ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 1
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ ।
অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্ব্বকারণকারণম্।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/১)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণ, যিনি গোবিন্দ নামেও পরিচিত, তিনি হচ্ছেন পরম ঈশ্বর৷ তাঁর রূপ সচ্চিদানন্দময় (নিত্য, জ্ঞানময় ও আনন্দময়)। তিনি হচ্ছেন সব কিছুর পরম উৎস৷ তাঁর কোন উৎস নেই, কেন না তিনি হচ্ছেন সমস্ত কারণের পরম কারণ৷
শ্লোক: 2
ওঁ জন্মাদাস্য যতঃ
(বেদান্তসূত্র ১/১/২)
অনুবাদঃ- সেই ব্রহ্ম হচ্ছেন তিনি, যাঁর থেকে প্রকাশিত ব্রহ্মাণ্ডসমূহের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সাধিত হয়।
শ্লোক: 3
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়
জন্মাদাস্য যতোহন্বয়াদিতরশ্চার্থেষ্বভিজ্ঞঃ স্বরাট্
তেনে ব্রহ্ম হৃদা য আদিকবয়ে মুহ্যন্তি যৎ সূরয়ঃ ।
তেজোবারিমৃদাং যথা বিনিময়ো যত্র ত্রিসর্গোহমৃষা
ধাম্না স্বেন সদা নিরস্তকুহকং সত্যং পরং ধীমহি ।।
(ভাগবত ১/১/১)
অনুবাদঃ- হে বসুদেব তনয় শ্রীকৃষ্ণ! হে সর্বব্যাপ্ত পরমেশ্বর ভগবান! আমি আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করি, কেন না তিনি হচ্ছেন প্রকাশিত ব্রহ্মাণ্ডসমূহের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের পরম কারণ। তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সব কিছু সম্বন্ধে অবগত এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন, কেন না তাঁর অতীত আর কোন কারণ নেই। তিনিই আদি কবি ব্রহ্মার হৃদয়ে সর্বপ্রথম বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। তাঁর দ্বারা মহান ঋষিরা এবং স্বর্গের দেবতারাও মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, ঠিক যেভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে আগুনে জল দর্শন হয়, অথবা জলে মাটি দর্শন হয়। তাঁরই প্রভাবে জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের মাধ্যমে জড় জগৎ সাময়িকভাবে প্রকাশিত হয় এবং তা অলীক হলেও সত্যবৎ প্রতিভাত হয়। তাই আমি সেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করি, যিনি জড় জগতের মোহ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত থেকে তাঁর ধামে নিত্যকাল বিরাজ করেন। আমি তাঁর ধ্যান করি, কেন না তিনিই হচ্ছেন পরম সত্য।
শ্লোক: 4
বাসুদেবপরা বেদা বাসুদেবপরা মখাঃ।
বাসুদেবপরা যোগা বাসুদেবপরাঃ ক্রিয়াঃ।।
বাসুদেবপরং জ্ঞানং বাসুদেবপরং তপঃ।
বাসুদেবপরো ধর্মো বাসুদেবপরা গতিঃ।।
(ভাগবত ১/২/২৮-২৯)
অনুবাদঃ- বৈদিক শাস্ত্রে জ্ঞানের পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। যজ্ঞ সম্পাদনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানের প্রীতিবিধান এবং যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁকে জানা। সমস্ত সকাম কর্মের চরম ফল তিনিই দান করেন। পরম জ্ঞান ও সমস্ত তপশ্চর্যার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁকে জানা এবং তাঁর প্রতি প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হওয়াই হচ্ছে ধর্মের উদ্দেশ্য। তিনি হচ্ছেন জীবনের পরম উদ্দেশ্য।
শ্লোক: 5
একলে ঈশ্বর কৃষ্ণ, আর সব ভৃত্য ।
যারে যৈছে নাচায়, সে তৈছে করে নৃত্য ।।
(চৈঃ চঃ আদি ৫/১৪২)
অনুবাদঃ- একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম ঈশ্বর এবং অন্য সকলেই তাঁর সেবক। তিনি যেভাবে নির্দেশ দেন, তাঁরা সেভাবেই নৃত্য করেন ।
শ্লোক: 6
সর্বভূতানি কৌন্তেয় প্রকৃতিং যান্তি মামিকাম্ ।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্ ॥
(গীতা ৯/৭)
অনুবাদঃ- হে কৌন্তেয় ! কল্পান্তে সমস্ত জড় সৃষ্ট আমারই প্রকৃতিতে প্রবেশ করে এবং পুনরায় কল্পারম্ভে প্রকৃতির দ্বারা আমি তাদের সৃষ্টি করি।
শ্লোক: 7
মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় ।
ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব ॥
(গীতা ৭/৭)
অনুবাদঃ- হে ধনঞ্জয় ! আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। সূত্রে যেমন মণিসমূহ গাঁথা থাকে, তেমনই সমস্ত বিশ্বই আমাতে ওতঃপ্রোতভাবে অবস্থান করে।
শ্লোক: 8
ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্ ।
হেতুনানেন কৌন্তেয় জগদ্ বিপরিবর্ততে ॥
(গীতা ৯/১০)
অনুবাদঃ- হে কৌন্তেয় ! আমার অধ্যক্ষতার দ্বারা জড়া প্রকৃতি এই চরাচর বিশ্ব সৃষ্টি করে। প্রকৃতির নিয়মে এই জগৎ পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি হয় এবং ধ্বংস হয়।
শ্লোক: 9
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে ।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।
(ঈশোপনিষদ, আবাহণ)
অনুবাদঃ- পররমেশ্বর ভগবান সর্বতোভাবে পূর্ণ। তিনি সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ বলে এই দৃশ্যমান জগৎ-এর মতো তাঁর থেকে উদ্ভুত সব কিছুই সর্বতোভাবে পূর্ণ। কিন্তু যেহেতু তিনি হচ্ছেন পরম পূর্ণ, তাই তাঁর থেকে অসংখ্য অখণ্ড ও পূর্ণ সত্তা বিনির্গত হলেও তিনি পূর্ণরূপেই অবশিষ্ট থাকেন।
শ্লোক: 10
অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে ।
ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ ॥
(গীতা ১০/৮)
অনুবাদঃ- আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস। সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়। সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে পণ্ডিতগণ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন।
শ্লোক: 11
পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্ ।
পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভুম্ ॥
আহুস্তামৃষয়ঃ সর্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা ।
অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্রবীষি মে ॥
(গীতা ১০/১২-১৩)
অনুবাদঃ- অর্জুন বললেন- তুমি পরম ব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র ও পরম পুরুষ৷ তুমি নিত্য, দিব্য, আদি দেব, অজ ও বিভু। দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাস আদি ঋষিরা তোমাকে সেভাবেই বর্ণনা করেছেন এবং তুমি নিজেও এখন আমাকে তা বলছ।
শ্লোক: 12
যদ্ যদ্বিভূতীমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা ।
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্ ॥
(গীতা ১০-৪১)
অনুবাদঃ- ঐশ্বর্য্যযুক্ত, শ্রী-সম্পন্ন ও বল-প্রভাবাদির আধিক্যযুক্ত যত বস্তু আছে, সে সবই আমার তেজাংশসম্ভূত বলে জানবে।
শ্লোক: 13
মম যোনির্মহদ্ ব্রহ্ম তস্মিন্ গর্ভং দধাম্যহম্।
সম্ভবঃ সর্বভূতানাং ততো ভবতি ভারত ॥
(গীতা ১৪/৩)
অনুবাদঃ- হে ভারত ! প্রকৃতি সংজ্ঞক ব্রহ্ম আমার যোনিস্বরূপ এবং সেই ব্রহ্মে আমি গর্ভাধান করি, যার ফলে সমস্ত জীবের জন্ম হয়।
শ্লোক: 14
সর্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্তয়ঃ সম্ভবন্তি যাঃ ।
তাসাং ব্রহ্ম মহদ্ যোনিরহং বীজপ্রদঃ পিতা ॥
(গীতা ১৪/৪)
অনুবাদঃ- হে কৌন্তেয় ! সকল যোনিতে যে সমস্ত মূর্তি প্রকাশিত হয়, ব্রহ্মরূপী যোনিই তাদের জননী-স্বরূপা এবং আমি তাদের বীজ প্রদানকারী পিতা।
শ্লোক: 15
তদ্ ঐক্ষত বহু স্যাম্ ।
(ছান্দোগ্য উপঃ ৬/২/৩)
অনুবাদঃ- ভগবান যখন বহু হতে ইচ্ছা করেন, তখন তিনি ঈক্ষণের (দৃষ্টি নিক্ষেপের) মাধ্যমে জড় জগতের প্রকাশ করেন।শ্লোক: 16
স ঐক্ষত
(ঐতেরেয় উপঃ ১/১/১)
অনুবাদঃ- সেই পরমেশ্বর ভগবান জড়া শক্তির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন।
শ্লোক: 17
স ইমাল্লোকান্ অসৃজত
(ঐতেরেয় উপঃ ১/১/২)
অনুবাদঃ- তিনি (পররমেশ্বর ভগবান) সমগ্র জড় জগৎ সৃষ্টি করলেন ।
শ্লোক: 18
যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ ৩/১/১)
অনুবাদঃ- সমস্ত জীব পরমেশ্বর ভগবান থেকে উৎপন্ন হয়।
শ্লোক: 19
অহমেবাসমেবাগ্রে নান্যদ্ যৎ সদসৎ পরম্ ।
পশ্চাদহং যদেতচ্চ যোহবশিষ্যেত সোহস্ম্যহম্ ।।
(ভাগবত ২/৯/৩৩)
অনুবাদঃ- হে ব্রহ্মা ! সৃষ্টির পূর্বে কেবল আমি ছিলাম এবং সৎ, অসৎ ও অনির্বচনীয় নির্বিশেষ ব্রহ্ম পর্যন্ত কোনকিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। সৃষ্টির পরে এই সমুদয় স্বরূপে আমিই বিরাজ করি এবং প্রলয়ের পর কেবল আমিই অবশিষ্ট থাকব।
শ্লোক: 20
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ ।
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা ॥
(গীতা ৭/৪)
অনুবাদঃ- ভূমি, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার- এই আট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত।
শ্লোক: 21
রামাদিমূর্তিষু কলানিয়মেন তিষ্ঠন্
নানাবতারমকরোদ্ভুবনেষু কিন্তু ।
কৃষ্ণঃ স্বয়ং সমভবৎ পরমঃ পুমান্ যো
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৯)
অনুবাদঃ- কলাবিভাগে রামাদি মূর্তিতে ভগবান জগতে নানা অবতার প্রকাশ করেছিলেন; কিন্তু যে পরম পুরুষ স্বয়ং কৃষ্ণরূপে প্রকট হন, সেই আদি-পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
শ্লোক: 22
নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্রুতিজাতং
সদয়হৃদয়দর্শিতপশুঘাতম্ ।
কেশব ধৃতবুদ্ধশরীর জয় জগদীশ হরে ।।
(শ্রীদশাবতার-স্তোত্র ৯)
অনুবাদঃ- হে কেশব ! হে জগদীশ ! পশুবধ দর্শনে আপনার সকরুণ হৃদয় আর্দ্রভূত হলে, আপনি হিংসার দোষ প্রদর্শনপূর্বক (পশুবধাত্মক) যজ্ঞ বিধান-প্রবর্তক বেদের অপবাদ দিয়েছিলেন। হে হরে! বুদ্ধ শরীরধারী আপনি জয়যুক্ত হোন ।
শ্লোক: 23
ততঃ কলৌ সম্প্রবৃত্তে সম্মোহায় সুরদ্বিষাম্ ।
বুদ্ধো নাম্নাঞ্জনসুতঃ কীকটেষু ভবিষ্যতি ।।
(ভাগবত ১/৩/২৪)
অনুবাদঃ- তারপর কলিযুগের প্রারম্ভে ভগবান ভগবৎ-বিদ্বেষী নাস্তিকদের সম্মোহিত করার জন্য বুদ্ধদেব নামে গয়া প্রদেশে অঞ্জনার পুত্ররূপে আবির্ভূত হবেন।
শ্লোক: 24
অবতারা হ্যসংখ্যেয়া হরেঃ সত্ত্বনিধের্দ্ধিজাঃ ।
যথাবিদাসিনঃ কুল্যাঃ সরসঃ স্যুঃ সহস্রশঃ ।।
(ভাগবত ১/৩/২৬)
অনুবাদঃ- হে ব্রাহ্মণগণ! বিশাল জলাশয় থেকে যেমন অসংখ্য নদী প্রবাহিত হয়, ঠিক তেমনই ভগবানের থেকে অসংখ্য অবতার প্রকাশিত হন ।
শ্লোক: 25
এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্ ।
ইন্দ্ররিব্যাকুলং লোকং মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে ।।
(ভাগবত ১/৩/২৮)
অনুবাদঃ- ভগবানের এই সমস্ত অবতারেরা পুরুষাবতারদের অংস অথবা কলা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। যখন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন আস্তিকদের রক্ষা করবার জন্য ভগবান এই ধরাধামে অবতির্ণ হন।
শ্লোক: 26
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ।।
(গীতা ৪/৭)
অনুবাদঃ- হে ভারত ! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।
শ্লোক: 27
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
(গীতা ৪/৮)
অনুবাদঃ- সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
শ্লোক: 28
দীপার্চিরেব হি দশান্তরমভ্যুপেত্য
দীপায়তে বিবৃতহেতুসমানধর্মা ।
যস্তাদৃ্গেব হি চ বিষ্ণুতয়া বিভাতি
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪৬)
অনুবাদঃ- এক মূল প্রদীপের জ্যোতি যেরূপ অন্য বর্তি বা বাতিগত হয়ে বিবৃত (বিস্তার) হেতু সমান ধর্মের সঙ্গে পৃথক প্রজ্জ্বলিত হয়, সেরূপ (বিষ্ণুর) চরিষ্ণুভাবে যিনি প্রকাশ পান, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।
শ্লোক: 29
প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং
বিহিতবহিত্রচরিত্রমখেদম্ ।
কেশব ধৃতমীনশরীর জয় জগদীশ হরে ।।
(দশাবতার-স্তোত্র ১)
অনুবাদঃ- হে কেশব ! হে জগদীশ ! হে হরি ! প্রলয়কালে যখন বেদরাশি সমুদ্রজলে নিমগ্ন হয়, তখন আপনি মীনশরীর ধারণ করে অক্লেশে নৌকার ন্যায় সেই বেদরাশি ধারণ করে রেখেছিলেন। মীন শরীরধারী আপনার জয় হোক ।
শ্লোক: 30
বসতি দশনশিখরে ধরণী তব লগ্না
শশিনি কলঙ্ককলেব নিমগ্না ।
কেশব ধৃতশূকররূপ জয় জগদীশ হরে ।।
(দশাবতার-স্তোত্র ৩)
অনুবাদঃ- হে কেশব ! আপনি যখন শূকরমূর্তি ধারণ করেছিলেন, তখন চন্দ্রের কলঙ্করেখার ন্যায় আপনার দন্তাগ্রে এই পৃথিবী সংলগ্না ছিল। হে শূকররূপী জগদীশ! হে হরে ! আপনার জয় হোক ।
শ্লোক: 31
তব করকমলবরে নখমদ্ভুতশৃ্ঙ্গং
দলিতহিরণ্যকশিপুতনুভৃঙ্গম্ ।
কেশব ধৃতনরহরিরূপ জয় জগদীশ হরে ।।
(দশাবতার-স্তোত্র ৪)
অনুবাদঃ- হে কেশব ! যখন আপনি নৃ্সিংহরূপ ধারণ করেছিলেন, তখন আপনার করকমলের নখাবলী অতীব আশ্চর্যাবহ অগ্রভাগযুক্ত হয়েছিল। আপনি ওই নখ দ্বারা দৈত্যপতি হিরণ্যকশিপুর তনুভৃঙ্গটিকে বিদীর্ণ করেছিলেন। হে নৃসিংহরূপী জগদীশ! হে হরে! আপনার জয় হোক।শ্লোক: 32
ছলয়সি বিক্রমণে বলিমদ্ভূতবামন
পদনখনীরজনিতজনপাবন ।
কেশব ধৃতবামনরূপ জয় জগদীশ হরে ।।
(দশাবতার-স্তোত্র ৫)
অনুবাদঃ- হে কেশব ! হে জগদীশ ! হে বামনরূপধারী শ্রীহরি, আপনার জয় হোক ! হে অদ্ভূত বামন দেব ! আপনার বিক্রমশালী পদক্ষেপে আপনি বলি মহারাজকে প্রতারিত করেছেন। আর আপনার চরণের নখনিঃসৃত জলে আপনি জগতের সমস্ত জীবকে উদ্ধার করেছেন।
শ্লোক: 33
বহসি বপুষি বিশদে বসনং জলদাভং
হলহতিভীতিমিলিতযমুনাভম্ ।
কেশব ধৃতহলকধররূপ জয় জগদীশ হরে ।।
(দশাবতার-স্তোত্র ৮)
অনুবাদঃ- হে কেশব ! হে জগদীশ ! হে হলধর বলরামের রূপ ধারণকারী শ্রীহরি ! আপনার জয় হোক ! আপনি আপনার শুভ্র দেহে জলভরা নবীন মেঘের মতো বর্ণবিশিষ্ট বসন পরিধান করেন। আপনার হলাকর্ষণে ভীতা যমুনার নীলবর্ণ জলের মতোই সুন্দর এই বসন।
শ্লোক: 34
ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সি করবালং
ধূমকেতুমিব কিমপি করালম্ ।
কেশব ধৃতকল্কিশরীর জয় জগদীশ হরে।।
(দশাবতার-স্তোত্র ১০)
অনুবাদঃ- হে কেশব ! হে জগদীশ্বর ! হে কল্কিরূপ ধারণকারী শ্রীহরি ! আপনার জয় হোক ! আপনি কলিযুগের নিধনপর্বে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন এবং ম্লেচ্ছদের হত্যা করার জন্য হাতে একটি ভয়ঙ্কর তলোয়ার বহন করেন।
শ্লোক: 35
যস্মাৎ ক্ষরমতীতোহহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ ।
অতোহস্মি লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ ॥
(গীতা ১৫/১৮)
অনুবাদঃ- যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর থেকেও উত্তম, সেই হেতু জগতে ও বেদে আমি পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত।
শ্লোক: 36
ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা ।
মৎস্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ ॥
(গীতা ৯/৪)
অনুবাদঃ- অব্যক্তরূপে আমি সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত আছি। সমস্ত জীব আমাতেই অবস্থিত, কিন্তু আমি তাতে অবস্থিত নই।
শ্লোক: 37
নমস্যে পুরুষং ত্বাদ্যমীশ্বরং প্রকৃতেঃ পরম্
অলক্ষ্যং সর্বভূতানামন্তর্বহিরবস্থিতম্ ।।
(ভাগবত ১/৮/১৮)
অনুবাদঃ- হে কৃষ্ণ ! আমি তোমাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। কারণ তুমি আদি পুরুষ এবং জড়া প্রকৃতির সমস্ত গুণের অতীত। তুমি সকলের অন্তরে ও বাইরে অবস্থিত, তবু তোমাকে কেউ দেখতে পায় না।
শ্লোক: 38
মায়াজবনিকাচ্ছন্নমজ্ঞাধোক্ষজমব্যয়ম্ ।
ন লক্ষ্যসে মূঢ়দৃশা নটো নাট্যধরো যথা ।।
অনুবাদঃ- তুমি ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের অতীত, তুমি মায়ারূপা যবনিকার দ্বারা আচ্ছাদিত, অব্যক্ত ও অচ্যুত। মূঢ় দ্রষ্টা যেমন অভিনেতার সাজে সজ্জিত শিল্পীকে দেখে সাধারণত চিনতে পারে না, তেমনই অজ্ঞ ব্যক্তিরা তোমাকে দেখতে পায় না।
শ্লোক: 39
ইদং হি বিশ্বং ভগবানিবেতরো
যতো জগৎস্থাননিরোধসম্ভবাঃ ।
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং এই বিশ্ব, তবুও তিনি তাঁর অতীত। তাঁর থেকেই এই জগৎ প্রকাশিত হয়েছে, তাঁকে আশ্রয় করেই এই জগৎ বর্তমান এবং প্রলয়ের পর তাঁর মধ্যেই তা লীন হয়ে যায়।
শ্লোক: 40
বেদাহং সমতীতানি বর্তমানানি চার্জুন ।
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কশ্চন ॥
(গীতা ৭/২৬)
অনুবাদঃ- হে অর্জুন ! পরমেশ্বর ভগবানরূপে আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত। আমি সমস্ত জীব সম্বন্ধে জানি, কিন্তু আমাকে কেউ জানে না।
শ্লোক: 41
ন মে বিদুঃ সুরগণাঃ প্রভবং ন মহর্ষয়ঃ ।
অহমাদির্হি দেবানাং মহর্ষীণাং চ সর্বশঃ ॥
(গীতা ১০/২)
অনুবাদঃ- দেবতারা বা মহর্ষিরাও আমার উৎপত্তি অবগত হতে পারে না, কেন না, সর্বতোভাবে আমিই দেবতা ও মহর্ষিদের আদি কারণ।
শ্লোক: 42
নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো
ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন ।
যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্য-
স্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনুং স্বাম্ ।।
(মুণ্ডক উপঃ ৩/২/৩ এবং কঠ উপঃ ১/২/২৩)
অনুবাদঃ- দক্ষ প্রবচনের দ্বারা, গভীর মেধার দ্বারা, এমন কি বহু শ্রবণের দ্বারাও পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ভগবান যাকে নির্বাচিত এবং পছন্দ করেন, তিনিই কেবল তাঁকে জানতে পারেন। সেই রকম ভক্তের কাছে ভগবান স্বয়ং নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন।
শ্লোক: 43
অতঃ শ্রীকৃষ্ণনামাদি ন ভবেদ্গ্রাহ্যমিন্দ্রিয়ৈঃ ।
সেবোন্মুখে হি জিহ্বাদৌ স্বয়মেব স্ফুরত্যদঃ ।।
(পদ্ম পুরাণ, ভঃ রঃ সিঃ ১/২/২৩৪)
অনুবাদঃ- অতএব শ্রীকৃষ্ণের নাম-রূপ-লীলা কখনও প্রাকৃত চক্ষু, কর্ণ আদির গ্রাহ্য নয়। জীব যখন সেবোন্মুখ হন অর্থাৎ চিৎ-স্বরূপে কৃষ্ণোন্মুখ হন, তখনই অপ্রাকৃত জিহ্বা আদি ইন্দ্রিয়ে কৃষ্ণনাম আদি স্বয়ংই স্ফূর্তি লাভ করে।
শ্লোক: 44
অতঃ শ্রীকৃষ্ণনামাদি ন ভবেদ্গ্রাহ্যমিন্দ্রিয়ৈঃ ।
সেবোন্মুখে হি জিহ্বাদৌ স্বয়মেব স্ফুরত্যদঃ ।।
(পদ্ম পুরাণ, ভঃ রঃ সিঃ ১/২/২৩৪)
অনুবাদঃ- অতএব শ্রীকৃষ্ণের নাম-রূপ-লীলা কখনও প্রাকৃত চক্ষু, কর্ণ আদির গ্রাহ্য নয়। জীব যখন সেবোন্মুখ হন অর্থাৎ চিৎ-স্বরূপে কৃষ্ণোন্মুখ হন, তখনই অপ্রাকৃত জিহ্বা আদি ইন্দ্রিয়ে কৃষ্ণনাম আদি স্বয়ংই স্ফূর্তি লাভ করে।
শ্লোক: 45
ন মাং কর্মাণি লিম্পন্তি ন মে কর্মফলে স্পৃহা ।
ইতি মাং যোহভিজানাতি কর্মভির্ন স বধ্যতে ।।
(গীতা- ৪/১৪)
অনুবাদঃ- কোন কর্মই আমাকে প্রভাবিত করতে পারে না এবং আমিও কোন কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা করি না। আমার এই তত্ত্ব যিনি জানেন, তিনিও কখনও সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হন না।
শ্লোক: 46
যো মামেবমসংমূঢ় জানাতি পুরুষোত্তমম্ ।
স সর্ববিদ্ ভজতি মাং সর্বভাবেন ভারত ॥
(গীতা- ১৫/১৯)
অনুবাদঃ- হে ভারত ! যিনি নিঃসন্দেহে আমাকে পুরুষোত্তম বলে জানেন, তিনি সর্বজ্ঞ এবং তিনি সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করেন।শ্লোক: 47
বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন ।
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ ।।
(গীতা- ৪/৫)
অনুবাদঃ- হে পরন্তপ অর্জুন ! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে ৷ আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না।
শ্লোক: 48
অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্ ।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া ।।
(গীতা- ৪/৬)
অনুবাদঃ- যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
শ্লোক: 49
রসোহহমপ্সু কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্যয়োঃ ।
প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু ॥
(গীতা- ৭/৮)
অনুবাদঃ- হে কৌন্তেয় ! আমিই জলের রস, চন্দ্র ও সূর্যের প্রভা, সর্ব বেদের প্রণব, আকাশের শব্দ এবং মানুষের পৌরুষ।
শ্লোক: 50
পূণ্যো গন্ধঃ পৃথিব্যাং চ তেজশ্চাস্মি বিভাবসৌ ।
জীবনং সর্বভূতেষু তপশ্চাস্মি তপস্বিষু ॥
(গীতা- ৭/৯)
অনুবাদঃ- আমি পৃথিবীর পবিত্র গন্ধ, অগ্নির তেজ, সর্বভূতের জীবন এবং তপস্বীদের তপ।
শ্লোক: 51
গামাবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্যহমোজসা ।
পুষ্ণামি চৌষধীঃ সর্বাঃ সোমো ভূত্বা রসাত্মকঃ ॥
(গীতা- ১৫/১৩)
অনুবাদঃ- আমি পৃথিবীতে প্রবিষ্ট হয়ে আমার শক্তির দ্বারা সমস্ত জীবদের ধারণ করি এবং রসাত্মক চন্দ্ররূপে ধান, যব আদি ঔষধি পুষ্ট করছি।
শ্লোক: 52
নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণহিতায় চ ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ ।।
(বিষ্ণু পুরাণ)
অনুবাদঃ- ব্রাহ্মণদের আরাধ্যদেব, গুরু ও ব্রাহ্মণদের হিতকারী এবং জগতের কল্যাণকারী শ্রীকৃষ্ণকে আমি সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি। শ্রীকৃষ্ণ ও গোবিন্দ নামে পরিচিত সেই পরমেশ্বর ভগবানকে আমি পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি ।
শ্লোক: 53
কৃষ্ণ- সূর্যসম; মায়া হয় অন্ধকার ।
যাহাঁ কৃষ্ণ, তাহাঁ নাহি মায়ার অধিকার ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ২২/৩১)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং মায়াকে অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সূর্য-কিরণের প্রকাশ হলে যেমন আর সেখানে অন্ধকার থাকতে পারে না, তেমনই কেউ যদি কৃষ্ণভক্তির পন্থা অবলম্বন করেন, তখন মায়ার অন্ধকার তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে দূর হয়ে যায়।
শ্লোক: 54
অহো বকী যং স্তনকালকূটং
জিঘাংসয়াপায়য়দপ্যসাধ্বী ।
লেভে গতিং ধাক্র্যচিতাং ততোহন্যং
কং বা দয়ালুং শরণং ব্রজেম ।।
(ভাগবত ৩/২/২৩)
অনুবাদঃ- আহা, কি আশ্চর্য! বকাসুরের ভগ্নী পুতনা কৃষ্ণকে বধ করার জন্য তার স্তনে কালকূট মাখিয়ে তা কৃষ্ণকে পান করিয়েছিল। কিন্তু তবুও, কৃষ্ণ তাকে তাঁর মাতারূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং তাকে মাতার উপযুক্ত গতি দান করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আমি আর কোন্ দয়ালুর শরণাপন্ন হতে পারি ?
শ্লোক: 55
চিন্তামণিপ্রকরসদ্মসু কল্পবৃক্ষ-
লক্ষাবৃতেষু সুরভীরভিপালয়ন্তম্ ।
লক্ষ্মীসহস্রশতসম্ভ্রমসেব্যমানং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/২৯)
অনুবাদঃ- আমি সেই আদি পুরুষ গোবিন্দের ভজনা করি, যিনি লক্ষ লক্ষ কল্পবৃক্ষ দ্বারা আবৃত, চিন্তামণির দ্বারা রচিত ধামে, সমস্ত বাসনা পূর্ণকারী সুরভী গাভীদের পালন করছেন। তিনি নিরন্তর শত শত লক্ষ্মীদেবীর দ্বারা সম্ভ্রম সহকারে সেবিত হচ্ছেন ।
শ্লোক: 56
আলোলচন্দ্রক লসদবনমাল্যবংশী-
রত্নাঙ্গদং প্রণয়কেলিকলাবিলাসম্ ।
শ্যামং ত্রিভঙ্গললিতং নিয়তপ্রকাশং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩১)
অনুবাদঃ- দোলায়িত চন্দ্রক শোভিতা বনমালা যাঁর গলদেশে, বংশী ও রত্নাঙ্গদ যাঁর করদ্বয়ে, সর্বদা প্রণয়কেলি বিলাসযুক্ত যিনি, ললিত ত্রিভঙ্গ শ্যামসুন্দর রূপই যাঁর নিত্য প্রকাশ, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।
শ্লোক: 57
ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ ।
জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষণ্ণং ভগ ইতীঙ্গনা ।।
(বিষ্ণু পুরাণ ৬/৫/৭৪)
অনুবাদঃ- পূর্ণ সম্পদ, পূর্ণ শক্তি, পূর্ণ খ্যাতি, পূর্ণ সৌন্দর্য, পূর্ণ জ্ঞান ও পূর্ণ বৈরাগ্য -এগুলি হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের ছয়টি ঐশ্বর্য।
শ্লোক: 58
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।
(গীতা ৪/১১)
অনুবাদঃ- যারা যেভাবে আমার প্রতি আত্মসমর্পণ করে, আমি তাদেরকে সেভাবেই পুরস্কৃত করি। হে পার্থ ! সকলেই সর্বতোভাবে আমার পথ অনুসরণ করে।
শ্লোক: 59
সমোহহং সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোহস্তি ন প্রিয়ঃ ।
যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্ ॥
(গীতা ৯/২৯)
অনুবাদঃ- আমি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন। কেউই আমার বিদ্বেষ ভাবাপন্ন নয় এবং প্রিয়ও নয়। কিন্তু যাঁরা ভক্তিপূর্বক আমাকে ভজনা করেন, তাঁরা আমাতে অবস্থান করেন এবং আমিও তাদের মধ্যে বাস করি।
শ্লোক: 60
অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক্ ।
সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগ্ ব্যবসিতো হি সঃ ॥
(গীতা ৯/৩০)
অনুবাদঃ- অতি দুরাচারী ব্যক্তিও যদি অনন্য ভক্তি সহকারে আমাকে ভজনা করেন, তাকে সাধু বলে মনে করবে, কারণ তাঁর দৃঢ় সংকল্পে তিনি যথার্থ মার্গে অবস্থিত।
শ্লোক: 61
ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি ।
কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি ॥
(গীতা ৯/৩১)
অনুবাদঃ- তিনি শীঘ্রই ধর্মাত্মায় পরিণত হন এবং নিত্য শান্তি লাভ করেন। হে কৌন্তেয় ! তুমি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা কর যে, আমার ভক্ত কখনও বিনষ্ট হন না।
শ্লোক: 62
তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম্ ।
দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে ॥
(গীতা ১০/১০)
অনুবাদঃ- যাঁরা ভক্তিযোগ দ্বারা প্রীতিপূর্বক আমার ভজনা করে নিত্যযুক্ত, আমি তাঁদের শুদ্ধ জ্ঞানজনিত বুদ্ধিযোগ দান করি, যার দ্বারা তাঁরা আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন।শ্লোক: 63
তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ ।
নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা ॥
(গীতা ১০/১১)
অনুবাদঃ- তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য আমি তাঁদের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে, উজ্জ্বল জ্ঞান-প্রদীপের দ্বারা অজ্ঞান-জনিত অন্ধকার নাশ করি।
শ্লোক: 64
ভাবগ্রাহী জনার্দনঃ
(চৈতন্য-ভাগবত আদি ১১/১০৮)
অনুবাদঃ- ভগবান জনার্দন শুধু ভক্তের ভাবটুকুই গ্রহণ করেন।
শ্লোক: 65
নাহং তিষ্ঠামি বৈকুণ্ঠে যোগিণাং হৃদয়েষু বা ।
মদ্ভক্তাঃ যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ ।।
(পদ্ম পুরাণ)
অনুবাদঃ- হে নারদ! আমি বৈকুণ্ঠে থাকি না, যোগীদের হৃদয়েও থাকি না। আমার ভক্তগণ যেখানেই আমার লীলাবিলাসের গুণকীর্তন করে, আমি সেখানেই থাকি।
শ্লোক: 66
তেষামহং সমুদ্ধর্তা মৃত্যুসংসারসাগরাৎ ।
ভমামি ন চিরাৎ পার্থ ময্যাবেশিতচেতসাম্ ॥
(গীতা ১২/৭)
অনুবাদঃ- হে পার্থ ! আমাতে আবিষ্টচিত্ত সেই সমস্ত ভক্তদের আমি মৃত্যুময় সংসার-সাগর থেকে অচিরেই উদ্ধার করি।
শ্লোক: 67
অসমোর্ধ্ব
(অজ্ঞাত উৎস) অসম—যাঁর সমান কেউ নেই; ঊর্ধ্ব—কিংবা যাঁর ঊর্ধ্বে কেউ নেই।
অনুবাদঃ- কেউ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সমান বা তাঁর থেকে বড় নয়।
শ্লোক: 68
একং ব্রহ্ম দ্বিতীয়ং নাস্তি
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- ভগবান একজনই, দুজন নন।
শ্লোক: 69
সঃ ভগবান্ স্বয়ং কৃষ্ণ
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- সেই শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান।
শ্লোক: 70
নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্ ।
একো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্ ।।
(কঠ উপঃ ২/২/১৩, শ্বেতাশ্বতর উপঃ ৬/১৩)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর হচ্ছেন নিত্য এবং জীবসকলও নিত্য। পরমেশ্বর হচ্ছেন চেতন এবং জীবসকলও চেতন। পার্থক্য শুধু এই যে, সেই পরমেশ্বর সমস্ত জীবের প্রয়োজন সরবরাহ করছেন।
শ্লোক: 71
একদেশস্থিতস্যাগ্নের্জ্যোৎস্না বিস্তারিণী যথা ।
পরস্য ব্রহ্মণঃ শক্তিস্তথেদমখিলং জগৎ ।।
(বিষ্ণু পুরাণ ১/২২/৫৩)
অনুবাদঃ- একই স্থানে অবস্থিত অগ্নির প্রভা বা আলোক যেমন সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়, সেই রকম পরব্রহ্মের শক্তি অখিল জগৎ জুড়ে ব্যাপ্ত হয়ে আছে।
শ্লোক: 72
সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- জড় ও চেতন – সব কিছুই পরমেশ্বর ভগবান তথা পরব্রহ্ম থেকে অভিন্ন ।
শ্লোক: 73
যঃ কারণার্ণবজলে ভজতি স্ম যোগ-
নিদ্রামনন্তজগদণ্ডসরোমকূপঃ ।
আধারশক্তিমবলম্ব্য পরাং স্বমূর্তিং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪৭)
অনুবাদঃ- আধার-শক্তিময়ী শেষাখ্যা শ্রেষ্ঠ-স্বমূর্তি অবলম্বনপূর্বক যিনি স্বীয় রোমকূপে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে কারণার্ণবে শয়ন করে যোগনিদ্রা সম্ভোগ করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
শ্লোক: 74
আনন্দচিন্ময়রসপ্রতিভাবিতাভি-
স্তাভির্য এব নিজরূপতয়া কলাভিঃ ।
গোলোক এব নিবসত্যখিলাত্মভূতো
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৭)
অনুবাদঃ- পরম আনন্দবিধায়ক হ্লাদিনী শক্তির মূর্ত প্রকাশ শ্রীমতি রাধারাণীর সঙ্গে যিনি স্বীয় ধাম গোলোকে অবস্থান করেন এবং শ্রীমতি রাধারাণীর অংশ-প্রকাশ, চিন্ময় রসের আনন্দে পরিপূর্ণ ব্রজগোপীরা যাঁর নিত্য লীলাসঙ্গিনী, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
শ্লোক: 75
নারায়ণ পরোহব্যক্তাৎ
(শঙ্করাচার্য/গীতা-ভাষ্য)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ হচ্ছেন ব্যক্ত ও অব্যক্ত জড় সৃষ্টির অতীত।
শ্লোক: 76
যথা মানতি ভূতানি ভূতষূচ্চাবচেষ্বনু ।
প্রবিষ্টান্যপ্রবিষ্টানি তথা তেষু ন তেষ্বহম্ ।
(ভাগবত ২/৯/৩৫)
অনুবাদঃ- জড় জগতের উপাদান বা মহাভূতসমূহ যেমন সমস্ত প্রাণীর ভিতরে প্রবিষ্ট হয়েও বাহিরে অপ্রবিষ্টরূপে স্বতন্ত্র বর্তমান থাকে, তেমনই আমিও সমস্ত জড় সৃষ্টির মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েও তার মধ্যে অবস্থিত নই।
শ্লোক: 77
ন হ্যস্য কর্হিচিদ্রাজন্ পুমান্ বেদ বিধিৎসিতম্ ।
যদ্বিজিজ্ঞাসয়া যুক্তা মুহ্যন্তি কবয়োহপি হি ।।
(ভাগবত ১/৯/১৬)
অনুবাদঃ- হে রাজন্, পরমেশ্বরের (শ্রীকৃষ্ণের) পরিকল্পনা কেউই জানতে পারে না। এমন কি, মহান দার্শনিকেরাও বিশদ অনুসন্ধিৎসা সহকারে নিয়োজিত থেকেও কেবলই বিভ্রান্ত হন। (যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভীষ্মদেবের উক্তি)
শ্লোক: 78
অদ্বৈতমচ্যুতমনাদিমনন্তরূপ-
মাদ্যং পুরাণপুরুষং নবযৌবনঞ্চ ।
বেদেষু দুর্লভমদুর্লভমাত্মভক্তৌ
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৩)
অনুবাদঃ- বেদেরও অগম্য, কিন্তু শুদ্ধ আত্মভক্তিরই লভ্য, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি। তিনি অদ্বৈত, অচ্যুত, অনাদি, অনন্তরূপ, আদ্য, পুরাণ পুরুষ হয়েও নবযৌবন-সম্পন্ন সুন্দর পুরুষ।
শ্লোক: 79
নায়ং সুখাপো ভগবান্ দেহিনাং গোপিকাসুতঃ ।
জ্ঞানিনাং চাত্মভূতানাং যথা ভক্তিমতামিহ ।।
(ভাগবত ১০/৯/২১)
অনুবাদঃ- যশোদা পুত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাগানুগাভক্তি-পরায়ণ ভক্তদের কাছে যেমন সুলভ, মনোধর্মী জ্ঞানী, ব্রত ও তপস্যা-পরায়ণ আত্মারাম অথবা দেহাত্মবুদ্ধি পরায়ণ ব্যক্তিদের কাছে তেমন সুলভ নন।
(শ্রী শুকদেব গোস্বামী )
শ্লোক: 80
এতদীশনমীশস্য প্রকৃতিস্থোহপি তদগুণৈঃ ।
ন যুজ্যতে সদাত্মস্থৈর্যথা বুদ্ধিস্তদাশ্রয়া ।।
(ভাগবত ১/১১/৩৮)
অনুবাদঃ- জড়া প্রকৃতিতে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃতির গুণের বশীভূত না হওয়াই হচ্ছে ভগবানের ঐশ্বর্য। তেমনই, যাঁরা তাঁর শরণাগত হয়ে তাঁদের বুদ্ধিকে তাঁর মধ্যে স্থির করেন, তাঁরা কখনও প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হন না।
(সূত গোস্বামী)
শ্লোক: 81
হরির্হি নির্গুণঃ সাক্ষাৎ পুরুষঃ প্রকৃতেঃ পরঃ ।
স সর্বদৃগুপদ্রষ্টা তং ভজন্নির্গুণো ভবেৎ ।।
(ভাগবত ১০/৮৮/৫)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি জড়া প্রকৃতির অতীত; তাই তিনি হচ্ছেন সাক্ষাৎ গুণাতীত পুরুষ। অন্তর ও বাইরের সমস্ত বিষয় তিনি দর্শন করতে পারেন। তাই তিনিই হচ্ছেন সমস্ত জীবের পরম অধ্যক্ষ। কেউ যদি তাঁর চরণকমলকে আশ্রয় করে তাঁর ভজনা করেন, তা হলে তিনিও সেই রকম গুণাতীত স্তর লাভ করতে পারেন।
শ্লোক: 82
যস্মিন্ বিজ্ঞাতে সর্বমেবং বিজ্ঞাতং ভবতি
(মুণ্ডক উপঃ ১/৩)
অনুবাদঃ- কেউ যদি পরম নিয়ন্তা ভগবানকে জানতে পারেন, তা হলে তিনি অন্য সব কিছুই জানতে পারেন।
শ্লোক: 83
ন তস্য কার্যং করণং চ বিদ্যতে
ন তৎ সমশ্চাভ্যধিকশ্চ দৃশ্যতে ।
পরাস্য শক্তির্বিবিধৈব শ্রুয়তে
স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ ।।
(শ্বেতাশ্বতর উপঃ ৬/৮)
অনুবাদঃ- সেই ভগবানের প্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কোন কার্য নেই, যেহেতু তাঁর কোন প্রাকৃত শরীর বা ইন্দ্রিয় নেই। কোন কিছুই তাঁর সমান বা তাঁর থেকে অধিক বলে দৃশ্য হয় না। তিনি বিবিধ অচিন্ত্য পরা শক্তির আধার। এক হয়েও সেই স্বাভাবিক পরা শক্তি জ্ঞান, বল ও ক্রিয়া ভেদে ত্রিবিধা।
শ্লোক: 84
অপানিপাদো জবনো গ্রহিতা
পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ ।
(শ্বেতাশ্বতর উপঃ ৩/১৯)
অনুবাদঃ- যদিও পরম পুরুষ ভগবানকে হস্ত-পদ বিহীন বলে বর্ণনা করা হয়েছে, তবুও তিনি সমস্ত যজ্ঞের নৈবেদ্য গ্রহণ করেন এবং দ্রুত গমন করেন। তাঁর কোন জড় চক্ষু নেই, তবুও তিনি সব কিছু দর্শন করেন। তাঁর কোন জড় কর্ণ নেই, তবুও তিনি সব কিছুই শ্রবণ করেন।
শ্লোক: 85
অঙ্গানি যস্য সকলেন্দ্রিয়বৃত্তিমন্তি
পশ্যন্তি পান্তি কলয়ন্তি চিরং জগন্তি ।
আনন্দচিন্ময়সদুজ্জ্বলবিগ্রহস্য
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩২)
অনুবাদঃ- সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি; তাহাঁর বিগ্রহ আনন্দময়, চিন্ময় ও সন্ময়, সুতরাং পরমোজ্জ্বল। সেই বিগ্রহগত অঙ্গসকল প্রত্যেকেই সমস্ত ইন্দ্রিয়বৃত্তি-বিশিষ্ট এই চিদচিৎ অনন্ত জগৎসমূহকে নিত্যকাল দর্শন, পালন ও কলন করেন।
শ্লোক: 86
ওঁ আনন্দময়োহভ্যাসাৎ
(বেদান্তসূত্র ১/১/১২)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান স্বভাবতই আনন্দময় ।
শ্লোক: 87
রসো বৈ সঃ
(তৈত্তিরীয় উপঃ ২/৭/১)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবানই হচ্ছেন সমস্ত দিব্য রসের উৎস ।
শ্লোক: 88
নিত্য নবনবায়মান
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- নিত্যকাল নব নব বৈশিষ্ট্য সমন্বিত।
শ্লোক: 89
কেশব তুয়া জগৎ বিচিত্র
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)
অনুবাদঃ- হে কেশব! তোমার সৃষ্ট জগৎ বড়ই বিচিত্র ।
শ্লোক: 90
আত্মারামাশ্চ মুনয়ো নির্গ্রন্থা অপ্যুরুক্রমে ।
কুর্বন্ত্যহৈতুকীং ভক্তিমিত্থম্ভূতগুণো হরিঃ ।।
(ভাগবত ১/৭/১০)
অনুবাদঃ- আত্মাতে যারা রমণ করেন, এরূপ বাসনা-গ্রন্থিশূন্য মুনিরাও অত্যদ্ভূত কার্য সম্পাদনকারী শ্রীকৃষ্ণে অহৈতুকী ভক্তি করেন, কেন না জগতে চিত্তহারী হরির এই রকম একটি গুণ আছে।
শ্লোক: 91
জয়তি জননিবাসো দেবকীজন্মবাদো
যদুবরপরিষৎ স্বৈর্দোর্ভিরস্যন্নধর্মম্ ।
স্থিরচরবৃজিনঘ্নঃ সুস্মিতশ্রীমুখেন
ব্রজপুরবনিতানাং বর্ধয়ন্ কামদেবম্ ।।
(ভাগবত ১০/৯০/৪৮)
অনুবাদঃ- সমস্ত জীবের আশ্রয়স্বরূপ, দেবকীপুত্ররূপে পরিচিত, যদুদের সভাপতি, নিজ বাহুর দ্বারা অধর্ম নাশকারী, স্থাবর-জঙ্গম সমস্ত জীবের অমঙ্গলহারী, মধুর হাস্য মুখের দ্বারা ব্রজবনিতাদের কামবর্ধনকারী শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র জয়যুক্ত হোন।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 92
বেণুং ক্বণন্তমরবিন্দদলায়তাক্ষং
বর্হাবতংসমসিতাম্বুদসুন্দরাঙ্গম্ ।
কন্দর্পকোটিকমনীয়বিশেষশোভং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩০)
অনুবাদঃ- মুরলীগান-তৎপর, কমলদলের ন্যায় প্রফুল্লচক্ষু, ময়ূরপুচ্ছ শিরোভূষণ, নীল মেঘবর্ণ সুন্দর শরীর, কোটি কন্দর্প মোহন বিশেষ শোভা-বিশিষ্ট সেই আদি-পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
শ্লোক: 93
স্বপাদমূলং ভজতঃ প্রিয়স্য
ত্যক্তান্যভাবস্য হরিঃ পরেশঃ ।
বিকর্ম যচ্চোৎপতিতং কথঞ্চিদ্
ধুনোতি সর্বং হৃদি সন্নিবিষ্টঃ ।।
(ভাগবত ১১/৫/৪২)
অনুবাদঃ- যিনি অন্য ভাব পরিত্যাগ করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের পূর্ণ আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয়। তিনি যদি ঘটনাক্রমে কোন পাপ করেও ফেলেন, পরমেশ্বর হৃদয়ে প্রবিষ্ট থেকে তাঁর পাপ বিনষ্ট করে দেন।
শ্লোক: 94
ভগবান্ ভক্তহৃদিস্থিতঃ
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বদাই তাঁর চরণকমল তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে স্থাপন করেন।
শ্লোক: 95
যস্যাহমনুগৃহ্নামি হরিষ্যে তদ্ধনং শনৈঃ ।
(ভাগবত ১০/৮৮/৮)
অনুবাদঃ- আমার ভক্তের প্রতি আমার প্রথম কৃপা হচ্ছে আমি তার সমস্ত জড়-জাগতিক ধনসম্পদ হরণ করি।
শ্লোক: 96
সত্যং দিশত্যর্থিতমর্থিতো নৃণাং
নৈবার্থদো যৎ পুনরর্থিতা যতঃ ।
স্বয়ং বিধত্তে ভজতামনিচ্ছতা-
মিচ্ছাপিধানং নিজপাদপল্লবম্ ।।
(ভাগবত ৫/১৯/২৭)
অনুবাদঃ- কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ যে তাঁর সেই প্রার্থনা পূর্ণ করেন, সেই কথা সত্য; কিন্তু যা থেকে পুনঃপুনঃ প্রার্থনার উদয় হয়, সেই প্রকার বস্তু তিনি দান করেন না। অন্য কামনাযুক্ত হয়ে কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করেন, তখন তিনি স্বয়ংই তাঁদের অন্য কামনা শান্তিকারী তাঁর শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় দান করেন।
(ভারতবাসীদের উদ্দেশ্যে দেবতাদের উক্তি)
শ্লোক: 97
বালস্য নেহ শরণং পিতরৌ নৃসিংহ
নার্তস্য চাগদমুদন্বতি মজ্জতো নৌঃ ।
তপ্তস্য তৎপ্রতিবিধির্য ইহাঞ্জসেষ্ট-
স্তাবদ্ বিভো তনুভৃতাং তদুপেক্ষিতানাম্ ।।
(ভাগবত ৭/৯/১৯)
অনুবাদঃ- হে নৃসিংহদেব! হে বিভো! জীবন সম্বন্ধে দেহ-চেতনাবশত যে সমস্ত দেহবদ্ধ জীবগণ আপনার দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছে, তারা তাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য কিছুই করতে পারে না। যে প্রতিবিধানই তারা গ্রহণ করুক না কেন, সেগুলি হয়ত সাময়িকভাবে উপকারী হতে পারে, কিন্তু নিশ্চিতরূপে সেগুলি ক্ষণস্থায়ী। দৃষ্টান্তস্বরূপ, পিতা-মাতা তাদের বালককে রক্ষা করতে পারে না, ওষুধ ও চিকিৎসক রোগীকে যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিতে পারে না এবং একটি নৌকা সমুদ্রে নিমজ্জমান কোনও ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারে না।
শ্লোক: 98
মারবি রাখবি—যো ইচ্ছা তোহারা ।
নিত্যদাস-প্রতি তুয়া অধিকারা ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, মানস, দেহ, গেহ ৩)
অনুবাদঃ- হে কৃষ্ণ! আমাকে মার কিংবা রক্ষা কর তা তোমার ইচ্ছা, কেন না আমি তোমার নিত্যদাস। এই দাসের প্রতি তোমার পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
0 Comments