ভক্তমূখে এক চমৎকারী কথা শোনা যায়। এক ভক্ত শ্রীকৃষ্ণ-দর্শনের আকাঙ্খায় বহু বর্ষ ব্যাপী ভজন সাধন করেও শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পান নি। কালক্রমে তিনি একটি ময়ূর হয়ে জন্ম লাভ করেন। পূর্ব জীবনের সংস্কারবশত সেই ময়ূরটি ব্রজে নন্দালয়ে কৃষ্ণ দর্শন পাবার আশায় বিচরণ করতো এবং সব সময় ‘কৃষ্ণ’ কৃষ্ণ’ কীর্তন করতো। নন্দভবনের চতুর্দিকে ইতস্তত ভ্রমণ ও নাম কীর্তন করেও সে কৃষ্ণের দর্শন পেলো না।
একদিন হঠাৎ তার খেয়াল হলো, এক পলকের মতো কৃষ্ণ বুঝি ঘরের ভেতর ঢুকলেন কিন্তু আর কোনও দর্শন নেই। এতে বিক্ষুব্ধ চিত্তে সেই ময়ূর নন্দগ্রাম ছেড়ে বর্ষণার দিকে চলে আসে। বর্ষণাতে এসে ‘কৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ করতে থাকলে বৃষভানু-কুমারী রাধা ঘর থেকে বেরিয়ে ময়ূরকে ননী, রাবড়ি, মিষ্টি প্রভৃতি খেতে দেন এবং ময়ূরের পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকেন।
রাধারাণী বললেন, হে ময়ূর, তোমার কন্ঠে আমার প্রিয়তম কৃষ্ণনাম শুনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। ময়ূর তখন রাধারাণীর করুণাময় দৃষ্টি এবং স্নেহাদর পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে ‘রাধা’ রাধা’ কীর্তন করে নাচতে লাগলো। রাধানাম কীর্তন করতে করতে সে এসে পৌছালো নন্দগ্রামে। রাধানাম শুনে নন্দকুমার কৃষ্ণ ঘর থেকে বেরিয়ে ময়ূরের কাছে দৌড়ে আসেন। ময়ূর তখন কৃষ্ণের দিকে তাকালো।
ময়ূরকে আনন্দিত দেখে কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার এত আনন্দ কেন? তখন ময়ূর বলতে থাকে, ‘হে প্রভু! আমি অতি তুচ্ছ জীব। আপনার নাম দর্শনের নিমিত্ত আমি বহু বছর ধরে আপনার নাম করে অপেক্ষা করেছি। কিন্তু আপনি আমাকে কৃপা করেন নি। পরম আরাধ্যা রাধারাণী কত সহজে আমাকে কৃপা করেছেন। আমাকে আদর করেছেন, রাবড়ি খাইয়েছেন। কিন্তু আপনি এতদিন আমার দিকে একটুও তাকান নি। সেজন্য আতি অত্যন্ত দুঃখিত ছিলাম।
কৃষ্ণ বললেন, ওহো, তোমাকে আমার প্রিয়তমা রাধারাণী রাবড়ি খাইয়েছে, সাদরে তোমার গায়ে হাত বুলিয়েছে, এ তোমার মহা সৌভাগ্য। তাই তুমি আমার প্রিয় রাধানাম গাইছো। তোমার মুখে রাধানাম শুনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। তোমাকে আমার শিরোধার্য বলে জ্ঞান করি।
এই বলে শ্রীকৃষ্ণ ময়ূরের গায়ে হাত বুলালেন। তাতে ময়ূরের একটি পুচ্ছশীর্ষ খুলে পড়ে। সেই পুচ্ছটি তুলে নিয়ে কৃষ্ণ নিজ মস্তকের মকুটে গুঁজে দিলেন। তখন ময়ূর সবিস্মরে উৎফুল্ল হয়ে উপলব্ধি করলো, কৃষ্ণনামে শ্রীরাধার কৃপা লাভ হয়, রাধানামে শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভ হয়।
শ্রীপ্রেমভক্তিচন্দ্রিকা গ্রন্থে শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর গেয়েছেন---
কৃষ্ণনাম-গানে ভাই রাধিকা-চরণ পাই,
রাধানাম-গানে কৃষ্ণচন্দ্র।
সংক্ষেপে কহিনু কথা, ঘুচাও মনের ব্যথা,
দুঃখময় অন্য কথা ধন্দ।।
রাধাবিমুখের কৃষ্ণকৃপা লাভ হয় না, কৃষ্ণবিমুখের রাধাকৃপা লাভ হয় না, যুগল নামই রাধা ও কৃষ্ণের পরস্পরের আকর্ষক মহামন্ত্র বিশেষ। ষোলো নামে বত্রিশ অক্ষরাত্মক হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ-কীর্তন করতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নির্দেশ দিয়েছেন।
‘হরেকৃষ্ণ’ মহামন্ত্রে রাধা ও কৃষ্ণ উভয়ের করুণা দৃষ্টি লাভের প্রার্থনা ইঙ্গিত করে। সংক্ষিপ্তসার হলো, মিথ্যা অন্য সব দুঃখময় কথা পরিত্যাগ করে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের নাম গানই অভীষ্ট লাভের একমাত্র উপায়। নাম মহিমা প্রচারকারী ভক্ত যে যুগলকিশোরের অনুকম্পার পাত্র হয়, সেই বিষয়টির দ্যোতক রূপে এই ময়ূরপুচ্ছ, যা ভগবান স্বয়ং মস্তকে ধারণ করেছেন
0 Comments