মায়া সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 1
অপ্রারব্ধফলং পাপং কূটং বীজং ফলোন্মুখম্ ।
ক্রমেনৈব প্রলীয়তে বিষ্ণুভক্তি-রতাত্মনাম্ ।।
(পদ্মপুরাণ)
অনুবাদঃ- পাপময় জীবনে পাপকর্মের সুপ্ত প্রতিক্রিয়াগুলির বিভিন্ন স্তর রয়েছে । কিছু প্রতিক্রিয়া প্রায় ফলোন্মুখ, কিছু প্রতিক্রিয়া আরও সুপ্ত (কূট) কিংবা কিছু রয়েছে একেবারে বীজ আকারে । তবে সর্ব অবস্থাতেই, বিষ্ণুভক্তিতে রত ব্যক্তির সমস্ত প্রকার পাপকর্মের প্রতিক্রিয়া ক্রমে ক্রমে লয় প্রাপ্ত হয় ।
শ্লোক: 2
লোকে ব্যবায়ামিষমদ্যসেবা
নিত্যা হি জন্তোর্ন হি তত্র চোদনা ।
ব্যবস্থিতিস্তেষু বিবাহযজ্ঞ
সুরাগ্রহৈরাসু নিবৃত্তিরিষ্টা ।।
(ভাগবত ১১/৫/১১)
অনুবাদঃ- এই জড় জগতে বদ্ধ জীবেরা সর্বদাই কাম উপভোগ, মাংসাহার ও মদ্যপানের প্রবণতা-সম্পন্ন। সুতরাং ধর্মীয় শাস্ত্র কখনও এগুলিকে উৎসাহ দেয় না। যদিও শাস্ত্রে বিবাহ যজ্ঞের মাধ্যমে কামভোগ, পশুযজ্ঞের মাধ্যমে মাংসাহার এবং সুরাগ্রহ যজ্ঞের মাধ্যমে মদ্যপানের নির্দেশ রয়েছে- কিন্তু এই সমস্ত যজ্ঞের পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐ সমস্ত ভোগ থেকে নিবৃত্তি লাভ করা।
শ্লোক: 3
শরীর অবিদ্যা-জাল, জড়েন্দ্রিয় তাহে কাল,
জীবে ফেলে বিষয়-সাগরে।
তা'র মধ্যে জিহ্বা অতি, লোভময় সুদুর্মতি,
তা'কে জেতা কঠিন সংসারে ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, প্রসাদ-সেবায় ১)
অনুবাদঃ- শরীর একটি অবিদ্যার জাল, ইন্দ্রিয়গুলি যেন কালশত্রু, কেন না সেগুলি জীবকে বিষয় ভোগের সাগরে নিক্ষেপ করে। ওই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে জিহ্বা হচ্ছে সবচেয়ে লোলুপ, অসংযত ও দুর্মতিবিশিষ্ট। এই সংসারে জিহ্বাকে জয় করা খুবই কঠিন।
শ্লোক: 4
তে তং ভুক্ত্বা স্বর্গলোকং বিশালং
ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি ।
এবং ত্রয়ীধর্মমনুপ্রপন্না
গতাগতং কামকামা লভন্তে ॥
(গীতা ৯/২১)
অনুবাদঃ- তাঁরা সেই বিপুল স্বর্গসুখ উপভোগ করে পুণ্য ক্ষয় হলে মর্তলোকে ফিরে আসেন। এভাবেই ত্রিবেদোক্ত ধর্মের অনুষ্ঠান করে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আকাঙ্ক্ষী মানুষেরা সংসারে কেবলমাত্র বারংবার জন্ম-মৃত্যু লাভ করে থাকেন।
শ্লোক: 5
কর্মণা দৈবনেত্রেণ জন্তুর্দেহোপপত্তয়ে।
স্ত্রীয়াঃ প্রবিষ্ট উদরং পুংসো রেতঃকণাশ্রয়ঃ।।
(ভাগবত ৩/৩১/১)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বরের অধ্যক্ষতায় জীবাত্মা তার পূর্বকৃ্ত কর্মের ফল অনুসারে, বিশেষ প্রকার শরীর ধারণের জন্য, পুরুষের রেতকণা আশ্রয় করে স্ত্রীর গর্ভে প্রবেশ করে।
শ্লোক: 6
পুরুষঃ প্রকৃতিস্থো হি ভুঙ্ ক্তে প্রকৃতিজান্ গুণান্ ।
কারণং গুণসঙ্গোহস্য সদসদ্ যোনিজন্মসু ॥
(গীতা ১৩/২২)
অনুবাদঃ- জড়া প্রকৃ্তিতে অবস্তিত হয়ে জীব প্রকৃতিজাত গুণসমূহ ভোগ করে। প্রকৃতির গুণের সঙ্গবসতই তার সৎ ও অসৎ যোনিসমূহে জন্ম হয়।
শ্লোক: 7
নূনং প্রমত্তঃ কুরুতে বিকর্ম
যদিন্দ্রিয়প্রীতয় আপৃণোতি।
ন সাধু মন্যে যত আত্মনোহয়-
মসন্নপি ক্লেশদ আস দেহঃ ।।
(ভাগবত ৫/৫/৪)
অনুবাদঃ- যখন কোন ব্যক্তি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগকেই জীবনের লক্ষ্য বলে গণ্য করে, সে নিঃসন্দেহে জড়বাদী জীবনধারায় প্রমত্ত হয়ে ওঠে এবং সমস্ত প্রকার পাপকর্মে লিপ্ত হয়। সে জানে না যে, তার অতীত পাপকর্মের ফলে সে ইতিমধ্যেই একটি দেহ পেয়েছে, যা ক্ষণস্থায়ী হওয়া সত্ত্বেও তার দুঃখের কারণ। আসলে এই জড় গ্রহণ করা জীবের উচিত হয়নি, কিন্তু ইন্দ্রিয়-ভোগের জন্যই জীবকে এই জড় দেহ প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি এভাবেই পুনরায় ইন্দ্রিয়ভোগে লিপ্ত হয়ে একের পর এক জড় দেহ লাভ করা বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে উপযুক্ত নয়।
শ্লোক: 8
পরাভবস্তাবদবোধজাতো
যাবন্ন জিজ্ঞাসত আত্মতত্ত্বম্ ।
যাবৎ ক্রিয়াস্তাবদিদং মনো বৈ
কর্মাত্মকং যেন শরীরবন্ধঃ ।।
(ভাগবত ৫/৫/৫)
অনুবাদঃ- যতদিন পর্যন্ত জীব আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা না করে, ততদিন পর্যন্তই সে জড় প্রকৃতির প্রভাবে পরাস্ত হয়ে অবিদ্যাজাত দুঃখ-কষ্টের শিকার হয়। পাপই হোক আর পুণ্যই হোক- কর্ম মাত্রই ফল উৎপাদন করে। কোন না কোন কর্মে রুচি থাকলেই মন কর্মাত্মক হয়, অর্থাৎ সকাম কর্মের দ্বারা তার মন কলুষিত থাকে। মন যতদিন কলুষিত থাকে, চেতনাও ততদিন আচ্ছাদিত থাকে এবং যতদিন পর্যন্ত কোন ব্যক্তি সকাম কর্মে মগ্ন থাকে, ততদিন তাকে জড় দেহ গ্রহণ করতেই হবে।
শ্লোক: 9
কৃষ্ণ-বহির্মুখ হঞা ভোগ-বাঞ্ছা করে।
নিকটস্থ মায়া তারে জাপটিয়া ধরে।।
(জগদানন্দ পণ্ডিত, প্রেমবিবর্ত)
অনুবাদঃ- যেই মুহূর্তে কেউ কৃষ্ণের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়ে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা করে, সেই মুহুর্তেই ভগবানের মায়াশক্তি তাকে জড় বন্ধনে আবদ্ধ করে।
শ্লোক: 10
কৃষ্ণ ভুলি' সেই জীব অনাদি- বহির্মুখ ।
অতএব মায়া তারে দেয় সংসার-দুঃখ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ২০/১১৭)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে জীব অনাদিকাল ধরে জড়া প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রয়েছে। তাই মায়া তাকে এই জড় জগতে নানা প্রকার দুঃখ প্রদান করছে ।
শ্লোক: 11
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-বাঞ্ছা- -তারে বলি, 'কাম' ।
কৃষ্ণেন্দ্রিয়প্রীতি-ইচ্ছা ধরে 'প্রেম' নাম ।।
(চৈঃ চঃ আদি ৪/১৬৫)
অনুবাদঃ- নিজের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির বাসনাকে বলা হয় কাম, আর শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়ের প্রীতি সাধনের ইচ্ছাকে বলা হয় প্রেম ।
শ্লোক: 12
বিষয় ছাড়িয়া কবে শুদ্ধ হবে মন ।
কবে হাম হেরব শ্রীবৃন্দাবন ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, গৌরাঙ্গ বলিতে)
অনুবাদঃ- সেদিন আমার কবে হবে যখন আমার মন বিষয় বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ হবে, আমি শ্রীবৃন্দাবন ধামে শ্রীশ্রীরাধা-কৃষ্ণের মাধুর্যপ্রেম উপলব্ধি করতে সক্ষম হব এবং আমার পারমার্থিক জীবন পূর্ণরূপে সাফল্যমণ্ডিত হবে।
শ্লোক: 13
'কাম' কৃষ্ণ-কর্মার্পণে, 'ক্রোধ' ভক্তদ্বেষি-জনে,
'লোভ' ইষ্টলাভ বিনে, 'মদ' কৃষ্ণগুণগানে,
নিযুক্ত করিব যথা তথা ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, অন্য অভিলাষ ছাড়ি)
অনুবাদঃ- আমার কর্মফল কৃষ্ণকে নিবেদন করার মাধ্যমে আমি কামকে নিযুক্ত করব। ভক্তবিদ্বেষীদের প্রতি আমার ক্রোধ প্রদর্শন করব। সাধুসঙ্গে হরিকথা শ্রবণ করার জন্য আমি আমার লোভকে নিযুক্ত করব। এই মুহূর্তে আমি আমার আরাধ্য ভগবানক লাভ করতে পারলাম না- এই চিন্তায় আমি মোহগ্রস্ত হব । শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তনের মধ্যেই আমার মত্ততা প্রকাশিত হবে। এভাবেই এদের আমি কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত করব।
শ্লোক: 16
পিশাচী পাইলে যেন মতিচ্ছন্ন হয়।
মায়াগ্রস্ত জীবের হয় সে-ভাব উদয় ।।
অনুবাদঃ- জীব যখন মায়াগ্রস্ত হয়, তখন তার অবস্থা ঠিক যেন পিশাচীর আক্রমণগ্রস্ত একজন ব্যক্তির মতো ।শ্লোক: 17
ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্বমিদং জগৎ ।
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্ ॥
(গীতা ৭/১৩)
অনুবাদঃ- (সত্ত্ব, রজ ও তম) তিনটি গুণের দ্বারা মোহিত হওয়ার ফলে সমগ্র জগৎ এই সমস্ত গুণের অতীত ও অব্যয় আমাকে জানতে পারে না।
শ্লোক: 18
প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ ।
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে ॥
(গীতা ৩/২৭)
অনুবাদঃ- অন্ধকারে মোহাচ্ছন্ন জীব জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ দ্বারা ক্রিয়মাণ সমস্ত কার্যকে স্বীয় কার্য বলে মনে করে 'আমি কর্তা'- এই রকম অভিমান করে।
শ্লোক: 19
ভক্তিযোগেন মনসি সম্যক্ প্রণিহিতেহমলে ।
অপশ্যৎপুরুষং পূর্ণং মায়াং চ তদপাশ্রয়ম্ ।।
(ভাগবত ১/৭/৪)
অনুবাদঃ- এভাবেই তাঁর মনকে একাগ্র করে জড় কলুষ থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হয়ে তিনি যখন পূর্ণরূপে ভক্তিযোগে যুক্ত হয়েছিলেন, তখন তিনি পরমেশ্বর ভগবানকে তাঁর মায়াশক্তি সহ দর্শন করেছিলেন, যে মায়া পূর্ণরূপে তাঁর বশীভূত ছিল।
শ্লোক: 20
যয়া সম্মোহিতো জীব আত্মানং ত্রিগুণাত্মকম্ ।
পরোহপি মনুতেহনর্থং তৎকৃতং চাভিপদ্যতে ।।
(ভাগবত ১/৭/৫)
অনুবাদঃ- এই বহিরঙ্গা শক্তির প্রভাবে জীব প্রকৃতির তিনটি গুণের অতীত হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে জড়া প্রকৃতি সম্ভূত বলে মনে করে এবং তার ফলে জড় জগতের দুঃখ-ভোগ করে।
শ্লোক: 21
অহন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তীহ যমালয়ম্ ।
শেষাঃ স্থাবরমিচ্ছন্তি কিমাশ্চর্যমতঃ পরম্ ।।
(মহাভারত, বনপর্ব, ৩১৩/১১৬)
অনুবাদঃ- প্রতিদিন শত সহস্র লক্ষ জীব যমালয়ে গমন করে। তবুও, যারা এখনও অবশিষ্ট রয়েছে তারা এখানে স্থায়ীভাবে বাস করতে চায়। এর থেকে আশ্চর্যজনক বিষয় আর কি হতে পারে?
শ্লোক: 22
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া ।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥
(গীতা ৭/১৪)
অনুবাদঃ- আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন।
শ্লোক: 23
সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়সাধনশক্তিরেকা
ছায়েব যস্য ভুবনানি বিভর্তি দুর্গা ।
ইচ্ছানুরূপমপি যস্য চ চেষ্টতে সা
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪৪)
অনুবাদঃ- স্বরূপশক্তি বা চিৎ-শক্তির ছায়াস্বরূপা প্রাপঞ্চিক জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-সাধিনী মায়াশক্তিই ভুবন-পূজিতা দুর্গা। তিনি যাঁর ইচ্ছানুরূপ চেষ্টা করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
শ্লোক: 24
ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্ ।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে ।।
(গীতা ২/৪৪)
অনুবাদঃ- যারা ভোগ ও ঐশ্বর্যসুখে একান্ত আসক্ত, সেই সমস্ত বিবেকবর্জিত মূঢ় ব্যক্তিদের বুদ্ধি সমাধি অর্থাৎ ভগবানে একনিষ্ঠতা লাভ হয় না।
শ্লোক: 25
ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে ।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে ॥
(গীতা ২/৬২)
অনুবাদঃ- ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়, আসক্তি থেকে কাম উৎপন্ন হয় এবং কামনা থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয় ।
শ্লোক: 26
ক্রোধাদ্ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি ॥
(গীতা ২/৬৩)
অনুবাদঃ- ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। অর্থাৎ, মানুষ পুনরায় জড় জগতের অন্ধকূপে অধঃপতিত হয়।
শ্লোক: 27
ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনোহনুবিধীয়তে ।
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি ॥
(গীতা ২/৬৭)
অনুবাদঃ- প্রতিকূল বায়ু নৌকাকে যেমন অস্থির করে, তেমনই সদা বিচরণকারী যে কোন একটি মাত্র ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণেও মন অসংযত ব্যক্তির প্রজ্ঞাকে হরণ করতে পারে।
শ্লোক: 28
কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ ।
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্ ॥
(গীতা ৩/৩৭)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন ! রজোগুণ থেকে সমুদ্ভূত কামই মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী ও পাপাত্মক; কামকেই জীবের প্রধান শত্রু বলে জানবে।
শ্লোক: 29
ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্ত্ত সঃ ॥
(গীতা ৩/৪২)
অনুবাদঃ- স্থূল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়; ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়; মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়; আর তিনি (আত্মা) সেই বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়।
শ্লোক: 30
যে হি সংস্পর্শজা ভোগা দুঃখযোনয় এব তে ।
আদ্যন্তবন্তঃ কৌন্তেয় ন তেষু রমতে বুধঃ ॥
(গীতা ৫/২২)
অনুবাদঃ- বিবেকবান পুরুষ দুঃখের কারণ যে ইন্দ্রিয়জাত বিষয়ভোগ তাতে আসক্ত হন না। হে কৌন্তেয় ! এই ধরনের সুখভোগ আদি ও অন্তবিশিষ্ট৷ তাই, জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাতে প্রীতি লাভ করেন না।
শ্লোক: 31
তস্যৈব হেতোঃ প্রয়তেত কোবিদো
ন লভ্যতে যদ্ভ্রমতামুপর্যধঃ ।
তল্লভ্যতে দুঃখবদন্যতঃ সুখং
কালেন সর্বত্র গভীররংহসা ।।
(ভাগবত ১/৫/১৮)
অনুবাদঃ- যে সমস্ত মানুষ যথার্থই বুদ্ধিমান এবং পরমার্থ বিষয়ে উৎসাহী, তাদের কর্তব্য হচ্ছে সেই চরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য প্রয়াস করা, যা এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ লোক (ব্রহ্মলোক) থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন লোক (পাতাল লোক) পর্যন্ত ভ্রমণ করেও লাভ করা যায় না । ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে লব্ধ যে জড় সুখ, তা কালের প্রভাবে আপনা থেকেই লাভ হয়, ঠিক যেমন আকাঙ্ক্ষা না করলেও কালক্রমে আমরা দুঃখভোগ করে থাকি।
শ্লোক: 32
জীব জাগ, জীব জাগ, গোরাচাঁদ বলে ।
কত নিদ্রা যাও মায়া-পিশাচীর কোলে ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, অরুণোদয় কীর্তন ২)
অনুবাদঃ- গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ডেকে বলছেন। হে ঘুমন্ত জীবসকল! উঠ, জেগে উঠ। মায়া পিশাচীর কোলে অনেক ঘুমিয়েছ। আর কত ঘুমাবে?শ্লোক: 33
নৈষ্কর্ম্যমপ্যচুতভাববর্জিতং
ন শোভতে জ্ঞানমলং নিরঞ্জনম্ ।
কুতঃ পুনঃ শশ্বদভদ্রমীশ্বরে
ন চার্পিত্নগ কর্ম যদপ্যকারণম্ ।।
(ভাগবত ১/৫/১২)
অনুবাদঃ- আত্ম-উপলব্ধির জ্ঞান সব রকমের জড় সংসর্গ-বিহীন হলেও তা যদি অচ্যুত ভগবানের মহিমা বর্ণনা না করে, তা হলে তা অর্থহীন। তেমনই, যে সকাম কর্ম শুরু থেকেই ক্লেশদায়ক ও অনিত্য, তা যদি পরমেশ্বর ভগবানের ভক্তিযুক্ত সেবার উদ্দেশ্যে সাধিত না হয়, তা হলে তার কি প্রয়োজন?
শ্লোক: 34
অপ্রারব্ধফলং পাপং কূটং বীজং ফলোন্মুখম্ ।
ক্রমেনৈব প্রলীয়েত বিষ্ণুভক্তি-রতাত্মনাম্ ।।
(পদ্ম পুরাণ)
অনুবাদঃ- পাপময় জীবনে পাপকর্মের সুপ্ত প্রতিক্রিয়াগুলির বিভিন্ন স্তর রয়েছে। কিছু প্রতিক্রিয়া প্রায় ফলোন্মুখ, কিছু প্রতিক্রিয়া আরও সুপ্ত (কূট) কিংবা কিছু রয়েছে একেবারে বীজ আকারে। তবে সর্ব অবস্থাতেই, বিষ্ণুভক্তিতে রত ব্যক্তির সমস্ত প্রকার পাপকর্মের প্রতিক্রিয়া ক্রমে ক্রমে লয় প্রাপ্ত হয়।
শ্লোক: 35
বৃদ্ধকাল আওল সব সুখ ভাগল ।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)
অনুবাদঃ- বৃদ্ধকাল সমুপস্থিত হলে জড় সুখভোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
শ্লোক: 36
তাতল সৈকতে, বারিবিন্দু সম,
সুত-মিত-রমণী সমাজে
(শ্রীল বিদ্যাপতি ঠাকুর)
অনুবাদঃ- স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব ও সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যে সুখ পাওয়া যায়, তা মরুভূমিতে একবিন্দু জলের মতো।
শ্লোক: 37
মাংস খাদতি ইতি মাংসঃ
(মনু সংহিতা)
অনুবাদঃ- আমি এখন তোমাকে খাচ্ছি কিন্তু ভবিষ্যতে তুমি আমাকে হত্যা করে খেতে পারবে।
শ্লোক: 38
ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে
(বাংলা প্রবাদ)
অনুবাদঃ- গোবরের শুকনো ঘুটে যখন আগুনে পোড়ে, কাঁচা নরম গোবর তখন হাসে।
শ্লোক: 39
কমলদলজল, জীবন টলমল,
(ভজহুঁ রে মন, শ্রীনন্দনন্দন ৩)
অনুবাদঃ- কমলদলের উপর এক বিন্দু জলের ন্যায় জীবন টলমল ।
(গোবিন্দ দাস কবিরাজ গোস্বামী)
শ্লোক: 40
‘দ্বৈতে’ ভদ্রাভদ্র-জ্ঞান, সব—‘মনোধর্ম’ ।
‘এই ভাল, এই মন্দ’, -- এই সব ‘ভ্রম’ ।।
(চৈঃ চঃ অন্তঃ ৪/১৭৬)
অনুবাদঃ- জড় জগতে ভাল ও মন্দের ধারণা হচ্ছে মনোধর্ম-প্রসূত। তাই, ‘এটি ভাল এবং এটি মন্দ’ এই ধারণাটি ভ্রান্ত।
(সনাতন গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)
শ্লোক: 41
অনাদি করম-ফলে, পড়ি’ ভবার্ণব-জলে,
তরিবারে না দেখি উপায়।
এ বিষয়-হলাহলে, দিবানিশি হিয়া জ্বলে,
মন কভু সুখ নাহি পায় ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, গীতাবলী)
অনুবাদঃ- আমার অতীত কর্মের ফলে আমি এখন অজ্ঞানতার সমুদে পতিত হয়েছি। এই সমুদ্র থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার কোন উপায় দেখছি না। এই সমুদ্রটি বাস্তবিকই একটি বিষের সমুদ্রের মতো। আমরা ইন্দ্রিয়ভোগের মাধ্যমে সুখী হওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ইন্দ্রিয়ভোগ হচ্ছে উত্তপ্ত খাদ্যের মতো যা হৃদয়ে জ্বালার সৃষ্টি করে।
শ্লোক: 42
ভয়ং দ্বিতীয়াভিনিবেশতঃ স্যা-
দীশাদপেতস্য বিপর্যয়োহস্মৃতিঃ ।
তন্ময়য়াতো বুধ আভজেত্তং
ভক্ত্যৈকয়েশং শুরুদেবতাত্মা ।।
(ভাগবত ১১/২/৩৭)
অনুবাদঃ- জীব যখন শ্রীকৃষ্ণের বহিরঙ্গা শক্তি মায়ার দ্বারা আকৃষ্ট হয়, তখন তার ভয় উপস্থিত হয়। জড়া প্রকৃতির প্রভাবে পরমেশ্বর ভগবানের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ফলে তার স্মৃতি বিপর্যয় হয়। অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণের নিত্য দাস হওয়ার পরিবর্তে সে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিযোগী হয়। এই ভ্রান্তি সংশোধন করার জন্য পণ্ডিত ব্যক্তি পরমেশ্বর ভগবানকে গুরুদেবরূপে, অর্চ্চা-বিগ্রহরূপে ও পরমাত্মারূপে ভজনা করেন।
শ্লোক: 43
কামাদীনাং কতি ন কতিধা পালিতা দুর্নিদেশো-
স্তেষাং জাতা ময়ি ন করুণা ন ত্রপা নোপশান্তিঃ ।
উৎসৃজ্যৈতানথ যদুপতে সাম্প্রতং লব্ধবুদ্ধি-
স্তামায়াতঃ শরণমভয়ং মাং নিযুঙ্ক্ষ্বাত্মদাস্যে ।।
(ভঃ রঃ সিঃ ৩/২/৩৫, অপরাধভঞ্জন)
অনুবাদঃ- হে ভগবান! আমার কামনা-বাসনার অবাঞ্ছিত আদেশের কোন শেষ নেই। যদিও আমি তাদের অনেক সেবা করেছি, কিন্তু তারা আমাকে কোনই করুণা প্রদর্শন করেনি। তাদের সেবা করে আমি কখনও লজ্জিত হইনি। তাদের ত্যাগ করার বাসনাও আমি কখনও করিনি। হে প্রভু ! হে যদুপতি ! সম্প্রতি আমার বুদ্ধি জাগ্রত হয়েছে এবং আমি তাদের ত্যাগ করেছি। চিন্ময় বুদ্ধির ফলে আমি এখন এই সব বাসনার অবাঞ্ছিত আদেশ অমান্য করছি। এখন আমি আপনার অভয়চরণে শরণ নিতে এসেছি। অনুগ্রহ করে আপনার ব্যক্তিগত সেবায় আমাকে নিযুক্ত করুন। আমাকে উদ্ধার করুন।
শ্লোক: 44
সংসার-দাবানল-লীঢ় লোক
ত্রাণায় কারুণ্যঘনাঘনত্বম্ ।
প্রাপ্তস্য কল্যাণ-গুণার্ণবস্য
বন্দে গুরোঃ শ্রীচরণারবিন্দম্ ।।
(বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর, শ্রীশ্রীগুর্বষ্টক ১)
অনুবাদঃ- সংসার-দাবানল-সন্তপ্ত লোক সকলের পরিত্রাণের জন্য যিনি কারুণ্য-বারিবাহ তরলত্ব প্রাপ্ত হয়ে কৃপাবারি বর্ষণ করেন, আমি সেই কল্যাণ গুণনিধি শ্রীগুরুদেবের পাদপদ্ম বন্দনা করি।
শ্লোক: 45
হয় ‘মায়াদাস’ করে নানা অভিলাষ ।
(বাংলা গান)
অনুবাদঃ- মায়ার দাস হয়ে জীব নানা রকমের জড় অভিলাষে অভিভূত হয়ে পড়ে।
শ্লোক: 46
আত্মবৎ মন্যতে জগৎ
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- জড়-জাগতিক জীবনে প্রত্যেকেই মনে করে যে, অন্যদের অবস্থাও তার মতোই। (মানুষ মনে করে সকলেই বুঝি তার মতো চিন্তা করে। )
শ্লোক: 47
সুখমৈন্দ্রিয়কং দৈত্যা দেহযোগেন দেহিনাম্ ।
সর্বত্র লভ্যতে দৈবাদ্ যথা দুঃখমযত্নতঃ ।।
(ভাগবত ৭/৬/৩)
অনুবাদঃ- হে আমার দৈত্যবন্ধুগণ ! বিভিন্ন প্রকার দেহের মাধ্যমে যে ইন্দ্রিয়জাত সুখ, তা পূর্ব কর্মফল অনুসারে যে কোন জীবদেহেই লাভ করা যায়। বিনা চেষ্টাতেই সেই দেহসুখ লাভ করা যায়, ঠিক যেমন বিনা চেষ্টাতেই আমরা দুঃখ লাভ করি।
0 Comments