রামায়ণ কথা (ধারাবাহিক- প্রথম পর্ব)

 রামায়ণ কথা (ধারাবাহিক- প্রথম পর্ব)



ভুমিকা 

রামায়ণ প্রাচীন ভারতীয় সূর্যবংশীয় রাজাদের কাহিনী অবলম্বনে মহর্ষি বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য। অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্রের জীবন-কাহিনী এর মুখ্য বিষয়। কাব্যটি সপ্তকান্ড বা সাত খন্ডে বিভক্ত এবং প্রতিটি কান্ডের বিবরণ গুলি হলো, যেমনঃ-

 সূচীপত্র

# আদিকান্ডে রামের জন্ম ও বাল্যজীবন

# অযোধ্যাকান্ডে অযোধ্যা থেকে রামের নির্বাসন

# অরণ্যকান্ডে রাম-লক্ষ্মণ-সীতার বনবাস ও রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ

# কিষ্কিন্ধ্যাকান্ডে বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে রামের মিত্রতা

# সুন্দরকান্ডে রামের সসৈন্যে লঙ্কা গমন

# লঙ্কাকান্ডে রাম-রাবণের যুদ্ধ, যুদ্ধে রাবণের পরাজয় ও সবংশে মৃত্যু, রাম কর্তৃক সীতা উদ্ধার ও রাবণভ্রাতা বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করে সদলে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন এবং

# উত্তরকান্ডে রামচন্দ্র কর্তৃক সীতাবিসর্জন, লব-কুশের জন্ম, রাম-সীতার পুনর্মিলন এবং মৃত্যু এ বিষয়গুলি বর্ণিত হয়েছে।

# এর সঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক ঘটনাবলি। এই সপ্তকান্ডের প্রতিটি আবার একাধিক সর্গ বা অধ্যায়ে বিভক্ত।


নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্।
দেবীং সরস্বতীঞ্চৈব ততোজয়মুদীরয়েৎ।।

ভয়হর মঙ্গল দশরথ রাম।
জয় জয় মঙ্গল সীতা রাম।।
মঙ্গলকর জয় মঙ্গল রাম।
সঙ্গতশুভবিভবোদয় রাম।।
আনন্দামৃতবর্ষক রাম।
আশ্রিতবৎসল জয় জয় রাম।।
রঘুপতি রাঘব রাজা রাম।
পতিতপাবন সীতা রাম।। (সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী)

 মূল পর্ব (আদিকান্ড) 

প্রথম সর্গ

ভারতবর্ষের উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক পাহাড়ে ঘেরা সুন্দর বন ছিলো। সেই বনে রত্নাকর নামক এক ডাকাত বাস করতো। ব্রাহ্মণ সন্তান চবনের পুত্র হয়েও তিনি ডাকাতি করে পরিবার পালন করতেন। সেই বনে যে যেতো রত্নাকর তাকে হত্যা করে তার সর্বস্ব লুট করতেন। এমনই নিষ্ঠুর ছিলো সেই ডাকাত। সেই সময় ছিলো ত্রেতা যুগের শেষ পর্যায়। একদিন ব্রহ্মা ও নারদ মুনি দুই সন্ন্যাসীর ছদ্দবেশে সেই বনে এসেছিলেন। রত্নাকর তাদের দেখে হত্যা করতে উদ্যত হলে ছদ্দবেশী ব্রহ্মা বললেন- “ওহে রত্নাকর। তুমি এই রকম ভাবে তস্কর বৃত্তি করে কেন হত্যা করছ ? এতে তোমার বিপুল পাপ জমা হচ্ছে ।

রত্নাকর বললেন- “আমি এইভাবে আমার পরিবার পালন করি। যদি পাপ হয় তাহলে আমার পরিবারে সবার পাপ হবে।” ব্রহ্মা বললেন- “তাই যদি হয়, তবে এক কাজ করো। তুমি আমাদের রজ্জুতে আবদ্ধ করে তারপর পরিবারের কাছে শুনে এসো যে তাহারা তোমার পাপের ভাগ গ্রহণ করবেন কিনা?”

রত্নাকর ছদ্দেবশী নারদ ও ব্রহ্মা কে দড়ি দিয়ে বেধে পরিবারের কাছে শুনতে গেলো। বৃদ্ধ চবন বলল- “তুমি যখন ছোটো ছিলে আমি তোমাকে খাইয়েছি। পিতামাতা বয়স্ক হলে তাদের দেখার দায়িত্ব সন্তানের। আমি তোমার পাপের ভাগ কেন নেবো?” চবনের পত্নী তথা রত্নাকরের মা এক কথাই বলল। তখন রত্নাকর নিজ স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলে স্ত্রী বলল- “বিবাহের পর কন্যার সমস্ত দায়িত্ব স্বামীর হয়। আপনি অগ্নি সাক্ষী রেখে আমাকে বিবাহ করেছেন। আমার ভরণ পোষণের দায়িত্ব এখন আপনার। আমি কেন আপনার পাপের ভাগ নেবো?

শুনে রত্নাকর কাঁদতে কাঁদতে এসে আবদ্ধ মুক্ত করে ছদ্দবেশী ব্রহ্মা ও নারদের চরণে পড়ে বলল- “হে ঠাকুর। আমি নরাধম। বহু ঘৃনিত পাপ করেছি। আমার পাপের ভাগ কেউ নেবে না।” ব্রহ্মা ও নারদ মুনি তখন স্বরূপে এসে বললেন- “হে রত্নাকর। পাপ করলে প্রায়শ্চিত্তের বিধান আছে। তোমাকে দিয়ে আগামী দিনে একটি মহৎ কাজ হবে। তুমি পবিত্র চিত্তে এখন তপস্যা করে প্রায়শ্চিত্ত করো। তুমি ‘রাম’ নাম জপ করো। আমি তোমাকে রাম মন্ত্রে দীক্ষা প্রদান করিব।

রত্নাকর পুষ্করিণীতে স্নান করতে গেলে পুষ্করিণী শুকিয়ে গেলো। তখন ব্রহ্মা কমণ্ডলুর বারি সেচন করলেন রত্নাকরের মস্তকে। কিন্তু পাপী রত্নাকরের মুখে পবিত্র ‘রাম’ নাম আসলো না। ব্রহ্মা তাকে ‘রাম’ শব্দের উল্টো ‘মরা’ নাম জপ করতে বললেন।

রত্নাকর ‘মরা’ শব্দ করতে করতে ‘রাম’ নাম উচ্চারনে এনে বহু বছর তপস্যা করলো। তপস্যার সময় উই পোকার ঢিপি হয়ে গেলো তার উপরে । ব্রহ্মা দর্শন দিলেন। বললেন- “তুমি রাম কথা লেখবে। ভগবান শ্রী বিষ্ণু অযোধ্যায় নর অবতার নেবেন। তাঁর জীবনি লেখবে তুমি। তুমি আমার কৃপায় দিব্যদৃষ্টি ও ভবিষ্যৎ দেখতে সমর্থ হবে। বল্মীকের ভেতর তপস্যা করেছিলে তাই তুমি জগতে মহর্ষি বাল্মিকী নামে খ্যাত হবে। তোমার জিহ্বাতে সরস্বতী দেবী অবস্থান করবেন।

এই ভাবে মহাডাকাত রত্নাকর হলেন দিব্যজ্ঞানী মহর্ষি বাল্মিকী। অপরদিকে একদিন দেবর্ষি নারদ মুনি বৈকুণ্ঠে গিয়ে দেখলেন শ্রী নারায়ন নিজেকে চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। মূল স্বরূপে তিনি নব দূর্বাদল বর্ণ ধারন করেছেন। চতুর্ভুজা দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া কমলা দেবী দ্বিভুজা হয়ে নারায়নের বামে অবস্থান করছেন। নারদ মুনি এমন রূপের কারণ জানতে চাইলে শ্রীহরি জানালেন- তিনি এই রূপে মর্তে অবতার গ্রহণ করতে চলেছেন।”


দ্বিতীয় সর্গ

মহর্ষি বাল্মিকীর কণ্ঠে দেবী সরস্বতী নিবাস করলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না কিভাবে রামায়ন রচনা করবেন। কারন কবিতা লেখতে ছন্দ, অলংকার এর প্রয়োজন হয়। যেগুলো না থাকলে কাব্যাকারে রচিত রামায়ন শ্রুতি মধুর হবে না। একদিনের কথা। মহর্ষি নদীতে আহ্নিক করতে গিয়েছেন। ফুলে ফলে শোভিত বন মাঝে কুলকুল রবে প্রবাহিত হচ্ছিল্ল নদী, আর মুনি সেই নদীর মধ্যে অর্ধ নিমজ্জিত অবস্থায় ধ্যান করছেন। নদী তটে একটি পুরুষ বক ও একটি নারী বক ঘুরছিলো। সেই জোড়া বক প্রেম বিনিময় করে মৈথুনে নিমগ্ন হয়েছিলো। সেসময় এক ব্যধ এসে বাণ মেরে যুগলের একটি বক কে বধ করে। অপর বকটি এই দেখে শোকে মাথা ঠুকে মারা যায়। মুনি এই দেখে ব্যাধকে শাপ দিয়ে বলেন-

“বিনা কারণে হিংসা কর তুমি পক্ষী জাতি।
এই পাপে নরকেতে হৈবে তোমার স্থিতি।।”

মুনি বাল্মিকী শাপ দেবার পর ভাবতে লাগলেন, আরে এই তো ছন্দাকারে শাপ বাক্য তাঁর মুখ হতে নিঃসৃত হয়েছে। “জাতি” ‘তি’ আর “স্থিতি”র ‘তি’- পদের অন্তে অন্তে মিল আছে, এটাই তো ছন্দ। এরপর মুনি বাল্মিকী “রামায়ন” গ্রন্থ রচনা করতে বসলেন।

অপরদিকে ত্রেতা যুগের শেষে রাক্ষস শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছিলো। “রাক্ষস” বলতে কেউ কেউ অনার্য বুঝিয়েছেন। মানে যারা ‘আর্য’ ভাব সংস্কৃতি নেয় নি বা এদের তামসিক শক্তি বলা যেতে পারে। অখাদ্য, কুখাদ্য এমনকি নর মাংস আহার করতো।
(কৃত্তিবাসী রামায়নে এমনই লেখা)

মালী, সুমালি, মাল্যবাণ নামক তিন রাক্ষস, প্রজাপতি ব্রহ্মার তপস্যা করে প্রজাপতি কে সন্তুষ্ট করে দক্ষিণের ভারত মহাসাগড়ের মধ্যে দ্বীপে বিশ্বকর্মা কে দিয়ে লঙ্কা নগরী স্থাপন করে রাজত্ব করতে লাগলেন। এই রাক্ষস দের আশা তবুও মিটলো না। দক্ষিণ ভারত থেকে ‘আর্য’ সংস্কৃতি বিনষ্ট করে মুনি ঋষি দের তাড়িয়ে দিলো, দক্ষিণ ভাগ হোলো রাক্ষস দের আক্রমণের জায়গা। সেসময় তেমন শক্তিশালী নৃপতি ছিলো না যে কিনা দক্ষিণ ভাগ রাক্ষস আতঙ্কমুক্ত করতে পারে।

এই রাক্ষসদের সাহস এত বৃদ্ধি পেলো যে স্বর্গ রাজ্য আক্রমণ করার পরিকল্পনা নিলো। দেবতারা এই জেনে নারদ মুনিকে শান্তিদূত রূপে পাঠালেন। কারণ ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত রাক্ষস দের বিনাশের শক্তি ইন্দ্রের ছিলো না। নারদ মুনি এসে মালী, সুমালি, মাল্যবাণ কে জানালো- “আপনারা যদি স্বর্গ আক্রমণ করেন, তবে দেবতারা শ্রী হরির সহায়তা নেবেন।” রাক্ষসেরা জানালো- “শ্রী হরি যুদ্ধে আসুন। আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি যেনো যুদ্ধে সুদর্শন প্রয়োগ না করেন। এটা যুদ্ধের শর্ত।”

দেবতাদের আক্রমণ করলো রাক্ষসেরা। যুদ্ধ চলতে লাগলো। রাক্ষসেরা মায়াবিদ্যার সাহায্য নিলে শ্রী হরি গরুড়ে আসীন হয়ে যুদ্ধে আসলেন। ভগবান নারায়ন বিপুল বেগে অস্ত্র চালনা করে রাক্ষসদের বধ করতে লাগলেন। এই দেখে দেবতারা আনন্দে জয়ধ্বনি দিলেন।

রাক্ষস দের বারবার মায়াবিদ্যা করতে দেখে ভগবান নারায়ন সুদর্শন চালনা করলে রাক্ষসেরা বলতে লাগলো- “হে নারায়ন। আপনি যুদ্ধের শর্ত ভঙ্গ করছেন। এই যুদ্ধে শর্ত দিয়েছিলাম আপনি সুদর্শন ধারন করতে পারবেন না।” সকল রাক্ষসেরা নারায়ন কে চক্র ফিরিয়ে নিতে বললে রাক্ষস মালী বললেন- “হে জনার্দন, হে মাধব, আপনার নাম স্মরণেই মহা অপবিত্র মানবও পবিত্র হয়। হে লক্ষ্মীপতি যুদ্ধে আপনার হাতে নিহত হলে আমি অবশ্যই আপনার শাশ্বত ধাম প্রাপ্ত করবো, এই রাক্ষস জন্ম থেকে মুক্তি পাবো।

হে দয়ানিধান দর্পহারী নারায়ন, আপনি সুদর্শন দ্বারা আমাকে মুক্তি প্রদান করুন।” মালীর প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে নারায়ন বললেন- “তথাস্তু।” এরপর ভগবান নারায়ণের সুদর্শন চক্র তীব্র গর্জনে ঘুরতে ঘুরতে কোটি সূর্যের দীপ্তির ন্যায় হয়ে মালীর মুণ্ডচ্ছেদ করলো। বাকী রাক্ষসেরা সুমালী, মাল্যবানের সাথে পাতালে প্রবেশ করলো।

জয় জয় নারায়ন নারায়ন হরি হরি।
তেরি লীলা হে ন্যায়ারী ন্যায়ারী।।
জয় জয় নারায়ন নারায়ণ হরি হরি।
স্বামী নারায়ণ নারায়ণ হরি।।
জয় নারায়ণ হরি হরি।
শ্রীমান নারায়ণ হরি হরি।।

তৃতীয় সর্গ

এবার রামায়ন কাব্যের প্রধান অশুভ চরিত্রের বর্ণনা করা যাক। ভগবান বিষ্ণুর কাছে পরাজিত হয়ে রাক্ষসেরা পাতালে পালিয়েছিলো। এই মুহূর্তে লঙ্কা ছিলো খালি। ব্রহ্মার বংশজ পুলস্ত্য ঋষির বংশধর মহর্ষি বিশ্বশ্রবা মুনির বিবাহ হয়েছিলো ভরদ্বাজ কন্যা লতার সাথে। তাঁহাদের পুত্র কুবের যক্ষদের নিয়ে লঙ্কাতে বাস করতে থাকলেন।

পাতালে থাকা মাল্যবান ও সুমালী মনের মধ্যে লঙ্কা ফিরে পাবার আশাকে জিইয়ে রাখলো। গণনা করে দেখলো মহর্ষি বিশ্বশ্রবার সাথে মাল্যবানের কন্যা কেকসীর বিবাহ হলে তাঁদের এক বলশালী পুত্র হবে। সে রাক্ষসদের হৃত গৌরব মর্যাদা ফিরিয়ে আনবে। প্রাচীন ভারতে আর্য অনার্য বিবাহ হতো। পরম রূপসী রাক্ষসী কেকসী, বিশ্বশ্রবাকে মায়াতে ফেলে তাকে বিবাহ করে। মুনি বিশ্বশ্রবা সন্ধ্যাকালে স্ত্রীসঙ্গ করে। এমন বলা হয় সন্ধ্যায় স্ত্রীসঙ্গ করলে ভূমিষ্ঠ সন্তান রাক্ষস হয়।

সেজন্য হিন্দু ধর্মে সন্ধ্যাকালে কেশ বিন্যাস, তৈল মর্দন, মৈথুন, আহার, নিদ্রা, মলিন বস্ত্র পরিধান করতে নিষেধ আছে। এই সময় সন্ধ্যা আরতি, বীজ মন্ত্র জপ, তুলসী বৃক্ষে প্রদীপ নিবেদনের প্রথা আছে। কেকসীর যখন প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হোলো তখন আকাশে বিনা মেঘে বজ্রপাত, রক্ত বৃষ্টি, চিল শকুনের রব, শেয়াল গর্দভ এর কান্না, নানা রকম অশুভ চিহ্ন ইত্যাদি হলো। জন্মে সেই শিশু এমন রব করলো যে চতুর্দিক কম্পিত হতে লাগলো। দারুন রব করবার জন্য তার নাম হোলো রাবণ।

এরপর কেকসি এর একটি শক্তিশালী পুত্রের জন্ম দেন, তার নাম কুম্ভকর্ণ। তার পড়ে শুভ লগ্নে যখন নানা শুভ চিহ্ন দেখা গেলো তখন কেকসির গর্ভ হতে একটি শিশু প্রসব হোলো, তাঁর নাম বিভীষণ। এরপর পুনঃ অশুভ লগ্নে কেকসি একটি কন্যার জন্ম দেন, তাঁর নাম শূর্পনাখা। রাবণ প্রথম জীবনে পিতার নিকট বেদাদি শাস্ত্র পাঠ, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, সঙ্গীত শাস্ত্র ইত্যাদি রপ্ত করেছিলো, কিন্তু মাতৃকূল থেকে রাক্ষস সংস্কৃতি লাভ করলো। লঙ্কায় গিয়ে কুবেরকে তাড়িয়ে কুবের এর সব সম্পদ হস্তগত করলো।

এমনকি পুস্পক বিমান অবধি। কুবের কৈলাসে আশ্রয় নিলেন যক্ষদের সহিত। পুনঃ লঙ্কায় রাক্ষস দের আধিপত্য কায়েম হোলো। রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, শূর্পনাখা কঠিন তপস্যা করে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করলো। ব্রহ্মার কাছে রাবণ অমর হবার বর চাইলে ব্রহ্মা দিলেন না। তিনি রাবনের পেটে অমৃত কুম্ভ স্থাপন করে বললেন- “হে রাবণ! যতকাল তোমার উদরে অমৃত কুম্ভ পূর্ণ থাকবে, তোমার মরণ হবে না। তুমি কেবল নর বানরের হাতে মরবে। আজ হতে তুমি আমার বরে নয়'টি মস্তক প্রাপ্ত করবে মোট ১০টি মস্তক হবে তোমার। তোমার নাম হবে দশগ্রীব, দশানন।” কুম্ভকর্ণ বর চাইতে গেলে দেবতারা দেখলেন এই শক্তিশালী কুম্ভকর্ণ যদি আরোও শক্তি পায় তো ত্রিলোক ধ্বংস করবে। দেবতারা দেবী সরস্বতীর শরণাপন্ন হলেন। দেবী সরস্বতী অভয় দিয়ে কুম্ভকর্ণের জিহ্বায় অধিষ্ঠান করলেন।

সরস্বতী প্রভাবে কুম্ভকর্ণ বর চাইলেন – “হে প্রজাপতি, তপস্যা করে আমি ক্লান্ত; আমাকে বর দিন। ব্রহ্মা বললেন, ঠিক আছে পুত্র চাও! কি বর চাইবে? অতঃপর কুম্ভকর্ণ ইন্দ্রাসন চাইতে গিয়ে সরস্বতীর প্রভাবে নিদ্রাসন চেয়ে বসে, ব্রহ্মা বললেন- “তথাস্তু। ব্রহ্মাদেব আরো বললেন, পুত্র তুমি ছ'মাস ঘুমাবে আর একদিন মাত্র জাগবে।” কিন্তু অকালে তোমার নিদ্রাভঙ্গ করলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত।” বিভীষণ কিছুই চাইলো না। ব্রহ্মা বললেন- “বিভীষণ তুমি উদার, সাত্ত্বিক। তোমাকে ইচ্ছা মৃত্যুর বর দিলাম।

শূর্পনাখাকে বর দিলেন- “মায়া বিদ্যায় পারঙ্গদা হবার।” ব্রহ্মার বর পেয়ে রাবণ ত্রিলোক বিজেতা রূপে যুদ্ধে জয়ী হলো। শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতে রাক্ষসদের তীব্র উৎপীড়ন শুরু হলো। ময় দানবের রাজ্য আক্রমণ করে রাবন ময় দানবের কন্যা মন্দাদোরী কে বিবাহ করলো। যদিও রাবন একাধিক বিয়ে করেছিলো।

কুম্ভকর্ণের বিবাহ হয়েছিলো ত্রিশালা নামক এক রাক্ষসী কন্যার সাথে, বিভীষণ ধর্মমতী সরমা নামক এক গন্ধর্ব কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। শূর্পনাখার সাথে এক রাক্ষসের ভালোবাসা হয়েছিলো, তারা পালিয়ে বিবাহ করেছিলো। কারন সেই রাক্ষস রাবণের সমকক্ষ ছিলো না, ফলে উভয়ের প্রকাশ্যে বিবাহ হবার কোনো সুযোগ ছিলো না। এরপর রাবণ তাঁদের খুজে বোনের স্বামীকে হত্যা করে। শূর্পনাখা প্রতিশোধের বীজ বুকে নিয়ে বিধবা হয়ে লঙ্কায় থাকতে লাগলো।


চতুর্থ সর্গ

ভগবান ভক্তের প্রদত্ত যেমন পূজা, নৈবদ্য সানন্দে গ্রহণ করেন, তেমনি ভক্ত রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দিলে ভগবান সানন্দে তা মাথা পেতে গ্রহণ করেন। ভগবান শ্রী হরির পরম ভক্ত নারদ মুনির কথা শোনা যাক। একবার নারদ মুনি হিমালয়ে কঠিন যোগ সাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন। অবিরত তুষারপাতেও তাঁর সেই সাধনা ভঙ্গ হয়নি। দেবতারা এসে তাকে আহ্বান করলেও তিনি যোগ সাধনা ভঙ্গ করেননি।

ইন্দ্রদেবতা তখন মদন দেব ও রতি দেবীর শরণাপন্ন হলেন। মদন দেবতা হিমালয়ে সেই তুষারাছন্ন পরিবেশে বসন্ত সৃষ্টি করে নারদ মুনিকে কামবাণ নিক্ষেপ করে বিদ্ধ করলেন। কিন্তু মদনের বাণ উপেক্ষা করেই নারদের যোগ সাধনা চলতে লাগলো। অবশেষে একদিন নারদের যোগা সমাপ্ত হোলো। নারদ মুনি নিজেকে শিবতুল্য জ্ঞান করলেন, যেহেতু কাম বাণে দেবাদিদেবের মনে কাম জাগেনি, সেইরূপ নারদের ওপর কামবাণ ব্যর্থ হয়েছে- সেইহেতু নারদ মুনি নিজেকে শিবতুল্য জাহির করলেন।

নারদের এরূপ অহংকার দেখে প্রজাপতি ব্রহ্মা চিন্তায় পড়ে বৈকুণ্ঠে গেলেন। ভগবান নারায়ণকে অনুরোধ জানালেন নারদের দর্প চূর্ণ করতে। ভগবান নারায়ণ একটি অদ্ভুত লীলা করলেন। যোগমায়া শক্তি অবলম্বন করে একটি মায়াপুরী নির্মাণ করলেন। তথায় সমুদ্র রাজা রত্নাকর কে রাজা বানিয়ে বসালেন। লক্ষ্মী দেবীর অংশ রূপিনী এক সুন্দরী সুশীলা কন্যা সেই রাজ্যের রাজকণ্যা হয়ে নিবাস করতে লাগলেন। বিষ্ণু মায়াতে সেখানে প্রজাদি ঘর গৃহ নির্মিত হল। একদা নারদ মুনি ভ্রমণ করতে করতে সেই রাজ্যে উপস্থিত হলেন। তথায় তিনি রাজকণ্যাকে দেখে মোহিত হয়ে ভাবেন এই রাজকন্যাকেই বিবাহ করবেন। রাজকন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন- “হে কন্যে তুমি কেমন পতি আশা কর?” কন্যা বললেন- “আমি হরি সদৃশ পুরুষ কেই পতি রূপে গ্রহণ করবো।

” নারদ মুনি ছদ্দবেশী রত্নাকর কে জানালেন শীঘ্র মেয়ের স্বয়ম্বর আয়োজন করতে। এই বলে নারদ মুনি বৈকুণ্ঠে গিয়ে নারায়ণকে বললেন- “প্রভু আমাকে হরি মুখ করে দিন।” হরি শব্দের এক অর্থ বানর, যেহেতু বানর সুযোগ পেলেই হরণ করে। শ্রী নারায়ণ নারদ মুনিকে বানর মুখী করে দিলেন। নারদ মুনি আয়না তে নিজ মুখ না দেখেই স্বয়ম্বরের দিন সেই রাজ্যে গেলেন। তাকে দেখে সকলে হেসে লুটোপুটি খেতে লাগলো।

নারদ মুনি ধারনা করলেন তাঁর সুন্দর মুখ দেখে হয়তো সকলে হিংসা বশত হাস্য করছে। কন্যা বরমাল্য নিয়ে ঘুরতে লাগলো। মর্কটের মতো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নারদ মুনি তার আগে পিছে ঘুরতে লাগলো। কিন্তু কন্যা কিছুতেই তাকে বরমালা দিলেন না। হঠাৎ সভা মাঝে শ্রী নারায়ণ আবির্ভূত হলেন। কন্যা শ্রী নারায়নের কণ্ঠে মাল্য দিলেন। এই দেখে নারদ মুনি রেগে নদীর ধারে চলে গেলো।

জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বৈকুণ্ঠে গিয়ে বলল- “প্রভু আপনি আমাকে ছলনা করলেন?” নারায়ণ বললেন- “দেবর্ষি তুমি হরি মুখ চেয়েছিলে, হরি শব্দের এক অর্থ বাঁদর, তুমিতো বলনি যে আমার মতোন মুখাবয়ব প্রদান করতে।” নারদ মুনি বললেন- “হে প্রভু। আপনি আমাকে যে ছলনা করলেন তার শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে। আমি আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি যেমন আমি সেই রাজকণ্যাকে হারালাম, আপনিও আগামী অবতারে বারংবার স্ত্রী বিচ্ছেদের কষ্ট পাবেন।”

নারদের অভিশাপ বাক্য মাথা পেতে নিলেন নারায়ণ। তখন ব্রহ্মা প্রকট হয়ে বললেন- “পুত্র তোমার গর্ব চূর্ণ করবার জন্যই এই লীলা রচনা হয়েছে। সেই কণ্যা স্বয়ং দেবী লক্ষ্মী। আর সেই রাজা লক্ষ্মী দেবীর পিতা রত্নাকর। তুমি ব্রহ্মচারী, তোমার মনে এইহেন চিন্তা কিভাবে আসে? কিভাবে তুমি নিজেকে শিবতুল্য মনে কর?

নারদ মুনির দর্প চূর্ণ হল। তিনি বুঝলেন তিনি মহাপাপ করেছেন। বারংবার নারায়নের চরণে ক্ষমা প্রার্থনা চাইলেন। শ্রীনারায়ন জানালেন , “ভক্তের অভিশাপ অসত্য হবে না। তোমার অভিশাপে বারংবার আমার আর লক্ষ্মী দেবীর বিচ্ছেদ ঘটবেই।” অপরদিকে রাবনের দিগ্বিজয় বেড়ে চলল। যক্ষ, নাগ, গন্ধর্ব, কিন্নর, অসুর, দেবতা, মানব ইত্যাদিরা রাবণের বশ্যতা স্বীকার করলো। কিন্তু সে যখন পাতালপুরী অসুর রাজ বলির রাজ্য আক্রমণ করলো- তখন তার আর রক্ষা থাকলো না। বলির সাথে যুদ্ধে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হলো। বলি রাবণকে বন্দী বানিয়ে কারাগারে আটকে রাখলো। শেষে মহর্ষি পুলস্ত্য এসে বলিকে অনুরোধ জানিয়ে রাবণ কে মুক্তি করলো।


পঞ্চম সর্গ

ইক্ষাকু ক্ষত্রিয় কূলে ভগবান শ্রীরাম আবির্ভূত হয়েছিলেন। ইক্ষাকু কূলের মহান দাতা রাজা হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান রামায়নে আছে। ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র মুনির ফুলে ফলে শোভিত বাগানে প্রত্যহ স্বর্গ থেকে দেবকন্যারা এসে ফুল, ফল নিয়ে যেতো। বিশ্বামিত্র মুনি, তাঁর শিষ্যদের চৌকিদারীতে রেখেও সুফল পেলেন না, দেবতাদের মায়ায় শিষ্যরা নিদ্রামগ্ন হতেই দেবকন্যারা ফুল, ফল নিয়ে গেলো।

একদিন মুনি বিশ্বামিত্র তপঃ তেজে নিজে এক মায়া রচলেন। যেই মায়াতে দেবকন্যারা ফুল নিতে আসলে লতাপাতার বেস্টনীতে জড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলো। রাজা হরিশ্চন্দ্র সেখান দিয়ে যাবার সময়, সেই দেবকন্যাদের মুক্ত করলেন। বিশ্বামিত্র মুনি যোগবলে সব জেনে ক্ষিপ্ত হয়ে রাজা হরিশ্চন্দ্রকে বললেন- “হে সম্রাট। তুমি কেন সেই দেবকন্যাদের মুক্তি করেছো?

রাজা বললেন- “হে মহর্ষি সেই দেবকন্যারা আমার নিকট মুক্তি ভিক্ষা চেয়েছিলো। আমি দাতাকে তাঁর ইস্পিত সম্পদ দান করি। ইহা আমার জীবনের প্রতিজ্ঞা।” বিশ্বামিত্র শুনে বললেন- “তাই যদি হয়, তবে তুমি তোমার রাজ্য সম্পদ এখুনি আমাকে দান করে এক বস্ত্রে বিদায় হও। আমি তোমার কাছে তোমার রাজ্য দান চাইছি। ” রাজা হরিশ্চন্দ্র তাই দান করে এক বস্ত্রে বেরিয়ে গেলেন। সাথে থাকলো মহারানী শৈব্যা, পুত্র রোহিতাশ্ব।

রাজা সসাগড়া রাজ্য মুনিকে দান করেছেন, তাই পৃথিবীতে আর কোথাও যাওয়া যাবে না। কিন্তু কাশীধাম কোনো রাজার রাজত্বে নয়। কাশীধাম ভগবান শিবের ত্রিশূলে অবস্থিত। এই স্থানের রাজা ভগবান শিব। রাজা হরিশ্চন্দ্র স্ত্রী, পুত্র নিয়ে কাশীধামে আসতেই বিশ্বামিত্র পুনঃ এসে বলল- “রাজা দান তো দিলে, কিন্তু দক্ষিণা কই?

রাজা হরিশ্চন্দ্র তখন নিজ স্ত্রী শৈব্যা আর পুত্র রোহিতাশ্ব কে কাজের ঝি হিসাবে বিক্রি করে দিলেন। নিজেও চণ্ডালের কাছে বিক্রিত হয়ে মহর্ষি বিশ্বামিত্র কে দান দিলেন। তবুও মুখের প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গলেন না। মহারানী শৈব্যা আর রাজপুত্র রোহিতাশ্ব ঝিগিরি করে বহু কষ্টে দিন যাপন করতে লাগলো। অপরদিকে হরিশ্চন্দ্র কাশীর শ্মশানে ডোম হয়ে জীবন কাটাতে লাগলেন। একদিনের কথা, রোহিতাশ্বকে সর্পে দংশন করলো। ছটফট করতে করতে মায়ের কোলেই মারা গেলো। রানী শৈব্যা কাশীর শ্মশানে পুত্রকে দাহ করতে গেলেন। অন্ধকার রাত্রিতে সেখানে ডোম রূপে হরিশ্চন্দ্রের দেখা পেলেও একে অপরকে চিনলো না। শৈব্যা তখন ডোম হরিশ্চন্দ্রকে দাহ করতে বললে, হরিশ্চন্দ্র বলল- “মূল্য ছাড়া দাহ হবে না। এ আমাদের সর্দারের আদেশ। যাও মূল্য নিয়ে এসো।” শৈব্যা কাঁদতে কাঁদতে জানালো- মূল্য নেই। সে নিজেই পড়ের বাড়ীর ঝি। অবশেষে শৈব্যা নিজের মলিন ছিন্ন বস্ত্র থেকে সামান্য বস্ত্র ছিড়ে হরিশ্চন্দ্র কে দিয়ে বলল- “এই নিন, আমার কাছে আর কিছুই নেই।”

রাজা হরিশ্চন্দ্র চিতা সাজিয়ে মৃত রোহিতাশ্বকে রেখে মশাল আনতে গেলো। মশাল নিয়ে এসে চিতায় শায়িত নিজ পুত্রকে দেখে ক্রন্দন করতে লাগলেন। শৈব্যা আর হরিশ্চন্দ্রের মিলন হলো। মৃত পুত্রকে জড়িয়ে হরিশ্চন্দ্র আর শৈব্যা খুব কাঁদলেন। তারপর হরিশ্চন্দ্র তিনটে চিতা সাজালেন, ঠিক করলেন পুত্রের চিতায় আগুন দিয়ে তারাও চিতাতে উঠে অগ্নিতে নিজেদের ভস্ম করবেন। ঠিক এই সময় শ্মশান আলো করে কাশীর রাজা ভগবান শিব ও কাশীর রাণী মাতা গৌরী আবির্ভূত হলেন!

"ভগবান শিব মহারাজ হরিশ্চন্দ্র আর রানী শৈব্যার প্রশংসা করে রোহিতাশ্বকে প্রাণদান করলেন।" রোহিতাশ্ব তার পিতামাতাকে ফিরে পেলো। অপরদিকে মহর্ষি বিশ্বামিত্র মুনি সেখানে উপস্থিত হলেন।

বিশ্বামিত্র মুনি বললেন- “হে রাজন। আমি তোমার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। তুমি সত্যি মহান দাতা। সত্যবাদীর সাক্ষাৎ রূপ। যাও তোমাকে তোমার রাজ্য ফিরিয়ে দিলাম। আজ থেকে তুমি সত্যবাদী রাজা হরিশ্চন্দ্র রূপে খ্যাত হবে।” রাজা হরিশ্চন্দ্র তখন রানী শৈব্যা ও রোহিতাশ্বকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরলেন। রাজা আবার রাজাসনে বসলেন। মহারানী শৈব্যা পুত্র রোহিতাশ্বকে ক্রোড়ে নিয়ে রাজার বামে বসলেন। ত্রিলোকে রাজার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো ।

Post a Comment

0 Comments