রামায়ণ (ধারাবাহিক - সপ্তদশ পর্ব)

রামায়ণ (ধারাবাহিক - সপ্তদশ পর্ব)




অতঃপর সুন্দরকান্ড দ্বিতীয় সর্গ শেষে তৃতীয় সর্গ থেকে শুরু করছি●●●●●●●


সুন্দরকান্ড তৃতীয় সর্গ

হনুমান এরপর লঙ্কা নগরীর ফটক দেখলেন। একবার ভাবলেন এক পদাঘাতে ফটক ভেঙ্গে ঢুকে গোটা লঙ্কা নগরী তুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে মাতা সীতাকে স্কন্ধে বহন করে নিয়ে যাই।

কিন্তু পর মুহূর্তে ভাবলেন প্রভু তো তাহাকে দূত করে পাঠিয়েছেন। দূতের কাজ শান্তি পূর্বক সংবাদ প্রদান করা। তাই এমন করা ঠিক হবে না।

দেখলেন রাক্ষসেরা সব পাহারা দিচ্ছে। তিনি মক্ষিকা আকৃতি ক্ষুদ্র হয়ে লঙ্কা নগরীতে দেখলেন। ঢুকেই লঙ্কা নগরী দেখে তার ঘিনঘিন করতে লাগলো।

সম্পূর্ণ অশাস্ত্রীয় নগরী। কোথাও বিষ্ণুধ্বজা দেখতে পেলেন না। কোথাও আধ্যাত্মিক পরিবেশ নেই। তবে সেই নগরী অন্যদিকে অতি সুন্দর ছিলো।

বিশাল চওড়া রাজপথে স্বর্ণ রথ সকল উন্নতমানের অশ্বের আকর্ষণে প্রহরা দিচ্ছে। চারিদিকে কেবল রম্য কানন, প্রতিটি গৃহ যেনো স্বর্ণ দিয়ে তৈরী,

স্তম্ভ গুলিতে অতি দুর্মূল্য ও দুস্পাপ্র্য হীরা, মুক্তা খচিত। বাগিচা গুলো নানা মিষ্ট ফলে সুশোভিত। দীঘি গুলি অতি সুন্দর টলটলে জল দ্বারা পূর্ণ, দুচারটে নদী দেখলেন।

দেখলেন চতুর্দিকে বিকট রাক্ষস, রাক্ষসীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের লজ্জা, শ্রী নেই। অর্ধ উলঙ্গ হয়ে ঘুরছে। কিন্তু তারা অতি সুন্দর অলঙ্কারাদি দ্বারা সুশোভিত।

তাহাদিগের বিকট চেহারা দেখলে হাড় হিম করা ভয় উৎপন্ন হয়। হনুমানজী ভাবতে লাগলেন এত বাগিচার মধ্যে কোনটি যে অশোক বাগিচা।

সম্পাতি বলেছে অশোক বাগিচাতে বন্দিনী হয়ে আছেন মাতা সীতা। এখানে সব বাগিচাই এত সুন্দর ও রম্য যে বোঝাই যাচ্ছে না যে কোনটি অশোক বাগিচা।

হনুমান প্রতিটি বাগিচা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। মক্ষিকা সমান ক্ষুদ্র হবার জন্য রাক্ষস রাক্ষসীরা একফোটাও টের পেলো না।

হনুমান দেখলো রাক্ষস রাক্ষসীরা কেউ ঈশ্বরের নাম পর্যন্ত করছে না। সকলে ভোগ বিলাসাদির কথা বলছে।

আর দেখলেন স্থানে স্থানে অগণিত রথ, অশ্ব, হস্তী, পদাতিক, ঘাতক অস্ত্র মজুত ও সেনা রাখা। এবার বোঝা গেলো কেন রাবণকে দেখে সকলে এত ভয় পায়।

এখানে প্রতিটি বাড়ী যেনো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবাড়ী। সকল বাড়ীতে রাক্ষসদের মহিষ চিহ্ন পতাকা শোভা পাচ্ছে।

এই হেন স্থিতিতে তুলসীদাস তাঁর রামায়ণে বলেছেন-

করি জতন ভট কোটিনহ বিকট তন নগর চহুঁ দিসি রচ্ছহীঁ।
কহুঁ মহিষ মানুষ ধেনু খর অজ খল নিসাচর ভচ্ছহীঁ।।
(তুলসীদাসী রামায়ণ হইতে= সংগৃহীত)

আর দেখলেন নানা ঘাতক অস্ত্র ধারন করে রাক্ষস সেনারা পাহাড়া দিচ্ছেন এই লঙ্কাকে। আরোও দেখলেন স্থানে স্থানে কসাইখানা বা মাংসের দোকান। (তুলসীদাসী রামায়নে এরূপ বর্ণনা আছে।)

রাক্ষসেরা মহিষ, মানুষ, ধেনু, খর, অজ ভক্ষণ করেছে। কিছু জায়গাতে রাক্ষসেরা সামুদ্রিক মৎস্য পরম প্রীতি সহকারে ভোজন করছেন।

হনুমান দেখে বিলাপ করে বলতে লাগলেন- “হা প্রভু! কোন পাপে আমি এই সকল দৃশ্য দেখছি। হা ঈশ্বর!

সেই দুষ্ট রাবণ মাতা সীতাকে এই পাপপুরীতে রেখেছে। না জানি মা সীতা কিভাবে জীবন ধারন করে আছেন এখানে। এই নরক ক্ষেত্র ধ্বংস হোক।

মাংস আহারী রাক্ষসেরা মহানন্দে মাংস ভক্ষণ করে সুখ বিলাস করছিলো। এরপর হনুমান গেলেন আরোও কিছু জায়গাতে। রাত নেমে এলো।

হনুমান দেখলেন রাবণের বিশাল স্বর্ণ মহল। যেনো স্বর্গকে নিয়ে এসে রাবন লঙ্কাতে স্থাপন করেছেন। অতি বীর যোদ্ধা নানা ঘাতক অস্ত্র নিয়ে মহলে প্রহরা দিচ্ছে।

হনুমান দেখলো দেবকন্যারা বন্দী। তারা রাবণের মহলে দাসীবৃত্তি করছে। গন্ধর্ব কন্যারা রাবণের রানীর সেবায় নিমগ্ন।

প্রতি কক্ষে ঢুকে তিনি দেখতে লাগলেন। সমস্ত জায়গা যেনো স্বর্ণ দিয়ে মোড়া। হীরা, মাণিক্য, মণি, মুক্তা ইত্যাদি দামী আভূষণে রাবণের মহল সুশোভিত।

রাবণের প্রধানা স্ত্রী মন্দাদোরীর কক্ষে গেলেন। দেখলেন স্বর্ণ আদি মণি মুক্তায় মন্দাদোরী সুসজ্জিতা। দেবকন্যারা তার সেবা করছেন।

হনুমান এক মুহূর্তের জন্য ভাবলেন ইনিই কি সীতাদেবী? পড়ে ভাবলেন ইনি সীতাদেবী হতেই পারেন না।

প্রভুর বিহনে মাতা সীতা কিভাবে এত অলঙ্কারে সজ্জিতা হয়ে আনন্দে দিন যাপন করতে পারবেন? ইনি নিশ্চয়ই রাবণের প্রধানা স্ত্রী হবেন।

এইভেবে হনুমান প্রস্থান করলেন। একস্থানে দেখলেন সেখানে হরিনাম হচ্ছে।
“ভজ মন নারায়ণ হরি হরি, অবিরত বোল হরি হরি।”

হনুমান সেই হরিনাম শুনে পরম শান্তি পেলেন। ভাবলেন এই পাপ ক্ষেত্রে কে প্রভুর নাম করছেন? এই ভেবে হনুমান একটি বাটীতে প্রবেশ করলেন।

দেখলেন সেখানে এক রাক্ষস সর্বাঙ্গে তিলক ধারন করে বিষ্ণু পূজো করছেন। হনুমান ভাবলেন একবার সাক্ষাৎ করাই যাক।

পড়ে ভাবলেন এও তো রাক্ষস! ভক্ত হলে হবে কি? রাবণ নিজেওতো শিব ভক্ত- তবুও সে নির্দয় আর নিষ্ঠুর।

সুতরাং হরি ভক্ত হলেই যে সদয় হবে এমন ভাবার কারণ নেই। সেটি ছিলো ধর্মাত্মা বিভীষণের বাটি। হনুমান সেখান থেকে বিদায় নিলেন। রাতের অন্ধকারে সুন্দর একটি বাগানে প্রবেশ করলেন।

নানারকম পুস্পের সুবাসে আমোদিত ছিলো কানন। বাগিচার নানা স্থানে তিনি স্বর্ণ দ্বারা রচিত স্তম্ভ ও চূড়া দেখতে পেলেন। আর দেখলেন সেখানে কোন পুরুষ রাক্ষস নেই।

কেবল রাক্ষসী সেনা পাহার দিচ্ছে। এখানে ওখানে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে রাক্ষসী সেনারা শয়ন করছে বিকট শব্দে নাসিকা গর্জন করে।

তাহাদের তীক্ষ্ণ সমান দন্তযুগল দেখলে ভয়ার্ত হতে হয়। আর সেখানে অনেক মিষ্ট ফলের গাছ। গাছগুলি ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে।

এত ফল গাছ গুলিতে যে পত্র গুলি ঢাকা পড়েছে। সেখানে অনেক সরোবর ও আয়ুর্বেদিক ঔষধের বৃক্ষ দেখতে পেলেন হনুমান।

একস্থানে দেখলেন একজন বন্দিনী নারী ক্রমাগত “হা রাম!” জপ করছেন। রূপে তিনি লক্ষ্মী সদৃশা। সর্বাঙ্গ দিয়ে দিব্য জ্যোতি বিচ্ছুরণ হচ্ছে,

পদ্মের ন্যায় কোমল তিনি, অঙ্গে নানা শ্রী প্রস্ফুটিত। হনুমান জী বুঝলেন ইনিই প্রভুর স্ত্রী সীতাদেবী।

হনুমান দূর থেকে প্রনাম করে সেই বৃক্ষে উঠলেন, যার তলায় মাতা সীতা বসে বসে রোদন করে রঘুবীরকে স্মরণ করছিলেন। (ক্রমশঃ)

(আপনাদের জানিয়ে রাখি হনুমানের চরণ চিহ্ন এখনও শ্রীলঙ্কাতে আছে। আপনারা নেট সার্চ করে দেখতে পারেন। এই থেকে প্রমানিত- রামায়ন সত্য, রাম কথা সত্য, হিন্দু ধর্ম সত্য।)


সুন্দরকান্ড চতুর্থ সর্গ

সন্ধ্যা হতেই রাবণ রানীগণ শোভিত হয়ে উদ্যানে আসলেন। এক আড়ম্বর শোভাযাত্রা ছিলো।

শত শত রাক্ষসেরা ধ্বজ, নিশান নিয়ে দামামা, ভেরী, তুড়ি, শিঙা বাজিয়ে আসতে লাগলেন। সীতাদেবী বুঝলেন যে রাবণ আসছে।

তিনি হস্তে দূর্বা ধারন করলেন। দেবকন্যা, গন্ধর্ব কন্যা, অপ্সরাগণ শোভাযাত্রার আগে আগে পবিত্র ঘট থেকে সুগন্ধি বারি দিয়ে আম্রপল্লব দ্বারা পথে জল সিঞ্চন করছিলো।

অতি সুন্দর দেবকন্যারা রাবণের দুপাশে সাড়ি সাড়ি অবস্থিত হয়ে চামর, পাখা ব্যাঞ্জন করছিলো। রাবণের জয়ধ্বনিতে লঙ্কার রাজপথ ভরে গেলো।

হনুমান ভাবল এবার দেখা যাক রাবণের স্বরূপ। রাবণ ও তার রানী সোনা, হীরা, মাণিক্য দ্বারা সুগঠিত অলঙ্কারে সুসজ্জিত ছিলেন।

সেই অলঙ্কার থেকে এমন দ্যুতি নির্গত হচ্ছিল যেনো মনে হচ্ছিল বিঁধুদেব, নক্ষত্রমালার মাঝে অবস্থিত ছিলেন।

রাবণ এসে অশোকবাটিকায় সীতার সামনে দাড়ালেন। রাবণ অট্টহাস্য করে বলল- “হে সুমুখী! চন্দ্রমুখী সীতা! একবার তোমার মুখমণ্ডল দেখতে চাই।

কেন তুমি আমার সম্মুখে অধোমুখে থাকো? কেনই বা আমাকে বিবাহ করছ না? তুমি কেন তোমার সৌভাগ্যকে পদদলিত করছ? এসো।

আমার সহিত আমার রাজবাটিতে চলো। আমাকে বিবাহ করে এই সুখ ঐশ্বর্য ভোগ করো। দেখো আমার আশ্রিতা এই দেবকন্যা, গন্ধর্ব কন্যারা সব তোমার দাসী হয়ে থাকবে।

ত্রিলোকের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কারে তোমার সুন্দর বদন আচ্ছাদিত থাকবে। তোমাকে দেখে ইন্দ্রপত্নী শচীদেবীও লজ্জা পাবেন। হে সুন্দরী! এসো আমার সহিত।

ভুলে যাও তোমার ভিক্ষুক স্বামী রামকে। সে তোমাকে দুঃখ ব্যতীত কিছুই দেয় নি। আমি তোমাকে সকল প্রকার সুখ প্রদান করবো।

আমার এই রানী তোমার দাসী হবে।” এই বলে রাবণ সীতাদেবীকে নানা প্রলোভন দেখাতে লাগলো।

সীতাদেবী ঘৃনা ভরে বলল- “ওরে দুর্মতি! জোনাকীর আলোকে কদাপি পুস্প ফোটে না। সেটা তোর সম্বন্ধেও প্রযোজ্য।

এই সীতা নামক পুস্প কেবল শ্রীরামের আলোকেই প্রস্ফুটিত হয়। ওরে পাপী। তোর কথা কর্ণে প্রবেশ করাই আমার সবথেকে বড় দুর্ভাগ্য।

নির্লজ্জের মতোন আমাকে হরণ করে এনে, স্ত্রীদের মাঝে অবস্থান করে নিজেকে বীরপুঙ্গব বলিস? তোর বীরত্বে ধিক! লজ্জাহীন,

কাপুরুষের এমন আড়ম্বর শোভা পায় না। তুই আমার স্বামী রঘুপতিকে ভয় পাস। কদাচিৎ তোর ভ্রাতা খড় আর দূষনের অন্তিম পরিণতি শুনে তুই ওঁনাকে ভয় পেয়েছিস-

তাই যুদ্ধ না করে সাধুর বেশে আমাকে হরণ করলি! শ্রীরামের শর থেকে তোরও মুক্তি নেই। সবংশে নিপাত হবি।” এই শুনে রাবণ ক্রোধে উগ্র হল।

দশ মস্তকের কুড়ি নয়ন বড় বড় হয়ে দাঁত কটমট করতে লাগলো। সবার সামনে এত অপমান! তরবারি নিয়ে রাবণ, সীতাকে কাটতে গেলো।

মন্দোদরী বলল- “আর কত নীচে নামবেন প্রভু! এমনিতেই নারী অপহরণ করে আপনার কলঙ্ক হয়েছে।

এর ওপর নারী হত্যা করলে আপনার আরোও অপযশ হবে। নারী হত্যা নিন্দনীয় কাজ।” এইভাবে মন্দোদরী রাবণকে নিরস্ত্র করলো।

তখন রাবণ বললঃ-
মাস দিবস মহুঁ কহা ন মানা।
তৌ মৈঁ মারবি কাঢ়ি কৃপানা।।
(তুলসীদাসী রামায়ণ হইতে= সংগৃহীত)

সীতার কথা শুনে রাবণ ক্রোধে বলল- “ওহে সীতা! তোমার বড় জেদ। এই জেদ আমি ভাঙ্গবো। এক মাস তোমাকে সময় দিলাম।

এর মধ্যে যদি আমার প্রস্তাবে সায় না দাও, তবে আমার রাক্ষসী সেনারা তোমাকে কেটে ভক্ষণ করবে।”

এরপর দশানন রাবণ রাক্ষসী চেড়িদের আদেশ দিলো সীতাকে নানাভাবে ভয় দেখাতে। দেখুক রাক্ষসদের বিক্রাল রূপ।

শুনে সীতাদেবী বললেন- “দুর্মতি রাবণ! তুই আমাকে একমাস সময় কি দিবি? যম তোকে আর মাত্র একমাস আয়ু দিয়েছে।

যত পারিস সুখ ভোগ করে নে। কারন এরপর রঘুবীরের শর তোকে যমালয়ে পৌছে দেবে।” এই বিষয়ে কৃত্তিবাসী রামায়নে আবার অন্যরকম লেখা।
যথাঃ-
এত যদি সীতাদেবী বলিলেন রোষে।
মনে সাত পাঁচ ভাবে রাবণ বিশেষে।।

আসিবার কালে আমি বলেছি বচন।
এক বর্ষ জানকীরে করিব পালন।।

বৎসরের তরে তোকে দিয়াছি আশ্বাস ।
বৎসরের মধ্যে তোর যায় দশ মাস।।

সহিবেক আর দুই মাস দশস্কন্ধ।
দুই মাস গেলে তোর যে থাকে নির্বন্ধ।।
(কৃত্তিবাসী রামায়ণ হইতে= সংগৃহীত)

(এখান কৃত্তিবাসী রামায়নে দুমাসের কথা বলা হয়েছে)

যাই হোক রাবণের আদেশে চেড়ীরা ভয় দেখাতে লাগলো। বিকট চেহারার রাক্ষসীরা সব দেখতে ক্রুর ছিলো।

কুৎসিত ভয়ানক মুখ, হাতের নখ তীক্ষ্ণ, তীক্ষ্ণ দন্ত। তাহাদের অট্টহাস্য শুনলে থরথর করে কাঁপতে হয়। অগ্নির ভাটার মতো তাদের চোখ।

হস্তী, অশ্ব, শ্বাপদ, শৃগালের মতো কাহারো কাহারো মুখ। রাতের অন্ধকারে সেই নিশাচরী রাক্ষসীরা বীভৎস রূপ ধরে সীতাকে ভয় দেখাতে লাগলো।

সীতাদেবী ভয় না পেয়ে দুঃখিত হয়ে বিলাপ করে বলতে লাগলো- “হা ঈশ্বর! আমার মরণ হয় না কেন? কেন এই অশোক বৃক্ষের শাখা আমার মস্তকে পড়িতেছে না।

হে অশোক! তুমি আমার শোক নিবৃত্তি করো। চন্দ্রের জ্যোৎস্না আকাশে অগ্নিসম– হে চন্দ্র আমার উপর অগ্নি বর্ষণ করো। এই জীবন আর রাখিতে চাই না।

এই বলে সীতাদেবী বিলাপ করে রোদন করতে লাগলেন। ত্রিজটা রাক্ষসী এসে অন্যান্য রাক্ষসীদের এক সত্য ঘটনা বলল।

ত্রিজটা বলল- “তোমরা একে এত কষ্ট দিও না! তোমরা জানো না এই সতী নারীর স্বামী কতটা শক্তিমান। আমি এক স্বপ্নে দেখেছি।

সেই স্বপ্ন শুনলে তোমরাও ভয় পাবে। দেখলাম একজন বানর এসে লঙ্কা নগরী আগুনে ভস্ম করেছে।

তারপর দেখলাম এই সীতার স্বামী রামচন্দ্র এসে সব রাক্ষসদের বিনাশ করেছে। এমনকি লঙ্কারাজ রাবনকে গর্দভের পীঠে চেপে ছিন্নস্কন্ধ হয়ে দক্ষিণ দিকে যেতে দেখলাম।

আর দেখলাম এর স্বামী রাম এখানে এসে একে নিয়ে যাচ্ছে। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। তোমরা একে কদাপি কষ্ট দিও না। তখন কিন্তু রামচন্দ্র তোমাদের দণ্ডিত করবেন।

এই শুনে রাক্ষসীরা সীতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। ত্রিজটা এইভাবে সীতাকে বুঝিয়ে চলে গেলো। হনুমান গাছ থেকে সব শুনছিলেন।

তাঁর মনে হচ্ছিল গদা দিয়ে রাবণের মুখ চূর্ণ করতে। কিন্তু রামচন্দ্রের আদেশে দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করছিলেন।


সুন্দরকান্ড পঞ্চম সর্গ

রাতের অন্ধকার চতুর্দিকে। জোনাকী পোকার সাড়ি অশোক বনে ফুলে ফলে সজ্জিত ডালাপালায় খেলা করে মিটিমিটি জ্বলছে।

যেনো তারকামালার সাড়ি বসেছে। রাক্ষসীরা সকলে অতি উচ্চ বীভৎস শব্দে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে নাসিকা গর্জন করে ঘুমাচ্ছে।

কেবল সীতা মাতা একাকী বসে ক্রন্দন করে ভগবান রামচন্দ্রকে স্মরণ করে বলছেন- “হে প্রভু! মম নাথ! তুমি কবে এই অভাগিনী জানকীকে কৃপা করবে।

কবে এই পাপ নগর থেকে আমি মুক্তি পাবো। হে নাথ! দয়া করে এসে আমাকে নিয়ে যান।” হনুমান দেখলো এই সুবর্ণ সুযোগ।

এই সময়ে কেউ কোথাও নেই। নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে। এই ভেবে হনুমান বৃক্ষ থেকে লম্ফ দিয়ে নীচে নামলো। স্বাভাবিক রূপে এসে বলল-

“মাতঃ! আমার প্রনাম গ্রহণ করুন। আমি আপনার পুত্র তথা প্রভু শ্রীরামের দূত হনুমান। সীতা এই সমুদ্র পাড়ে দ্বীপে হনুমানকে দেখে অবাক হল।

আশ্চর্য হয়ে ভাবল এই স্থানে কিভাবে উনি দূত পাঠাবেন। এ নিশ্চয়ই রাবণ হবে। মর্কট বেশে ছলনা করতে এসেছে।

যে সন্ন্যাসী বেশ ধরে ছলনা করতে পারে সে সব পারে। সেই নির্দয়, ধর্ষক, নারীলোলুপ জঘন্য দশানন রাবণ সকল প্রকার পাপেই সিদ্ধহস্ত।

সীতাদেবী ক্রোধে বললেন- “মূঢ়মতি রাবণ! তুমি পুনঃ কপির রূপ ধরে আমাকে ছলনা করতে এসেছো ? রাবণ তোমার মায়া এবার ধরতে পেরেছি।

আর তুমি ছলনা করতে পারবে না। পাপীষ্ঠি! তোর লজ্জা, বিবেক বোধ কি সমুদ্রদেব তার স্রোতে ধুয়ে নিয়ে চলে গেছে।

জগতের সব থেকে নিকৃষ্ট প্রানী তুই। চলে যা এখান থেকে। হনুমান বলল- “মাতঃ! আপনার সন্দেহ স্বাভাবিক। এই রাক্ষসেরা মায়া দ্বারা যেকোন রূপ ধরতে পারঙ্গদ।

কিন্তু মা বিশ্বাস করুন, আমি পাপী রাবন নই। আমি বৃক্ষের ওপরে থেকে সব দেখেছি যে রাবণ আপনাকে কিভাবে যন্ত্রনা প্রদান করেই যাচ্ছে। মাতঃ!

আমি সত্যি বলছি আমি ভগবান শ্রীরামের দূত। মা আপনিই তো প্রভু শ্রীরামকে সঙ্কেত দেবার জন্য ঋষমূক পর্বতে আপনার অলঙ্কারাদি নিক্ষেপ করেছিলেন।

আমরা সেই গুলো পেয়ে প্রভুকে দেখিয়েছি। প্রভু আমাকে তাঁর অঙ্গুলির অঙ্গুষ্ঠ প্রদান করে দূত রূপে এখানে প্রেরন করছেন।”

এই বলে হনুমান প্রভুর অঙ্গুরীয় মাতা সীতাকে প্রদান করলো। মাতা সীতা অঙ্গুরীয় দেখে নিলো। অঙ্গুরীয়তে “রাম” নাম লেখা। এই অঙ্গুরীয় তাঁর চেনা।

ভগবান শ্রীরামের পদ্মাভ হস্তের আঙ্গুলে শোভা পেতো এই অঙ্গুরীয়। এই অঙ্গুরীয় স্বয়ং ভগবান শ্রীরামের। তবে ঠিক স্বামী, এই কপিকে প্রেরন করেছে।

সীতা বলল- “বৎস! তুমি সত্যই বলেছো। এই অঙ্গুরীয় আমার স্বামীর। আমাকে ক্ষমা করো পুত্র। রাবণের এই পাপ রাজ্যে কাউকে বিশ্বাস করতে মন চায় না।

সেই মায়াবী মায়া দ্বারা সব করতে পারে। সেই পাপীর মৃত্যু হলে ত্রিলোকে শান্তি নেমে আসবে। কেন যে আমি সেদিন স্বামীকে মৃগ ধরে আনতে বলেছিলাম,

কেনই বা ভ্রাতা লক্ষ্মণকে আকথা- কুকথা বলে বনে প্রেরন করেছিলাম, কেনই যে লক্ষ্মণের রচিত গণ্ডী অতিক্রম করে সেই পাপীষ্ঠিকে ভিক্ষা দিতে গিয়েছিলাম।

সব আমার জেদের ফল। এই পাপী রাবণের মনে দয়া মায়া বিন্দুমাত্র নেই। সে সব পারে। এই রাক্ষসেরা সব রকম পাপকর্মে সিদ্ধহস্ত।

তবে রাবণ প্রভু শ্রীরামের বীররূপ দেখেনি। যেদিন দেখবে সেইদিন তার অহঙ্কার মাটিতে মিশবে। তুমি বল হনুমান আমার স্বামী আমার দেবরভ্রাতা সকলে কেমন আছে?”

হনুমান তখন শ্রীরামের শোকার্ত অবস্থা বর্ণনা করে বললেন- “মাতঃ! রাবণের ধ্বংসের আয়োজন তিনি করেছেন।

বানররাজ বালিকে বধ করে, তাঁর ভ্রাতা সুগ্রীবকে বানর জাতির রাজা বানিয়েছেন। সুগ্রীব সকল বানর সেনা সমেত প্রভুর সাথে আছেন।

প্রভু আপনার বিহনে খুবুই শোকগ্রস্ত। আমরা বানরেরা আপনার খোঁজে গোটা ধরিত্রী ভ্রমণ করেছি। জটায়ুর ভ্রাতা সম্পাতি আমাদের আপনার খোঁজ দিয়েছেন।”

এই বলে হনুমান সকল ঘটনা সকল বলল। মাতা সীতা ভগবান শ্রীরামের শোকার্ত কথা শুনে রোদন করলেন। আহা প্রভু তাঁকে এত ভালোবাসেন।

তারপর বললেন- “হনুমান! তুমি ওঁনাকে বলবে শোক ত্যাগ করে কঠোর হতে। এই রাক্ষসদের বিনাশের সময় এসেছে। তাঁর হস্তেই এদের মৃত্যু লিখিত আছে।

তুমি তো দেখলে রাবণ আমাকে মাত্র দু'মাসের সময় দিয়েছে। যা করার ওঁনাকে তাড়াতাড়ি করতে হবে। এই রাবণ এত নিষ্ঠুর সে আমাকে ফিরিয়ে কদাপি দেবে না। এর নাশ হওয়াই মঙ্গল।”

হনুমান বলল- “মাতঃ! আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা বানরসেনারা তৈরী হচ্ছি। যুদ্ধের সময় রাবণ টের পাবে আমরা কত শক্তিশালী।

এই সকল রাক্ষসদের আয়ুস্কাল পূর্ণ হয়েছে। তাই এদের অত্যাধিক আস্ফালন হয়েছে। প্রদীপ নির্বাপণের আগে তা একটু বেশীভাবে জ্বলে ওঠে।

এদের জীবন শেষ সীমায় এসেছে। মাতাঃ আপনি চাইলে আমার স্কন্ধে আরোহণ করুন। এখুনি আপনাকে আমি সমুদ্র পারে প্রভুর কাছে নিয়ে যাবো।


(বিঃদ্রঃ- সুন্দরকান্ড পঞ্চম সর্গের বাকি অংশ রামায়ণ অষ্টাদশ পর্বে বর্ণিত)

Post a Comment

0 Comments