#সুপ্রভাত 


🐍🐍"কালীয় নাগের পুর্বজন্ম কথা"🐍🐍

-

"মহারাজ পরীক্ষিত সুকদেব গোস্বামীর পদতলে বসে বলছেন, "হে মুনিবর! কালীয় নাগ এমন কি পূণ্য করলো, যার ফলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম চিহ্ন তার মাথায় চিহ্নিত হয়ে থাকলো। সে কথা বলুন মুনিবর।"

-

সুকদেব গোস্বামী বললেন, "শোনো পরীক্ষিত রাজন, কালীয় নাগের এ জন্মে কোনো পূণ্য নেই। যা ছিলো, তা পূর্বজন্মে। সেই পূর্বজন্মের কথা শোনো। উশী নগরে বিষদর্ব্বি নামে একজন.কৃষ্ণভক্ত রাজা ছিলেন। ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবদের তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু দৈবের ঘটনা তো বলা যায় না। এমনই একটি দৈব ঘটনা ঘটলো।

-

রাজার ছিলো একটি পূষ্প উদ্যান। সে উদ্যান থেকে মালীগণ পূষ্প তুলতো। সেই উদ্যানের কোনো স্থানে একজন ব্যধিগ্রস্থ ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব বাস করতো। তার হাত পা সবকিছূ পচে গিয়ে খসে পড়ছিলো। রক্ত, পুঁজ পড়ছিলো। শরীরের বিভিন্ন স্থানে কৃমি বাস করতো। এমন দূর্গন্ধ যে, তার কাছে কেউ যেতে পারতো না।

-

একদিন দূত এসে রাজাকে বললো, 'মহারাজ, পুষ্পের উদ্যানে একজন ব্যাধিগ্রস্থ ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব, তার হাত পা পচে গিয়েছে। শরীর থেকে দূর্গন্ধ বের হচ্ছে। তার কাছে যাওয় যায় না। উদ্যান থেকে আপনার জন্য পূষ্প সংগ্রহ করতে সমস্যা হচ্ছে।'

-

তখন রাজা বললেন, 'ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবকে বলো, অন্য কোনস স্থানে যেতে। আর তিনি যদি যেতে না পারেন তা হলে তোমরা কোনো স্থানে তাকে রেখে এসো।'

-

রাজার আদেশ পেয়ে দূতগণ নাকে হাত দিয়ে ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবের নিকট গিয়ে বললো, 'শোনো ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব, রাজার আদেশ হয়েছে, তোমাকে অন্যত্র যেতে হবে।'

-

ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব বললো, 'আমি কি ভাবে যাবো। আমার তো যাওয়ার শক্তি নেই। আমার হাত পা পঁচন ধরেছে আমি কি ভাবে যাবো।'

-

তখন দূতগণ মনে মনে ভাবলো, রাজার আদেশ আছে যেতে না পারলে অন্য কোনো স্থানে রেখে আসতে। তাই দূতগণ ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবকে মাঠের একটি বৃক্ষমূলে রেখে এলো। বৈষ্ণবকে বাইরে রেখে আসার সাথে সাথে রাজাকে শূলব্যাধি আক্রান্ত করলস। রাজা মনে মনে ভাবে, বৈষ্ণব অপমানে শূলব্যাধি হয়নি, হয়েছে দৈবের কারণে। বৈদ্য ডেকে রাজার অনেক চিকিৎসা করানো হলো। কিন্তু কোনো কিছুতেই রাজার অসুখ ভালো হলো না। রাজা দিন দিন নিস্তেজ হয়ে পড়তে লাগলো।

-

বেদনায় কাতর হয়ে পড়ছে রাজা। অবশেষে একজন রোজা বা বৈদ্য এসে বললো, 'মহারাজ, আপনার এ অসুখ কোনো ঔষধে সারবে না। আপনাকে ঔষধের মধ্যে রাজহংসের মাংস চাই। তাহলে কেবল আপনি ভালো হবেন।'

-

রাজা তখন বলে, 'রাজহংস কোথায় পাই।'

-

বৈদ্য তখন বলে, 'মহারাজ ব্রহ্মার সরোবরে রাজহংস আছে। হংস বা হংসী যে কোনোটি হলেই চলবে। তা হলেই আপনি নিশ্চিত সুস্থ্য হবেন।'

-

রাজা বিষদর্ব্বি তখন দূতগণকে ডেকে সমস্ত ঘটনা বললো এবং যে কোনো প্রকারে হোক, রাজহংস বা হংসী যে এনে দেবে তাকে তিনি যথোপযুক্ত. পুরষ্কার দিবেন। বলে ঘোষণা করলো।  দ্যুতরা তখন ব্যাধদের এ কথা জানালে ব্যাধরা বললো, 'অবশ্যই আমরা রাজহংস রাজার জন্য আনবো।'

-

এ বলে ব্যাধরা ব্রহ্মার সরোবরে উপস্থিত হলো। ব্রহ্মার সরোবর যোড়শ যোজন দীর্ঘ যে ৬৪ কোশ লম্বা, এবং দ্বাদশ যোজন প্রস্থ বা ৪৮ কোশ প্রস্থ। সাদা, নীল, পীত ও রক্ত বর্ণ কমল ব্রহ্মার সরোবরের ফুটে আছে। মাঝখানে রাজহংস ও রাজহংসী আছে। ব্যাধগণ তাদের দেখে খুবই খুশি হলো। ব্যাধগণ রাজহংসদের ধরার জন্য আমিষ দ্রব্য মিশিয়ে ফাঁদ পেতে, এ ভাবে পাঁচ দিব বসে রইলো। কিন্তু কোনো হংস বা হংসী ফাঁদে ধরা দিলো না।

-

ব্যাধগণ হতাশ হয়ে নিকটস্থ লোকজনের নিকট হতে জানতে পারলো। এ দুই হংস-হংসী পদ্মের মৃনাল অথবা কোনো বৈষ্ণবের দ্রব্য দিলে তারা আহার করে। তখন ব্যাধগণ তাদের বস্ত্র ত্যাগ করে ফাঁদ তুলে বৈষ্ণবের বেশ ধারণ করে, সরোবরের তীরে দাড়িয়ে খাদ্যদ্রব্য লয়ে সযত্নে হংসী-হংসীদের ডাকতে আরম্ভ করলো। ডাক শুনে হংসগণ তীরের দিকে যেতে লাগলে, একটা হংসী বলে, 'কোথায় যাও প্রাননাথ?'

-

হংস বলে, 'ঐ দেখো বৈষ্ণব ডাকছে।'

-

হংসী তখন বলে, 'যেও না প্রাননাথ, এরা বৈষ্ণব নয়। মনে হয় এরা মায়াধারী ব্যাধ। পাঁচ দিন পূর্বে তারা এখানে ফাঁদ পেতে ছিলো। এখন কপট করে বৈষ্ণবের বেশ ধারণ করেছে। খাবার নাম করে আমাদের ধরবে।'

-

তখন হংস বললো, 'কপট হলেও বৈষ্ণবের বেশ। কাছে না গেলে অপমান হবে। যদি শ্রীকৃষ্ণের চরণ না পাই। যদি কৃষ্ণ চরণ সেবা হতে যদি বঞ্চিত হই। তাই আমি তার কাছে যাবো।'

-

এ কথা বলে হংস যেখানে কিরাতকুল অর্থাৎ ব্যাধ উচ্চস্বরে ডাকছে, সেখানে গেলো। ব্যাধগণ হাত পেতে খাদ্যদ্রব্য দেয় যেনো তারা কতো সুখে তাদের খাওয়াতে চাচ্ছে। মনের সুখে হংস আহার করতে লাগলো। সহসাই ব্যাধ বাম হাতে হংসের গলা ধরলো এবং মারতে উদ্যত হলো। তখন হংস বললো, 'কেনো তোমরা আমাকে মারছো।'

-

ব্যাধ বললো, 'উশি নগরের রাজার শূলব্যাধী হয়েছে। বৈদ্য এসে বললো রাজহংস রক্তমাংশে ঔষধ করে খাওয়ালে তবেই রাজা ভাল হবেন। তাই তোমাকে ধরে মেরে রাজার কাছে নিয়ে যাবো। অনেক ধন পাবো।'

-

তখন রাজহংস বলে, 'এখানে কেনো আমাকে প্রহার করে প্রান সংহার করবে? আমাকে রাজার নিকট লয়ে যাও। তিনি আমাকে যা করার করবেন।'

-

হংসের বচন শুনে ব্যাধগণ তাকে নৃপতির নিকট লয়ে গেলস। বহু ধনরত্ন দিযে ব্যাধকে বিদায় করে নৃপতি রাজহংসকে বধ করতে বললেন। তখন রাজহংস বলে, 'কিসের জন্য মহারাজ আপনি আমাকে বধ করবেন?'

-

মহারাজ বলে, 'তোমার রক্তমাংশ দ্বারা ঔষধ করে খেলে আমার শূলব্যাধী ভালো হয়ে যাবে।'

-

রাজহংস বলে, 'এর জন্য আপনি আমাকে হত্যা করবেন! আপনি ঔষধ খেলে ভালো হবেন না। আমি যা বলি তা আপনি শুনুন।'

-

তখন বিষদর্ব্বি রাজা বলে, কি দ্রব্য আমাকে আহার করতে হবে।'

-

হংস বলে, 'আপনাকে কোনো দ্রব্য আহার করতে হবে না। কেবল মাত্র ব্রাহ্মণ চরণোদক পান করলেই আপনি মুক্ত হবেন।'

-

রাজা ব্রাহ্মণের চরণোদক আনার জন্য দুতগণকে প্রেরণ করলেন। কিন্তু কোথাও ব্রাহ্মণের চনণোদক পেলো না। দূতগণ ফিরে এসে বললো, 'মহারাজ কোথাও ব্রাহ্মণের চরণোদক পাওয়া গেলো না। তবে উদ্যানে বৃক্ষমূলে একজন ব্যাধিগ্রস্থ বৈষ্ণব আছেন।“

-

সহসাই রাজহংস বললো, 'হোক বৈষ্ণব ব্যাধিগ্রস্থ, তার চরণোদকই নিয়ে এসো।

-

একজন দূত দ্রুত সেই ব্যাধিগ্রস্থ.বৈষ্ণবে কাছে উপনীত হয়ে, বললো, 'মহারাজ পাঠিয়েছেন। তিনি ব্যাধি গ্রস্থ আপনার পাদোদক দিতে বলেছেন। তাড়াতাড়ি আপনার পাদোদক দিন।'

-

বৈষ্ণব বললো, 'আমি পাদোদক কোথায় পাবো? আমার তো পায়ে কোনো আংগুল নেই।“ 

-

তখন দূত তার হাতে থাকা পাত্রটিতেই তার চরণ ডুবিয়ে দিলো। তাতে রক্ত, মাংশ, পূঁজ কীট পড়লো। সেই পাত্র থেকে রাজহংস আগে রক্ত, মাংস, পূঁজ সমেত জল পান করলো। পরে রাজাকে তা পান করার জন্য বললো। রাজা দেখে, পাত্রস্থিত জলে রক্ত, মাংস, পূঁজ ও কীট ভাসছে। তা দেখে রাজার মনে ঘৃনার উদ্রেক হলো। তিনি তখন বললে, 'আমি অন্দরে রানী সহ তা পান করবো।'

-

এ বলে রাজা অন্দরে প্রবেশ করে রানীকে বললে, 'রাজহংস এনেছি ঔষধ করে খেতে, সে বলে বৈষ্ণবে পাদোদক খেলে আমি মুক্ত হবো। কিন্তু সেই চরনামৃতে রক্ত, মাংশ, পূঁজ ও কিট ভাসছে। কেমনে তা আমি পান করবো! মনে ঘৃণার উদয় হচ্ছে। এখন তুমি বলো রানী আমি কি করবো।'

-

রানী বলে, 'আপনার যা মনে হয় তা করুন।'

-

রাজা তা না খেয়ে সেই বিপ্র পাদোদক শীরে ধারণ করা মাত্রই রাজার শূলব্যাধি চলে গেলো এবং দিব্য জ্ঞানের উদয় হলো। তখন কেঁদে কেঁদে রাজা রানীকে বলে, 

-

'করি যে অতি মন্দ।

 বুঝিলাম প্রবঞ্ছনা করেন গোবিন্দ।।'

-

রক্ত চরণামৃত এনেছি ভোজন করার জন্য কিন্তু মস্তুকে ধারণ করার ফলে শূলব্যাধি চলে গেলো। ভক্তিভরে যদি চরণামৃত খেতাম তাও হয়তো হরির কৃপায় ভালো হতাম। এখন বুঝলাম সেই রক্ত পূঁজ নয়, তা মায়া। আর এ ওই রাজহংস সামান্য নয়। পরম বৈষ্ণব।'

-

এ কথা বলে রাজা রাজহংসের সম্মুখে আসলো। রাজহংস ধ্যানেতে সবকিছু জানলো। রাজাকে বললো, 'ঘৃনায় চরণাদোক না খেয়ে তা আপনি.মস্তকে ধারণ করেছেন। তাই আপনাকে আমি শাপ দিবো। মহাখল সাপ হয়ে জন্ম হবে আপনার। বৈষ্ণবের চরণোদক শিরে ধারণ করেছেন, তাই শ্রীহরি পাদপদ্ম চিহ্ন মস্তকে ধারণ করবেন।'

-

এ কথা বলে রাজহংস উড়ে গেলো। রোগমুক্ত হয়ে রাজা কিছুদিন বেঁচে ছিলো। সেই বিষদর্ব্বি রাজা প্রাণ ত্যাগ করলে, কালীয় নামেতে সর্পকূলে তার জন্ম হলো। রাজহংস বাক্য রক্ষা করার জন্য শ্রীহরি কালীয় নাগের মাথায় পাদপদ্ম চিহ্ন রাখলেন। ভক্তিভরে যে এ কাহিনী শুনে তার কোনো সর্প ভয়, ব্যাধি হয় না।"

-

                 🙏"জয় কৃপাময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ"🙏

Post a Comment

0 Comments