শ্ৰীপদ্মপুরাণে শ্রীরাধাষ্টমী ব্রতকথা
শৌনক কহিলেন,—হে মহাপ্রাজ্ঞ! মানব কোন্ কর্ম্মপ্রভাবে দুস্তর সংসারসাগর হইতে গোলোকে গমন করে, তাহা আমার নিকট বল। হে সূত! আর রাধাষ্টমীর উত্তম মাহাত্ম্যও আমার নিকট কীর্ত্তন কর।
সূত কহিলেন,—হে মহামুনে! পুরাকালে নারদ ব্রহ্মার নিকট ইহা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন।
হে দ্বিজ! সংক্ষেপে আপনার নিকট আমি তাহা বলিতেছি, শ্রবণ করুন।
নারদ কহিলেন,—হে সর্ব্বশাস্ত্রজ্ঞগণের অগ্রণী, মহাপ্রাজ্ঞ, পিতামহ! আপনি আমার নিকট রাধাজন্মাষ্টমীব্রত বলুন।
হে বিভো! ঐ ব্রতের পুণ্যফল কি? কেই বা পূর্ব্বে উহা করিয়াছিলেন? ঐ ব্রত না করিলেই বা জনগণের কিরূপ পাপ হয়? কিরূপ বিধানে কোন্ কালে উহা করিতে হয়? এবং কাহা হইতেই বা ঐ রাধা জন্মিয়াছিলেন? এ সকল আমার নিকট আমূল বর্ণন করুন।
ব্রহ্মা কহিলেন,—বৎস! সম্যক্ অবহিত হইয়া রাধাজন্মাষ্টমী—বিবরণ শ্রবণ কর। আমি সংক্ষেপেই উহা বলিতেছি। হে নারদ! একমাত্র হরি ব্যতীত উহার সমগ্র পুণ্যফল কেহই বলিতে পারেন না। যাঁহারা ভক্তিভরে একবার মাত্র এই ব্রতের অনুষ্ঠান করে, তাঁহাদের কোটিজন্মার্জ্জিত ব্রহ্মাহত্যাদি মহাপাপও তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হইয়া যায়। সহস্র একাদশীব্রত করিলে নর যে ফললাভ করে, রাধাজন্মাষ্টমীর পুণ্য তাহা হইতেও শতগুণ অধিক হয়। ( অর্থাৎ, মানব ১০০০ একাদশী ব্রতোপবাস পালন করিলে যে ফললাভ করেন, শ্রীরাধাষ্টমী ব্রতোপবাস পালন করিলে তার চেয়েও শতগুণ ১০০০×১০০=১০০,০০০ বা এক লক্ষেরও অধিক ফললাভ করেন।) মেরুপ্রমাণ সুবর্ণ দান করিয়া মানব যে ফল প্রাপ্ত হয় একবার মাত্র রাধাষ্টমীব্রত করিয়া তাহা হইতেও শতগুণ অধিক ফল প্রাপ্ত হইয়া থাকে॥১-৯॥
সহস্র কন্যাদান করিয়া জনগণ যেরূপ পুণ্য লাভ করে, একমাত্র রাধাষ্টমীব্রতে সেই ফল প্রাপ্ত হইয়া থাকে। গঙ্গাদি সর্ব্বতীর্থে স্নান করিয়া যে ফল লাভ করে, কৃষ্ণপ্রণয়িনী রাধার জন্মাষ্টমীব্রতকরণে মানব তাদৃশ ফল প্রাপ্ত হইয়া থাকে। যে পাপী মানব এই ব্রত হেলায় বা অশ্রদ্ধায়ও সম্পাদন করে, সেও কোটিকুলান্বিত হইয়া বিষ্ণুসদনে প্রয়াণ করিয়া থাকে। বৎস! পূর্ব্বে কৃতযুগে লীলাবতী নামে এক গণিকা ছিল। ঐ বিলাসিনী সুমধ্যা, হরিণাক্ষী, সুকেশী, চারুকর্ণী ও চারিহাসিনী ছিল। লীলাবতী বহুতর পাপ করিয়াছিল। একদা লীলাবতী ধনলাভ কামনায় নিজ পুর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া নগরান্তরে গমন করিল। গিয়া দেখিল, সেখানকার সুন্দর দেবালয়ে বহু বিজ্ঞ লোক রাধাষ্টমীব্রতের অনুষ্ঠান করিতেছেন। তাঁহারা গন্ধ, পুষ্প, ধুপ, দীপ, বস্ত্র ও নানাবিধ ফল দ্বারা ভক্তিভাবে রাধার উত্তম মূর্ত্তির পূজা করিতেছেন। কেহ গান গাহিতেছে, কেহ নৃত্য করিতেছে, কেহ উত্তম স্তবপাঠ করিতেছে; কেহ কেহ প্রীতিযুক্ত হইয়া তাল বেণু ও মৃদঙ্গ বাজাইতেছে। লীলাবতী তাঁহাদিগকে তদস্থাপন্ন দেখিয়া কৌতূকসহকারে তাঁহাদের নিকট গমন করিল এবং জিজ্ঞাসিল—ভো ভো পুণ্যাত্মগণ! আপনারা প্রমোদযুক্ত হইয়া কি করিতেছেন? আপনারা পুণ্যবান, আমি বিনীত, আমাকে এই বৃত্তান্ত বলুন। পরকার্য্যহিতেরত, ব্রতনিষ্ঠ বৈষ্ণবগণ তখন তাহার বাক্য শুনিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন।
রাধাব্রতিগণ কহিলেন,—ভাদ্র মাসে শুক্লাষ্টমীতে শ্রীরাধিকা জন্মগ্রহণ করেন। অদ্য সেই অষ্টমী তিথি উপস্থিত। তাই সাদরে আমরা সেই অষ্টমীব্রতের অনুষ্ঠান করিতেছি। এই অষ্টমীব্রত করিলে নরগণের গোহত্যা, ব্রহ্মহত্যা, স্তেয় ( মানে চুরি ), পরস্ত্রীহরণ, গুরুতল্পগমন, বিশ্বাসঘাতন ও স্ত্রীহত্যাজনিত পাপ বিনষ্ট হইয়া থাকে॥১০-২৪॥
লীলাবতী তাঁহাদের সেই নিখিল পাতকহর বাক্য শ্রবণ করিয়া 'আমি' এই ব্রত করিব, মনে মনে পুনঃপুনঃ এইরূপ আলোচনা করিল। পরে সেই স্থানেই ব্রতপরায়ণ জনগণের সহিত উত্তম রাধাষ্টমীব্রতের অনুষ্ঠান করিল। পরে দৈবক্রমে সর্পাঘাতে লীলাবতীর মৃত্যু ঘটিল। অনন্তর যমাজ্ঞায় দূতগণ পাশমুদ্গরহস্তে লীলাবতীকে গ্রহণ করিতে আসিল এবং অতি কঠোরভাবে তাহাকে বন্ধন করিল। এই অবস্থায় যখন তাঁহারা লীলাবতীকে যমসদনাভিমুখে লইলা চলিল, তখন শঙ্খচক্রগদাধারী বিষ্ণুদূতগণ আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজহংসযুত শুভ হিরণ্ময় বিমান তাঁহাদের সঙ্গে আসিল। তাঁহারা সত্বর চক্রধারায় পাশচ্ছেন করিয়া সেই নিস্পাপা নারীকে রথে আরোপণ করিল এবং গোলোক নামক মনোহর বিষ্ণুপুরে লইয়া গেল। সেখানে লীলাবতী ব্রতপ্রসাদে রাধাকৃষ্ণসহ অবস্থান করিতে লাগিল।
হে তাত! যে মূঢ়বুদ্ধি নর রাধাষ্টমীব্রত না করে, শতকোটি কল্প কালেও তাহার নরক হইতে নিষ্কৃতি ঘটে না। যে সকল নারী রাধাকৃষ্ণের প্রীতিকর এই সর্ব্বপাপহর শুভপ্রদ ব্রত না করে, তাহারা অন্তে যমপুরে গিয়া চিরকাল ঘোর নরকে পতিত হয়; পরে কদাচিৎ পৃথিবীতে জন্ম লইয়া নিশ্চয় বিধবা হইয়া থাকে॥২৫-৩৩॥
বৎস! একদা পৃথিবী দুষ্টজনসমূহে পরিপীড়িত হওয়ায় গোরূপ ধারণপূর্ব্বক অত্যন্ত দীন হইয়া পুনঃপুনঃ কাঁদিতে কাঁদিতে আমার নিকট আসিয়া স্বীয় দুঃখ নিবেদন করিল। পৃথিবীর বাক্য শুনিয়া আমি বিষ্ণুসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক তাঁহার নিকট পৃথিবীর দুঃখরাশি নিবেদন করিলাম।
তিনি বলিলেন,—হে ব্রহ্মন্! তুমি দেবগণসহ ভূতলে গমন কর। আমি পরে আমার লোকজনসহ তথায় গমন করিব। আমি সেই কথা শুনিয়া দেবগণসহ ভূতলে আসিলাম। অনন্তর কৃষ্ণ প্রাণপ্রিয়া রাধাকে আহ্বান করিয়া বলিলেন,—দেবি! আমি পৃথিবীতে গমন করিব। পৃথিবীর ভারনাশের নিমিত্ত তুমিও মর্ত্ত্যমণ্ডলে গমন কর। রাধা এই কথা শুনিয়া পৃথিবীতলে আগমন করিলেন। ভাদ্রমাসে শুক্লপক্ষে অষ্টমী তিথিতে রাধিকা দেবী বৃষভানুর যজ্ঞস্থলে জন্মগ্রহণ করিলেন। যজ্ঞার্থ শোধিত ভূতলে সেই দিব্যরূপিনী রাধা পরিদৃষ্ট হইলেন। রাজা তাঁহাকে পাইয়া আনন্দিত মনে নিজ নিকেতনে লইয়া গেলেন এবং মহিষীর নিকট অর্পণ করিলেন। রাজমহিষী তাঁহাকে পালন করিতে লাগিলেন। বৎস! তুমি যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, এই আমি তোমার নিকট তাহা কীর্ত্তন করিলাম। ইহা সযত্নে গোপনীয়, অতি গোপনীয়।
সূত কহিলেন,—এই চতুর্ব্বর্গফলপ্রদ বৃত্তান্ত যে ব্যক্তি ভক্তির সহিত শ্রবণ করে, সে সর্ব্বপাপ হইতে মুক্ত হইয়া হরিগৃহে প্রয়াণ করিয়া থাকে॥৩৪-৪৪॥
ইতি শ্ৰীপদ্মপুরাণে ব্ৰহ্মখণ্ডে শ্রীব্রহ্মা–নারদ সংবাদে শ্রীরাধাষ্টমী মাহাত্ম্য নামক সপ্তম অধ্যায় সমাপ্ত।
0 Comments