জপ কীর্তন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 1
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
ইতি ষোড়শকং নাম্নাং কলিকল্মষনাশনম্।
নাতঃ পরতরোপায়ঃ সর্ববেদেষু দৃশ্যতে।।
(কলিসন্তরণ উপনিষদ)অনুবাদঃ- হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রের এই ষোলটি নাম বিশেষত কলিযুগের পাপ নাশের জন্যই উদ্দিষ্ট। নিজেকে কলিযুগের কলুষ থেকে মুক্ত রাখতে হলে এই হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মতো অন্য আর কোন উপায় নেই। যুগধর্ম হিসাবে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মতো অন্য কোন মহান পন্থা সমস্ত বৈদিক গ্রন্থে অনুসন্ধান করেও খুঁজে পাওয়া যায় না।
( প্রজাপতি ব্রহ্মা )
শ্লোক: 2
জীবন অনিত্য জানহ সার,
তাহে নানাবিধ বিপদ ভার।
নামাশ্রয় করি' যতনে তুমি,
থাকহ আপন কাজে।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)
অনুবাদ:- অনুবাদঃ- এই সার কথা জেনে রাখা উচিত যে, এই জীবন অনিত্য এবং বহু বিপদ ও দুঃখে পরিপূর্ণ। তাই যত্ন সহকারে হরিনামকে আশ্রয় করে কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত থাকতে হবে।
শ্লোক: 3
একবার হরি নামে যত পাপ হরে।
পাপীর সাধ্য নাই তত পাপ করে ।।অনুবাদ:- একবার মাত্র শুদ্ধভাবে হরিনাম করলে যত পাপ হরণ হয়, তত পাপ করার সাধ্য কোন পাপীর নেই।
শ্লোক: 4
নাম্নো হি যাবতী শক্তিঃ পাপ-নির্হরণে হরেঃ।
তাবৎ কর্তুং ন শক্নোতি পাতকং পাতকী নরঃ ।।
(বৃহদ্ বিষ্ণু পুরাণ)অনুবাদঃ- শুধুমাত্র হরিনাম কীর্তন বা জপ করার ফলে একজন পাতকী যত পাপ দূর করতে পারে, তত পাপ করার সামর্থ্যও তার নেই।
শ্লোক: 5
তস্মাৎ সঙ্কীর্তনং বিষ্ণোর্জগন্মঙ্গলমংহসাম্।
মহতামপি কৌরব্য বিদ্ধ্যৈকান্তিকনিষ্কৃতম্।।
(ভাগবত ৬/৩/৩১)অনুবাদঃ- হে কুরুরাজ, হরিনাম সংকীর্তন এমন কি মহাপাপের ফলকেও নির্মূল করতে পারে। তাই হরিনাম সংকীর্তনই হচ্ছে জগতের সবচেয়ে মঙ্গলময় অনুষ্ঠান। অনুগ্রহ করে তা হৃদয়ঙ্গম করুন যাতে অন্যেরাও তা নিষ্ঠাভরে গ্রহণ করে।
শ্লোক: 6
চেতোদর্পণমার্জনং ভবমহাদাবাগ্নিনির্বাপণং
শ্রেয়ঃকৈরবচন্দ্রিকাবিতরণং বিদ্যাবধূজীবনম্ ।
আনন্দাম্বুধিবর্ধনং প্রতিপদং পূর্ণামৃতাস্বাদনং
সর্বাত্মস্নপনং পরং বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণসঙ্কীর্তনম্ ।। (শিক্ষাষ্টক-১)অনুবাদঃ- চিত্তরূপ দর্পনের মার্জনকারী, ভবরূপ মহাদাবাগ্নি নির্বাপণকারী, জীবের মঙ্গলরূপ কৈরবচন্দ্রিকা বিতরণকারী, বিদ্যাবধূর জীবনস্বরূপ, আনন্দ-সমুদ্রের বর্ধনকারী, পদে পদে পূর্ণ অমৃত আস্বাদন-স্বরূপ এবং সর্ব স্বরূপের শীতলকারী শ্রীকৃষ্ণসঙ্কীর্তন বিশেষভাবে জয়যুক্ত হোন।
শ্লোক: 7
হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্ ।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা ।। (বৃহন্নারদীয় পূরাণ ৩/৮/১২৬)অনুবাদঃ- এই কলিযুগে ভগবানের দিব্য নাম কীর্তন করা ছাড়া আর অন্য কোন গতি নেই, আর অন্য কোন গতি নেই, আর অন্য কোন গতি নেই ।
শ্লোক: 8
নয়নং গলদশ্রুধারয়া বদনং গদ্ গদরুদ্ধয়া গিরা ।
পুলকৈর্নিচিতং বপুঃ কদা তব নামগ্রহণে ভবিষ্যতি ।।
(শিক্ষাষ্টক-৬)অনুবাদঃ- হে প্রভু ! তোমার নাম গ্রহণে কবে আমার নয়নযুগল গলদশ্রুধারায় শোভিত হবে? বাক্য নিঃসরণ সময়ে বদনে গদ্ গদ স্বর বের হবে এবং আমার সমস্ত শরীর পুলকাঞ্চিত হবে?
শ্লোক: 9
নাম্নামকারি বহুধা নিজসর্বশক্তি-
স্তত্রার্পিতা নিয়মিতঃ স্মরণে ন কালঃ ।
এতাদৃশী তব কৃপা ভগবন্মাপি
দুর্দৈবমীদৃশমিহাজনি নানুরাগঃ ।।
(শিক্ষাষ্টক -২)অনুবাদঃ- হে পরমেশ্বর ভগবান ! তোমার নামই জীবের সর্বমঙ্গল বিধান করেন, এই জন্য তোমার 'কৃষ্ণ', 'গোবিন্দ' আদি বহুবিধ নাম তুমি বিস্তার করেছ। সেই নামে তুমি তোমার সর্বশক্তি অর্পণ করেছ এবং সেই নাম স্মরণের স্থান-কাল-পাত্র আদির কোন রকম বিধি বা বিচার করনি। হে প্রভু ! জীবের প্রতি এভাবেই কৃপা করে তুমি তোমার নামকে সুলভ করেছ, তবুও আমার এমনই দুর্দৈব যে, সেই নাম গ্রহণ করার সময় আমি অপরাধ করি এবং তার ফলে তোমার সুলভ নামেও আমার অনুরাগ জন্মায় না।
শ্লোক: 10
নাম-অক্ষর বাহির হয় বটে, নাম নাহি হয়।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)অনুবাদঃ- হরিনাম যান্ত্রিকভাবে উচ্চারণ করলে, মুখে যদিও হরে কৃষ্ণ উচ্চারণ হচ্ছে, প্রকৃত শুদ্ধ নাম তা কখনই নয়।
শ্লোক: 11
তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা ।
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ ।।
(শিক্ষাষ্টক -৩)অনুবাদঃ- যিনি নিজেকে সকলের পদদলিত তৃণের থেকেও ক্ষুদ্র বলে মনে করেন, যিনি বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু, যিনি মান শূন্য এবং অন্য সকলকে সম্মান প্রদর্শন করেন, তিনি সর্বক্ষণ ভগবানের দিব্যনাম কীর্তনের অধিকারী।
শ্লোক: 12
দুষ্ট মন ! তুমি কিসের বৈষ্ণব ?
প্রতিষ্ঠার তরে , নির্জনের ঘরে ,
তব 'হরিনাম' কেবল 'কৈতব'। (ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী)অনুবাদঃ- হে দুষ্ট মন! তুমি কি রকম বৈষ্ণব ? সস্তা প্রতিষ্ঠার লোভে তুমি নির্জনে বসে হরিনাম করার ভান করছ, কিন্তু তোমার এই নির্জন ভজন শুধু প্রতারণা মাত্র ।
শ্লোক: 13
নামাপরাধযুক্তানাং নামান্যেব হরন্ত্যঘম্ ।
অবিশ্রান্তিপ্রযুক্তানি তান্যেবার্থকরাণি চ ।।
(পদ্ম পূরাণ)অনুবাদঃ- হরিনামের প্রতি যারা অপরাধ করে, তাদেরও হরে কৃষ্ণ নাম জপের বিধান দেওয়া হয়েছে, কারণ তারা যদি জপ করে চলে, ক্রমে ক্রমে তারা নিরপরাধে জপ করতে পারবে। শুরুতে যদিও বা অপরাধ হয়, তবুও পুনঃপুনঃ জপের ফলে সেই সব অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
শ্লোক: 14
নামাপরাধযুক্তানাং নামান্যেব হরন্ত্যঘম্ ।
অবিশ্রান্তিপ্রযুক্তানি তান্যেবার্থকরাণি চ ।।
(পদ্ম পূরাণ)অনুবাদঃ- হরিনামের প্রতি যারা অপরাধ করে, তাদেরও হরে কৃষ্ণ নাম জপের বিধান দেওয়া হয়েছে, কারণ তারা যদি জপ করে চলে, ক্রমে ক্রমে তারা নিরপরাধে জপ করতে পারবে। শুরুতে যদিও বা অপরাধ হয়, তবুও পুনঃপুনঃ জপের ফলে সেই সব অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
শ্লোক: 15
"মালী হঞা করে সেই বীজ আরোপণ ।
শ্রবণ-কীর্তণ-জলে করয়ে সেচন ।। " (চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৫২)
অনুবাদঃ- সেই বীজ লাভ করার পর, মালী হয়ে সেই বীজটিকে হৃদয়ে রোপণ করতে হয় এবং শ্রবণ, কীর্তণরূপ জল তাতে সিঞ্চন করতে হয়।
(শ্রীল রূপ গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)
শ্লোক: 16
নিত্যসিদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম ‘সাধ্য’ কভু নয় ।
শ্রবণাদি-শুদ্ধচিত্তে করয়ে উদয় ।। (চৈঃ চঃ মধ্য ২২/১০৭)অনুবাদঃ- কৃষ্ণপ্রেম নিত্যসিদ্ধ বস্তু, তা কখনও (শুদ্ধ ভক্তি ব্যতীত অন্য কোন অভিধেয়ের) সাধ্য নয়। কেবলমাত্র শ্রবণাদি দ্বারা বিশোধিত চিত্তে তার উদয় সম্ভব।
(শ্রীল সনাতন গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)
শ্লোক: 17
যন্নামধেয়শ্রবণানুকীর্তনাদ্
যৎপ্রহ্বণাদ্ যৎস্মরণাদপি ক্বচিৎ ।
শ্বাদোহপি সদ্যঃ সবনায় কল্পতে
কুতঃ পুনস্তে ভগবন্নু দর্শনাৎ ।। (ভাগবত ৩/৩৩/৬)
অনুবাদঃ- হে ভগবন্ যাঁর নাম শ্রবণ, অনুকীর্তন, প্রণাম ও স্মরণ করা মাত্র চণ্ডাল ও যবন কুলোদ্ভূত ব্যক্তিও তৎক্ষণাৎ বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের যোগ্য হয়ে উঠে, এমন যে প্রভু তুমি, তোমার দর্শনের প্রভাবে কি না হয়?
শ্লোক: 18
অহো বত শ্বপচোহতো গরীয়ান্
যজ্জিহ্বাগ্রে বর্ততে নাম তুভ্যম্ ।
তেপুস্তপস্তে জুহুবুঃ সস্নুরার্যা
ব্রহ্মানূচুর্নাম গৃণন্তি যে তে ।। (ভাগবত ৩/৩৩/৭)
অনুবাদঃ- হে ভগবান ! যাঁদের জিহ্বায় আপনার নাম বিরাজ করে, তাঁরা যদি অত্যন্ত নীচকুলেও জন্মগ্রহণ করেন, তা হলেও তাঁরা শ্রেষ্ঠ। যাঁরা আপনার নাম কীর্তন করেন, তাঁরা সব রকম তপস্যা করেছেন, সমস্ত যজ্ঞ করেছেন, সর্বতীর্থে স্নান করেছেন এবং সমস্ত বেদ পাঠ করেছেন, সুতরাং তাঁরা আর্য মধ্যে পরিগণিত।
শ্লোক: 19
নাম চিন্তামণিঃ কৃষ্ণশ্চৈতন্যরসবিগ্রহঃ ।
পূর্ণ শুদ্ধো নিত্যমুক্তোহভিন্নত্বান্নামনামিনোঃ ।। (পদ্ম পুরাণ)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের নাম চিন্ময় চিন্তামণি বিশেষ, তা চৈতন্যরসের বিগ্রহস্বরূপ। তা পূর্ণ অর্থাৎ মায়িক বস্তুর মতো আবদ্ধ ও খণ্ড নয়; তা শুদ্ধ, অর্থাৎ মায়া-মিশ্য নয়; তা নিত্য মুক্ত অর্থাৎ সর্বদা চিন্ময়, কখনও জড় সম্বন্ধে আবদ্ধ হয় না, যেহেতু নাম ও নামীর স্বরূপে কোন ভেদ নেই।
শ্লোক: 20
শৃণ্বন্তি গায়ন্তি গৃণন্ত্যভীক্ষ্নশঃ
স্মরন্তি নন্দন্তি তবেহিতং জনাঃ ।
ত এব পশ্যন্তচিরেণ তাবকং
ভবপ্রবাহোপরমং পদাম্বুজম্ ।। (ভাগবত ১/৮/৩৬)
অনুবাদঃ- হে শ্রীকৃষ্ণ ! যাঁরা তোমার অপ্রাকৃত চরিত-কথা নিরন্তর শ্রবণ করেন, কীর্তন করেন, স্মরণ করেন এবং অবিরাম উচ্চারণ করেন, অথবা অন্যে তা করলে আনন্দিত হন, তাঁরা অবশ্যই তোমার শ্রীপাদপদ্ম অচিরেই দর্শন করতে পারেন, যা একমাত্র জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহকে নিবৃত করতে পারে।
0 Comments