🔥রামায়ণ🔥(ধারাবাহিক- তৃতীয় পর্ব)


অতঃপর আদিকাণ্ড ষোড়শ সর্গের পর থেকে শুরু●●●●●●●●


👉আদিকাণ্ড সপ্তদশ সর্গ👇

                                       অগস্ত্য মুনির নাম সকলেই শুনেছেন। এই মুনির তপঃ শক্তি ছিলো আশ্চর্য রকম। ব্রহ্মার আরাধনা করে অগস্ত্য মুনি অনেক অলৌকিক দিব্যশক্তি পেয়েছিলেন। একবার উনি সমুদ্রের জল এক গণ্ডূষে পান করেছিলেন বলে পুরাণ শাস্ত্রে লেখা। তিনিই নিজ স্ত্রীরূপে যজ্ঞ থেকে লোপামুদ্রা দেবীকে উৎপন্ন করেন। ব্রহ্মার কৃপা পেয়েও নির্লোভী এই মুনি শাস্ত্র নিয়ম মেনে অরণ্যে কুটিরে থাকতেন। 


বিঃদ্রঃ:- এদের সাথে আজকালকার গুরুদেবের অনেক তফাৎ। আজকালকার যুগে বাজার চলতি করে খাওয়া এক ধরণের গুরুর আবির্ভাব হয়েছে। সামান্য ১০-২০ টা শিষ্য হলেই ধরা কে সরা জ্ঞান করে শিষ্যের টাকায় শ্বেতপাথরের দালান কোঠা নির্মাণ করে মহাভোগে জীবন কাটান।


যাই হোক। যক্ষ সুকেতুর কন্যা তাড়কার বিবাহ হয়েছিলো যক্ষ শুণ্ডের সাথে। একদিন গর্ভস্থ অবস্থায় তাড়কা অগ্যস্ত মুনির আশ্রমে আসেন।


তাড়কা বলেন- “মহর্ষি আমার জন্য অপূর্ব সুন্দর রাজমহল নির্মাণ করে দিন। শুনেছি আপনি দেবতাদের বরে অনেক চমৎকার ঘটাতে সমর্থ। সেই রাজমহল হবে দ্বিতীয় অমরাবতী। স্বর্গের দেবতারা এই মহল দেখে হিংসায় জ্বলে মরবে।” অগস্ত্য মুনি মানা করে দিলেন। জানালে ঐ সব দাবী তিনি মানবেন না। এসমস্ত কর্মে তিনি যোগশক্তির ব্যবহার করবেন না। 


তাড়কা অনেক আকুতি মিনতি করল। অগস্ত্য মুনি কিছুতেই সম্মত হলেন না। তাড়কা রেগে তখন মুনির আশ্রম লণ্ডভণ্ড করলেন। আশ্রম তছনছ করে মুনিকে শাসাতে লাগলেন। প্রথমে মুনি চুপ থাকলেও শেষে ক্রোধে অভিশাপ দিয়ে বললেন- “দুর্মতি নারী। তুই আমার আশ্রম উন্মত্ত রাক্ষসের ন্যায় ধ্বংস করেছিস। তুই তোর গর্ভস্থ সন্তান সহ রাক্ষস হবি। ভগবান হরির হস্তে নিধন হলেই তোদের মুক্তি ঘটবে।


মুনির শাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলল। তাড়কা রাক্ষসী হয়ে তপবনে বেড়াতে লাগলো। রাক্ষসী হবার পর তাড়কার প্রথম আঘাত গিয়ে পড়লো অগস্ত্য মুনির আশ্রমে। মুনির আশ্রম লণ্ডভণ্ড করে মুনির শিষ্যদের চিবিয়ে ভক্ষণ করল। তাড়কার তাণ্ডবে অগস্ত্য মুনির আশ্রম শ্মশানে পরিণত হোলো। মুনি যজ্ঞ করতে আরম্ভ করলেই রাক্ষসেরা ধেয়ে এসে যজ্ঞে রক্ত, অস্থি, মাংস, চর্বি নিক্ষেপ করতো। এইভাবে যজ্ঞ অপবিত্র করতো। মুনি অগস্ত্য শেষে তাঁর আশ্রম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন। 


এরপর তাড়কার নেতৃত্বে তার পুত্র মারীচ, সুবাহু নামক এক রাক্ষস ও অনান্য রাক্ষসরা ‘মলদ’ ও ‘কুরূষ’ নামক দুটি জনপদে হানা দিতে থাকে। রাক্ষসেরা সেখানে মানুষদের হত্যা করে রক্ত মাংস আহার করতে থাকে। রাক্ষসদের উৎপাত ভয়ানক আকার নেয়। মতঙ্গ মুনির আশ্রমেও তাণ্ডব চলে। মহর্ষি তখন আক্ষেপ করেন যে তিনি কেন বালিকে শাপ দিলেন। এই অবস্থায় বালি এখানে এসে রাক্ষস বধ করতে পারবে না। 


রাবণ এই সংবাদ শুনে খুবুই আহ্লাদিত হয়। অপরদিকে পঞ্চবটিতে রাবণের ভ্রাতা খর ও দূষনের নেতৃত্বে রাক্ষসদের তাণ্ডব আরম্ভ হয়। বালির ভয়ে তারা কিস্কিন্ধ্যাতে না গেলেও আশেপাশে তাণ্ডব শুরু করে। সুদূঢ হিমালয়েও রাক্ষস দের অত্যাচার আরম্ভ হয় কালনেমির মাধ্যমে। 


‘মলদ’ ও ‘কুরূষ’ নামক রাজ্য ক্রমশঃ রাক্ষসদের আহার হতে লাগলে সেখানকার বেঁচে থাকা লোকেরা কিছু অযোধ্যায়, কিছু কিস্কিন্ধ্যায় আশ্রয় নেয়। পরিত্যক্ত নগরী ধীরে ধীরে জঙ্গল হয়। বিশ্বামিত্র মুনির আশ্রম রেহাই পায় নি। এমনকি একবার নারদ মুনিকেউ আহার করতে গিয়েছিলো তাড়কার বাহিনী রাক্ষসেরা। নারদ মুনি পালিয়ে মহর্ষি দুর্বাসার আশ্রমে যান। দুর্বাসা মুনি অভিশাপ দিয়ে রাক্ষসদের ভস্ম করেন। 


বিশ্বামিত্র মুনির আশ্রমে রাক্ষসদের তাণ্ডব হতে থাকে। গৌতম মুনির পরিত্যক্ত আশ্রমে কাউকে না পেয়ে রাক্ষসেরা বিশ্বামিত্রের আশ্রমে হানা দেয়। বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রোজ তাণ্ডব হোতো। বিশ্বামিত্রের যজ্ঞাদি পণ্ড হত। দেবতাদের সাহায্য চাইলে দেবতারা রাবণের ভয়ে রাক্ষস বধ করতে রাজী ছিলো না। বিশ্বামিত্রের আশ্রমে নারদ মুনি একদা পদার্পণ করলে বিশ্বামিত্র মুনি এর প্রতিকারের কথা জানতে চান।


নারদ মুনি বলেন- “এই রাক্ষস দের ধ্বংসকর্তারা বানর রূপে জন্ম নিয়েছে। আর এই রাক্ষসদের ধ্বংস কেবল ভগবান শ্রীহরিই করতে পারবেন। আপনারা সকলে মিলে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন।” অপরদিকে রক্তমালা নামক এক রাক্ষসীর হাতে আক্রান্ত হয়ে দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর সাহায্য চাইলো। রক্তমালার ঔদ্ধত্য, তাড়কাকেউ ছাড়িয়ে গেছিলো। ভগবান বিষ্ণু একদা ছদ্দবেশে রক্তমালার হাতে আক্রান্ত তপবনে আসলেন ছদ্দবেশে। মুনির ছদ্দবেশে হরিকে দেখে রাক্ষসী রক্তমালা তাকে ভক্ষণ করতে আসলো। ভগবান নারায়ণ তখন সুদর্শন চক্রে রক্তমালার বধ করলেন। 


👉আদিকাণ্ড অষ্টাদশ সর্গ👇

                                       রাক্ষসদের এমন অত্যাচারে গোটা ভারতই আক্রান্ত হচ্ছিল্ল। রাক্ষসদের হাতে নিপীড়িত হতে হতে মুনি, ঋষি আদি মানব সকল ভগবান বিষ্ণুকে ডাকতে লাগলেন। এমনকি দেবতারা মিলে বৈকুণ্ঠে গমন করে ভগবান শ্রী বিষ্ণুকে সকল বৃন্তান্ত জানালেন।


তারা বললেন- “রাক্ষস বাহিনীর মাত্রাছাড়া তাণ্ডবে ধর্ম কর্ম বিনষ্ট হতে বসেছে। অনার্য রাক্ষস সংস্কৃতিতে লুপ্ত হতে বসেছে বৈদিক শাস্ত্র জ্ঞান। মুনি ঋষিরা যজ্ঞাদি করে দেবতাদের হব্য প্রদান করতে অসমর্থ হচ্ছেন। ধর্ম নষ্ট হয়ে অধর্মের প্রভাব সর্বত্র দেখা দিচ্ছে। যে জগদীশ আপনি কৃপা বশত পুনঃ আবির্ভূত হন। পূর্বে আপনি মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম অবতার গ্রহণ করে আসুরিক শক্তির নাশ করেছেন, পুনঃ আপনি দানবিক শক্তির সংহার করুন। 


এইভাবে দেবতারা সকলে কাকুতি মিনতি জানালেন। ভগবান মহেশ্বর বললেন- “হে নারায়ণ। আমার অবতার হনুমান মর্তে আবির্ভূত হয়েছে। এবার আপনি মর্তে অবতার গ্রহণ করুন। আপনি সৃষ্টি পালন করেন। এই কারনে আপনি অবতার গ্রহণ করেন, আগামীতেও করবেন। হে লক্ষ্মীনাথ ত্রিবিক্রম, আপনি রাক্ষস বিনাশের জন্য আবির্ভূত হন। রাবণ আপনার হাতেই বধ্য।


বসুমতী দেবী বললেন- “হে জনার্দন। আমি সর্বংসহা বসুমতী। কিন্তু রাবণের পাপের বোঝা আমি গ্রহণে অসমর্থ। সে স্বয়ং দেবী লক্ষ্মীর অবতার বেদবতীকে অসম্মান করেছে। এই মহাপাপীর বিনাশ না হলে ধরিত্রী ধ্বংস হবে।”


সকলের প্রার্থনা শুনে ভগবান বিষ্ণু অভয় দিয়ে তাঁর অবতারের কথা ঘোষনা করে দিলেন। বললেন- “আপনারা চিন্তিত হবেন না। আমি ইক্ষাকু বংশে অযোধ্যার সম্রাট দশরথের নন্দন রূপে কৌশল্যা দেবীর গর্ভে আবির্ভূত হব। ধর্ম রক্ষা করে দুষ্ট রাক্ষস দিগকে বধ করবো। ধর্ম সংস্থাপন করে অধর্মের বিনাশ করবো।” দেবতারা আশ্বস্ত হলেন। 


ভগবান বিষ্ণু বললেন- “এই অবতারে দেবী লক্ষ্মীও অবতার গ্রহণ করে রাবণের বিনাশের হেতু হবেন।” দেবী লক্ষ্মী বলিলেন- “বসুমতী ধরিত্রীর কন্যা রূপে আবির্ভূত হয়ে আমি মিথিলা রাজ জনক ও তাঁর পত্নী সুনয়নার গৃহে প্রতিপালিত হবো।” দেবতারা আশ্বস্ত হলেন। 


ব্রহ্মা তখন মহর্ষি বিশ্বশ্রবা কে স্বপ্নে জানালেন- “বিশ্বশ্রবা তুমি তোমার পুত্র দশাননকে সংযত হতে বল। ভগবান হরি মর্তে আবির্ভূত হচ্ছেন তাঁর বিনাশ করবার জন্য। সে এরূপ অধর্ম আশ্রয় করে থাকলে সে ধ্বংস হবেই, তাঁর কূলেও কেউ রক্ষা পাবে না।” বিশ্বশ্রবা রাবণকে অনেক বোঝালো, রাবণ সংযত হলই না। উলটে আস্ফালন করে বলল- “যদি বিষ্ণু আমাকে বধ করতে আবির্ভূত হয়, তবে আমি বিষ্ণু বধ করবো। কিন্তু বিষ্ণুর ভয়ে আমি ভীত হবো না। ” 


এখানে সবাই প্রশ্ন করতে পারেন যে ভগবান বিষ্ণু ইচ্ছা করলেই গরুড়ে আসীন হয়েই লঙ্কা আক্রমণ করে রাক্ষস বধ করতে পারতেন। এতটাও দরকার হত না, তিনি বৈকুণ্ঠ থেকেই সুদর্শন চালনা করে রাক্ষস বধ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি মর্তে আবির্ভূত কেন হবেন? এটা ছেড়েও বলা যায়, দেবী লক্ষ্মীর অংশ বেদবতী নিজে যজ্ঞে ঝাঁপ না দিয়ে রাবণকে ভস্ম করতে পারতেন। 


কিংবা রুদ্রাবতার হনুমান রাবণকে বধ করতে পারতেন, কিংবা দেবী পার্বতীকে লঙ্কায় নিয়ে যাবার কালে দেবী শাপ দিয়ে রাবণকে ভস্ম করতে পারতেন বা রাবণ যেদিন কৈলাস আক্রমণ করেছিলো সেদিনই ভগবান শিব তার বধ করতে পারতেন। কিন্তু এঁনারা এমন করলেন না। ভগবান শ্রীহরি কেন মর্তে অবতার নিতে চলেছেন? এর কারন রূপে কেউ কেউ জয়- বিজয়ের প্রতি সনকাদি মুনিদের অভিসম্পাত, নন্দীর দেওয়া নর বানরের হাতে ধ্বংসের শাপ বা ব্রহ্মার প্রদত্ত নর বানরের হাতে বিনাশের বর প্রদান, বেদবতীর প্রদত্ত অভিশাপ বা রম্ভার অভিশাপকে মুখ্য হেতু মনে করতে পারতেন।


যে ভগবান তাই মানব অবতার নিয়েছেন। হ্যা এইগুলো ঠিক। কিন্তু ভগবানের অবতারের দুটি উদ্দেশ্য – অসাধু বিনাশ ও জীবশিক্ষা প্রদান সাথে ভক্ত সঙ্গ। আমরা জানি ভগবান লাভ আমাদের কাছে মূল উদ্দেশ্য। হ্যা ঠিক, যে হরি ভক্ত সে হরিকে, যে শিব ভক্ত সে শিবকে যে দুর্গা ভক্ত সে দুর্গাদেবীর কৃপা প্রাপ্তির জন্যই অচলা ভক্তির পথে চলেন।


কিন্তু আমরা কি জানি, যে আমরা ভগবান প্রাপ্তির জন্য যতটা ব্যাকুল, ভগবান নিজে শুদ্ধভক্তের সঙ্গ প্রাপ্তির জন্য তাঁর অধিক ব্যাকুল। তিনি শুদ্ধ ভক্ত খুঁজে বেড়ান। তাই ভক্তের জীবনে এত কষ্ট, এই কষ্ট ঈশ্বরের পরীক্ষা। তিনি পরীক্ষা করেন ভক্ত কতটা আঘাত সহ্য করে আমাকে ডাকে, তবেই না সে শুদ্ধভক্ত। ভগবান তখন সেই ভক্তের দাসানুদাস হন। ভগবান বলেন- “যে করে আমার আশ, করি তার সর্বনাশ। যদি না ছাড়ে পাশ, হই তার দাসের অনুদাস।” ভগবান রামের জীবনে আমরা এমন ভক্তের পরিচয় পাবো। তাই তো বলা হয় ভগবানের চেয়ে ভক্ত বড়। ভগবান এমন ভক্তকেই খোঁজেন, এটি তাঁর অবতারের আর একটি উদ্দেশ্য। 


👉আদিকাণ্ড উনবিংশ সর্গ👇

                                         আজ অযোধ্যা নগরীর বর্ণনা করবো। ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে সরয়ূ নদীর তীরে এই রাজ্য অবস্থিত ছিলো। এই রাজ্যে সর্বত্র শ্রী, ঐশ্বর্য ছিলো। সুউচ্চ মহল, পুস্পশোভিত উদ্যান, নির্মল টলটলে জল ভরা সরোবরে হংস হংসী কেলি, মন্দির, মুনি– ঋষি, পাঠশালা, নাট্টশালা, পুস্পে ফলে শোভিত বৃক্ষ, পক্ষী কলতান সবে মিলে অযোধ্যা নগরী এক সুন্দর পরিবেশ ছিলো। এই রাজ্যের রাজা দশরথ ছিলেন প্রজা পালক, দেব দ্বিজে ভক্তি পরায়ণ, জিতেন্দ্রিয়, ধর্মনিষ্ঠ।


এই রাজ্যে ব্রাহ্মণগণ নিত্যযজ্ঞাদি করতেন। কদর্য, নাস্তিক, গরীব, মূর্খ, কামুক, কৃপণ, নিষ্ঠুর এ রাজ্যে ছিলো না। রাজা এত দানবীর ছিলেন দরিদ্রেরাও ধনী হত। এই নগরীর চারপাশে গভীর জলের পরিখাতে মনুষ্যমাংস আহারী কুমীর রাখা হত, যাতে শত্রু আক্রমণ করতে না পারে। সুপ্রশস্ত রাজপথ ছিল। নগরের চারপাশে সুরক্ষার জন্য ‘শতঘ্নি’ নামক অস্ত্র উচিয়ে রাখা হত। বিপুল সেনা চারপাশে পাহারা দিতো। 


বোধ হয় রাবনের রাক্ষস বাহিনীর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য এমন আয়োজন। রাজর্ষি দশরথের সভায় ৮জন বিচক্ষন, সু-পরামর্শদাতা মন্ত্রী ছিলেন। এছাড়া ৭জন ঋষি দশরথকে সুবুদ্ধি দিতেন। রাজা দশরথ সাগরের মতো গম্ভীর আর আকাশের ন্যায় নির্মল ছিলেন। 


তাঁর তিন রানী যথা- কৌশল রাজ্যের রাজকণ্যা কৌশল্যা, কেকয় রাজ্যের রাজকণ্যা কৈকয়ী, ও কলিঙ্গের রাজকণ্যা সুমিত্রা দেবী। দশরথের একটি কন্যা সন্তান ছিলেন তাঁর নাম শান্তা। শান্তার বিবাহ হয়েছিলো ঋষিশৃঙ্গ মুনির সাথে। রাজার কোন পুত্র সন্তান ছিলো না।


এক সময়ের কথা। রাজা দশরথের সুন্দর রাজ্যে একদিন অকাল নেমে আসলো। চারপাশে খরা। মাঠের ফসল মাঠেই রোদে পুড়ে গেলো। বর্ষা ঋতুতে কোন বৃষ্টি নেই। এমন সুন্দর স্বর্গসম রাজ্য বৃষ্টির অভাবে যেনো নরকে পরিণত হতে লাগলো। রাজা অন্নসত্র খুলে প্রজাদের অন্ন বিতরণ করতে লাগলেন।


ধীরে ধীরে অন্নের ভাণ্ডার সমাপ্ত হতে লাগলো। রাজা সমস্ত প্রকার কর মুকুব করে দিলেন। কিন্তু ফসল না হলে খাবে কি? রাজা তখন জ্যোতিষীদের শরণাপন্ন হলেন। জ্যোতিষীরা বলল- “হে রাজন। ইন্দ্র দেবতার কোপে এই অনাবৃষ্টি হয়নি। গ্রহরাজ শনিদেব রোহিনী নক্ষত্রের শকট ভেদ করেছেন, তাই এই অবস্থা। এই অবস্থায় শনির দশায় আপনার রাজ্যে বারো বছর অনাবৃষ্টি হবে।” রাজা মহাচিন্তায় পড়লেন। রাজ্যে শনিপূজার আয়োজন করলেন শনি দেবকে সন্তুষ্ট করবার জন্য।


কিন্তু শনিদেব তবুও রোহিনী নক্ষত্র ছেড়ে গেলেন না। রাজা বাধ্য হয়ে শনিদেবকে আক্রমণ করলেন। দুজনে মহাযুদ্ধ হল। দশরথ রাজা একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন। তিনি এমন সব দিব্যাস্ত্র চালনা করলেন যে, দেবতা হয়ে শনিদেব পর্যন্ত অবাক হলেন। কিন্তু দৈবশক্তির বিরুদ্ধে কতক্ষণ আর লড়াই চলে। ঘায়েল হলেন দশরথ । তখন জটায়ু পাখী তাকে সুস্থ করলেন। জটায়ু বললেন- “রাজন। আমি গরুড় পুত্র জটায়ু। আপনাকে আমি সুস্থ করেছি।


রাজা দশরথ বললেন- “হে জটায়ু। আপনি আমার প্রান রক্ষা করে আমাকে নবজীবন দান করেছেন। আজ থেকে আপনি আমার মিত্র।” সুস্থ হয়ে রাজা দশরথ পুনঃ শনিদেবকে আক্রমণ করলেন। একজন মানবের এত স্পর্ধা দেখে শনিদেব আশ্চর্য চকিত হলেন। দুজনের নানা দিব্যাস্ত্রে গগন ছেয়ে গেলো। 


নারদ মুনি মধ্যস্থতা করলেন। শনিদেবকে বললেন- “হে সূর্য পুত্র। আপনি রোহিনী নক্ষত্রে এসেছেন বলেই অযোধ্যায় অনাবৃষ্টি হচ্ছে। সেই কারনেই দশরথ রাজা আপনাকে আক্রমণ করেছেন। উপরন্তু ভগবান হরির আগামী অবতারের পিতা হচ্ছেন দশরথ। আপনি প্রভুর পিতার কোনো ক্ষতি করলে তখন হরির কোপ থেকে আপনাকে কেউ বাঁচাতে পারবেন না। অতএব আপনি রোহিনী নক্ষত্র ছেড়ে চলে যান।


শনিদেব বললেন- “তাই হবে। আমি কদাপি আর রোহিনী নক্ষত্রের সীমা অতিক্রম করবো না।” শনিদেব চলে গেলেন। অযোধ্যায় আবার সুদিন ফিরে এলো। অপরদিকে সম্বর নামক অসুরের হাতে দেবাতারা রাজ্যপাট হারিয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন- “সম্বর অসুর কেবল দশরথের হাতে বধ্য। তোমরা তাহাকে যুদ্ধে আনো।


দেবতারা গিয়ে দশরথকে সব কিছু বললেন। দশরথ যুদ্ধে আসলেন। সাথে আসলেন তাঁর স্ত্রী কৈকয়ী। অসুরের সাথে যুদ্ধে দশরথ দারুন ভাবে আহত হলেন। কিন্তু সম্বর অসুরকে বধ করলেন। অসুরের বধ হতে দেবতারা স্বর্গ ফিরে পেলো। কৈকয়ী যুদ্ধে স্বামীকে সাহায্য করেছিলেন। এমনকি দশরথ দারুন ভাবে আহত হয়েছিলেন। সমস্ত শরীরে আঘাত স্থানে পচন ধরেছিল। স্বর্গের বৈদ্য অশ্বিনী কুমার ঔষধ দিলেন। কৈকয়ী প্রানপণে সেবা করে দশরথকে সুস্থ করলেন।


খুশী হয়ে দশরথ বললেন- “কৈকয়ী তোমার সেবাতে আমি সুস্থ হয়ে নব জীবন লাভ করেছি। এই ঋণ আমি কদাপি বিস্মৃত হবো না। তোমাকে আমি দুটি বর দিতে চাই। প্রতিজ্ঞা করছি দুই বরে তুমি যা চাইবে তাই আমি দেবো।” কৈকয়ী বললেন- “সময় আসলে আমি অবশ্যই আপনার কাছে দুটি বর চেয়ে নেবো। এখন না।”


👉আদিকাণ্ড বিংশ সর্গ👇

                                  অযোধ্যা নগরীর নরপতি রাজা দশরথের কোন পুত্র সন্তান ছিলো না। তিনি তাঁর কন্যা শান্তার স্বামী ঋষশৃঙ্গ মুনিকে রাজা হতে অনুরোধ জানালে ঋষশৃঙ্গ মুনি মানা করলেন। কারন ঋষি তপ, যোগ, সাধনা নিয়েই সুখে ছিলেন। এই নিয়ে রাজা দশরথের চিন্তার শেষ ছিলো না। শেষে কি এই মহান ইক্ষাকু বংশ বিলুপ্ত হবে? একদিনের কথা রাজা দশরথ মৃগয়াতে বনে গেছেন। 


পাত্র, মিত্র, সেনা নিয়ে জঙ্গলে মৃগ অন্বেষণ করছেন। মৃগ মাংস তৎকালীন আহার্য ছিলো। মৃগ চর্মে বসে সাধনা করা হত। এছাড়া মৃগ নাভি, মাংস যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হত। অপরদিকে সেই তপবনে এসেছেন শ্রবন কুমার। তিনি তার বৃদ্ধ বয়স্ক মাতাপিতাকে নিয়ে তীর্থ ভ্রমণে বেড়িয়েছেন। শ্রবণকুমার তার পিতামাতাকে স্কন্ধে বহন করে বিভিন্ন তীর্থে গমন করতেন।


তাঁর পিতামাতা বয়সের ভারে জরাজীর্ণ, তার উপর অন্ধ। শ্রবণকুমার এক আদর্শ হিন্দু পুত্র। আজকালকার যুগে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে । কোন কোন গুরুদেব আবার অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদের সন্ন্যাস নিতে বলছেন পিতামাতার সেবা না করে। কেউ আবার পিতামাতার সেবা না করে ভগবানকে ছাপান্ন ভোগ দিচ্ছেন, তিনবেলা আরতি করছেন। কত সব নিয়ম।


কেউ আবার জীবিতকালে পিতামাতাকে খেতে দেয় না, দেখে না, মরলে পড়ে ঘটা করে এলাহী ভোজ খাইয়ে শ্রাদ্ধ, বামন ভোজোন, বৈষ্ণব সেবা, কীর্তন দান ধ্যান আবার গয়াযাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেন।


তাই বলে কেউ ধরে নেবেন না যে শাস্ত্রে লেখা ঐ সব কথা মিথ্যা। যে ব্যাক্তি শাস্ত্র মানে না- ইহলোকে সে শান্তি তো পায় না, মরেও মুক্তি পায় না। হ্যা শাস্ত্র নিয়ম অবশ্যই পালনীয়, কিন্তু জীবিত থাকাকালিন পিতামাতার সেবা করা, দেখাশোনা করাও শাস্ত্রের বিধান। গণেশজী বিশ্ব পরিক্রমা করেছিলেন হরগৌরীকে পরিক্রমা করেই। পিতার অঙ্গীকার করা বচন রাখতে রামচন্দ্র বনবাস গেছিলেন। খালি শাস্ত্রের একদিকটা দেখলেই হয় না। যাই হোক শ্রবণ কুমার পীঠে দাঁড়িপাল্লার মতোন বাঁশের সাথে বাধা ঝুঁড়িতে পিতামাতাকে বসিয়ে তীর্থে যেতেন। 


একদা শ্রবণ কুমার অন্ধ পিতামাতাকে একস্থানে বসিয়ে দ্বিপ্রহরের ফল মূলাদি সংগ্রহ করতে বের হলেন। ত্রেতা যুগে ভারতবর্ষের বন আজকের মতো রুক্ষ ছিলো না। চারপাশে সবুজে সবুজ, এছাড়া গাছ গুলি নানাপ্রকার মিষ্ট ফলে বারোমাস ভরা থাকতো। মানুষ পশু পাখীর তুলনায় ত্রিনগুণ বৃক্ষ ছিলো। যত ইচ্ছা বনের ফল খাও – এমন ছিলো। শ্রবণ কুমার ফলমূলাদি আহরণ করে নদীতে জল নিতে গেলো।


নদীর নিকটেই দশরথ রাজা ধনুর্বাণ নিয়ে মৃগ অন্বেষণ করছিলেন। শ্রবন কুমার যখন জল ভরছিলেন তাঁর শব্দে দশরথ রাজা ভাবলেন কোন মৃগ জল খাচ্ছে। তিনি আগেপিছে না দেখে অব্যর্থ শব্দেভেদী বাণ চালালেন। বাণ গিয়ে শ্রবন কুমারের বুক বিদ্ধ করল। মানবের চিৎকারে দশরথ রাজা ভয় পেয়ে গিয়ে দেখেন তার বাণ শ্রবণকুমারের বুক বিদ্ধ করছে।


দশরথ রাজা মুনির সামনে গিয়ে বললেন- “হে মুনিকুমার। আমার দ্বারা অজান্তে মহাপাপ হয়েছে। আমি আপনাকে বধ করতে চাইনি। আমি মৃগ ভ্রমে বাণ নিক্ষেপ করেছিলাম। আপনি এই অধম দশরথকে ক্ষমা করুন।”


আহত শ্রবণকুমার বললেন- “হে রাজন! আমি শ্রবন কুমার। আমার পিতা অন্ধমুনির কাছে আমাকে শীঘ্র নিয়ে চলুন। আমার পিতামাতা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।” এই বলে শ্রবণকুমার দেহত্যাগ করলেন। রাজা মুনি কুমারের মৃতদেহ তার পিতামাতার কাছে নিয়ে গেলেন। মুনি আর মুনি পত্নী কে বললেন- “মুনিবর। আমি অযোধ্যার নৃপতি দশরথ। মৃগ ভ্রমে আমার নিক্ষেপিত শরে আপনাদের পুত্র শ্রবণ কুমারের প্রান গেছে। আমার দ্বারা অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটি হয়েছে।


শুনে বৃদ্ধ পিতামাতা শোকে কেঁদে উঠলেন। বিশেষ করে শ্রবণকুমারের মা এই শোক সহ্য করতে না পেরে তখুনি প্রান ত্যাগ করলেন। বৃদ্ধ অন্ধ মুনি বললেন- “দশরথ। অগ্নিতে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হাত দিলে হাত পুড়েই যায়। তোমার অনিচ্ছাকৃত ভুলে আমরা পুত্র হারালাম। আমার স্ত্রী দেহ রেখেছেন। আমিও আর এই দেহ রাখবো না। আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি যেভাবে আমরা পুত্রশোকে দেহ ত্যাগ করলাম, তুমিও পুত্রশোকে ইহলোকে ত্যাগ করবে।


দশরথ বললেন- “মুনিন্দ্র আমি অপুত্রক। আমার কোন পুত্র নেই। কিভাবে আপনার শাপ বাস্তবায়িত হবে?” অন্ধ মুনি বললেন- “সম্রাট। ব্রাহ্মণের বাক্য কদাপি মিথ্যা হয় না। তুমি ঋষশৃঙ্গ মুনিকে এনে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ সম্পন্ন কর। তোমার অবশ্যই পুত্র হবে।” এই বলে অন্ধ মুনি প্রান ত্যাজিলেন। দশরথ তিনজনকে প্রনাম জানিয়ে বললেন- “আপনারা আশীর্বাদ দিলেন অভিশাপের ছলে।” এরপর রাজা তিনজনের দেহ সৎকার করলেন।


👉আদিকাণ্ড একবিংশ সর্গ👇

                                         তিনজন ব্রাহ্মণ হত্যা হওয়াতে রাজা দশরথ খুবই শোকার্ত ও দুঃখিত ছিলেন। বিশেষত তিনি যখন রাজ্যে অর্থ, জমি দিয়ে ব্রাহ্মণ গণকে তুষ্ট রাখেন। এই কথা জানলো মাত্র সুমন্ত্র সারথি ও দশরথের সু পরামর্শদাতা। এখন কি হবে উপায়? ব্রহ্মহত্যার পাপে দেবতারা না অভিশাপ প্রদান করেন গোটা অযোধ্যা নগরী কে। তিনি বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে গেলেন। এখানে একটু আলোচনা করলে মন্দ হয় না।


“ব্রাহ্মণ” কে? এই ক্ষেত্রে জন্ম সূত্রে পৈতেধারী বংশের বিপ্রগণ বলবেন – “তাঁরাই ব্রাহ্মণ”। সাথে কিছু স্মৃতির বুলি আউরে দেবেন। প্রথমে বলে রাখা প্রয়োজন- স্মৃতি গুলি যুগানুসারে লেখা। ঐ যুগ শেষ, ঐ স্মৃতি গুলির প্রয়োজনীয়তা শেষ। 


“শ্রীমদ্ভগবতগীতায়” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজ মুখে চতুর্বর্ণের সংজ্ঞা দিয়েছেন। এছাড়া সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগে তপস্যার মাধ্যমে ব্রাহ্মণ হতে হতো। যেমন ছিলেন বিশ্বামিত্র বা শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত সমাধি বৈশ্য। এঁনারা তপস্যার মাধ্যমে ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তি করেছিলেন। আর স্বয়ং নারায়ণ যখন অবতার ধারন করলেন তিনি এসে এই ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র মুনিকে গুরুপদে বরণ করলেন। রামচন্দ্রের অপর গুরু ছিলেন বশিষ্ঠ ও অগ্যস্ত। 


শ্রীরাম ক্ষত্রিয় কূলের ছিলেন। বংশে নয়- সাধন ভজনেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রাপ্তি সম্ভব, ভগবান রাম এই শিক্ষাই মানব জাতিকে দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে এটা ভাববেন না যে বর্তমানে যারা জন্মসূত্রে পৈতেধারী তাদের অসম্মান করবো। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সব সাপের বিষ নেই। কিন্তু আমরা দাঁড়াশ, লাউডগা, ধরা ইত্যাদি নির্বিষ সাপ দেখলেও ভয় পাই। তাদের থেকে দূরে থাকি। তেমনি কলির বামুন তেজ, শক্তি, তপ শক্তি হীন। কিন্তু আমাদের কর্তব্য তাদের সম্মান করা। 


এই সম্মান বলতে কেউ ভাববেন না, বয়সে ছোটো ব্রাহ্মণদের প্রনাম করা, তাঁদের পাদোদক পান, তাদের ছায়া না ডিঙানো, তাদের জুতা না ডিঙানো এগুলো। এগুলো চলে না। যেমন পূজা সকলেই করতে পারে। কিন্তু বারোয়ারী পূজা বা মন্দিরের পূজা বা বাৎসরিক পূজো, বিবাহ, শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি এই জন্মগত পৈতেধারীদের দিয়েই করাবেন। হিন্দু ধর্মে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সবারই অবদান আছে।


ব্রাহ্মণ সমস্ত জাতিকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিতরণ করবেন, ক্ষত্রিয় যুদ্ধ বিদ্যা দ্বারা গো- ব্রাহ্মণ- শাস্ত্র - নারী ও প্রজা রক্ষা করবেন। বৈশ্য ব্যবসা দ্বারা জাতির আর্থিক উন্নতি মজবুত করবেন আর শূদ্র সেবা দ্বারা সমাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবেন। দেখতে গেলে শূদ্রের অবদান কিছু কম নয়। সে ময়লা, আবর্জনা পরিষ্কার করে আমাদের করছেন জীবানুমুক্ত। রামায়নেই আমরা দেখবো ভগবান ভক্তের ভালোবাসায় মোহিত হয়ে শূদ্র ভক্তিনীর মুখের উচ্ছিষ্ট ফল পরম তৃপ্তির সাথে খেয়েছিলেন।


ভগবান ছুঁৎমার্গ করেন না। তিনি শুদ্ধ ভক্ত খুঁজে বেড়ান। যাকে তিনি ভালোবেসে নিজ শাশ্বত ধামে নিয়ে যাবেন। যাই হোক জন্মগত পৈতেধারী দেখলে আপনি শাস্ত্র নিয়ম মেনে তাকে সম্মান করবেন। পূজার পর দক্ষিণা দিবেন, খাওয়াবেন। আজকাল কার বিপ্ররা খুবুই দরিদ্র। আগের মতো অবস্থা নেই। সুতরাং হিন্দু হিসাবে আপনার কর্তব্য হিন্দুর পাশে দাঁড়ানো।


যাই হোক রাজা দশরথ মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইতে গেলেন। বশিষ্ঠ মুনি সেসময় আশ্রমে ছিলেন না। তাঁর পুত্র বামদেব সব শুনে বললেন- “হে রাজন! দস্যু রত্নাকর পবিত্র ‘রাম’ নাম জপ করে মহর্ষি হয়েছেন। আপনি তিনবার রাম নাম জপ করুন । রাম নামে মহাপাপ খণ্ডন হয়।


রাজা দশরথ নদীতে স্নানাদি করে পবিত্র চিত্তে ‘রাম’ নাম জপ করে রাজ্যে ফিরে গেলেন। বশিষ্ঠ আশ্রমে ফিরে পুত্র বামদেবের মুখে সব শুনে ক্রোধিত হয়ে বললেন- “মূর্খ। তুই রাজাকে তিনবার রাম নাম নিতে কেন বললি?” বামদেব জানালেন- “রাজা তিনটি ব্রহ্মহত্যা করেছেন তাই।” 


বশিষ্ঠ মুনি শুনে আরো অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন- “ওরে মূর্খ। একবার ‘রাম’ নামে কোটি ব্রহ্মহত্যার পাপ নাশ হয়। তোর রাম নামে এত অবিশ্বাস যে রাজাকে তিনবার রাম নাম নিতে বললি? যা গিয়ে নিষাদ কূলে জন্ম নে।” মুনিপুত্র বামদেব নিষাদ কূলে জন্ম নিয়েছিলেন। এর পেছনেও ভগবানের লীলা আছে। ভাবুন ‘রাম’ নামের কি মহিমা। রামায়ন বলেছে- একবার ‘রাম’ নাম নিলেই কোটি ব্রহ্মহত্যার পাপ দূর হয়।


ভগবানের নামের এতই মহিমা। নিশ্চিন্ত হয়ে ভগবান রামের নাম করুন। যমের সাধ্যি নেই আপনাকে স্পর্শ করবার। তবে এখানে একটা কথা নাস্তিক ও ঘোর অদ্বৈতবাদী বলবেন- “তাহলে সমানে পাপ করবো আর রাম নাম জপে যাবো।” তেমন না। প্রতিদিন পাপ করে রাম নাম জপলে ভগবান রাম নিজেই শাস্তি দেবেন। ভগবান শুধরানোর সুযোগ সকলকেই দেন। 


আমাদের উচিৎ সেই শুধরানোর সুযোগ নিয়ে পাপ কর্ম থেকে বিরত হয়ে শাস্ত্র নির্দেশিত পথে চলা। তবেই এই রাম নাম কার্যকারী হবে। ব্রহ্মর্ষি হবার পর বাল্মিকী মুনি কিন্তু আর ডাকাতি করেন নি। জগাই মাধাই ভক্ত হবার পর আর কিন্তু পাপে নিমগ্ন হয়নি। সেই রকম। রোজ রোজ মহাপাপ করে কোটি কোটি নাম করলেও ভগবান আপনাকে ক্ষমা করবেন না। 


👉আদিকাণ্ড দ্বাবিংশ সর্গ👇

                                        রাজা দশরথ বশিষ্ঠ মুনির সাথে কথাবার্তা বললেন। বশিষ্ঠ মুনি জানালেন অন্ধমুনির প্রদত্ত শাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলবে। কিন্তু ইক্ষাকু বংশকে ধরে রাখবার জন্য পরবর্তী অযোধ্যার সম্রাট রূপে রাজার বংশজ তো চাই। নাহলে শত্রুরাজ্য অযোধ্যা দখল করবে। রাজা হীন রাজ্য আর তালাখোলা সিন্দুক এক সমান। রাজা নিজ জীবনের তোয়াক্কা না করে ‘পুত্রেষ্টি’ যজ্ঞ করতে মন দিলেন।


ঋষিশৃঙ্গ মুনিকে আনা হল। রাজা দূত পাঠিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের আমন্ত্রণ জানালেন। মুনি ঋষিদের সাদরে আহ্বান করলেন। বোধ হয় তখন ভারতে আর্য, অনার্য মিত্রতা হয় নি। এই মিত্রতার সূত্রপাত করেছিলেন ভগবান রামচন্দ্র। পরবর্তীতে দেখবো ভগবান রামের অশ্বমেধ যজ্ঞে রক্ষ রাজ বিভীষণ, বানর কূলের সুগ্রীব, অঙ্গদ, হনুমান যোগ দিয়েছিলেন।


কিন্তু দশরথ রাজার যজ্ঞে এনারা কেউ আসেন নি। রাবণের সাথে মিত্রতা হবার চান্স তো ছিলোই না, কিস্কিন্ধ্যা থেকেও কেউ আসেন নি। পুলোম, বিশ্বশ্রবা, অগ্যস্ত, বৈশ্যাম্পন, দুর্বাসা, গৌতম, জৈমিনী, পরাশর, ভৃগু, মতঙ্গ, কৌন্ডিন্য, নিশাকর, সনকাদি মুনি, মার্কণ্ড, ভরত, ভরদ্বাজ, পরশুরাম , অষ্টাবক্র, ভৃগু, কূর্ম, দক্ষ, গর্গ, শরভঙ্গ, বিশ্বামিত্র, শতানন্দ, কপিল, বেদবান, চক্রবান, সাবর্ণ , মৎস্যকর্ণি, সৌভরি, বাল্মিকী, বিভাণ্ডক ইত্যাদি ঋষিগণ তাঁহাদিগের বিশাল শিষ্য সহ এলেন।


সপ্তর্ষি, জটায়ু আসলেন। অসুর গুরু শুক্রকেউ আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো, তিনি আসেন নি। অপরদিকে অন্য সব রাজা যেমন জনক, কাশী, লোমপাদ, তৈলঙ্গ, পুরন্দর, ঘনশ্যাম, চম্পেশর, মাগধ ইত্যাদি রাজা আসলেন।


বিঃদ্রঃ- কুলাঙ্গার কৃত্তিবাসী রামায়নে এই সংখ্যা অনেক বেশী। কৃত্তিবাসী রামায়ণে ৮৮ লক্ষ কোটি রাজার কথা বলা হয়েছে। ঐখানে মনে হয় কিছু ও নিজে জন্ম দিয়েছেন।


যাই হোক, অযোধ্যা নগরীতে আনন্দের বাণ বইল। রাজা দশরথ নিজ মৃত্যু ভুলে সেই আনন্দে যোগ দিলেন। ব্রাহ্মণগণ পরিবার সহিত অযোধ্যায় এলেন। সমগ্র অযোধ্যা মঙ্গল কলস, স্বস্তিক, ওঁকার ধ্বজা, কলা বৃক্ষ দিয়ে সাজানো হল। রাস্তা ঘাট পুস্প দ্বারা সজ্জিত করা হল।


বিঃদ্রঃ- কৃত্তিবাসী রামায়নে লেখা ৮১ যোজন দীর্ঘ, ১২ যোজন প্রস্থ সমান ঘরে এই যজ্ঞ আরম্ভ হয়। ঐখানে কিছু ওর বাপের ভিটে সহ যোগ করেছিল মনেহয়। যেরকম একটি এডাল্ট ফ্লিম শুরুর আগে বলা হয় ১৮বছরের নিম্নে কেউ দেখবেন না। ঠিক সেইভাবে বলা উচিৎ যে, কৃত্তিবাসী রামায়ণ ১৮বছরের উর্দ্ধে কেউ পড়বেন না।


যাই হোক, সবাই উপস্থিত হওয়ায় পরে তিথি নির্ণয়ে মুনিগণ পবিত্র মন্ত্র আরম্ভ করলেন। যজ্ঞাগ্নি প্রজ্বলিত হল। ঋষিশৃঙ্গ মুনি বৈদিক মন্ত্র পড়ে যজ্ঞে আহুতি দিতে লাগলেন। যজ্ঞ ধূমে পবিত সুগন্ধি সুবাস চতুর্দিকে ছেয়ে গেল। খাঁটি গব্য ঘৃত, উৎকৃষ্ট বনজ মৌমাছির মধু, মৃগ নাভি, কস্তূরী সুবাসিত বিবিধ দ্রব্য যজ্ঞদেবতাকে অর্পিত করা হল। যজ্ঞে আমরা যে আহুতি দেই সেই আহুতি অগ্নিদেবতা গ্রহণ করে বিভিন্ন দেবী দেবতার কাছে পৌছে দেন। যজ্ঞের বিধিবিধান ভুল বা ত্রুটি বা মন্ত্র অশুদ্ধ উচ্চারণে ভয়ানক কুপ্রভাব সৃষ্টি হয়।


অগ্নি দেবতা বৈশ্বানর কুপিত হয়ে সর্বস্ব গ্রাস করেন। সেজন্য সর্বদা বেদজ্ঞ সংস্কৃত শাস্ত্র জ্ঞাত, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ দ্বারা যজ্ঞ করানো উচিৎ। ভোগী ব্রাহ্মণদের দ্বারা নয়। যাই হোক, রাজা দশরথের রাজ্যে দান ধ্যান আদি কর্ম করা হল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চার বর্ণের মানুষ দান পেলো। সকলে রাজার নামে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। অবশেষে যজ্ঞে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ সুসম্পন্ন করা হল। যজ্ঞের অগ্নি রাশি থেকে অগ্নি দেবতা স্বর্ণ পাত্রে চরু নিয়ে উঠে আসলেন। 


অগ্নিদেবতা বললেন- “রাজন! তোমার আয়োজিত যজ্ঞে দেবতাবৃন্দ অত্যন্ত প্রীত হয়েছেন। তোমার যজ্ঞ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। এই চরু তোমার রানীদিগকে ভোজোন করাবে। তোমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে।” রাজা দশরথ প্রথমে সেই চরু কৌশল্যা ও কৈকয়ীর মধ্যে ভাগ করে দিলেন। কিন্তু রানী সুমিত্রা এসে সেই চরুর ভাগ চাইলো। 


তখন কৌশল্যা ও কৈকয়ী নিজের অংশের থেকে অল্প ২ জনে ২ অংশ সুমিত্রাকে দিলেন। এভাবে তিন রানী অগ্নি দেবতা প্রদত্ত চরু ভক্ষণ করলেন। কালে কালে তিন রানীর গর্ভের লক্ষণ প্রকাশ পেলো। মহারানী কৌশল্যার শরীরে দিব্যজ্যোতি দেখা দিলো। তাঁর রূপ ফুটে উঠলো।


যারা এসময় কৌশল্যাকে দেখতেন তারা অবাক হতেন যেমন মানব শরীরে এমন দেবজ্যোতি! কৌশল্যা দেবীর গর্ভে অবস্থান করছেন স্বয়ং ভগবান শ্রীহরি। শুধু তাই নয়, এই সময় কৌশল্যা দেবী অনেক দিব্য দর্শন লাভ করতেন। সুরবৃন্দ করতেন কি কৌশল্যা দেবীকে দর্শন করতে আসতেন। মানব হয়ে সচরাচর দেবতার দর্শন পাওয়া যায় না। এমন কারণে কৌশল্যা দেবী মাঝে মাঝে ভীত হতেন। নানারকম দেবতার স্বপ্ন দেখতেন। ব্রহ্মা, শিব দর্শন পেতেন। ধীরে ধীরে ভগবান, কৌশল্যার গর্ভে বৃদ্ধি পেতে লাগলেন।


👉আদিকাণ্ড ত্রিবিংশ সর্গ👇

                                      কৌশল্যা দেবী স্বপ্নে চতুর্ভুজ ভগবানের নীলনবঘন শ্রীমূর্তি দর্শন পেলেন। দেখলেন সেই অনাদির আদি গোবিন্দ পুত্র রূপে তাঁর ক্রোড়ে। কিন্তু ভগবান তাঁহার অবিছিন্না যোগমায়া শক্তি অবলম্বন করে মায়া দ্বারা কৌশল্যার সেই স্বপ্ন স্মৃতি মুছে দিলেন। 


কারন তাহলে ভগবান রাম বাৎসল্য সেবা পাবেন না। আমরা যেরূপ শ্রীকৃষ্ণের শিশু রূপ গোপাল পূজা করি তেমনি উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান ঐদিকে শিশু রামের পূজো হয়। যাঁহাকে বলে “রামলালা”।

সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী মহারাজ লিখেছেন-


বিপ্র ধেনু সুর সন্ত হিত লীনহ মনুজ অবতার।

নিজ ইচ্ছা নির্মিত তনু মায়া গুন গো পার।।


এর অর্থ- “শ্রীভগবানের নরদেহ ধারন বিপ্র, ধেনু, দেবগণ ও সাধু সন্ত কল্যাণে নিহিত ছিল। অজ্ঞান রূপে মায়ার মলিনতা, ত্রিগুণ ও ইন্দ্রিয় তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর দিব্য তনু নিজ ইচ্ছায় নির্মিত, তা কোন কর্ম বন্ধনের বশীভূত হয়ে ত্রিগুণাত্মক পঞ্চভূত দেহ নয়।”=(সন্ত তুলসীদাস)


এখানে “সাধু” শব্দের অর্থ যিনি জটা লম্বা শ্রশ্রু রেখে বনে থাকেন খালি তারাই নয়, সাধু বলতে যিনি অন্তর থেকে পবিত্র সর্বদা অন্যের মঙ্গল কামনা করে সেই মতো কর্ম করেন। “সন্ন্যাসী” শব্দের অর্থ- “সৎ ন্যাস” অর্থাৎ যিনি সৎ অর্থাৎ মঙ্গল কর্ম করেন তিনিই সন্ন্যাসী। আর শ্রীভগবান এঁনাদের কল্যাণ করেন।


যাই হোক চৈত্র মাসের শুক্ল নবমী তিথিতে কর্কট লগ্নে পুনর্বসু নক্ষত্র (মতান্তরে অশ্লেষা) দ্বিপ্রহরে কৌশল্যা দেবীর গর্ভ থেকে আবির্ভূত হলেন শ্রীভগবান রামচন্দ্র। এই দিনটি “রামনবমী” নামে পালিত হয়।


মধু চৈত্রমাস, শুক্লা শ্রীরাম নবমী।

শুভক্ষণে ভূমিষ্ঠ হলেন জগৎস্বামী।।=(মহর্ষি বাল্মীকি)


শ্রীরামের আবির্ভাব হতে দাসীরা গিয়ে রাজা দশরথকে সংবাদ দিলেন। রাজা দাসীদিগকে মণি মুক্তা অলংকার বিতরণ করলেন। পুত্রের মুখ দেখে অতিশয় খুশী হলেন। এই দেখে মন্থরা গিয়ে গর্ভ যন্ত্রনায় কাতর কৈকয়ীকে বললেন- “তোমার কপাল পুড়লো, এবার কৌশল্যা আগে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে সেই রাজা হবে, আর তুমি ভিখারী।


কৈকয়ী জন্ম দিলেন এক পুত্রের। দশরথ রাজা শুনে আনন্দে দান ধ্যান করে কৈকয়ী পুত্রকে দর্শন করলেন। একদিন পর সুমিত্রা দুটি যমজ পুত্রের জন্ম দিলেন। রাজা দশরথের আনন্দের সীমা নেই। সুমিত্রা সহ যমজ পুত্র দেখে খুশীতে ভরে উঠলেন। শ্রীরামের জন্মেতে ধরিত্রী দেবী খুশী হলেন। মুনি ঋষিরা আনন্দিত হলেন।


অযোধ্যায় শঙ্খ, উলুধ্বনি, মৃদঙ্গ, করতাল আদি মঙ্গলজনক বাদ্য বাজতে থাকলো। স্বর্গের দেবতারা পুস্প বর্ষণ করতে লাগলেন। ছদ্দবেশে অযোধ্যা পুরীতে এলেন। চার পুত্রকে একই দোলনায় রাখা হল। রানীরা একে অপরের পুত্রকে আদর করিতে লাগলেন। কে কার মা বোঝাই গেলো না। সরল হৃদয় কৈকয়ী রামচন্দ্রকে আদর বাৎসল্য প্রদান করতে লাগলেন। 


ভগবানের বাল্যরূপ দর্শন করা অতি সৌভাগ্যের। বিশেষত ভগবান যখন পূর্ণব্রহ্মজ্ঞান নিয়ে অবতার গ্রহণ করেন। এর পূর্বে বামন, কপিল, পরশুরাম অবতারে এই দৃশ্য দেখবার সৌভাগ্য হয় নি। মুনি ঋষিগণ আশীর্বাদ করে অন্তরে অন্তরে কৌশল্যার পুত্রকে প্রনাম করলেন। শিশু ভগবান রাম রূপে নারায়ণ অবস্থান করছেন। সেই শিশু রামের কি অপূর্ব শোভা–


অন্ধকার ঘুচে যে জ্বালিলেক বাতি।

কোটি সূর্য জিনিয়া তাঁহার দেহ- জ্যোতি।।

শ্যামল শরীর প্রভু চাঁচর কুন্তল।

সুধাংশু জিনিয়া মুখ করে ঝলমল।।

আজানুলম্বিত দীর্ঘ ভুজ সুললিত।

নীলোৎপল জিনি চক্ষু আকর্ণ পূর্ণিত।।

কে বর্ণিতে হয় শক্ত রক্ত ওষ্ঠাধর।

নবনীত জিনিয়া কোমল কলেবর।।

সিন্দূরে মণ্ডিত রাঙা চরণ সুন্দর।

কমল জিনিয়া প্রভু- নাভি মনোহর ।

সংসারের রূপ যত একত্র মিলন।

কিসে বা তুলনা দিব নাহিক তেমন।।=(মহর্ষি বাল্মীকি)


অপূর্ব সুন্দর সদ্যোজাত ভগবানকে দখে মোহিত হয়ে গেলেন সকলে। লঙ্কায় নানা অশুভ চিহ্ন দেখা দিলো। রক্তবৃষ্টি, শেয়াল সারমেয় ক্রন্দন, গৃধ দলের আকাশে বিচরণ, বিনা মেঘে বজ্রপাত, গর্দভের ক্রন্দন ইত্যাদি ইত্যাদি। রাক্ষসেরা ভয়ে ভীত হল। 


চৈত্র মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে অবশ্যই রাম নবমী তিথি পালন করুন। জন্মাষ্টমীর মতো নিয়ম। তবে শ্রীরামের জন্ম দ্বিপ্রহরে। তাই পূজা দ্বিপ্রহরে ১টার মধ্যে সমাপন করবেন। উপোবাসী থেকে পূজাদি করে প্রসাদ সেবা নিয়ে ভগবানের নাম কীর্তন করে পালন করবেন এই তিথি। পূজাতে আপনার সাধ্য মতো ফলমূল ও একটি লাড্ডু হলেও দিবেন।


কেউ কেউ মাটির সড়ায় ছাতু, মধু, দৈ, ঘৃত , শর্করা একত্রে দেন। ভগবানের পূজার আড়ম্বর নেই। যার যেমন সামর্থ্য। ভগবান রাম শবরীর দেওয়া উচ্ছিষ্ট জাম ফল খেয়েই তুষ্ট হয়েছিলেন। গর্বে উন্মত্ত হয়ে রাশি রাশি ভোগ দিলে ভগবানের কাছে তা বিষ, আবার ভক্তিভাবে এক পাত্র জল দিলেই তিনি তা আনন্দে সেবা করেন।


সুদামার তিন মুঠ চিড়াতেই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, আবার বিদূরের স্ত্রী, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখে ভক্তিভাবে এতই উন্মত্ত হয়েছিলেন যে কলা খেতে দিয়ে ভাবে মোহিত হয়ে নিজেই কলা ছুলে কলার পরিবর্তে কলার খোসা নিবেদন করেছিলেন। আর ভগবান হাসতে হাসতে সেই কলার খোসা সেবা নিয়েছিলেন। 


👉আদিকাণ্ড চতুর্বিংশ সর্গ👇

                                         চার পুত্র পেয়ে সমস্ত অযোধ্যা নগরীতে আনন্দ বয়ে গেলো। পুত্রদের নামকরণ অনুষ্ঠান বা ছয়ষষ্ঠীর আয়োজন করলেন রাজা দশরথ। সেই উৎসব কে কেন্দ্র করে আবার এক মহা আয়োজন চলল। রাজা দশরথ কুলগুরু বশিষ্ঠ মুনিকে আমন্ত্রণ করে স্বাগত জানিয়ে করজোড়ে বললেন- “হে মুনিবর! বলুন কি নাম রাখা যায়?


মুনি বললেন- “হে রাজন! এঁদের অনেক সুন্দর অনুপম নাম আছে। তবুও আমি বিচার অনুসারে বলছি। আপনার পুত্রেরা সুখ রাশি সম্পন্ন ও আনন্দসাগর। এই সাগরের একবিন্দু সংসারকে সুখ দান করতে সক্ষম।


সুখধাম ও বিশ্ব চরাচরের শান্তিদাতা আপনার জেষ্ঠ্যপুত্র কৌশল্যা নন্দনের নাম হবে ‘রাম’। জগতের ভরন পোষণকারী আপনার দ্বিতীয় পুত্র তথা কৈকয়ীর সন্তানের নাম ভরত। আর সর্ব সুলক্ষণ যুক্ত রামের প্রিয় যিনি, যিনি মস্তকে পৃথিবীর ভার বহন করে আছেন সুমিত্রার সেই পুত্রের নাম হবে লক্ষ্মণ। আর যাঁকে স্মরণ করলে সর্ব শত্রু নাশ হয়, সুমিত্রার অপর পুত্রের নাম হবে শত্রুঘ্ন।


বাল্যকাল থেকেই সুমিত্রা নন্দন লক্ষ্মণ, ভগবান রামের যেনো ছায়া ছিলেন। সর্বদা অগ্রজের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। অপরদিকে ভরতের ছায়া ছিলেন সুমিত্রার অপর পুত্র শত্রুঘ্ন। অবশ্য চার ভ্রাতার মধ্যে ভাতৃত্ব বন্ধন ছিলো সুনিবিড়। রাজা দশরথের গৃহে বড় হতে লাগলেন চার ভাই। শ্রীরাম কে দেখে সকলেই মোহিত হতেন। 


তিনি হামাগুড়ি দিয়ে চলতেন, কোমোরে বন্ধনী, চরণের নূপুর ঝুমঝুম করে বাজতো। মাতা কৌশল্যা পুত্রকে ক্রোড়ে নিয়ে বাৎসল্য প্রদান করতেন। কৈকয়ী নিজেও রামকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন। মন্থরা এ সকল দেখে কৈকয়ীকে সর্বদা গাল মন্দ করে কুবুদ্ধি প্রদান করতো। কৈকয়ী এ সকল এড়িয়ে চলতেন। কৌশল্যা দেবী সহ রাজবাড়ীতে দাস দাসীরা অদ্ভুদ দর্শন পেতেন। 


কখনো দেখতেন বালক রাম যেখানে যেখানে হাত পা ফেলছেন সেখানেই পদ্ম ফুটে উঠছে। কিংবা দেখতেন বালক রাম চন্দ্রের চরণ ছাপে ধ্বজা, পতাকা, চক্র, শঙ্খ আদি চিহ্ন। তাঁরা ভয় পেতেন। তাঁর নূপুরের রুনুঝুনু মুনি মনকে মোহিত করেছিলো। তাঁর কটিতে ছিল কিঙ্কিনি আর উদরে ছিলো ত্রিবলী রেখা। 


বাল্মীকি রামায়ণের এই শ্লোক অনুবাদ করতে গিয়ে সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী খুব সুন্দর লিখেছেন লিখেছেন-------

“তাঁর নীলকমল (সদৃশ্য) নবনীরদ ঘনশ্যাম তনুতে ছিল কোটি কামদেবের সৌন্দর্য। অরুনাভ শ্রীপাদপদ্মের নখের জ্যোতি দেখে মনে হচ্ছিল্ল রক্তকমল পত্র দলের উপর মুক্তা বিরাজিত। চরণ বজ্র, ধ্বজ, অঙ্কুশ চিহ্ন শোভিত ছিলো"।=(সন্ত তুলসীদাস)


সুবিশাল বাহু যুগল ছিল অতিশয় সুন্দর; তাতে বিভিন্ন কর ভূষণ থাকাতে তা আরো সুন্দর লাগছিল। বুকে ব্যঘ্র নখের দ্যুতি ছিল। কণ্ঠে ছিল রত্নখচিত মণি হার। বক্ষে ভৃগু পদচিহ্ন দর্শন করলেই মন মুগ্ধ হয়ে যায়। তিনি ত্রিরেখাযুক্ত কম্বু কণ্ঠ সুশোভন চিবুকবিশিষ্ট। বদনে অসংখ্য অধরের মধ্যে দুটি অনুপম শোভা, নাসিকা গঠন সুচারু। মাতা কৌশল্যা শিশু রামকে নানা সাজে সজ্জিত করতেন।”


👉আদিকাণ্ড পঞ্চবিংশ সর্গ👇

                                           ভগবান রাম ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল্লেন দশরথ রাজার গৃহে। হামাগুড়ি ছেড়ে ভগবান রাম ধীরে ধীরে হাঁটা শিখলেন। একদা কৌশল্যা দেবী শ্রী সূর্য নারায়ণকে ভোগ নিবেদন করে এসে দেখেন তাঁর আদরের রাম দোলনাতে শয়ন করে মৃদু মৃদু হাসছে।


ভগবান রামের সেই অনুপম হাসিতে ত্রিভুবন মোহিত হয়ে যায়। পুনঃ কৌশল্যা দেবী ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখেন শিশু রাম সেই নারায়ণকে প্রদত্ত নৈবদ্য সেবা নিচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে রানী ভয় পেয়ে এসে দেখেন শিশু রাম আগের মতোই দোলনাতে শয়ন করে হাস্য করছেন, পুনঃ ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখেন শিশু রাম সেই নৈবদ্য খাচ্ছেন।


বার কয়েক এই দৃশ্য দেখে রাণী ভয় পান। তখন শ্রীরাম, রাণীকে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড দর্শন করান। পুনঃ যোগমায়া শক্তি অবলম্বন করে কৌশল্যার সেই স্মৃতি বিলুপ্ত করেন। মাতা কৌশল্যা শিশু রামকে ক্রোড়ে নিয়ে বাৎসল্য, স্তন্য দুগ্ধ প্রদান করেন। শিশুরা যেমন মায়ের ক্রোড়ে অবস্থান করেন, মা তাহাদের চন্দ্র দর্শন করে ঘুমপাড়ানি সঙ্গীত গুনগুন করে গেয়ে চলেন, তেমনি মাতা কৌশল্যা শিশু রামকে নিয়ে সেই চন্দ্র দর্শন করাতেন।


শিশু রামকে দেখে রোহিনীপতি নিশানাথ প্রনাম জানিয়ে চন্দ্রালোকের মাধ্যমে ভগবানের চরণ স্পর্শ করতেন। একটু একটু করে চার ভ্রাতা হাঁটা শিখছিলেন। রাজা দশরথের হাত ধরে শিশু রামচন্দ্র হাঁটছেন, আবার পড়ে যাচ্ছেন। রাজা এসে রামচন্দ্রকে ক্রোড়ে নিয়ে তাঁর ক্রন্দন সামলাচ্ছেন। পদ্ম পুস্পের ন্যায় রামচন্দ্রের নয়ন থেকে মুক্তাধারার মতো পতিত অশ্রুবিন্দু রাজা দশরথ মুছিয়ে পুত্রকে স্নেহে চুম্বন করছেন।


বাল্মীকি রামায়ণের এই মধুর ইতিবৃত্ত দেখে সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী তাঁর অনুবাদিত রামায়ণে সুন্দর একটি ভজন গেয়েছেন- 


ঠুমকি চলত রামচন্দ্র বাজত পৈঁজানিয়াঁ।

কিলকিলাই উঠত ধায়, গিরত ভূমি লটপটায়;

ধায়ী মাতু গোদ লেত দশরথকী রানিয়াঁ।

তুলসীদাস অতি আনন্দ হেরত মুখারবিন্দ;

রঘুবরকী ছবি সমান রঘুবর ছবি বাণিয়াঁ।।

অঙ্গ রজঃ অঙ্গলাই, বিবিধ ভাঁতি সোঁ দুলার।

তন মন ধন বার বার কহত মৃদু বাণিয়াঁ।।=(সন্ত তুলসীদাস)


শ্রীরামচন্দ্র অল্প অল্প হাঁটা শিখছেন। তাঁর চরণের মল, কোমোরের বন্ধনী বেজে উঠতো। হাঁটা শিখতে শিখতে বাচ্চা পড়ে যায়। সেই মতো রামচন্দ্র পড়ে গেলে, দশরথের তিন রাণী ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসতেন। কে আগে ক্রোড়ে নেবে, তাঁর জন্যই এই ছুটে আসা, ব্যাকুলতা। প্রথম স্নেহ কৈকয়ী দিতেন। 


চার ভ্রাতার দন্ত দেখা দিলো। শিশু রামের হালকা রক্তাভ অধর দ্বয়ের মধ্যে মুক্তা বিন্দুর মতো দন্ত দেখা দিলো। অতএব অন্নপ্রাশন প্রয়োজন। অযোধ্যা রাজ্যে চার ভ্রাতার অন্নপ্রাশন হল। কুলগুরু বশিষ্ঠ ও অনেক মুনি ঋষি শিষ্য সমেত পদার্পণ করলেন। যজ্ঞাদি, পূজা, দান, বিতরণ, বিশাল ভোজের ব্যবস্থা করা হল।


কুলগুরু সূর্যনারায়নের পূজা করে চার ভ্রাতার মুখে অন্ন দিলেন। রাজার হস্ত থেকে অন্ন নিলেন রামচন্দ্র। এভাবে অন্নপ্রাশন সমাপ্ত হল। শিশু রামকে দেখতে ভীর উপচে পড়লো। মাতা কৌশল্যা বিবিধ খাদ্য- ক্ষীর, নবনী, মাখন, সর, দুগ্ধ, দধি, লাড্ডু, মোদক বিবিধ মিষ্টান্ন শ্রীরামের মুখে দিতেন। রাণী কৈকয়ী মাঝে মাঝে ভরত কে বিস্মৃত হয়ে রামচন্দ্রকে অনেক আদর বাৎসল্য প্রদান করতেন। কৈকয়ীর দাসী মন্থরা এসব দেখে হিংসায় জ্বলতে লাগলো।


👉আদিকাণ্ড ষষ্ঠবিংশ সর্গ👇

                                        ভগবান তো এসেছেন। কিন্তু তাঁর শক্তি আসবেন এই অবতারে। ভগবান যখন অবতীর্ণ হন, শক্তিও আসেন। শক্তি বিনা পুরুষ জড়, শব।


বিষ্ণু পুরাণে উল্লেখিত হয়েছে– 


চ যথা জগৎস্বামী দেবদেবো জনার্দনঃ।

অবতারং করোতোষা তথা শ্রীস্তৎসহায়িনী।।

রাঘবত্বেহভবৎ সীতা রুক্মিণী কৃষ্ণজন্মনি।

অন্যেষু চাবতারেষু বিষ্ণোরেষা সহায়িনী।।

দেবত্বে দেবদেহেয়ং মনুষ্যত্বে চ মানুষী।

বিষ্ণোর্দেহানুরূপাং বৈ করোত্যেষাত্মনস্তনুম্।।


( বিষ্ণুপুরাণ- ১/৯/১৪০,১৪২-৪৩)


অর্থাৎ:- জগৎস্বামী দেবদেব জনার্দন যেমন অবতীর্ণ হন, তাঁর সহায়িনী লক্ষ্মীদেবীও সেইরূপই অবতীর্ণা হন। ... রামাবতারে ইনি সীতা এবং কৃষ্ণাবতারে রুক্মিণী হয়েছিলেন; অনান্য অবতারেও ইনি বিষ্ণুর সহায়কারিণী। বিষ্ণু যখন দেবরূপে অবতীর্ণ হন তখন ইনি দেবী হন, বিষ্ণু মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হলে ইনি মানবী হন- প্রতি অবতারে বিষ্ণুর দেহের অনুরূপ দেহই পরিগ্রহ করেন। 


একবার মিথিলা রাজ্যে অকাল মহামারী দেখা দিয়েছিলো। ফসল নষ্ট হল। নদী নালা শুকিয়ে কাঠ। চারপাশে খালি দুর্ভিক্ষ আর পশু পক্ষী মানুষের মৃতদেহ- এমন অবস্থা। গাছপালা শুকিয়ে মিথিলা রাজ্য মরুভূমি হল। মিথিলা রাজ্য বর্তমান বিহার আর নেপালের কিছু অংশ নিয়ে ছিল। মিথিলার রাজা জনক মহাচিন্তায় পড়ে কুলগুরু মহর্ষি শতানন্দের শরণাপন্ন হলেন।


মহর্ষি বললেন- “রাজন! দেবী লক্ষ্মী সুখ, সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্যের দেবী। তিনি তুষ্টা হলে রাজ্যে অনাচার দূর হয়ে শ্রীবৃদ্ধি পাবে। অতএব তুমি মাতা লক্ষ্মীর উপাসনা কর।” রাজা জনক তাই করলেন। মা লক্ষ্মীর শরণ নিয়ে তপ করতে লাগলেন। দেবী হরিপ্রিয়া সেই তপস্যায় তুষ্ট হয়ে রাজা জনক কে দর্শন দিলেন। রাজা জনক দেবী লক্ষ্মীর অপূর্ব মূর্তি দর্শন করলেন। দেবী কমলা চতুর্ভুজা , হস্তে মঙ্গল কলস, উপরের দুহস্তে পদ্মপুস্প, নীচের এক হস্তে তিনি ঐশ্বর্য প্রদান করছেন, আর এক হস্তে কলস। 


মস্তকে চারটি হিমালয়ের চূড়া সদৃশ শ্বেত গজ মঙ্গল কলস এর সলিল দ্বারা দেবী ক্ষীরোদার অভিষেক করছেন। সকল প্রকার শ্রীযুক্ত পদ্মাসীনা সেই দেবী অভয় দিয়ে বললেন- “পিতা! আমি আপনারই কন্যা রূপে আবির্ভূতা হব। আমার আগমনে এই রাজ্য সুজলা সুফলা ধনধান্যে ভরে উঠবে। আপনি শীঘ্রই ভূমি কর্ষণ উৎসবের আয়োজন করুন। সেই উৎসবে আপনি আমাকে প্রাপ্ত করবেন।” 


রাজা জনক তাই করলেন ভূমি কর্ষণ উৎসব আরম্ভ করলেন। বৈশাখের শুক্ল পক্ষের নবমী তিথিতে মঙ্গলবার পুষ্যা নক্ষত্রে কন্যা রাশিতে (বর্তমান বাজারের পণ্ডিতদের মতে বাল্মীকি মুনির হিসাবের মতান্তর আছে) জনক রাজা প্রাপ্তি করলেন সীতা দেবীকে। সেই দিনটি “সীতানবমী” নামে পালিত হয়। মাতা সীতা বসুমতী কণ্যা রূপে অযোনিজা হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। মা লক্ষ্মীর আগমন হতেই মিথিলা রাজ্য সুখ সমৃদ্ধি ফসলে ভরে উঠলো, দুর্ভিক্ষ মহামারী দূর হল। উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ, মৃদঙ্গ পবিত্র বাদ্য বাজিয়ে রাজা জনক শিশু সীতাদেবীকে ঘরে নিয়ে গেলেন। হরিপ্রিয়া কমলা দেবীর আশীর্বাদ যার উপর থাকে সে রোগ, শোক, ব্যাধি, দারিদ্র মুক্ত হয়। তাই গানে বলা হয়–


এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী

থাকো মা লক্ষ্মী ঘরে ঘরে।

গাছে ভরা ফুল আর মাঠে ভরা ধান

দুধে ভাতে বেঁচে থাক মা তোমার সন্তান।।

দীপ জ্বলে শাঁখ বাঁজে মা তোমার আহ্বানে।

যেবা নারী পূজে তোমায় যেবা স্মরে

তুমি মা তার দাও মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে।।


যাঁরা অর্থ, ধন, সম্পত্তি পেতে চান তাঁরা মা লক্ষ্মীর অর্চনা করতে পারেন। অর্থ, ধন বলতে কেবল টাকা পয়সা কে বোঝায় না। চারিত্রিক সম্পদ, পারমার্থিক সম্পদ দেবী লক্ষ্মী প্রদান করেন। তবুও যারা অর্থ সম্পদ পেতে চান- তারা সকালে উঠে ভূমিতে চরণ রাখার পূর্বে এই মন্ত্র উচ্চারন করুন – 


লক্ষ্মীঃ শ্রীঃ কমলা বিদ্যা মাতা বিষ্ণুপ্রিয়া সতী।

পদ্মালয়া পদ্মহস্তা পদ্মাক্ষী পদ্মসুন্দরী।।

ভূতানামীশ্বরী নিত্যা মতা সত্যাগতা শুভা।।

বিষ্ণুপত্নী মহাদেবী ক্ষীরোদতনয়া ক্ষমা।।

অনন্তলোকলাভা চ ভূলীলা চ সুখপ্রদা।

রুক্মিনী চ তথা সীতা মা বৈ বেদবতী শুভা।

এতানি পুণ্যনামানি প্রাতরুত্থায় যঃ পঠেৎ।

মহাশ্রিয়মবাপ্নোতি ধনধান্যমকল্মষম্।।


বঙ্গানুবাদ- শ্রী, কমলা বিদ্যা, মাতা, বিষ্ণুপ্রিয়া, সতী, পদ্মালয়া, পদ্মহস্তা, পদ্মাক্ষী, পদ্মসুন্দরী, ভূতগণের ঈশ্বরী, নিত্যা, সত্যাগতা, শুভা, বিষ্ণুপত্নী, ক্ষীরোদতনয়া, ক্ষমাস্বরূপা, অনন্তলোকলাভা, ভূলীলা, সুখপ্রদা, রুক্মিনী, সীতা, বেদবতী- দেবী লক্ষ্মীর এসকল নাম। প্রাতে উত্থান কালে যিনি দেবীর এই পুন্য নামাবলী পাঠ করেন, তিনি বিপুল ঐশ্বর্য ও নিস্পাপ ধনধান্য প্রাপ্ত হন।


👉আদিকাণ্ড সপ্তবিংশ সর্গ👇

                                         এবার একটু বালির কথা শোনা যাক। বালি আর সুগ্রীব এর ভাতৃপ্রেম সকলেই বিদিত ছিলেন। বালির স্ত্রীর নাম তারা, সুগ্রীবের স্ত্রীর নাম রুমা। বালি ইন্দ্র দেবতার বর পুত্র ছিলেন, সুগ্রীব সূর্য দেবতার বর পুত্র ছিলেন। দুন্দুভি রাক্ষস বধ বধ করার সময় তাঁর সহযোগী রাক্ষস মায়াবী পলায়ন করেছিলো। পুনঃ একদিন মায়াবী রাক্ষস কিস্কিন্ধ্যায় এসে মহা উপদ্রব সৃষ্টি করলো। 


বানর দের বধ করতে লাগলো। খবর পেয়ে বালি গদা হস্তে ভীষণ মূর্তি ধরে ছুটলো। পেছন পেছন সুগ্রীব ও কিছু বানর ছুটলো। মায়াবী রাক্ষস মায়াবিদ্যায় পটু ছিলো। কিন্তু বালির সাথে যুদ্ধে পেরে উঠছিলো না। বালির গদায় আহত হয়ে মায়াবী রক্তবমন করতে লাগল। মায়াবী যুদ্ধে হেরে আরবল্লী পর্বতের একটি গুহায় ঢুকল। 


বালি গদা হাতে সেই গুহায় ঢুকতে গেলে সুগ্রীব বাধা দিয়ে বলল- “অগ্রজ, পলায়মান শত্রুর ওপর আঘাত যুদ্ধ নিয়মের বিরোধী। আপনি ফিরে চলুন।” বালি সে কথায় কান না দিয়ে গুহার ভেতরে একা প্রবেশ করল। দুজনে এমন যুদ্ধ হল গুহার ভেতরে যে মনে হল গোটা পর্বত টাই ভেঙে পড়বে। দুজনের যুদ্ধে পর্বতে কম্পন সৃষ্টি হয়ে ধস নামল। গুহার মধ্যে থেকে রক্ত নদীর ধারা বের হল।


মায়াবী গুহার ভেতরে বালির গলার নকল করে আর্তনাদ করতে লাগল। সুগ্রীব ভাবল বালি বুঝি সেই রাক্ষসের হাতে মারা পরেছে। এবার যদি সেই রাক্ষস বের হয়ে আসে তবে গোটা কিস্কিন্ধ্যা ধ্বংস করবে। এই ভেবে সুগ্রীব একটা বড় পাথর চাপা দিয়ে গুহার মুখ বন্ধ করে রাজ্যে ফিরে এলো। 


রাজ্যে ফিরে সব বলতেই বালির পত্নী তারা কান্নায় ভেঙে পড়ে শাখা পলা সিঁদুর বিসর্জন দিয়ে বিধবার বেশ ধরল। বালির দেহ আনাও সম্ভব না। দেহ আনতে হলে পাথর সড়িয়ে আনতে হবে, আর তাহলে সেই রাক্ষস পুনঃ এসে উৎপাত আরম্ভ করবে। বালির কুশপুতুল পুড়িয়ে অঙ্গদ সকল প্রকার ভাবে পিতৃ শ্রাদ্ধ পালন করল।


ফাঁকা রাজ আসনে কে বসবে? অঙ্গদ এখনও শিশু। সুগ্রীব রাজা হয়ে অঙ্গদকে যুবরাজ ঘোষিত করে রাজ্য চালাতে লাগল। বছর ভরে যুদ্ধ করার পর বালি সেই গুহার ভেতরে মায়াবীকে বধ করলো। বালির শরীরে এত বল ছিলো যে সে হাত দিয়ে পাথর সড়িয়ে গুহা থেকে বের হল। 


রাজ্যে ফিরে সুগ্রীবকে রাজার আসনে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল- “তুই ভাই নামে কলঙ্ক। আমি সেখানে যুদ্ধ করছিলাম, আর তুই রাজ্য পাবার লোভে আমাকে পাথর চাপা দিয়ে গুহা মুখ বন্ধ করে এসে রাজা হয়েছিস। কি ভেবেছিলি যে আমি ঐ বদ্ধ গুহায় মারা যাবো?” জীবিত দাদাকে দেখে সুগ্রীব এসে ভ্রাতাকে আলিঙ্গন করে বলল- “অগ্রজ। আপনাকে জীবিত দেখে আমি আনন্দিত হয়েছি। আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি ঐ রাক্ষসের হস্তে মারা গেছেন। যাতে ঐ রাক্ষস বের হতে না পারে সেই জন্য গুহা মুখ রুদ্ধ করেছিলাম।


বালি ত ঐ সকল কথা বিশ্বাস করলো না। উলটে বলল- “সুগ্রীব। যদি এতই তোর রাজা হবার ইচ্ছা তো আমাকে বলতিস তোকে এই রাজ্য দান করতাম। আমি স্বয়ং দশানন কে সাতবার জলে ডুবানোর ক্ষমতা রাখি। আর ঐ সামান্য রাক্ষস আমাকে বধ করবে? বেরিয়ে যা আমার রাজ্য হতে।


বালি সুগ্রীবকে তাড়িয়ে দিল। সুগ্রীব গিয়ে ঋষমূক পর্বতে আশ্রয় নিলো। বালি সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলো। রুমা রাজী হল না, বালি তখন রুমাকে কারাবন্দী করল। 


একদিনের কথা। ভগবান শিব একজন মাদারী (বাদর খেলা যে দেখায় তাকে মাদারী বলে) সেজে আর হনুমান কে এক বাঁদর সাজিয়ে অযোধ্যা তে গেলো। রামের ইষ্ট শিব আবার শিবের ইষ্ট রাম। অযোধ্যা নগরীতে নেমে ডুগডুগি বাজিয়ে শিব বাদর খেলা দেখাতে লাগলো। রাজবাটিটে বাঁদর নাচানো দেখাতে গেলেন স্বয়ং পশুপতি। চার ভ্রাতা সেই খেলা দেখে আনন্দিত হলেন। শিশু রাম, দশরথকে অনুরোধ জানালেন তাঁকে ঐ বাঁদর টি দিতে। দশরথ রাজা মাদারীকে বললেন- “কত মূল্যে তুমি বাঁদর টি দেবে?” মাদারী রূপধারী হর জানালেন- “মহারাজ। এর কোনো মূল্য লাগবে না। খালি একটি প্রতিজ্ঞা করতে হবে, যেনো সারা জীবন আপনার পুত্র এই বাঁদর টিকে তাঁর সেবক রূপে রাখেন।


রামচন্দ্র বচন দিলেন। মাদারী রূপী শিব সেইখানে বাঁদর টি দিয়ে চলে গেলেন। চার ভ্রাতা যখন খেলা খেলতো তখন বাণর রূপী হনুমান তাঁদের সাথে খেলা করতেন। ভগবান রাম খুবুই স্নেহ করতেন হনুমানকে।


আর হনুমান মহারাজ সর্বদা রামচন্দ্রের আগেপিছে ঘুরতেন। প্রভুর খেলা সামগ্রী যেমন কন্দু, ঘুড়ির লাটাই, তির ইত্যাদি এনে এনে দিতেন। গাছে উঠে সুগন্ধি পুস্প বা মিষ্ট ফল পেরে পেরে দিতেন। সুগ্রীবের অবস্থার কথা রামচন্দ্র যোগবলে জেনেছিলেন। তিনি হনুমানকে সুগ্রীবের কাছে ঋষমূক পর্বতে গিয়ে অবস্থান করতে বলেছিলেন। আর বলেছিলেন- যথা সময়ে আবার দেখা হবে।


👉আদিকাণ্ড অষ্টবিংশ সর্গ👇

                                         এভাবে অযোধ্যায় শ্রীরাম বয়োঃবৃদ্ধি পাচ্ছিলেন। তিনি নিত্য বাগানে খেলা করতেন। সখাদের সাথে ভ্রাতার সাথে মিলে কুল ধর্ম মেনে বনে গিয়ে মৃগয়া করতেন। প্রিয় সনাতনী সুধী, এই বিষয়টি নিয়ে সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী সুন্দর একটি ছন্দ লিখেছেন:-

বন্ধু সখা সঁগ লেহিঁ বোলাঈ।

বন মৃগয়া নিত খেলহিঁ জাঈ।।

পাবন মৃগ মারহিঁ জিয়ঁ জানী।

দিন প্রতি নৃপহি দেখাবহিঁ আনী।।


অর্থ:- ভ্রাতা সখা পরিবৃত হয়ে শ্রীরামচন্দ্র নিত্য মৃগয়ায় যেতেন (ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুসারে)। পূত মৃগ শিকার করতেন এবং তা এনে দশরথকে দেখাতেন।


প্রাচীন কালে ক্ষত্রিয় গণ বনে গিয়ে মৃগয়া করতেন। এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে। এক আহার্য হিসাবে মৃগ মাংস সেই যুগে প্রসিদ্ধ ছিল এবং ক্ষত্রিয়গণ তা খেতেন। দ্বিতীয়ত মৃগ চর্ম পবিত্র আসন। এছাড়া শিকাড় করাকে বীরত্ব মানা হত। অবশ্য রামচন্দ্রের হাতে নিহত মৃগ অবশ্যই মুক্তি পেয়েছিলেন। অপরদিকে রাজা জনকের গৃহে সীতা দেবী বৃদ্ধি পেতে লাগলেন।


রাজা জনকের রাজ্যে শ্রীবৃদ্ধি ঘটলো। উপযুক্ত পরিমাণে বর্ষণ হল। মাঠগুলি সিক্ত হলে প্রজারা চাষাবাদ করে ধনধান্যে ফুলে উঠলেন। এসবই হয়েছে মাতা লক্ষ্মীর কৃপায়। তিনি নিজেই সীতা রূপে জনক রাজা ও সুনয়নার কোল আলো করে বড় হতে লাগলেন। সীতা দেবী ভগবতী উমামাতার ভক্ত ছিলেন। 


অপরদিকে রামচন্দ্র ছিলেন শিবভক্ত। রামচন্দ্রের মনোহর রূপ দেখে অযোধ্যার আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই মোহিত হয়ে রামচন্দ্রকে ক্রোড়ে নিয়ে আদর করতেন। এমনই ছিলো রামচন্দ্রের রূপ। পাঁচ বছর বয়স হতে রামচন্দ্রকে ভ্রাতাদের সহিত গুরু বশিষ্ঠের আশ্রমে বিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠানো হল। বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে রামচন্দ্র ও তাঁহার ভ্রাতারা চতুর্বেদ, উপনিষদ, কাব্য, অলংকার, ব্যাকারন, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন বিদ্যা আদি সব শাস্ত্র শিখলেন।


এরপর অস্ত্র বিদ্যা শুরু হল। প্রথমে মল্ল বিদ্যা শিখলেন। তারপর গদা, তরবারি, বর্শা, লাঠি, ছোড়া ইত্যাদি অস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করলেন। এরপর মহর্ষি বশিষ্ঠ ধনুর্বিদ্যা দিলেন চার রাজকুমারকে। চার ভ্রাতাকে অনেক দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান দিলেন। এই অস্ত্র গুলি জগত ধ্বংস করবার শক্তি রাখে। রামচন্দ্রের তীব্র বেগে বাণ নিক্ষেপ, অব্যর্থ নিশানা দেখে দেবতাবৃন্দ আনন্দ প্রাপ্তি করেন। কারন এবার রাবণ অনায়েসে মরবে। 


একদিন মারীচ রাক্ষস মায়া দ্বারা হরিণ সেজে খোঁজ করতে আসেন। হরিণ রূপী মারীচ বনে ঘুরছিলো। সেসময় রাম লক্ষণ ধনুক হাতে বনে ঘুরছিলেন। মৃগ দেখে রামচন্দ্র বাণ নিক্ষেপ করেন। প্রিয় সনাতনী সুধী, বাল্মীকি রামায়ণের এই বিষয়টি নিয়ে কুলাঙ্গার কৃত্তিবাসী তাঁর রামায়ণে সুন্দর একটি ছন্দ কথা লেখেছেন সেটি এখানে তুলে ধরছি:-


মৃগ দেখি রামের কৌতুক হৈল মন।

ধনুকে অব্যর্থ বাণ যুড়িল তখন।।

ছুটিল রামের বাণ তারা যেন খসে।

মহাভীত মারীচ পলায় মহাত্রাসে।।

শ্রীরামের বাণশব্দে ছাড়িল সে বন।

জনকের দেশে গেল মিথিলা ভুবন।।


অর্থ:- রামচন্দ্রের বাণে ভীত হয়ে মারীচ রাক্ষস অযোধ্যার সীমা ছেড়ে সোজা মিথিলায় পলায়ন করলো।


👉আদিকাণ্ড উনবিংশ সর্গ👇

                                         বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে এভাবে বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করছিলেন শ্রীরাম। মুনি নানা অস্ত্র বিদ্যার জ্ঞান দিলেন শ্রীরামচন্দ্রকে। দেবতারা অতীব প্রীত হলেন রামচন্দ্রের বিদ্যাশিক্ষা দেখে। গুরুগৃহে থাকাকালীন শিক্ষা লাভের পাশাপাশি আশ্রমের কাজ কর্ম করতে হত। সেখানে রাজকুমার আর সাধারণ শিক্ষার্থীকে এক ভাবেই রাখা হত। রাজার তনয় বলে বিশেষ কোন ছাড় বা সুবিধা দেওয়া হত না। এই আশ্রম গুলিকে “গুরুকুল” বলে। 


এখানে গার্হস্থ আশ্রম, সংসার ধর্ম পালনের শিক্ষা দেওয়া হত। বর্তমানে স্কুল কলেজগুলিতে এর কানাকড়িও দেওয়া হয় না। তাই সমাজ অমানুষে ছেয়ে গেছে। তেমনি মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে থাকাকালীন রাম, ভরত, লক্ষণ, শত্রুঘ্ন চার ভ্রাতাই অনান্য শিক্ষার্থীর মত আশ্রমের নিয়মাবলী পালন করতেন। ব্রাহ্ম মুহূর্তে উত্থান, যোগাসন প্রানায়াম, পূজা, বনে গিয়ে কাষ্ঠ পুস্প ফলমূলাদি সংগ্রহ, নদী থেকে জল ভরে আনা, গো পালন, গোসেবার জন্য তৃন সংগ্রহ, আশ্রম পরিষ্কার ইত্যাদি এমন কর্ম করতে হত। 


একদিন রাম লক্ষণ বনে গেছেন। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা সমগ্র বনে ছেয়ে গিয়েছিল। হরিণ শিশুর ইতিউতি ভ্রমণ, বিবিধ পক্ষীর মধুর কলরব, সুগন্ধি পুস্পের ঘ্রান, তরুলতা গুলি সূর্যের আলো মেখে সুন্দর প্রাকৃতিক শোভা বর্ধন করেছিল। রাম লক্ষণ এই মধুর দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে গেলেন। দানার লোভে পক্ষী গুলি শ্রীরামচন্দ্রের আশেপাশে এসে বিচরণ করতে লাগলেন। নবদূর্বাদল কান্তিময় রামচন্দ্রের মধুর মনোহর রূপ দেখে ময়ূর গুলি কেকা রবে ডাকতে লাগলো, বৃক্ষ গুলি যেনো পুস্পের ডালি দিয়ে ভগবানের চলার পথ কোমল করে দিয়েছিলো। 


রাম ও লক্ষণ এইগুলি দেখে অতীব প্রীত হলেন। কিন্তু উভয়ের ক্ষুধা তৃষ্ণা পেলো। দেবলোকে ইন্দ্রাদি দেবগণ ব্রহ্মা সহিত ভগবানের বাল্যলীলা দেখে আনন্দ প্রাপ্তি করতে লাগলেন। উভয়ে যখন ক্লান্ত তখন রামচন্দ্র একটি আমলকী বৃক্ষ দেখতে পেলেন। ভগবান সেই বৃক্ষে আরোহণ করে আমলকী ফল পেরে এনে ভ্রাতা লক্ষণকে দিয়ে কিছু নিজে সেবা নিলেন।


সম্মুখে তাঁরা এক দীঘি দেখতে পেলেন। টলটলে দীঘির জলে পদ্ম ফুটে আছে। ব্রহ্মার আদেশে ইন্দ্রদেবতা পদ্মের মৃণালে ‘সুধা’ সৃষ্টি করলেন। রাম লক্ষণ সেই জলে নেমে পদ্ম পুস্প আরোহণ করে মৃণালের সেই সুধা গ্রহণ করলেন। অতঃ দীঘির শীতল মিষ্টি জল পান করে বনে ফিরলেন। বৃক্ষের ছায়ায় কোমোল পাতার ওপর শয্যা রচনা করে উভয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। পক্ষী গুলি মধুর কলরব করে যেনো তাহাদিগকে ঘুমপাড়ানি সঙ্গীত শ্রবন করাতে লাগলেন। ভ্রমরেরা গুনগুন করে সেই সঙ্গীতে সুরতাল দিল। 


এই অতীব সুন্দর লীলা দেখে স্বর্গের সুরেরা মর্তলোকে নেমে আসলেন। ইন্দ্রদেবতা দেখলেন গাছপালার মধ্যে মধ্যে সূর্য কিরণ এসে প্রভুর চোখে মুখে পড়ছে এবং তিনি তাতে বিরক্ত হচ্ছিল্লেন ঘুমের মধ্যে। এই দেখে ইন্দ্রদেবতা মেঘ দিয়ে আকাশে আচ্ছাদন করলেন। সমস্ত জায়গাতে সূর্যের কিরণ পৌছালেও প্রভুর উপরে কেবল মেঘের আচ্ছাদন থাকলো।


অগ্নি দেবতা তাপ হরণ করে সেই স্থানকে শীতল মনোরম করলেন, পবন দেবতা মৃদু মৃদু বায়ু উৎপন্ন করে প্রভুকে বাতাস দিতে লাগলেন। বিবিধ কোমল, সুগন্ধি পুস্প কত জন্মের পুণ্যফলে তাঁরা এখানে পুস্প হয়ে ফুটেছিলো, তাঁরা শ্রীপ্রভুর অঙ্গে পতিত হতে লাগলো। বরুণ দেব সেই পুস্প গুলিতে শিশির বিন্দু সৃষ্টি করলেন যাতে গরমে প্রভুর নিদ্রার ব্যাঘাত না ঘটে। 


শিশিরসিক্ত পুস্প গুলি শ্রীরামের অঙ্গে পতিত হয়ে প্রভুকে গরমে শীতলতা প্রদান করছিল। এইভাবে দেবতাকূল ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে সেবা করে নিজেদের ধন্য করলেন। অতঃ সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হতে উভয়ে আশ্রমে ফিরে গেলেন। গিয়ে দেখলেন তাঁহাদের বিদ্যা সমাপনে রাজবাড়ী থেকে দশরথ, রাজা কৈকয়ী এসেছেন। রাণী কৈকয়ী তাহাদের না দেখে অতীব চিন্তায় ছিলেন। পুত্র রামচন্দ্রকে ক্রোড়ে নিয়ে বাৎসল্য প্রদান করতে লাগলেন।


👉আদিকাণ্ড ত্রিংশ সর্গ👇

                                    বিদ্যা শিক্ষা সমাপন করে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে এলেন। রানীরা সাদর সমারোহে চার রাজকুমারকে বরণ করে নিলেন। শ্রীরামচন্দ্রের ধনুর্বিদ্যা দেখে সকলের তাক লেগে গেল। চোখের নিমিষে রামচন্দ্রের ধনুক থেকে বাণ ছুটে নিশানায় বিদ্ধ করে। রাজা দশরথ নিশ্চিন্ত হলেন। ভাবলেন অযোধ্যার যোগ্য উত্তরসূরি এসে গেছে। এবার আর চিন্তার কারণ নেই। ওদিকে তপোবনের কথা। 


তপবনে বিশ্বামিত্রর আশ্রমে রাক্ষসেরা রোজ হামলা চালাতো। তাড়কার ভয়ে অরন্য একেবারে জীবশূন্য হয়েছিলো। গাছগুলিও যেনো জড়বৎ হয়ে গিয়েছিলো। গাছে ফুল, ফল আসতো না। অরন্যের শোভা নষ্ট হয়ে জায়গায় জায়গায় কেবল অস্থি, খুলি ইত্যাদি দেখা যেতো। ভুলবশত এই বনে কেউ প্রবেশ করলে সে আর জীবিত ফিরতো না। সোজা রাক্ষসদের আহারের তালিকায় স্থান পেতো। সেই হাড় হিম অরণ্য ছিলো প্রাকৃতিক শোভা বর্জিত। কেবল রাক্ষসদের অট্টহাস্য শোনা যেতো। 


শিষ্যেরা বললেন- “হে গুরুদেব! এই রাক্ষসের অত্যাচার কোনোকালেই কি স্তব্ধ হবে না? আমরা কি চিরকাল যাগ যজ্ঞ করে দেবতাবৃন্দকে আহুতি প্রদানে ব্যর্থ হব? দেবর্ষি নারদ বলেছিলেন এই রাক্ষসদের বিনাশ করতে ভগবান হরি আসবেন!” বিশ্বামিত্র বললেন- “বোধ হয় এই রাক্ষসদের অন্তিম কাল উপস্থিত। ভগবান, দশরথ রাজার গৃহে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁহার শিক্ষা সমাপ্তি হয়েছে। আমি তাহাদিগকে আনিতে অযোধ্যায় যাবো।”


মহর্ষি বিশ্বামিত্র মুনি অযোধ্যায় আসলেন। রাজা দশরথ এই সংবাদে ভীত হয়েছিলেন। তিনি জানতেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র পূর্বে তাঁর পূর্বপুরুষ হরিশ্চন্দ্র রাজার কাছে দানে সমগ্র রাজ্য নিয়েছিলেন। আবার কি তিনি এমন করবেন? রাজা মুনিকে স্বাগত জানালেন। করজোড়ে রানী সহিত মুনিকে আপ্যায়ন করলেন। আসনে বসিয়ে মুনির পদযুগল সুগন্ধি বারি দ্বারা ধৌত করতো, স্বর্ণ উত্তরীয় দ্বারা মুনির পদযুগল মুছিয়ে দিলেন।


অতঃ চামর, পাখা ব্যাঞ্জনাদি করে চন্দন অগুরু কর্পূর পুস্প দ্বারা, বিবিধ নৈবদ্য দ্বারা মুনির পূজা করে বলিলেন- “হে মহর্ষি আদেশ করুন, আমি আপনার কিরূপে সেবা করিতে পারি?” বিশ্বামিত্র রাক্ষসদের অত্যাচার কাহানী বলে বললেন- “হে রাজা দশরথ! রাক্ষস বাহিনীর বধ প্রয়োজন। অন্যথায় তারা তপোবন ধ্বংস করে দেবে। আপনি রাম লক্ষণ কে প্রদান করুন। তাহারা রাক্ষস বধ করবেন।” শুনে দশরথ রাজা, রাণীদের প্রান শুকিয়ে গেল। দশরথ রাজার বুকে মহাভয় উপস্থিত হল। তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন।


মহর্ষির চরণ ধরে বললেন- “ মহর্ষি! আপনি অন্য কিছু প্রার্থনা করুন। কিন্তু রাম লক্ষণকে কিভাবে দেবো? তাহারা সদ্য কৈশোরে এসেছে। তাহারা কিভাবে সেই ভয়ানক মায়াবী রাক্ষসদের বধ করবে? আপনি চাইলে সমগ্র অযোধ্যা নগরী আপনার চরণে সমর্পণ করব, সমগ্র অযোধ্যার সেনা আপনার সহিত প্রেরন করবো, তাহারা গিয়ে সেই রাক্ষসের বধ করবে। আমি নিজে তাহাদিগকে বধ করবো- আপনি আদেশ করুন। কিন্তু প্রভু, রাম লক্ষণ এখনো বালক, তারা ঐ রাক্ষসদের বধ করা তো দূর, তাহাদের দেখেই হয়তো প্রাণত্যাগ করবে।


বিশ্বামিত্র বললেন- “রাজন। সেই রাক্ষস গণ আপনি বা অন্য কেউ কিংবা আমার হাতে বধ্য নয়। এমন হলে আমি নিজেই তাদের বধ করতাম। পূর্বে আমি ক্ষত্রিয় গাঁধিপুত্র ছিলাম। বহু অস্ত্রের জ্ঞাতা আমি। আপনার বা মিথিলা নরেশ জনকের সাহায্য চাইতে পারতাম। কিন্তু ওরা কেবল রাম- লক্ষণের হাতে বধ্য হবে।


রাজা তো নারাজ। কিন্তু শেষে রাম লক্ষণ এগিয়ে এলেন। পিতাকে সান্তনা দিলেন। বললেন- “পিতা। আপনার আশীর্বাদে আমরা সেই রাক্ষস বধ করতে পারবো। গুরুদেব বশিষ্ঠ মুনি আমাদের যে যুদ্ধবিদ্যা, অস্ত্রদান করেছেন- এখন সেইগুলির প্রয়োগের সময় এসেছে। তবেই তো জানবো যে আমাদের বিদ্যা শিক্ষা সফল হয়েছে। আপনি অমত করবেন না। সেই রাক্ষস কূল বিনষ্ট করে আমি আপনার নাম উজ্জ্বল করবো।


প্রজা পালন ও দুষ্টের বিনাশ করা ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য। আপনি অনুমতি প্রদান করুন।” রাজা ভয়ে দিশেহারা। মনে মনে অন্ধ মুনির প্রদত্ত শাপ মনে পড়লো। হয়তো রাম লক্ষণ আর বেঁচে ফিরবে না। রাক্ষসেরা তাদের বধ করে খাবে। আর সেই শোকে তাঁর মৃত্যু ঘটবে। অনেক মানা আপত্তি করতে লাগলেন রাজা দশরথ।


মুনি বিশ্বামিত্র ক্রোধে বললেন- “দশরথ। তুমি আমার শক্তি সম্বন্ধে অবগত আছো। পূর্বে তোমার পূর্বপুরুষ রাজা হরিশ্চন্দ্রকে যেরূপ সর্বস্বান্ত করেছিলাম, সেইরূপ শাপ দিয়ে তোমার নগরী ভস্ম করবো। অবশ্য রাক্ষসেরা বধ না হলে তারা এরপর তোমার রাজ্যে হানা দিয়ে তোমার রাজ্য ছারখার করবে। যদি তুমি এমন না চাও তাহলে রাম লক্ষণ কে প্রদান কর।” রাজা দশরথ আর কি করেন? দিয়ে দিলেন শ্রীরাম ও লক্ষণ কে। রাজা শোকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়লেন। বিশ্বামিত্র মুনি তখন রাম লক্ষণ কে নিয়ে চললেন।


👉আদিকাণ্ড একত্রিংশ সর্গ👇

                                         বিশ্বামিত্র মুনি রাম লক্ষণ কে সাথে নিয়ে গেলেন বনে। তাড়কা সম্বন্ধে বলে মুনি বললেন- “রাম! তাড়কার দেহে ব্রহ্মার বরে সহস্র হস্তীর শক্তি আছে।” রামচন্দ্র জানালেন- “ হে ব্রহ্মর্ষি! তাঁড়কা নারী। নারীর ওপর অস্ত্র নিক্ষেপ কি প্রকারে করি?” মহর্ষি বললেন- “নারী হোক বা পুরুষ, পাপ কর্মের ফল সকলকেই ভুগতে হয়। তাড়কা তার কৃতকর্মের ফল পাবেই।=(বাকিঅংশ চলমান চতুর্থ পর্বে)


       । ⬛

                                        🔻

                                     


ॐ সর্বেসাং মঙ্গলং ভবতুঃ সর্বে সন্তু্ নিরাময়াহা।

সর্বে ভদ্রানি নিপশসন্তু্  মা কশ্চিত দুঃখ ভাগভবেৎ।।


                                ॐ জয় মা ॐ

         ॐ জয়গুরু অদ্বৈতানন্দ ॐ জয়গুরু পূর্ণানন্দ

Post a Comment

0 Comments