আত্মনিবেদনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। - শ্রীপাদ মহাবরাহ দাস ব্রহ্মচারী।

 আত্মনিবেদনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত - শ্রীপাদ মহাবরাহ দাস ব্রহ্মচারী।



"আমার মনে পড়ে, চেন্নাইতে একদিন ডায়ালাইসিস শেষে ঘরে ফেরার পর, শ্রীল গুরু মহারাজের দুজন ভগ্নী শ্রীল গুরু মহারাজের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ঘরে ফিরে এসে প্রথমে প্রবচন প্রদান করলেন, এবং তারপর তিনি তাঁর পূর্বাশ্রমের দুই বোনের সাথে রাতের প্রসাদ পেলেন এবং সেখানে তিনি রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত টানা তাদের নিকট প্রচার করলেন। এতটাই ছিল তাঁর উৎসাহ! জুলাই মাসে আমাদের আরো বেশি বেশি হাসপাতালে যেতে হচ্ছিল। শ্রীল গুরু মহারাজকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত তিনবার ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে শরীর থেকে অতিরিক্ত তরল অপসারণের জন্য হাসপাতালে যেতে হতো। এই হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারটি তাঁর জন্য ছিল খুবই অসুবিধাজনক। তখন আমরা সবসময়ই খুব উদ্বিগ্ন থাকতাম। আমার মনে পড়ে, একদিন আমি আর জানকীরমণ প্রভু এক সাথে কথা বলছিলাম- গুরু মহারাজের কী হতে যাচ্ছে! কবে তাঁর প্রতিস্থাপন অপারেশন সম্পন্ন হবে? সেসময় শ্যাম রসিক প্রভু, জানকীরমণ প্রভু সহ অন্যান্য ভক্তেরা বিভিন্ন জ্যোতিষীর সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ করতেন, এটি জানতে যে গুরু মহারাজের কী হবে? একদিন তিনি কোয়েম্বাটুর এর ভবানীর নিকটে বাস করেন এমন একজন জ্যোতিষীর সাথে সাক্ষাৎ করলেন ঠিক ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশনের কয়েকদিন পূর্বেই। সেই জ্যোতিষী পূর্বে কখনো গুরু মহারাজের কথা শোনেননি, গুরু মহারাজের সাথে সাক্ষাৎও হয়নি এবং জানেনও না যে গুরু মহারাজ কে। শ্রীল গুরুমহারাজের জন্মকুণ্ডলী অধ্যয়ন করার পর সেই জ্যোতিষী বললেন, "এই ব্যক্তির আয়ুষ্কাল ২০০৮ সালেই সমাপ্ত হয়েছে। এই ব্যক্তি তাঁর গুরুদেবের প্রদান করা কিছু নির্দেশনা পালন করার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল। এবং কেবল মাত্র এ কারণেই তিনি আরো বেশি বেশি সময় পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চান।" সেই জ্যোতিষী আরো বললেন, "এই ব্যাক্তি যে দেহে বেঁচে আছে সে দেহটি মোটেও বেঁচে থাকার উপযুক্ত নয়। কিন্তু কেবলমাত্র যেহেতু তিনি তাঁর গুরুদেবের নির্দেশনাবলী পূর্ণ করতে চা, তিনি এই দেহে তাঁর জীবন দীর্ঘসময় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।"


তখন জানকীরমণ প্রভু সেই জ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসা করলেন "আপনি কি আমাদের বলতে পারেন যে তিনি আর কতদিন বাঁচবেন?" 


সেই জ্যোতিষী উত্তর দিলেন "এটি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছা এবং এই মহান ব্যক্তির ইচ্ছার উপর। এই ব্যক্তি একজন মহাত্মা এবং আমি তাঁর সাথে মিলিত হতে চাই।" 


ভেবে দেখুন, এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আমি আর কি দিতে পারি! শ্রীল গুরু মহারাজ হচ্ছেন সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত- কীভাবে শ্রীগুরুদেবের অভিলাষ পূরণে সর্বতোভাবে আত্মসমর্পণ করা সম্ভব। যদিও তাঁর দেহটি বেঁচে থাকার জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়, তবুও তিনি কেবল একটি উদ্দেশ্যেই সেই দেহে অধিক থেকে অধিকতর সময় বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সেটি কেবল শ্রীল প্রভুপাদ কে সেবা করার জন্যই। এবং কেবল মাত্র সেই নির্দিষ্ট জ্যোতিষীই নন, প্রায় একই রকম বক্তব্য আমরা আরও দুই থেকে তিনজন জ্যোতিষীর কাছ থেকে শুনেছি। 


এটি সত্য যে, শ্রীল গুরু মহারাজের উপর একবার একটি প্রাণঘাতী আক্রমণ হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, স্পেনের মাদ্রিদে। তখন তিনি বিমানবন্দরে ছিলেন এবং তাঁর গলায় ছুরিকাঘাতের ফলে গভীর এক ক্ষত সৃষ্ট হয়েছিল। তিনি তাঁর উত্তরীয় গলার চারপাশে পেচিয়ে ধরলেন, যেন রক্তপাত বন্ধ হয়। তারপর তিনি মেঝেতে বসে পড়লেন এবং একাগ্রচিত্তে শ্রীল প্রভুপাদ এর নিকট প্রার্থনা করলেন- "শ্রীল প্রভুপাদ, আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে আমাকে আরো কিছুদিন বাঁচার সুযোগ দিন কেননা আমার এখনো আপনার অনেক নির্দেশনা পালন করা বাকি। ১৯৮৯ সালে তিনি সমঝোতা করেছেন, তিনি ২০০৮ সালেও সমঝোতা করেছেন- যখন তাঁর স্ট্রোক হয়েছিল। গুরু মহারাজ বলেছেন যে, তিনি মানসিকভাবে সবসময়ই শ্রীল প্রভুপাদ এবং কৃষ্ণের নিকট প্রার্থনা করছিলেন। এটি ছিল দ্বিতীয় বারের মতো তার জীবনের দীর্ঘায়ণ। এবং যখন ২০১৫ সালে তাঁর ফুসফুসের সংক্রমণ ধরা দিলো তখন তাঁর জীবন পুনরায় ঝুঁকিতে পড়ে ছিল। এবং সে সময়ে তিনি আইসিইউতে এক দিব্যদর্শন লাভ করলেন- সমগ্র আইসিইউটি যেন এক স্বর্ণাভ সভায় পর্যবসিত হল। তিনি দেখতে পেলেন, সেখানে তাঁর অপ্রকট সকল গুরুভ্রাতা এবং গুরুভগ্নীরা- তাঁদের দেখতে স্বর্ণকান্তিমকয় মনে হচ্ছে। সেখানে তাঁরা তাকে ডাকছেন- চলে আসো! চলে আসো! আমাদের সাথে পুনরায় মিলিত হও! গুরু মহারাজ বললেন, "এখন নয়, আমার শ্রীল প্রভুপাদের এখনো অনেক নির্দেশনা পরিপূর্ণ করা বাকি!" পুনরায় এটি ছিল তাঁর জীবনের দীর্ঘায়ণ। এবং এই লিভার এবং কিডনির ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশনের পূর্বে, আমরা যখন সার্জনের সাথে মিলিত হলাম, তখন তিনি বলছিলেন যে- পূর্বের তথ্য অনুসারে সার্জারির পরে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ। তারপর হঠাৎ করেই তাঁর অবস্থার অবনতি হল এবং অপারেশনের দিন সার্জন বললেন, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি! এবং ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশনের পর শ্রীল গুরু মহারাজ বললেন, "আমি জীবনেও এত ব্যাথা পাইনি, যতটা ব্যথা আমি এই অপারেশনের পর অনুভব করছি।"  এটি এতই তীব্র ব্যথা ছিল যে, গুরু মহারাজ কিছু কিছু সময় ভাবছিলেন- তিনি যেন এখনই তার দিব্য আলয়ে ফিরে যান। কিন্তু তিনি কেবল থাকতে মনস্থির করলেন কেননা তিনি শ্রীল প্রভুপাদ এর প্রাপ্ত নির্দেশনাগুলো সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ করতে চেয়েছেন। তাই তাঁর প্রায় চার থেকে পাঁচবার মৃত্যুপ্রায় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যদিও তিনি ভালভাবেই জানেন যে এই দেহে বেঁচে থাকার পরিণতি কি, তবুও তিনি কেবল একটি উদ্দেশ্যেই বারংবার এই দেহে তার জীবনকে দীর্ঘায়িত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই কারণটি হলো কেবলমাত্র শ্রীল প্রভুপাদের ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ করা। এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কি হতে পারে!


এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ যে, কিভাবে একজন শিষ্যের, তাঁর গুরুদেবের নির্দেশনা পালনে সর্বান্তকরণে আত্মসমর্পণ করা উচিত।"


শ্রীপাদ মহাবরাহ দাস ব্রহ্মচারী, 

১৫ই এপ্রিল ২০১৯।

Post a Comment

0 Comments