবাদঃ- আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন- এই চারটি কর্ম মানুষ ও পশুর মধ্যে সমানভাবে বর্তমান। কিন্তু মানুষের অধিকতর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা পারমার্থিক অনুশীলনে নিযুক্ত হতে সক্ষম। অতএব পারমার্থিক জীবন তথা ধর্ম ছাড়া মানুষ পশুর সমান।
শ্লোক: 6
উত্তিষ্ঠ জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।
ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া
দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি ।।
(কঠ উপঃ ১/৩/১৪)
অনুবাদঃ- হে জীবগণ, এই জড় জগতে তোমরা ঘুমিয়ে আছ! অনুগ্রহ করে জাগ এবং এই মনুষ্য- জন্মের সুযোগ গ্রহণ কর! পারমার্থিক উপলব্ধির পথ বড়ই দুর্গম। তা ক্ষুরের অগ্রভাগের মতোই ধারালো। এই হচ্ছে তত্ত্বদর্শী পণ্ডিতদের অভিমত।
শ্লোক: 7
কামস্য নেন্দ্রিয়প্রীতির্লাভো জীবেত যাবতা ।
জীবস্য তত্ত্বজিজ্ঞাসা নার্থো যশ্চেহ কর্মভিঃ ।।
(ভাগবত ১/২/১০)
অনুবাদঃ- ইন্দ্রিয়সুখ ভোগকে কখনই জীবনের উদ্দেশ্য বলে গ্রহণ করা উচিত নয়। সুস্থ জীবন যাপন করা অথবা আত্মাকে নির্মল রাখার বাসনাই কেবল করা উচিত, কেন না মানব-জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা। এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম করা উচিত নয়।
শ্লোক: 8
হরি হরি ! বিফলে জনম গোঙাইনু ।
মনুষ্য-জনম পাইয়া, রাধাকৃষ্ণ না ভজিয়া,
জানিয়া শুনিয়া বিষ খাইনু ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, প্রার্থনা)
অনুবাদঃ- হে শ্রীহরি ! হে শ্রীহরি ! বৃথাই এই জন্ম কাটালাম। এই দুর্লভ মনুষ্যজন্ম পেয়েও শ্রীশ্রীরাধা-কৃষ্ণের ভজনা না করে আমি শুধু জেনে শুনে বিষ পান করলাম।
শ্লোক: 9
প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং নিবৃত্তিস্তু মহাফলম্ ।
(মনু সংহিতা)
অনুবাদঃ- এই জড় জগতে সকলেই প্রবৃত্তি মার্গের প্রতি আসক্ত হয়, কিন্তু নিবৃত্তি মার্গের অনুগমন করেই মহত্তম সম্পদ লাভ করা যায়।
শ্লোক: 10
যো বা এতদক্ষরং গার্গ্যবিদিত্বাস্মাল্লোকাৎ প্রৈতি স কৃপণঃ ।
(বৃহদারণ্যক উপঃ ৩/৮/১০)
অনুবাদঃ- যে মানুষ আত্মতত্ত্ব-বিজ্ঞান উপলব্ধি না করে, কুকুর বিড়ালের মতো এই জগৎ ত্যাগ করে এবং মনুষ্য দেহ লাভ করেও জীবনের সমস্যার সমাধান করে না, সে একজন কৃপণ।
দ্রঃ কৃপণ কথাটির বিপরীত শব্দ হচ্ছে ব্রাহ্মণ। যিনি জীবনের সমস্যার সমাধান জেনে দেহত্যাগ করেন, তিনিই ব্রাহ্মণ। শ্লোকটির অবশিষ্ট অংশ নিম্নরূপ –
শ্লোক: 11
যো বা এতদক্ষরং গার্গি বিদিত্বাস্মাল্লোকাৎ প্রৈতি স ব্রাহ্মণঃ ।।
(বৃহদারণ্যক উপঃ ৩/৮/১০)
অনুবাদঃ- যিনি জীবনের মূল সমস্যার (জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির) সমাধান সম্পর্কে অবগত হয়ে দেহত্যাগ করেন, তিনিই ব্রাহ্মণ।
শ্লোক: 12
অসতো মা সদ্গময় তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোর্মামৃতং গময়।
(বৃঃ আরণ্যক উপঃ ১/৩/২৮)
অনুবাদঃ- অসত্যে থেকো না, নিত্য সত্যের জগতে গমন কর। অন্ধকারে থেকো না, জ্যোতির্ময় লোকে গমন কর। জড় দেহ গ্রহণ করে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ঘুরে মর না, অমরত্ব লাভ কর।
শ্লোক: 13
তরবঃ কিং ন জীবন্তি ভস্ত্রাঃ কিং ন শ্বসন্ত্ত্যত ।
ন খাদন্তি ন মেহন্তি কিং গ্রামে পশবোহপরে ।।
(ভাগবত ২/৩/১৮)
অনুবাদঃ- বৃক্ষসমূহ কি বেঁচে থাকে না? কামারের হাপর কি শ্বাসগ্রহণ ও পরিত্যাগ করে না? আমাদের চতুর্দিকে পশুরা কি আহার ও স্ত্রীসম্ভোগ করে না?
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 14
নায়ং দেহো দেহভাজং নৃলোকে
কষ্টান্ কামানর্হতে বিড়্ ভুজাং যে।
তপো দিব্যং পুত্রকা যেন সত্ত্বং
শুদ্ধ্যেদ্ যস্মাদ্ ব্রহ্মসৌখ্যং ত্বনন্তম্ ।।
(ভাগবত ৫/৫/১)
অনুবাদঃ- হে পুত্রগণ ! এই জগতে দেহধারী প্রাণীদের মধ্যে এই নরদেহ লাভ করে, কেবল ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করা উচিত নয়। ওই প্রকার ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ বিষ্ঠাভোজী কুকুর এবং শূকরদেরও লাভ হয়ে থাকে। ভগবৎ সেবাপর অপ্রাকৃত তপস্যা করাই উচিত, কারণ তার ফলে হৃদয় নির্মল হয় এবং হৃদয় নির্মল হলে জড় সুখের অতীত অন্তহীন চিন্ময় আনন্দ লাভ হয়।
শ্লোক: 15
কৌমার আচরেৎ প্রাজ্ঞো ধর্মান্ ভাগবতানিহ ।
দুর্লভং মানুষং জন্ম তদপ্যধ্রুবমর্থদম্ ।।
(ভাগবত ৭/৬/১)
অনুবাদঃ- প্রাজ্ঞ ব্যক্তি মনুষ্যজন্ম লাভ করে জীবনের শুরু থেকেই, অর্থাৎ বাল্যকাল থেকেই অন্য সমস্ত প্রয়াস ত্যাগ করে ভাগবত-ধর্ম অনুষ্ঠান করবেন। মনুষ্যজন্ম অত্যন্ত দুর্লভ এবং অন্যান্য শরীরের মতো অনিত্য হলেও তা অত্যন্ত অর্থপূর্ণ, কারণ মনুষ্য-জীবনে ভগবানের সেবা সম্পাদন করা সম্ভব। নিষ্ঠাপূর্বক কিঞ্চিৎ মাত্র ভগবদ্ভক্তির অনুষ্ঠান করলেও মানুষ পূর্ণসিদ্ধি লাভ করতে পারে।
(প্রহ্লাদ মহারাজ)
শ্লোক: 16
ওঁ অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা
(বেদান্তসূত্র ১/১/১)
অনুবাদঃ- অতএব, এখনই ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসা (পরমেশ্বর সম্পর্কে) কর্তব্য ।
0 Comments