卐 মহাভারত 卐  (ধারাবাহিক- প্রথম পর্ব)


                          🌲আদিপর্ব 🌲


      👉||অনুক্রমণিকা ও পর্ব অধ্যায় সংগ্রহ||👈


🔴শৌনকের আশ্রমে সৌতি🔴


🙏নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম।

দেবীং সরস্বতীঞ্চৈব ততো জয়মুদীরয়েৎ।।🙏


🙏অর্থ:- নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করে তারপর জয় উচ্চারণ করবে।🙏


                           🔴মূলপর্ব🔴


কুলপতি মহর্ষি শৈনক নিমিষারণ্য দ্বাদশ বার্ষিক যজ্ঞ করছিলেন। একদিন লোমহর্ষণের পুত্র পুরাণকথক সৌতি সেখানে বিনীত ভাবে উপস্থিত হলেন। আশ্রমের মুনিরা তাঁকে প্রশ্ন করলেন, সৌতি; তুমি এখন কোথা থেকে আসছ? এতকাল কোথায় ছিলে? সৌতি উত্তর দিলেন, আমি রাজর্ষি জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে ছিলাম;  সেখানে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন রচিত বিচিত্র মহাভারত কথা বৈশম্পায়নের মুখে শুনেছি। তারপর বহু তীর্থে ভ্রমণ করে সমন্তপঞ্চক দেশে যাই, যেখানে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ হয়েছিল। এখন আপনাদের দর্শন করতে এখানে এসেছি। দ্বিজগণ আপনারা যজ্ঞে আহুতি দিয়ে শুচি হয়ে সুখে উপবিষ্ট রয়েছেন, আমার কাছে কি শুনতে ইচ্ছা করেন আদেশ করুন-পবিত্র পুরাণ কথা, না মহাত্মা নরপতি ও ঋষিগণের ইতিহাস। ঋষিরা বললেন, রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে বৈশম্পায়ন যে ব্যাসরচিত মহাভারত কথা বলেছিলেন আমরা তাই শুনতে ইচ্ছা করি।


                           সৌতি বললেন, চরাচর গুরু হৃষীকেশ হরিকে নমস্কার করে আমি ব্যাসপ্রোক্ত মহাভারত কথা আরম্ভ করছি। কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন; আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরাও বলবেন। ব্যাসদেব এই মহাভারত সংক্ষেপে বলেছেন আবার সবিস্তারেও বলেছেন। কোনও কোনও ব্রাহ্মণ এই গ্রন্থ আদি থেকে, কেউ আস্তিকের উপাখ্যান থেকে, কেউবা উপরিচরের উপাখ্যান থেকে পাঠ করেন।

                           

                           মহাভারত রচনার পর ব্যাসদেব ভেবেছিলেন, কোন্ উপায়ে এই ইতিহাস শিষ্যদের অধ্যায়ন করাব? তখন ভগবান ব্রহ্মা তাঁর কাছে আবির্ভূত হয়ে বললেন, তুমি সিদ্বিবিনায়ক গণেশকে স্মরণ কর তিনি তোমার গ্রন্থের লিপিকার হবেন। ব্যাসদেব গণেশকে অনুরোধ জ্ঞাপন করলে গণেশ বললেন আমি সম্মত আছি, কিন্তু আমার লেখনী ক্ষণমাত্র থামতে পারবে না। ব্যাসদেব ভাবলেন, আমার রচনায় আট হাজার আট'শ এমন কুটশ্লোক আছে যাঁর অর্থ আমি আর আমার পুত্র বুঝতে পারি, সঞ্জয় পারেন কিনা সন্দেহ। ব্যাসদেব গণেশকে বললেন, আমি যা বলে যাব আপনি তাঁর অর্থ না বুঝে লিখতে পারবেন না। গণেশ বললেন, তাই হবে। গণেশ সর্বজ্ঞ হলেও কুটশ্লোক লেখবার সময় তাঁকে ভাবতে হ'ত, সেই অবসরে ব্যাস অন্য বহু শ্লোক রচনা করতেন। 

                           

                রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর ব্যাসদেব তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত কথা শোনাবার আজ্ঞা দিয়েছিলেন। ভগবান ব্যাস এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়নতা এবং ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। উপাখ্যান সহিত এই মহাভারতে লক্ষ শ্লোক আছে। উপাখ্যান ভাগ বর্জন করে ব্যাস চব্বিশ হাজার শ্লোকে এক সংহিতা রচনা করেছেন। পণ্ডিতগণের মতে তা'ই প্রকৃত মহাভারত। তাছাড়া ব্যাস দেড়'শ শ্লোকে সমস্ত পর্বের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত অনুক্রমণিকা-অধ্যায়ে দিয়েছেন। ব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তারপর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আরেকটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তাঁর ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনেরো লক্ষ শ্লোক পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ শ্লোক গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ শ্লোক মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। ব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষের লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন, আমি তাই বলব। পূর্বকালে দেবতারা তুলাদণ্ডে ওজন করে দেখেছিলেন যে, উপনিষদ সহ চার বেদের তুলনায় একখানি এই গ্রন্থ মহত্ত্বে ও ভারবত্তায় অধিক; সেজন্যই দেবতারা এর নাকরন করে মহাভারত।

                

                অনন্তর সৌতি অতি সংক্ষেপে মহাভারতের মূল আখ্যান এবং পর্ব সংগ্রহ (অর্থাৎ প্রত্যেক পর্বের বিষয় সমূহ) বর্ণনা করলেন।

                

                

                     👉||পৌষ্য পর্বাধ্যায়||👈


🔴জনমেজয়ের শাপ- আরুণি, উপমন্যু ও বেদ🔴


সৌতি বললেন- পরীক্ষিৎ পুত্র জনমেজয় তাঁর তিন ভ্রাতার সংঙ্গে কুরুক্ষেত্রে এক যজ্ঞ করেছিলেন এমন সময় সেখানে একটি কুকুর এল। জনমেজয়ের ভ্রাতারা কুকুরটির উপর প্রহার করলেন, সে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর মাতার কাছে গেল। কুকুরী ক্ষুব্ধ হয়ে তৎক্ষণাত যজ্ঞস্থলে এসে বললে, আমার পুত্রকে বিনা দোষে মারলে কেন? জনমেজয় প্রভৃতি কোনও উত্তর দিলেন না। কুকুরী বললেন, এ কোনও অপরাধ করেনি তথাপি প্রহত হয়েছে; তোমার উপরেও অতর্কিত বিপদ এসে পড়বে।


                                          দেবশুনী সরমার এই অভিশাপ শুনে জনমেজয় অত্যন্ত চিন্তাকুল হলেন। যজ্ঞ শেষ হলে তিনি হস্তিনাপুরে ফিরে এসে পাপ মোচনের জন্য উপযুক্ত পুরোহিতের সন্ধান করতে লাগলেন। একদিন তিনি মৃগয়া করতে গিয়ে শ্রুতশ্রবা ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হলেন এবং নমস্কার করে বললেন, ভগবান, আপনার পুত্র সোমশ্রবাকে দিন; তিনি আমার পুরোহিত হবেন। শ্রুতশ্রবা বললেন, আমার এই পুত্র সর্পীর গর্ভজাত, এ মহাতপস্বী ও বেদজ্ঞ, মহাদেবের শাপ ভিন্ন অন্য সমস্ত শাপ নিবারণ করতে পারে। কিন্তু এর একটি গুঢ় ব্রত আছে, কোনও ব্রাহ্মণ কিছু প্রার্থনা করলে এ তা অবশ্যই পূরণ করবে। যদি তুমি তাতে সম্মত হও তবে এঁকে নিয়ে যাও। জনমেজয় ঋষি পুত্রকে নিয়ে গিয়ে ভ্রাতাদের বললেন, আমি এঁকে উপাধ্যায় রুপে বরণ করেছি, ইনি যা বলবেন তোমরা তা নির্বিচারে পালন করবে। এই আদেশ দিয়ে জনমেজয় তক্ষশিলা প্রদেশ জয় করতে গেলেন।

                                          

                          এই সময় অয়োধ ধৌম্য নামে এক ঋষি ছিলেন, তাঁর তিন শিষ্য উপমন্যু, আরুণি ও বেদ। তিনি তাঁর পাঞ্চালদেশীয় শিষ্য আরুণিকে আজ্ঞা দিলেন, যাও, তুমি আমার ক্ষেত্রের আল বাঁধ। আরুণি গুরুর আজ্ঞা পালন করতে গেলেন, কিন্তু আল বাঁধতে না পেরে অবশেষে শুয়ে পড়ে জলরোধ করলেন। আরুণি ফিরে এলেন না দেখে ধৌম্য তা'র দুই শিষ্যের সঙ্গে ক্ষেত্রে গিয়ে ডাকলেন, বৎস আরুণি, কোথায় আছ, এস। আরুণি উঠে এসে বললেন, আমি জলপ্রবাহ রোধ করতে না পেরে সেখানে শুয়ে ছিলাম, এখন আপনি ডাকতে উঠে এসেছি; আজ্ঞা করুন কি করতে হবে। ধৌম্য বললেন, তুমি কেদারখণ্ড(ক্ষেত্রের আল) বিদারণ করে উঠেছ সেজন্য তোমার নাম উদালক হবে। আমার আজ্ঞা পালন করেছ সেজন্য তুমি শ্রেয়োলাভ করবে এবং সমস্ত বেদ ও ধর্ম শাস্ত্র তোমার অন্তরে প্রকাশিত থাকবে।

                          

                          অয়োধ ধৌম্য আর এক শিষ্য উপমন্যুকে আদেশ দিলেন, বৎস, তুমি আমার গো রক্ষা কর। উপমন্যু প্রত্যহ গরু চড়িয়ে সন্ধ্যায় ফিরে এসে গরুকে প্রণাম করতে লাগলেন। একদিন গুরু জিজ্ঞাসা করলেন, বৎস, তুমি কি খাও? তোমাকে বেশ স্থুল দেখছি। উপমন্যু বললেন, আমি ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করি। গুরু বললেন, আমাকে নিবেদন না করে ভিক্ষান্ন ভোজন উচিত নয়। তারপর থেকে উপমন্যু ভিক্ষাদ্রব্য এনে গুরুকে দিতেন। তথাপি তাঁকে পুষ্ট দেখে গুরু বললেন, তুমি যা ভিক্ষা পাও সবেই তো আমি নিয়ে নিই; তুমি এখন কি খাও? উপমন্যু বললেন, প্রথমবার ভিক্ষা করে আপনাকে দিয়ে দিই, তারপর আবার ভিক্ষা করি, তাতেই আমার জীবিকা নির্বাহ হয়। এ তোমার অন্যায়, তাতে অন্য ভিক্ষাজীবিদের হানি হয়, তুমিও লোভী হয়ে পড়েছ। তারপর উপমন্যু একবার মাত্র ভিক্ষা করে গুরুকে দিতে লাগলেন। গুরু তাঁকে আবার প্রশ্ন করলেন, বৎস, তোমাকে তো অতিশয় স্থুল দেখছি; এখন কি খাও? আমি এখন গরুর দুধ খাই। গুরু বললেন, আমার অনুমতি বিনা গরুর দুধ খাওয়া তোমার অন্যায়। উপমন্যু তারপরেও স্থুলকায় রয়েছেন দেখে গুরু বললেন, বৎস, তুমি এখন কি খাও? উপমন্যু বললেন, স্তন্যপানের পর বাছুররা যে উদ্গার করে তা খাই। গুরু বললেন, এই বাছুররা দয়া করে তোমার জন্য প্রচুর ফেন উদ্গার করে, তাতে এদের পুষ্টির ব্যাঘাত হয়; ফেন খাওয়া তোমার উচিত নয়। গুরুর সকল নিষেধ মেনে নিয়ে উপমন্যু গরু চড়াতে লাগলেন। একদিন তিনি ক্ষুধার্ত হয়ে অর্কপত্র(আকন্দ পাতা) খেলেন। সেই ক্ষার তিক্ত কটুরুক্ষ তীক্ষ্ম বস্তু খেয়ে তিনি অন্ধ হলেন এবং চলতে চলতে কূপের মধ্যে পড়ে গেলেন। সূর্যাস্তের পর উপমন্যু ফিরে এলেন না দেখে অয়োধ ধৌম্য বললেন, আমি তাঁর সকল প্রকার ভোজনই নিষেধ করেছি, সে নিশ্চয়ই রাগ করেছে, তাঁকে খোঁজা উচিত। এই ব'লে তিনি শিষ্যদের সঙ্গে অরণ্য গিয়ে ডাকলেন, বৎস উপমন্যু, কোথায় আছ এস। উপমন্যু কূপের ভিতর থেকে উত্তর দিলেন, আমি অর্কপত্র ভক্ষণের ফলে অন্ধ হয়ে এখানে পড়ে গেছি। ধৌম্য বললেন, তুমি দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের স্তব কর, তাঁরা তোমাকে চক্ষুষ্মান করবে। উপমন্যু স্তব করলেন। অশ্বিনীদ্বয় তাঁর নিকট আবির্ভূত হয়ে বললেন, আমরা প্রীত হয়েছি তুমি পূপ(পিষ্টক) ভক্ষণ কর। উপমন্যু বললেন, গুরুকে নিবেদন না করে আমি খেতে পারি না। অশ্বিনীদ্বয় বললেন, তোমার উপাধ্যায়ও পূর্বে আমাদের স্তব করে এই পূপ পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা গুরুকে নিবেদন না করেই খেয়েছিলেন। উপমন্যু বললেন, আমি আপনার নিকট অনুনয় করছি, গুরুকে নিবেদন না করে আমি খেতে পারবো না। অশ্বিনীদ্বয় বললেন, তোমার গুরু ভক্তিতে আমরা প্রীত হয়েছি; তোমার উপাধ্যায়ের দন্ত কৃষ্ণ লৌহময় হবে, তোমার দন্ত হিরণ্ময় হবে, তুমি চক্ষুষ্মান হবে এবং শ্রেয়োলাভ করবে। উপমন্যু চক্ষুলাভ করে গুরুর কাছে এলেন এবং অভি-বাদন করে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। গুরু প্রীত হয়ে বললেন, অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের বরে তোমার মঙ্গল হবে, সকল বেদ ও ধর্ম শাস্ত্র তুমি আয়ত্ত করবে। এইরূপ উপমন্যুর পরীক্ষা শেষ হল।

                          

                          অয়োধ ধৌম্য তাঁর তৃতীয় শিষ্য বেদকে আদেশ দিলেন, তুমি আমার গৃহে কিছুকাল বাস করে আমার সেবা কর; তোমার মঙ্গল হবে। বেদ দীর্ঘকাল গুরুগৃহে থেকে তাঁর আজ্ঞায় বলদের মতো ভারবহন এবং শীত, গ্রীষ্ম, ক্ষুধা, তৃষ্ণাদি কষ্ট সইতে লাগলেন। অবশেষে তিনি গুরুকে পরিতুষ্ট করে শ্রেয় ও সর্বজ্ঞতা লাভ করলেন। এইরূপ তাঁর পরীক্ষা শেষ হল।


                 🔴উতঙ্ক, পৌষ্য ও তক্ষক🔴


উপাধ্যায়ের আজ্ঞা নিয়ে বেদ গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করলেন, তাঁরও তিনটি শিষ্য হ'ল। তিনি শিষ্যদের বলতেন না যে এই কর্ম কর, বা আমার শুশ্রূষা কর। গুরু গৃহবাসের দুঃখ তিনি জানতেন সেজন্য শিষ্যদের তিনি কষ্ট দিতে চাইতেন না। কিছুকাল পরে জনমেজয় এবং পৌষ্য নামে আর এক রাজা বেদকে উপাধ্যায়ের পদে বরণ করলেন। একদা বেদ যাজন কার্যের জন্য বিদেশে যাবার সময় উতঙ্ক নামক শিষ্যকে বলে গেলেন, আমার প্রবাসকালে গৃহে যে বিষয়ের অভাব হবে তুমি তা পূরণ করবে। উতঙ্ক গুরুগৃহে থেকে সকল কর্তব্য পালন করতে লাগলেন। একদিন আশ্রমের নারীরা তাঁকে বললে, তোমার উপাধ্যায়ানী ঋতুমতী হয়েছেন কিন্তু উপাধ্যায় এখানে নেই; ঋতু যাতে নিষ্ফল না হয় তুমি তা কর। উতঙ্ক উত্তর দিলেন, আমি স্ত্রীলোকের কথায় এমন অকার্য করতে পারি না, উপাধ্যায় আমাকে অকার্য করবার আদেশ দেননি। কিছুকাল পরে বেদ ফিরে এলেন এবং সকল বৃত্তান্ত শুনে প্রীত হয়ে বললেন, বৎস উতঙ্ক, আমি তোমার কি প্রিয় সাধন করব বলো।


(বিঃদ্রঃ- অশ্বমেধিক পর্বের ৬নং- পরিচ্ছেদে উতঙ্কের উপাখ্যান কিছু অন্য প্রকার)


তুমি ধর্মানুসারে আমার সেবা করেছ, আমাদের পরস্পরের প্রীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। তোমার সকল কামনা পূর্ণ হবে। এখন তুমি স্বগৃহে যেতে পার।


             উতঙ্ক বললেন, আমিই বা আপনার কি প্রিয় সাধন করব বলুন, আমি আপনার অভীষ্ট দক্ষিণা দিতে ইচ্ছা করি। বেদ বললেন, বৎস এখন থাকুক না। কিছুকাল পরে উতঙ্ক পূর্বাবার গুরুকে দক্ষিণার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বেদ বললেন, তুমি বহুবার আমাকে দক্ষিণার কথা বলেছ; গৃহমধ্যে গিয়ে উপাধ্যায়ানীকে জিজ্ঞাসা কর কি দিতে হবে। তখন উতঙ্ক গুরুপত্নীর কাছে গিয়ে বললেন, ভগবতী, উপাধ্যায় আমাকে গৃহ গমনের অনুমতি দিয়েছেন, আমি গুরু দক্ষিণা দিয়ে ঋণমুক্ত হতে চায়, আপনি বলুন কি দক্ষিণা দেব। উপাধ্যায়পত্নী বললেন, তুমি রাজা পৌষ্যের কাছে যাও, তাঁর ক্ষত্রিয়া পত্নী যে দুই কুণ্ডল পড়েন তাই চেয়ে আন। চারদিন পরে পুণ্যক ব্রত হবে, তাতে আমি ঐ কুণ্ডলে শোভিত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিবেশন করতে ইচ্ছা করি। তুমি আমার এই অভীষ্ট পূর্ণ কর, তাতে তোমার মঙ্গল হবে, কিন্তু যদি না কর তবে অনিষ্ট হবে।

             

             উতঙ্ক কুণ্ডল আনবার জন্য যাত্রা করলেন। পথে যেতে যেতে তিনি প্রকাণ্ড বৃষে আরুঢ় এক মহাকায় পুরুষকে দেখতে পেলেন। সেই পুরুষ বললেন, উতঙ্ক, তুমি এই বৃষের পুরীষ ভক্ষণ কর। উতঙ্ককে অনিচ্ছুক দেখে তিনি আবার বললেন, উতঙ্ক, খাও, বিচার করো না, তোমার উপাধ্যায়ও পূর্বে খেয়েছেন। তখন উতঙ্ক বৃষের পুরীষ খেলেন এবং দাঁড়িয়ে উঠে সত্বর আচমণ করে পৌষ্যের নিকট যাত্রা করলেন। পৌষ্য তাঁকে বললেন, ভগবান, কি আজ্ঞা বলুন? উতঙ্ক কুণ্ডল প্রার্থনা করলে রাজা বললেন, আপনি অন্তঃপুরে গিয়ে মহিষীর কাছে চেয়ে নিন। উতঙ্ক মহিষীকে দেখতে না পেয়ে ফিরে এসে পৌষ্যকে বললেন, আমাকে মিথ্যা বলা উচিত হয়নি, অন্তঃপুরে মহিষী নেই। পৌষ্য ক্ষণকাল চিন্তা করে বললেন, নিশ্চয়ই আপনি উচ্ছিষ্ট(এ'টো মুখে) আছেন, অশুচী ব্যক্তি আমার পতিব্রতা ভার্যাকে দেখতে পায় না। উতঙ্ক স্মরণ করে বললেন, আমি এখানে শীঘ্রই আসবার জন্য দাঁড়িয়ে আচমণ করেছিলাম সেজন্য এই দোষ হয়েছে। উতঙ্ক তখন পূর্বমুখী বসে হাত, পা ও মুখ ধুলেন এবং তিনবার নিঃশব্দে ফেনশূণ্য অনুষ্ণ হৃদ্য জল পান করে দু'বার মুখাদি ইন্দ্রিয় মুছলেন। তারপর তিনি অন্তঃপুরে গিয়ে মহিষীকে দেখতে পেলেন। উতঙ্কের প্রার্থনা শুনে মহিষী প্রীত হয়ে তাঁকে কুণ্ডল দিলেন এবং বললেন, নাগরাজ তক্ষক এই কুণ্ডল দু'টির প্রার্থী, অতএব সাবধানে নিয়ে যাবেন।

             

             উতঙ্ক সন্তুষ্ট হয়ে পৌষ্যের কাছে এলেন। পৌষ্য বললেন, ভগবান, সৎপাত্র সহজে পাওয়া যায় না, আপনি গুণবান অতিথি, আপনার সৎকার করতে ইচ্ছা করি। উতঙ্ক বললেন, গৃহে যে অন্ন আছে তাই শীঘ্র নিয়ে আসুন। অন্ন আনা হলে উতঙ্ক দেখলেন তা ঠাণ্ডা এবং তাতে চুল রয়েছে। তিনি বললেন, আমাকে অশুচী অন্ন দিয়েছেন অতএব আপনি অন্ধ হবেন। পৌষ্য বললেন, আপনি নির্দোষ অন্নের দোষ দিচ্ছেন এইজন্য আপনি নিঃসন্তান হবেন। উতঙ্ক বললেন, অশুচী অন্ন দিয়ে আবার অভিশাপ দেওয়া আপনার অনুচিত, দেখুন না অন্ন অশুচী কিনা। রাজা অন্ন খেয়ে অনুমান করলেন এই শীতল অন্ন কোনো মুক্তকেশী স্ত্রী এনেছে, তাঁরই কেশ এখানে পড়েছে। তিনি ক্ষমা চাইলে উতঙ্ক বললেন, আমার বাক্য মিথ্যা হয় না, আপনি অন্ধ হবেন, কিন্তু শীঘ্রই আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আমাকে যে শাপ দিয়েছেন তাও যেন না ফলে। রাজা বললেন, আমার ক্রোধ এখনও শান্ত হয়নি, ব্রাহ্মণের হৃদয় নানীততুল্য কিন্তু বাক্য তীক্ষ্মধার ক্ষুর থাকে, ক্ষত্রিয়ের এর বিপরীত। আমি শাপ প্রত্যাহার করতে পারি না, আপনি চলে যান। উতঙ্ক বললেন, আপনি অন্নের দোষ স্বীকার করেছেন অতএব আপনার শাপ ফলবে না। এই বলে তিনি কুণ্ডল নিয়ে চলে গেলেন।

             

             উতঙ্ক যেতে যেতে পথে এক নগ্ন ক্ষপনক দেখতে পেলেন, সে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হচ্ছে। তিনি কুণ্ডল দুটি ভূমিতে রেখে স্নানাদির জন্য জলাশয় গেলেন, সেই অবসরে ক্ষপনক কুণ্ডল নিয়ে পালিয়ে গেল। স্নান শেষ করে উতঙ্ক দৌড়ে গিয়ে ক্ষপনককে ধরে ফেললেন। সে তখনই তক্ষকের রুপ ধারণ করলে এবং সহসা আবির্ভূত এক গর্তে প্রবেশ করে নাগলোকে চলে গেল। উতঙ্ক সেই গর্ত দণ্ডকাষ্ঠ (ব্রহ্মচারীর যষ্টি) দিয়ে খুঁড়ে বড় করবার চেষ্টা করলেন। তাঁকে ক্লান্ত ও অকৃতকার্য দেখে ইন্দ্র তাঁর বজ্রকে বললেন, যাও, ঐ ব্রাহ্মণকে সাহায্য কর। বজ্র দণ্ডকাষ্ঠে অধিষ্ঠান করে গর্তটি বড় করে দিলেন। উতঙ্ক সেই গর্ত দিয়ে নাগলোকে গেলেন এবং নানাবিধ প্রাসাদ হর্ম্য ক্রীড়াস্থানাদি দেখতে পেলেন। কুণ্ডল ফিরে পাবার জন্য তিনি নাগগণের স্তব করতে লাগলেন। তারপর দেখলেন, দুই স্ত্রী তাঁতে কাপড় বুনছে, তাঁর কতক সুতো কাল কতক সুতো সাদা; ছয় কুমার দ্বাদশ অর (পাখি) যুক্ত একটি চক্র ঘোরাচ্ছে একজন সুদর্শন পুরুষ এবং একটি অশ্বও সেখানে রয়েছে। উতঙ্ক এই সকলেরও স্তব করলেন। সেই পুরুষ উতঙ্ককে বললেন, আমি তোমার স্তবে প্রীত হয়েছি; কি অভীষ্ট করবো ব'ল। উতঙ্ক বললেন, নারায়ণ আমার বশীভূত হ'ক। পুরুষ বললেন, তুমি এই অশ্বের গুহ্যদেশে ফুৎকার দাও। উতঙ্ক ফুৎকার দিলে অশ্বের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার থেকে সুধম অগ্নিশিখা নির্গত হয়ে সমস্ত নাগলোকে ব্যাপ্ত হ'ল। তখন ভীত হয়ে তক্ষক তাঁর বাসভবন থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, এই নিন আপনার কুণ্ডল। কুণ্ডল পেয়ে উতঙ্ক ভাবলেন, আজ উপাধ্যায়ানীর পূর্ণ্যক ব্রত, আমি বহু দূরে এসে পড়েছি, কি করে তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করব? সেই পুরুষ বললেন, তুমি এই অশ্বে আরুঢ় হয়ে যাও, ক্ষণমধ্যে তোমার উপাধ্যায়ের গৃহে পৌছাবে। 

             

             উপাধ্যায়ানী স্নান করে কেশসংস্কার করছিলেন এবং উতঙ্ক এলেন না দেখে তাঁকে শাপ দেবার উপক্রম করছিলেন, এমন সময় উতঙ্ক এসে প্রণাম করে কুণ্ডল দিলেন। তারপর তিনি উপাধ্যায়ের নিকট গিয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। উপাধ্যায় বললেন, তুমি যে দুই স্ত্রীকে বস্ত্র বয়ন করতে দেখেছ তাঁরা ধাতা ও বিধাতা কৃষ্ণ ও শ্বেতসূত্র রাত্রি ও দিন; ছয় কুমার ছয় ঋতু, চক্রাট সংবৎসর, তার দ্বাদশ অর দ্বাদশ মাস, যিনি পুরুষ তিনি স্বয়ং ইন্দ্র এবং অশ্ব অগ্নি। তুমি যাবার সময় পথে যে বৃষ দেখেছিলে সে ঐরাবত, তাঁর আরোহী ইন্দ্র। তুমি যে পুরীষ খেয়েছ তা অমৃত। নাগলোকে তোমার বিপদ হয়নি, কারণ ইন্দ্র আমার সখা তাঁর অনুগ্রহে তুমি কুণ্ডল আনতে পেরেছ। সৌম্য তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি স্বগৃহে যাও, তোমার মঙ্গল হবে।

             

             উতঙ্ক তক্ষকের উপর প্রতিশোধ নেবার সংকল্প করে হস্তিনাপুরে জনমেজয়ের কাছে গেলেন। জনমেজয় তখন তক্ষশিলা জয় করে ফিরে এসেছেন, মন্ত্রীরা তাকে ঘিরে আছেন। উতঙ্ক যথাবিধি আশীর্বাদ করে বললেন, মহারাজ, যে কার্য করা উচিত ছিল তা না করে আপনি বালকের ন্যায় অন্য কার্য করছেন। জনমেজয় তাঁকে সংবর্ধনা করে বললেন, আমি ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুসারে প্রজাপালন করে থাকি, আমাকে আপনি কি করতে বলেন? উতঙ্ক বললেন, আপনার পিতা মহাত্মা পরীক্ষিতের যে প্রাণহরণ করেছে সেই দূরাত্মা তক্ষকের উপর আপনি প্রতিশোধ নিন। সেই নৃপতির চিকিৎসার জন্য কাশ্যপ আসছিলেন, কিন্তু তক্ষক তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আপনি শীঘ্র সর্পসত্রের অনুষ্ঠান করুন এবং জ্বলিত অগ্নিতে সেই পাপীকে আহুতি দিন। তাতে আপনার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ হবে, আমিও প্রীত হ'ব, কারণ সেই দূরাত্মা আমার বিঘ্ন করেছিল।

             

                   উতঙ্কের কথা শুনে জনমেজয় তক্ষকের উপরে অতিশয় ক্ষুব্ধ হলেন এবং শোকার্ত মনে মন্ত্রীগণকে পরীক্ষিতের মৃত্যুর বিষয় জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।

                   

                   👉||পৌলোম-পর্বাধ্যায়||👈

                   

       🔴ভৃগু-পুলোমা-চ্যবন-অগ্নির শাপমোচন🔴


মহর্ষি শৌনক সৌতিকে বললেন, বৎস, আমি ভৃগুবংশের বিবরণ শুনতে ইচ্ছা করি, তুমি তা বল।


সৌতি বললেন - ব্রহ্মা যখন বরুণের যজ্ঞ করছিলেন তখন সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে মহর্ষি ভৃগুর জন্ম হয়েছিল। মহর্ষি ভৃগুর ভার্যার নাম পুলোমা। তিনি গর্ভবতী হলে একদিন ভৃগু স্নান করতে যান তখন এক রাক্ষস আশ্রমে এসে ভৃগুপত্নীকে দেখে মুগ্ধ হল। এই রাক্ষসেরও নাম পুলোমা। পূর্বে সে ভূগুপত্নী পুলোমাকে বিবাহ করতে চেয়েছিল কিন্তু কন্যার পিতা ভৃগুকেই কন্যাদান করেন। সেই দুঃখ সর্বদাই রাক্ষসের মনে ছিল। ভৃগুর হোমগৃহে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি দেখে রাক্ষস বললেন, অগ্নি, তুমি দেবগণের মুখে, সত্য বল এই পুলোমা কার ভার্যা। এই সুন্দরীকে আমি পূর্বে ভার্যারুপে বরণ করেছিলাম কিন্তু ভৃগু অন্যায়ভাবে এ'কে গ্রহণ করেছেন। এখন আমি এ'কে আশ্রম থেকে হরণ করতে চাই। তুমি সত্য কথা বল।


          অগ্নি ভীত হয়ে ধীরে ধীরে বললেন, দানবনন্দন তুমি পূর্বে এই পুলোমাকে বরণ করেছিলে কিন্তু যথাবিধি মন্ত্র পাঠ করে বিবাহ করনি। পুলোমার পিতা বরলাভের আশায় ভৃগুকেই কন্যাদান করেছিলেন। ভৃগু আমার সম্মুখে এ'কে বিবাহ করেছেন। যাঁকে তুমি পূর্বে বরণ করেছিলে ইনিই সেই পুলোমা। আমি মিথ্যা বলতে পারবোনা।


            তখন রাক্ষস বরাহের রুপ ধারণ করে পুলোমাকে হরণ করে মহাবেগে নিয়ে চলল। পুলোমার শিশু গর্ভচ্যুত হ'ল, সেজন্য তাঁর নাম চ্যবন। সূর্যতূল্য তজোময় সেই শিশুকে দেখে রাক্ষস ভষ্ম হয়ে ভুতলে পড়ল, পুলোমা দুঃখিত মনে পুত্রকে নিয়ে আশ্রমের দিকে চললেন। ব্রহ্মা তাঁর এই ররুদ্যমানা পুত্রবধূকে সান্ত্বনা দিলেন এবং পুলোমার অশ্রুজাত নদীর নাম বধূসরা রাখলেন। ভৃগু তাঁর পত্নীকে বললেন, তোমার পরিচয় রাক্ষসকে কে দিয়েছিল? পুলোমা উত্তর দিলেন, অগ্নি আমার পরিচয় দিয়েছিলেন। তখন ভৃগু সরোষে অগ্নিকে শাপ দিলেন, তুমি সর্বভূক হবে। অগ্নি বললেন, তুমি কেন এরুপ শাপ দিলে? আমি ধর্মানুসারে রাক্ষসকে সত্য কথাই বলেছি। তুমি ব্রাহ্মণ, আমার মাননীয়, সেজন্য আমি প্রত্যাভিশাপ দিলাম না। আমি যোগবলে বহু মূর্তিতে অধিষ্ঠান করি, আমাকে যে আহুতি দেওয়া হয় তাতেই দেবগণ ও পিতৃগণ তৃপ্ত হন, অতএব আমি সর্বভূক কি ক'রে হব?


               অগ্নি দ্বিজগণের অগ্নিহোত্র ও যজ্ঞাদি ক্রীয়া হতে অন্তর্হিত হলেন। তাঁর অভাবে সকলে অতিশয় কষ্টে পড়ল, ঋষিরা উদ্বিগ্ন হয়ে দেবগণের সঙ্গে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে শাপের বিষয় জানলেন এবং বললেন, অগ্নির অন্তর্ধানে আমাদের ক্রীয়ালোপ হয়েছে; যিনি দেবগণের মুখ এবং যজ্ঞের অগ্রভাগ ভোজন করেন তিনি কি করে সর্বভূক হতে পারেন? ব্রহ্মা মিষ্টবাক্য অগ্নিকে বললেন, হুতাসন, তুমি ত্রিলোকের ধারয়িতা এবং ক্রিয়াকলাপের প্রবর্ত্তক, ক্রীয়ালোপ করা তোমার উচিত নয়। তুমি সদা পবিত্র, সর্বশরীর দিয়ে তুমি সর্বভূক হবে না, তোমার গুহ্যদেশে যে শিখা আছে এবং তোমার যে ক্রব্যাদ (মাংস ভক্ষক) শরীর আছে তাই সর্বভূক হবে। তেজঃস্বরুপ, মহর্ষি ভৃগু যে শাপ দিয়েছেন তা সত্য কর এবং তোমার মুখে যে আহুতি দেওয়া হবে তাই দেবগণের ও নিজের ভাগরুপে গ্রহণ কর। অগ্নি বললেন, তাই হবে। তখন সকলে সন্তুষ্ট হয়ে নিজ নিজ স্থানে চলে গেলেন।

               

                 🔴রুরু-প্রমদ্বারা-ডুন্ডুভ🔴


ভৃগু পুত্র চ্যবনের পত্নীর নাম সুকন্যা, তাঁর গর্ভে প্রমতি জন্মগ্রহণ করেন। প্রমতির ঔরসে ঘৃতাচীর গর্ভে রুরু নামক পুত্র উৎপন্ন হন। এই রুরুর কথা এখন বলব।


          স্থুলকেশ নামে খ্যাত সর্বভুতহিতে রত এক মহর্ষি ছিলেন। গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর সহিত সহবাসে মেনকা গর্ভবতী হন। সেই নির্দয়া নির্লজ্জা অপ্সরা নদীতীরে তাঁর কন্যা সন্তানকে পরিত্যাগ করেন। মহর্ষি স্থুলকেশ দেবকন্যার ন্যায় কান্তিমতী সেই কন্যাটিকে দেখতে পেয়ে তাকে নিজের আশ্রমে এনে পালন করতে লাগলেন। এই কন্যা স্বভাবে রুপে গুণে সকল প্রমদার শ্রেষ্ঠ, সেজন্য মহর্ষি স্থুলকেশ তাঁর নাম রাখলেন-প্রমদ্বারা। রুরু সেই কন্যাকে দেখে মোহিত হলেন, তাঁর পিতা প্রমতির অনুরোধে স্থুলকেশও কন্যাদান করতে সম্মত হলেন।


                         কিছুকাল পরে বিবাহকাল আসন্ন হল। প্রমদ্বারা তার সখীদের সঙ্গে খেলা করতে করতে দুর্দৈবক্রমে একটি সুপ্ত সর্পের দেহে পা দিয়ে ফেলেন। সর্পের দংশনে প্রমদ্বারা বিবর্ণ বিগতশ্রী ও হতচেতন হয়ে প'ড়ে গেলেন। স্থুলকেশ এবং অন্যান্য ঋষিরা দেখলেন, পদ্মকান্তি সেই বালা নিস্পন্দ হয়ে প'ড়ে আছেন। প্রমতি ও বনবাসী অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ সেখানে এসে কাঁদতে লাগলেন। শোকার্ত রুরু গহন বনে গিয়ে করুনস্বরে বিলাপ করতে করতে বললেন, যদি আমি দান তপস্যা ও গুরুজনের সেবা করে থাকি, যদি জন্মাবাধ ব্রত পালন করে থাকি, বিষ্ণুর প্রতি যদি আমার অচলা ভক্তি থাকে, তবে আমার প্রিয়া এখনই জীবনলাভ করুক।


                            রুরুর বিলাপ শুনে দেবতারা কৃপান্বিত হয়ে একজন দূত পাঠালেন। এই দেবদূত রুরুকে বললেন, বৎস, এই কন্যার আয়ু শেষ হয়েছে, তুমি বৃথা শোক ক'রো না। তবে দেবতারা একটি উপায় নির্দিষ্ট করেছেন, তা যদি করতে পার তবে প্রমদ্বারাকে ফিরে পাবে। রুরু বললেন, হে আকাশচারী, বলুন সে উপায় কি? আমি তাই করব। দেবদূত বললেন, এই কন্যাকে তোমার আয়ুর অর্ধ দান কর, তা হলেই সে জীবিত হবে। রুরু বললেন, আমি অর্ধ আয়ু দিলাম, আমার প্রিয়া সৌন্দর্যময়ী ও সালংকারা হয়ে উত্থান করুক।


                        প্রমদ্বারার পিতা গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর দেবদূতের সঙ্গে যমের কাছে গিয়ে বললেন, ধর্মরাজ, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে মৃতা প্রমদ্বারা রুরুর অর্ধ আয়ু নিয়ে বেঁচে উঠুক। যম বললেন, তাই হোক। তখন বরবর্ণিনী প্রমদ্বারা যেন নিদ্রা থেকে গাত্রত্থান করলেন। প্রমতি ও স্থুলকেশ মহানন্দে বর কন্যার বিবাহ দিলেন।

 

                     রুরু অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে সর্পকূল বিনষ্ট করবার প্রতিজ্ঞা করলেন এবং যথাশক্তি সকল প্রকার সর্পই বধ করতে লাগলেন। একদিন তিনি বনে গিয়ে দেখলেন এক বৃদ্ধ ডুন্ডভ (ঢ়োরাসাপ) শুয়ে আছে। রুরু তখনই তাঁকে দন্ডাঘাতে মারতে গেলেন। ডুন্ডভ বললেন, তপোধন, আমি কোনও প্রকার অপরাধ করিনি, তবে কেন আমায় মারতে চান? রুরু বললেন, আমার প্রণসমা ভার্যাকে সাপে কামড়ে ছিল, সেজন্য প্রতিজ্ঞা করেছি সাপ দেখলেই মারব। ডুন্ডভ বললেন, যাঁরা মানুষকে দংশন করে তাঁরা অন্যজাতীয়, আপনি ধর্মজ্ঞ হয়ে ডুন্ডভ বধ করতে পারেন না। রুরু জিজ্ঞাসা করলেন, ডুন্ডভ, তুমি কে? ডুন্ডভ উত্তর দিলেন, পূর্বে আমি সহস্রপাৎ নামে ঋষি ছিলাম। খগম নামে এক ব্রাহ্মণ আমার সখা ছিলেন, তাঁর বাক্য অব্যর্থ। একদিন তিনি অগ্নিহোত্রে নিযুক্ত ছিলেন সেই সময়ে আমি বালসুলভ খেলার ছলে একটি তৃণনির্মিত সর্প নিয়ে ভয় দেখিয়াছিলাম, তাতে তিনি মুর্ছিত হন। সংজ্ঞালাভ করে তিনি স্বক্রোধে বললেন, আমাকে ভয় দেখাবার জন্য তুমি যেমন নির্বিষ সর্প নির্মাণ করেছ, আমার শাপে তুমিও সেইরূপ হবে। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে কৃতাজ্ঞলি- পুটে তাঁকে বললাম, আমি আপনাকে সখা জ্ঞান করে এই পরিহাস করেছি; আমাকে ক্ষমা করুন, শাপ প্রত্যাহার করুন। খগম বললেন, যা বলেছি তা মিথ্যা হবে না, তবে আমার এই কথা শুনে রাখ- প্রমতির পুত্র রুরুর দর্শন পেলে তুমি শাপমুক্ত হবে। তুমি সেই রুরু আজ আমি পূর্ব রুপ ফিরে পাব।


                                ঋষি সহস্রপাৎ ডুন্ডভ রুপ ত্যাগ করলেন এবং তজোময় পূর্বরুপ লাভ করে রুরুকে বললেন-


 অহিংসা পরমোধর্মঃ সর্বপ্রাণভৃতাং স্মৃতঃ।।

 তস্মাৎ প্রাণভুতঃ সর্বান্ন ন হিংস্যাদ্ ব্রাহ্মণঃ ক্বচিৎ।

 ব্রাহ্মণঃ সৌম্য এবেহ ভবতীতি পরা শ্রুতিঃ।।

 বেদবেদাঙ্গবিৎ তাত সর্বভুতাভয়প্রদঃ।

 অহিংসা সত্যবচনং ক্ষমা চেতী বিনিশ্চিতম্।।

 ব্রাহ্মণস্য পরো ধর্মো বেদানাং ধারণাপি চ।

 ক্ষত্রিয়স্য হি যো ধর্মঃ সে হি নেষ্যেত বৈ তব।।


অর্থ- সর্ব প্রাণীর অহিংসাই পরম ধর্ম; অতএব, ব্রাহ্মণ, কখনও কোনও প্রাণীর হিংসা করবেন না। বৎস, এইরূপ শ্রুতিবাক্য আছে যে ব্রাহ্মণ শান্তমূর্তি বেদবেদাঙ্গবিৎ এবং সর্ব প্রাণীর অভয়দাতা হবেন, তাঁর পক্ষে অহিংসা, সত্যকথন, ক্ষমা ও বেদের ধারণাই পরম ধর্ম। ক্ষত্রিয়ের যে ধর্ম তা তোমার গ্রহনীয় নয়।


তারপর সহস্রপাৎ বললেন, দন্ডদান, উগ্রতা ও প্রজাপালন ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। পূর্বকালে জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে সর্পসমূহ বিনষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তপোবল সম্পন্ন বেদবেদাঙ্গবিৎ দ্বিজশ্রেষ্ঠ আস্তিক ভীত সর্পগণকে পরিত্রাণ করেছিলেন।


                রুরু সেই ইতিহাস জানতে চাইলে সহস্রপাৎ বললেন, আমি এখন যাবার জন্য ব্যস্ত হয়েছি, তুমি ব্রাহ্মণদের কাছে সব শুনতে পাবে। এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন। রুরু তাঁকে চতুর্দিকে অন্বেষণ ক'রে পরিশ্রান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়লেন, তারপর আশ্রমে এসে পিতার নিকট সর্পযজ্ঞের বৃত্তান্ত শুনলেন।


                    👉||আস্তিক পর্বাধ্যায়||👈


🔴জগৎকারু মুনি- কদ্রু ও বিনতা- সমুদ্র মন্থন🔴


শৌনক বললেন, তুমি জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ ও আস্তিক ইতিহাস বল।

সৌতি বললেন- আস্তিকের পিতার নাম জগৎকারু, তিনি মহাতপা ব্রহ্মচারী উধ্বরেতা পরিব্রাজক ছিলেন। একদিন তিনি পর্যটক করতে করতে দেখলেন, কতকগুলি মানুষ উশীর(বেনা) তৃণ অবলম্বন ক'রে উধ্বপাত অধোমুখ হয়ে গর্তের উপর ঝুলছেন। জগৎকারু জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা এইভাবে আ'ছ কেন? জগৎকারুর প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বললেন, আমরা যাযাবর নামক ঋষি ছিলাম। জগৎকারু নামে আমাদের একটি পুত্র আছে, সেই মূঢ় কেবল তপস্যা করে, বিবাহ এবং সন্তান উৎপাদনের চেষ্টা তাঁর নেই। আমরা অনাথ হয়ে বংশলোপের আশঙ্কায় পাপীর ন্যায় এই গর্তে লম্বমান রয়েছি। জগৎকারু বললেন, আপনারা আমারই পিতৃপুরুষ, বলুন কি করব? পিতৃগণ বললেন, বৎস, দারগ্রহন ও সন্তান উৎপাদন কর, তাতেই আমাদের পরম মঙ্গল হবে। জগৎকারু বললেন, আমি নিজের জন্য বিবাহ বা ধনোপার্জন করব না, আপনাদের হিতের জন্যই দারগ্রহন করব। যে কন্যার নাম আমার নামের সমান, যাঁকে তাঁর আত্মীয়রা স্বেচ্ছায় দান করবে; তাকেই আমি ভিক্ষাস্বরুপ নেব।


                           জগৎকারু বিবাহার্থী হয়ে ভ্রমণ করতে লাগলেন। একদিন তিনি বনে গিয়ে ধীর ও উচ্চ কন্ঠে তিনবার কন্যা ভিক্ষা করলেন। তখন বাসুকি তাঁর ভগিনীকে নিয়ে এসে বললেন, দ্বিজত্তম, আপনি এ'কে গ্রহণ করুন। কন্যার নাম আর নিজের নাম এক জেনে জগৎকারু তাঁকে বিবাহ করলেন। আস্তিক নামে তাঁদের এক পুত্র হল, তিনিই সর্পগণকে ত্রাণ করেন এবং পিতৃগণকেও উদ্ধার করেন।


(বিঃদ্রঃ- জগৎকারুকে বাসুকি যে ভগ্নি দান করেছেন, তাঁরই নাম মনসা। জগৎকারু ঋষি ও মনসার পূর্ণ বৃত্তান্ত পদ্মাপুরাণের মধ্যে অবস্থিত। মহাভারতে শুধুই আস্তিকের জন্ম ও সর্পের ত্রাণ ও পূর্ব পিতৃগণকে উদ্ধার কথা মৌলিক অংশ প্রকাশিত।)


          শৌনক বললেন, বৎস সৌতি, তোমার কথা অতি মধুর, আমরা আরও শুনতে ইচ্ছা করি।


সৌতি বলতে লাগলেন---

পুরাকালে সত্যযুগে দক্ষ প্রজাপতির কদ্রু ও বিনতা নামে দুই সুলক্ষণা রুপবতী কন্যা ছিলেন, তাঁরা কাশ্যপ ঋষির ধর্মপত্নী। কশ্যপ তাঁদের বর দিতে ইচ্ছা করলে কদ্রু বললেন, তুল্যবলশালী সহস্র নাগ আমার পুত্র হ'ক; বিনতা বললেন, আমাকে দুই পুত্র দিন যাঁরা কদ্রুর পুত্রের চেয়েও বলবান ও ত্বেজসী। কশ্যপ দুই পত্নীকেই অভীষ্ট বর দিলেন। যথাকালে কদ্রু এক সহস্র এবং বিনতা দুই ডিম্ব প্রসব করলেন। পাঁচ'শ বৎসর পরে কদ্রুর প্রত্যেক ডিম্ব থেকে পুত্র নির্গত হল। নিজের দুই ডিম্ব থেকে কিছুই বার হ'ল না দেখে বিনতা একটি ডিম্ব ভেঙ্গে দেখলেন, তাঁর মধ্যস্ত সন্তানের দেহের উর্দ্ধভাগ আছে কিন্তু নিম্নভাগ অপরিণত। সেই পুত্র ক্রুদ্ধ হয়ে মাতাকে শাপ দিলেন, তোমার লোভের ফলে আমার দেহ অসম্পূর্ণ হয়েছে; তুমি পাঁচ'শ বৎসর কদ্রুর দাসী হয়ে থাকবে। অন্য ডিম্বটিকে অসময়ে ভেঙ্গ না, যথাকালে তা থেকে পুত্র নির্গত হয়ে তোমার দাসীত্ব মোচন করবে। এই কথা বলে তিনি আকাশে উড়লেন এবং অরুণ রুপে সূর্যের সারথি হলেন। পরবর্তী ডিম্ব থেকে যথাকালে এক সন্তান উৎপাদন হয় যাঁর নাম গরুড়। গরুড় যথাকালে জন্ম হয়ে এবং জননী বিনতাকে ত্যাগ করে ক্ষুধার্ত হয়ে আকাশে উড়লেন। একদিন কদ্রু ও বিনতা দেখলেন, তাঁদের নিকট দিয়ে উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব যাচ্ছে। অমৃত মন্থনে উৎপন্ন এই অশ্বরত্নের প্রশংসা সকল দেবতাই করতেন।


শৌনক অমৃত মন্থনের বিবরণ শুনতে চাইলে সৌতি বললেন, একদা দেবগণ সুমেরু পর্বতের শিখরে বসে অমৃত প্রাপ্তির জন্য মন্ত্রনা করছিলেন। নারায়ণ ব্রহ্মাকে বললেন, দেবগণ ও অসুরগণ একত্র হয়ে সমুদ্র মন্থন করু'ক, তা হলে অমৃত পাবেন। ব্রহ্মা ও নারায়ণের আদেশে নাগরাজ অনন্ত মন্দর পর্বত উৎপাটন করলেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে দেবতারা সমুদ্র তীরে গিয়ে বললেন, অমৃতের জন্য আমরা আপনাকে মন্থন করব। সমুদ্র বললেন, আমাকে অনেক মর্দন (কষ্ট) সইতে হবে, অমৃতের অংশ যেন আমি পাই।


(বিঃদ্রঃ- দূর্বাষা ঋষির স্বর্গারোহণ সময় দূর্বাষা দ্বারা দেবরাজ ইন্দ্র অভিশপ্ত ও ব্রহ্মাণ্ড শ্রীহীন দন্ডশাপ ইতিহাস, পূর্ণ্যার্থ মহাভারতে নেই; এর পরিপূর্ণ ইতিহাস শিবপুরাণ অন্তর্গত। মহাভারতে শুধুমাত্র মৌলিক অংশ প্রকাশিত যা মহাভারত কথা রুপে পরিচিত।)


দেবাসুরের অনুরোধে সাগরস্ত কূর্মরাজ মন্দর পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারণ করলেন, ইন্দ্র বজ্র দ্বারা পর্বতের নিম্নদেশ সমান করে দিলেন। তারপর মন্দরকে মন্থনদন্ড ও নাগরাজ বাসুকী (অনন্ত)কে রজ্জু করে দেবাসুর সমুদ্র মন্থন করতে লাগলেন। অসুরগণ নাগরাজের শীর্ষদেশ ও দেবগণ পুচ্ছ ধারণ করলেন। বাসুকীর মুখ থেকে ধুম ও অগ্নিশিখার সহিত যে নিঃশ্বাস বায়ু নির্গত হল তা মেঘে পরিণত হয়ে পরিশ্রান্ত দেবাসুরের উপর জল বর্ষন করতে লাগল। সমুদ্র থেকে মেঘ গর্জনের ন্যায় শব্দ উঠল, মন্দরের ঘর্ষণে বহু জলজন্তু নিষ্পিষ্ট হল, পর্বতের বৃক্ষ সকল পক্ষীসমেত নিপতিত হল,বৃক্ষের ঘর্ষণে অগ্নি উৎপন্ন হয়ে হস্তী সিংহ প্রভৃতি জীবজন্তুকে দগ্ধ করে ফেলল। নানা প্রকার বৃক্ষের নির্যাস ও ঔষধি রস এবং কাঞ্চনদ্রব্য সমুদ্র জলে পড়ল। সেই সকল রস মিশ্রিত জল থেকে দুগ্ধ ও ঘৃত উৎপন্ন হল।


                  তারপর মথ্যমান সাগর থেকে চন্দ্র উঠলেন এবং ঘৃত থেকে লক্ষ্মী, সুরাদেবী, শ্বেতবর্ণের উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব ও নারায়ণের বক্ষের ভূষণ কৌস্তুর মনির উদ্ভব হল। সর্বকামনা পূরক পারিজাত বৃক্ষ এবং সুরভি ধেণু উত্থিত হল। লক্ষ্মী, সুরাদেবী, চন্দ্র ও উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব দেবগণের নিকট গেলেন। অনন্তর ধন্বন্তরি দেব অমৃতপূর্ণ কমন্ডুল নিয়ে উঠলেন, তা দেখে দানবগণ 'আমার আমার' ব'লে কোলাহল করতে লাগল। তারপর শ্বেতবর্ণের চতুর্দন্ত মহাকায় ঐরাবত উত্থিত হলে ইন্দ্র তাঁকে ধরলেন। অতিশয় মন্থনের ফলে কালকুট উঠল, সধুম অগ্নির ন্যায় সেই বিষে জগৎ ব্যাপ্ত হল। ব্রহ্মার অনুরোধে ভগবান মহেশ্বর সেই পান করে নিজের কন্ঠস্ত ধারণ করলেন, সেই থেকে ভগবান শিবের নাম নীলকণ্ঠ।


                 দানবগণ অমৃত ও লক্ষ্মী লাভের জন্য দেবতাদের সঙ্গে কলহ করতে লাগল। নারায়ণ মোহিনী মায়ায় স্ত্রীরুপ ধারণ করে দানবগণের কাছে গেলেন, তাঁরা মোহিত হয়ে তাঁকে অমৃত সমর্পণ করলে; তিনি দানবগণকে শ্রেণীবদ্ধ করে বসিয়ে কমন্ডলু থেকে কেবল দেবগণকে অমৃত পান করালেন। দানবগণ ক্রদ্ধ হয়ে দেবগণের প্রতি ধাবিত হ'ল, তখন বিষ্ণু অমৃত হরণ করলেন। দেবতারা বিষ্ণুর কাছ থেকে অমৃত নিয়ে পান করছিলেন সেই অবসরে রাহু নামক এক দানব দেবতার রুপ ধারণ করে অমৃত পান কর'লে, অমৃত রাহুর কন্ঠদেশে যাবার আগেই চন্দ্র ও সূর্য বিষ্ণুকে বলে দিলেন; বিষ্ণু তখনই তাঁর চক্র দিয়ে রাহুর মুন্ডচ্ছেদ করলেন। রাহুর মুন্ড আকাশে উড়ে গর্জন করতে লাগল, তাঁর কবন্ধ(ধর) ভূমিতে পড়ল, তখন সমস্ত পৃথিবী কম্পিত হল। সেই হতে চন্দ্র ও সূর্যের সাথে রাহুর চিরস্থায়ী শত্রুতা হল। বিষ্ণু স্ত্রীরুপ ত্যাগ করে দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঘোর যুদ্ধ করলেন। দানবগণ সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলেন।


🔴কদ্রু-বিনতার পণ, গড়ুর-গজকচ্ছপ-অমৃতহরণ🔴


একদিন উচ্চৈঃশ্রবাকে দেখে কদ্রু ও বিনতা তর্ক করলেন, এই অশ্বের বর্ণ কি। বিনতা বললেন, শ্বেত; কদ্রু বললেন, পুচ্ছদেশ কৃষ্ণ। অবশেষে এই পণ স্থির হল যে কাল তাঁরা অশ্বটিকে ভালো করে দেখবেন এবং যাঁর কথা মিথ্যা হবে তিনি সপত্নীর দাসী হবেন। 


               কদ্রু তাঁর সর্পপুত্রদের ডেকে বললেন, তোমরা শীঘ্রই গিয়ে ঐ অশ্বের পুচ্ছে লগ্ন হও, যাতে কজ্জলবর্ণ দেখায়। যে সর্পরা সম্মত হল না কদ্রু তাঁদের শাপ দিলেন, তোমরা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে দগ্ধ হবে। পরদিন প্রভাতে কদ্রু ও বিনতা আকাশপথে সমুদ্রের পরপারে গেলেন। উচ্চৈঃশ্রবার পুচ্ছে কৃষ্ণবর্ণ লোম দেখে বিনতা বিষন্ন হলেন এবং কদ্রু তাঁকে দাসীত্বে নিযুক্ত করলেন। 


            এই সময়ে বিনতার দ্বিতীয় ডিম্ব বিদীর্ণ করে মহাবল গড়ুর বহির্গত হলেন এবং অগ্নি রাশির ন্যায় তজোময় বিশাল দেহ ধারণ করে আকাশে উড়ে গর্জন করতে লাগলেন। তারপর তিনি সমুদ্রের পরপারে মাতার নিকট গেলেন। কদ্রু বিনতাকে বললেন, সমুদ্রের মধ্যে এক সুরম্য নাগালয় আছে; সেখানে আমাকে নিয়ে চল। বিনতা কদ্রুকে এবং গড়ুর তাঁর বৈমাত্র ভ্রাতা সর্পগণকে বহন করে নিয়ে চললেন। সূর্যতাপে পুত্ররা কষ্ট পাচ্ছে দেখে কদ্রু ইন্দ্রের স্তব করলেন, ইন্দ্রের আদেশে মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত হল। সর্প সকল হৃষ্ট হয়ে গড়ুরের পিঠে চড়ে এক রমনীয় দ্বীপে এল। তাঁরা গড়ুরকে বললেন, আমাদের অন্য এক দ্বীপে নিয়ে চল যেখানে নির্মল জল আছে। গড়ুর বিনতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এঁদের আজ্ঞানুসারে আমাকে চলতে হবে কেন? বিনতা জানালেন যে, কদ্রু কপট উপায়ে তাঁকে পণে পরাজিত করে দাসীত্বে নিযুক্ত করেছেন। গড়ুর দুঃখিত হয়ে সর্পদের জিজ্ঞাসা করলেন, কি করলে আমরা দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারি? সর্পরা বললেন, যদি নিজ বীর্যবলে অমৃত আনতে পার তবে মুক্তি পাবে।


                    গড়ুর বিনতাকে বললেন, আমি অমৃত আনতে যাচ্ছি; পথে কি খাব? বিনতা বললেন, সমুদ্রের এক প্রান্তে বহু সহস্র নিষাদ বাস করে, তুমি সেই নির্দয় দূরাত্মাদের খেয়ো কিন্তু ব্রাহ্মণদের কখনও হিংসা করো না। গড়ুর আকাশমার্গে যাত্রা করে নিষাদালয়ে উপস্থিত হলেন এবং মুখব্যাদান করে নিষাদগণকে গ্রাস করতে লাগলেন। এক ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নীর সঙ্গে গড়ুরের কন্ঠে প্রবেশ করেছিলেন। দীপ্ত অঙ্গারের ন্যায় দাহ বোধ হওয়ায় গড়ুর বললেন, দ্বিজত্তম, তুমি শীঘ্রই নির্গত হও। ব্রাহ্মণ পাপী হলেও আমার ভক্ষ্য নয়। ব্রাহ্মণ বললেন, তবে আমার নিষাদী ভার্যাকেও ছেড়ে দাও। গড়ুর বললেন, আপনি তাঁকে নিয়ে শীঘ্রই বেরিয়ে আসুন, যেন আমার জঠরানলে জীর্ণ না হন। ব্রাহ্মণ সস্ত্রীক নির্গত হয়ে গড়ুরকে আশীর্বাদ করে প্রস্থান করলেন।


              তারপর গড়ুর তার পিতা মহর্ষি কশ্যপের কাছে গেলেন। কশ্যপ কুশল প্রশ্ন করলে গড়ুর বললেন, আমি মাতার দাসীত্ব মোচনের জন্য অমৃত আনতে যাচ্ছি; কিন্তু আমি প্রচুর খাদ্য পাই না, আপনি আমার ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তর উপায় বলুন। কশ্যপ বললেন, বিভাবসু নামে এক কোপন স্বভাব মহর্ষি ছিলেন, তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুপ্রতীক ধনবিভাগের জন্য বার বার অনুরোধ করতেন। একদিন বিভাবসু বললেন, যে ভ্রাতারা গুরু ও শাস্ত্র মানে না তারাই পরস্পরকে শত্রু ভেবে শঙ্কিত হয়; সাধুলোকে ধনবিভাগের প্রশংসা করেন না। তুমি আমার নিষেধ শুনবে না, ভিন্ন হয়ে ধনশালী হতে চাও; অতএব আমার শাপে তুমি হস্তী হও। সুপ্রতীক জ্যেষ্ঠকে শাপ দিলেন, তুমি কচ্ছপ হও। বৎস গড়ুর, ওই যে সরোবর দেখছ ওখানে দুই ভ্রাতা গজকচ্ছপ রুপে পরস্পরকে আক্রমণ করছে। তুমি ওই মহাগিরিতুল্য গজ এবং মহামেঘতুল্য কচ্ছপ ভোজন কর।


                   এক নকে গজ আর এক নকে কচ্ছপকে তুলে নিয়ে গড়ুর অলম্ব তীর্থে গেলেন। সেখানকার বৃক্ষ সকল শাখা ভঙ্গের ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। একটি বিশাল দিব্য বটবৃক্ষ গড়ুরকে বললেন, আমার শতযোজন আয়ত মহাশাখায় বসে তুমি গজকচ্ছপ ভোজন কর। গড়ুর বসবামাত্র মহাশাখা ভেঙে গেল। বাল্যখিল্য মুনিগণ সেই শাখা থেকে অধোমুখে ঝুলছেন দেখে গড়ুর সন্ত্রস্ত হয়ে চঞ্চুদ্বারা শাখাটি ধরে ফেললেন এবং বহু দেশে বিচরণ করে অবশেষে গন্ধমার্দন পর্বতে উপস্থিত হলেন। কশ্যপ সেখানে তপস্যা করছিলেন। তিনি পুত্রের অনিষ্টবারণের জন্য বালখিল্যগণকে বললেন, তপোধন, লোকের হিতের নিমিত্ত গড়ুর মহৎ কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছে, আপনারা তাঁকে অনুমতি দিন। তখন বালখিল্যগণ শাখা ত্যাগ করে হিমালয়ে তপস্যা করতে গেলেন। গড়ুর শাখা মুখে করে বিকৃতস্বরে পিতাকে বললেন, ভগবান, মানুষ বর্জিত এমন স্থান বলুন যেখানে আমি এই শাখা ফেলতে পারি। কশ্যপ একটি তুষারময় জনশূন্য পর্বতের কথা বললেন। গড়ুর সেখানে গিয়ে শাখা ত্যাগ করলেন এবং পর্বতশৃঙ্গে বসে গজকচ্ছপ ভোজন করলেন।


             ভোজন শেষ করে গড়ুর মহাবেগে উড়ে চললেন। অশুভ সূচক নানা প্রকার প্রাকৃতিক উপদ্রব দেখে ইন্দ্রাদি দেবগণ ভীত হলেন। বৃহস্পতি বললেন, কশ্যপ-বিনতার পুত্র কামরুপী গড়ুর অমৃত হরণ করতে আসছে। তখন দেবতারা নানাবিধ অস্ত্র ধারণ করে অমৃত রক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেন। গড়ুরকে দেখে দেবগণ ভয়ে কম্পিত হয়ে পরস্পরকে অস্ত্রাঘাত করতে লাগলেন। বিশ্বকর্মা অমৃতের রক্ষক ছিলেন, তিনি গড়ুরের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভূপাতিত হলেন। গড়ুরের পক্ষের আন্দোলনে ধুলি উড়ে দেবলোক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল, বায়ু সেই ধুলি অপসারিত করলেন। গড়ুর দেখলেন অমৃতের চতুর্দিকে অগ্নিশিখা জ্বলছে, তাঁর নিকটে একটি ক্ষুরধার লৌহচক্র নিরন্তর ঘুরছে। তিনি তার দেহ সংকুচিত করে চক্রের অরের অন্তরাল দিয়ে প্রবেশ করে দেখলেন, অমৃত রক্ষার জন্য দুই ভয়ঙ্কর সর্প চক্রের নিম্নদেশে রয়েছে। গড়ুর তাঁদের বধ করে অমৃত নিয়ে আকাশে এসে বিষ্ণুর দর্শন পেলেন। গড়ুর অমৃত পানের লোভ সংবরণ করছে দেখে বিষ্ণু প্রীত হয়ে বললেন, তোমাকে বর দেব। গড়ুর বললেন, আমি তোমার উপরে থাকতে এবং অমৃত পান না করেই অজর অমর হ'তে ইচ্ছা করি। বিষ্ণু বললেন, তাই হবে। তখন গড়ুর বললেন, ভগবান, তুমিও আমার কাছে বর চাও। বিষ্ণু বললেন, তুমি আমার বাহন হও, আমার রথধ্বজের উপরেও থেকো। গড়ুর তাই হবে বলে মহাবেগে প্রস্থান করলেন।


                     তখন ইন্দ্র তাঁকে বজ্রাঘাত করলেন। গড়ুর সহাস্য বললেন, শতক্রতু দধীচি মুনি, তাঁর অস্থিজাত বজ্র এবং তোমার সম্মানের নিমিত্ত আমি একটি পালক ফেলে দিলাম, তোমার বজ্রপাতে আমার কোনও ব্যথা হয়নি। গড়ুরের নিক্ষিপ্ত সেই সুন্দর পালক দেখে সকলে আনন্দিত হয়ে তাঁর নাম দিলেন সুপর্ণ। ইন্দ্র তার সঙ্গে সখ্য স্থাপন করে বললেন, যদি তোমার অমৃতের প্রয়োজন না থাকে তবে আমাকে ফিরিয়ে দাও, কারণ তুমি যাঁদের দেবে তাঁরাই আমাদের উপর উপদ্রব করবে। গড়ুর বললেন, কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য আমি অমৃত নিয়ে যাচ্ছি; যেখানে আমি রাখবো সেখান থেকে তুমি হরণ করো। ইন্দ্র তুষ্ট হয়ে বর্তমান দিতে চাইলে গড়ুর বললেন, মহাবল সর্পগণ আমার ভক্ষ্য হোক। ইন্দ্র বললেন, তাই হবে। তারপর গড়ুর বিনতার কাছে এলেন এবং সর্প ভ্রাতাদের বললেন, আমি অমৃত এনেছি, এই কুশের উপর রাখছি; তোমরা স্নান করে এসে খেয়ো। এখন তোমাদের কথা রাখ, আমার মাতাকে দাসীত্ব থেকে মুক্ত কর। তাই হোক বলে সর্পরা স্নান করতে গেলেন, সেই অবসরে ইন্দ্র অমৃত হরণ করলেন। সর্পের দল ফিরে এসে 'আমি আগে, আমি আগে' বলে অমৃত খেতে গেল কিন্তু না পেয়ে কুশ চাটতে লাগল, তার ফলে তাঁদের জিহ্বা দ্বিধা বিভক্ত হল।


   🔴আস্তিকের জন্ম-পরীক্ষিতের মৃত্যু বিবরণ🔴


শৌনক বললেন, কদ্রুর অভিশাপ শুনে তাঁর পুত্ররা কি করেছিল বল-----


সৌতি বললেন- ভগবান শেষনাগ (অনন্ত-বাসুকি) কদ্রুর জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি মাতার অভিশাপের পর নানা পবিত্র তীর্থে গিয়ে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। ব্রহ্মা তাঁর কাছে এসে বললেন, তোমার কি কামনা তা বল। শেষনাগ উত্তর দিলেন, আমার সহোদরগণ অতি মন্দমতি, তাঁরা আমার বৈমাত্র ভ্রাতা গড়ুরকে দ্বেষ করে। আমি পরলোকেও সহোদরদের সংস্বর্গ চাইনা, সেজন্য তপস্যায় প্রাণ বিসর্জন দেব। ব্রহ্মা বললেন, আমি তোমার ভ্রাতাদের আচরণ জানি। ভাগ্যক্রমে তোমার ধর্মবুদ্ধি হয়েছে, তুমি আমার আদেশে এই শৈল-বন-সাগর-জনপদাদি-সমন্বিত-চঞ্চল পৃথিবীকে নিশ্চল করে ধারণ কর। শেষনাগ পাতালে গিয়ে মস্তক দ্বারা পৃথিবী ধারণ করলেন, ব্রহ্মার ইচ্ছায় গড়ুর তাঁর সহায় হলেন। পাতালবাসী নাগগণ তাঁকে বাসুকি রুপে নাগরাজ পদে অভিষিক্ত করলেন।


               মাতৃপদত্ত শাপ খন্ডন করবার জন্য বাসুকি তাঁর ধার্মিক ভ্রাতাদের সঙ্গে মন্ত্রনা করলেন। নাগগণ অনেক প্রকার উপায় নির্দেশ করলেন কিন্তু বাসুকি কোনওটিতে সম্মত হলেন না। তখন এলাপত্র নামে এক নাগ বললেন, আমাদের মাতা যখন অভিশাপ দেন তখন আমি তাঁর ক্রোড়ে বসে শুনেছিলাম- ব্রহ্মা দেবগণকে বলছেন, তপস্বী পরিব্রাজক জগৎকারুর ঔরসে বাসুকির ভগিনী; জগৎকারুর গর্ভে আস্তিক নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করবেন, তিনিই ধার্মীক সর্পগণকে রক্ষা করবেন।


                       তারপর বাসুকি বহু অন্বেষণের পর মহর্ষি জগৎকারুকে পেয়ে তাঁকে ভগিনী সম্প্রদান করবেন। সেই ধার্মীক তপস্বী বাসুকির প্রদত্ত রমনীর গৃহে সস্ত্রীক বাস করতে লাগলেন। তিনি ভার্যাকে বললেন, তুমি কদাচিত্ আমার অপ্রিয় কিছু করবে না, যদি কর তবে তোমাকে ও এই বাসগৃহ ত্যাগ করব। বাসুকির ভগিনী তাতেই সম্মত হলেন এবং শ্বেতকাকী'ক ন্যায় পতির সেবা করে যথাকালে গর্ভবতী হলেন। একদিন মহর্ষি তাঁর ক্রোড়ে মস্তক রেখে নিদ্রা যাচ্ছিলেন এমন সময় সূর্যাস্তকাল উপস্থিত হ'ল। পাছে সন্ধ্যাকৃত্যের কাল উত্তীর্ণ হল এই আশঙ্কায় তিনি মৃদুস্বরে স্বামীকে জাগালেন। মহর্ষি বললেন, নিদ্রা ভঙ্গ করে তুমি আমার অবমাননা করেছ; তোমার কাছে আর আমি থাকব না। আমি যতক্ষণ সুপ্ত থাকি ততক্ষণ সূর্যের অস্ত যাবার ক্ষমতা নেই। অনেক অনুনয় করলেও তিনি তাঁর বাক্য প্রত্যাহার করলেন না, যাবার সময় তিনি পত্নীকে বলে গেলেন; ভাগ্যবতী, তোমার গর্ভে অগ্নিতুল্য তেজস্বী পরম ধর্মাত্মা বেদজ্ঞ ঋষি আছেন।


                     যথাকালে বাসুকি ভগিনীর দেবকুমার তুল্য এক পুত্র হল। এই পুত্র চ্যবনতনয় প্রমতির কাছে বেদ অধ্যায়ন করলেন। মহর্ষি জগৎকারু চলে যাবার সময় তাঁর পত্নীর গর্ভস্থ সন্তানকে লক্ষ্যে করে 'অস্তি'(আছে) বলেছিলেন, সেজন্য তাঁর পুত্র আস্তিক নামে খ্যাত হবেন।


         শৌনক জিজ্ঞাসা করলেন, জনমেজয় তাঁর পিতার মৃত্যুর বৃত্তান্ত জানতে চাইলে মন্ত্রীরা কি বলেছিলেন?


          সৌতি বললেন, জনমেজয়ের মন্ত্রীরা এই ইতিহাস বলেছিলেন। অভিমন্যু- উত্তরার পুত্র মহারাজ পরীক্ষিৎ কৃপাচার্যের শিষ্য এবং গোবিন্দের প্রিয় ছিলেন। ষাট বছর বয়স পর্যন্ত রাজত্ব করার পর, দুরদৃষ্টক্রমে তাঁর প্রাণনাশ হয়। তিনি প্রপিতামহ পান্ডুর ন্যায় মহাবীর ও ধনুর্ধর ছিলেন। একদা পরীক্ষিৎ মৃগয়া করতে গিয়ে একটি মৃগকে বাণসিদ্ধ করে তাঁর অনুসরণ করলেন এবং পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে গহন বনে শমীক নামক এক মুনিকে দেখতে পেলেন। রাজা মৃগ সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে মুনি উত্তর দিলেন না, কারণ তিনি মৌনব্রতধারী ছিলেন। পরীক্ষিৎ ক্রুদ্ধ হয়ে একটা মৃত সর্প ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে তুলে মুনির স্কন্ধে পড়িয়ে দিলেন। মুনি কিছুই বললেন না, ক্রোধও প্রকাশ করলেন না। রাজা তখন নিজের পুরীতে ফিরে গেলেন। শমীক মুনির শৃঙ্গী নামে এক তেজস্বী ক্রোধী পুত্র ছিলেন, তিনি তাঁর আচার্যের গৃহ থেকে ফেরবার সময় কৃশ নামক এক বন্ধুর কাছে শুনলেন; রাজা পরীক্ষিৎ তাঁর তপোরত পিতাকে কিরুপে অপমান করেছেন। শৃঙ্গী ক্রোধে যেন প্রদীপ্ত হয়ে এই অভিশাপ দিলেন, আমার নিরপরাধ পিতার স্কন্ধে যে মৃত সর্প দিয়েছে সেই পাপীকে সপ্ত রাত্রির মধ্যে মহাবিষধর তক্ষক নাগ দগ্ধ করেন। শৃঙ্গী তাঁর পিতার নিকট গিয়ে শাপের কথা জানালেন। শমীক বললেন, বৎস; আমরা পরীক্ষিতের রাজ্য বাস করি, তিনি আমাদের রক্ষক; তাঁর অনিষ্ট আমি চাইনা। তিনি ক্ষুধিত ও শ্রান্ত হয়ে এসেছিলেন, আমার মৌনব্রত না জেনেই এই কর্ম করেছেন। পুত্র তাঁকে অভিশাপ দেওয়া উচিৎ হয়নি। শৃঙ্গী বললেন, পিতা; আমি যদি অন্যায়ও করে থাকি তথাপি আমার শাপ মিথ্যা হবে না।


           গৌরমুখ নামক এক শিষ্যকে শমীক পরীক্ষিতের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। গুরুর উপদেশ অনুসারে গৌরমুখ বললেন, মহারাজ মৌনব্রতী শমীকের স্কন্ধে আপনি মৃত সাপ রেখেছিলেন, তিনি সেই অপরাধ ক্ষমা করেছেন। কিন্তু তাঁর পুত্র ক্ষমা করেননি, তাঁর শাপে সপ্ত রাত্রির মধ্যে তক্ষক আপনার প্রাণ হরণ করবে। শমীক বার বার ব'লে দিয়েছেন আপনি যেন আত্মরক্ষায় যত্নবান হন। পরীক্ষিৎ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে মন্ত্রীদের সাথে মন্ত্রনা করলেন। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি একটি মাত্র স্তম্ভের উপর সুরক্ষিত প্রাসাদ নির্মাণ করালেন এবং বিষচিকিৎসক ও মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণগণকে নিযুক্ত করলেন। তিনি সেখানে থেকেই মন্ত্রীদের সাহায্য রাজকার্য করতে লাগলেন, অন্য কেউ তাঁর কাছে আসতে পারত না। সপ্তম দিনে কশ্যপ নামে এক ব্রাহ্মণ বিষচিকিৎসার জন্য রাজার কাছে যাচ্ছিলেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে তক্ষক তাঁকে বললেন, আপনি এত দ্রুত কোথায় যাচ্ছেন? কশ্যপ বললেন, আজ তক্ষক নাগ পরীক্ষিৎকে দংশন করবেন; আমি গুরুর কৃপায় বিষ নষ্ট করতে পারি, রাজাকে সদ্য সদ্য নিরাময় করব। তক্ষক বললেন, আমিই তক্ষক; এই বটবৃক্ষে দংশন করছি, আপনার মন্ত্রবল দেখান।


                      তখন তক্ষকের দংশনে বটবৃক্ষ জ্বলে গেল। কশ্যপের মন্ত্রশক্তিতে ভস্মরাশি থেকে প্রথমে অংকুর, তারপর দুটি প্রল্লব, তারপর বহু পত্র ও শাখা প্রশাখা উদ্ভব হল। তক্ষক বললেন, তপোধন, আপনি কিসের প্রার্থী হয়ে রাজার কাছে যাচ্ছেন? ব্রাহ্মণের শাপে তাঁর আয়ুক্ষয় পেয়েছে, আপনি তাঁর চিকিৎসায় কৃতকার্য হবেন কিনা সন্দেহ। রাজার কাছে আপনি যত ধন আসা করেন তার চেয়ে বেশি আমি দেব, আপনি ফিরে যান। কশ্যপ ধ্যান করে জানলেন যে পরীক্ষিতের আয়ু শেষ হয়েছে, তিনি তক্ষকের কাছে অভীষ্ট ধন নিয়ে চলে গেলেন। 


                তক্ষককের উপদেশে কয়েকজন নাগ, তপস্বী সেজে ফল কুল আর জল নিয়ে পরীক্ষিতের কাছে গেলেন। রাজা সেই সকল উপহার নিয়ে তাদের বিদায় দিলেন এবং অমাত্য-সুহৃদগণের সঙ্গে ফল খাবার উপক্রম করলেন। তাঁর ফলে একটি ক্ষুদ্র কৃষ্ণনয়ন তাম্রবর্ণ কীট দেখে রাজা তা হাতে ধ'রে সচিবদের বললেন, সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, আমার দুঃখ বা ভয় নেই; শৃঙ্গীর বাক্য সত্য হোক, এই কীট তক্ষক হয়ে আমাকে দংশন করুক। এই বলে তিনি নিজের কন্ঠদেশে সেই কীট রেখে হাসতে লাগলেন। তখন কীটরুপী তক্ষক নিজ মূর্তি ধারণ করে রাজাকে বেষ্টন করলে এবং স্বগর্জনে তাঁকে দংশন করলেন। মন্ত্রীরা ভয়ে পালিয়ে গেলেন। তারপর তাঁরা দেখলেন, পদ্মবর্ণ তক্ষক আকাশে যেন সীমান্ত রেখা বিস্তার করে চলছে। বিষের অনলে রাজার গৃহ আলোকিত হ' ল, তিনি বজ্রহতের ন্যায় পড়ে গেলেন।


                   পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর রাজপুরোহিত ও মন্ত্রীরা পরলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে তাঁর শিশুপুত্র জনমেজয়কে রাজা করলেন। যথাকালে কাশীরাজ সুবর্ণ-বর্মার কন্যা বপুষ্টমার সঙ্গে জনমেজয়ের বিবাহ হল। তিনি অন্য নারীর প্রতি মন দিতেন না, পতিব্রতা রুপব্রতী বপুষ্টমার সঙ্গে মহানন্দে কালযাপন করতে লাগলেন।


বিঃদ্রঃ- আগামী শুক্রবার রামায়ণ ধারাবাহিক দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে।


ॐ সর্বেসাং মঙ্গলং ভবতুঃ সর্বে সন্তু্ নিরাময়াহা।

সর্বে ভদ্রানি নিপশসন্তু্  মা কশ্চিত দুঃখ ভাগভবেৎ।।


                              ॐ জয় মা ॐ

       ॐ জয়গুরু অদ্বৈতানন্দ ॐ জয়গুরু পূর্ণানন্দ

Post a Comment

0 Comments