★ *পানিহাটি চিড়াদধি মহোৎসব কি?* ★ *কেন করা হয়?* ★ *শ্রীরঘুনাথদাস গোস্বামী কে ছিলেন?*



★ *পানিহাটি চিড়াদধি মহোৎসব কি?* 

★ *কেন করা হয়?* 

★ *শ্রীরঘুনাথদাস গোস্বামী কে ছিলেন?* 


★ আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগেকার কথা।সে সময় ভারত বিভক্ত হয় নি। বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে একই সঙ্গে ভারতের ভূখণ্ড ছিল। সেই সময় যশোরের ভৈরব নদ থেকে আরম্ভ করে রূপনারায়ণ নদ পর্যন্ত এক বিশাল ভূখণ্ডের নাম ছিল সপ্তগ্রাম। সে সময় এ সপ্তগ্রাম ছিল এক উল্লেখযোগ্য বন্দর। তাই এ অঞ্চলের গুরুত্ব অনুসারে সেটি ছিল সবচেয়ে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। এই সপ্তগ্রামেরই জমিদার ছিলেন শ্রী গোবর্ধন মজুমদার। তার বাৎসরিক আয় ছিল কুড়ি লক্ষ টাকা।আজ থেকে ৫০০ বছর আগের এ কুড়ি লক্ষ টাকাকে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ভেবে দেখলে আন্দাজ করা যাবে,তখনকার দিনের কুড়ি লক্ষ টাকা এখনকার দিনের প্রায় ২০০ কোটির সমান।এ রকম এক বিশাল ধনী পিতার পুত্ররূপে ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে হুগলী জেলার অন্তর্গত কৃষ্ণপুর গ্রামে,বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীদের অন্যতম শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী আবির্ভূত হন।


ধনশালী জমিদার পিতার একমাত্র উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও রঘুনাথ এইসব ঐশ্বর্য ও বিষয় এর প্রতি উদাসীন ছিলেন। তিনি সর্বদাই ভগবানের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতেন,উপযুক্ত ব্যক্তি পেলে ভগবানের কথা জিজ্ঞাসা করতেন। রঘুনাথের বৈরাগ্য দূর করে তাঁকে সংসারমুখী করার উদ্দেশ্যে তাঁর পিতামাতা অবশেষে এক পরমা সুন্দরী কন্যার সাথে তাঁর বিয়ে দিলেন। কিন্তু তাতেও রঘুনাথের সংসারের প্রতি উদাসীনভাব গেল না।


★পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব উপলক্ষ্যে বিশেষ প্রতিবেদনঃ


 প্রায় ১৫১৩-১৪ খৃষ্টাব্দের কথা। উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলায় সোদপুর স্টেশন থেকে অনতিদূরে গঙ্গাতীরে পানিহাটি গ্রাম। এখানে শ্রীল রাঘব পণ্ডিত গোস্বামীর বাড়িতে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভূ এসেছেন। সেইদিন ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথি। সপ্তগ্রামের জমিদার শ্রী গোবর্ধন মজুমদারের একমাত্র সন্তান রঘুনাথ দাস, নিত্যানন্দ প্রভুকে দর্শন করবার জন্য ও কৃপা দৃষ্টি লাভের জন্য পানিহাটি আসেন। তিনি দেখলেন গঙ্গার তটে এক বটবৃক্ষের তলে বেদীর উপর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বসে আছেন তিনি কোটি কোটি সূর্যের মতো জ্যোর্তিময়। তাঁকে পরিবেষ্টন করে বহু ভক্ত বসে আছেন। দূর থেকে রঘুনাথ দাস গোস্বামী শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে দণ্ডবৎ প্রণাম করে পড়ে রইলেন। কোনো ভক্ত শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে বললেন, রঘুনাথ আপনাকে প্রণতি নিবেদন করছেন। সে কথা শুনে নিত্যানন্দ প্রভু স্নেহ বিগলিতভাবে রঘুনাথ দাস প্রভুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, চোরা,দিলি দরশন। আয়, আয়, আজি তোর করিমু দণ্ডন।


★কারণ মহাপ্রভু হচ্ছেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর সম্পত্তি। কিন্তু রঘুনাথ দাস গোস্বামী নিত্যানন্দ প্রভুর অনুমোদন ব্যতীতই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সেবা অনুরাগী হয়েছিলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু হচ্ছেন আদি গুরু, তাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পেতে হলে তাঁর প্রতিনিধি শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মাধ্যমে পেতে হবে। এখন শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী নিত্যানন্দ প্রভুর কাছে গেলেন, তিনি দণ্ড দেবেন বললেন। দণ্ড অন্য কিছু নয়, বরং তার কৃপা, সেই কৃপা কৃষ্ণপ্রাপ্তির উপায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পাওয়ার উপায়। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর কৃপা না হলে আমরা কখনও শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণকে বা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পেতে পারি না। যেহেতু শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু হচ্ছেন আদি গুরু।


★শ্রীনিত্যানন্দ মহাপ্রভু বলিলেন,- রঘুনাথ তুই এতদিন চোরের মতন পালিয়ে থেকে অবশেষে আজ আমাকে দর্শন দিলি। দাঁড়া আজ তোকে আমি দণ্ড দেব। রঘুনাথকে নিত্যানন্দ প্রভু কাছে ডাকলেও তিনি নিত্যানন্দ প্রভুর কাছে যেতে ইতস্তত করছিলেন। তখন নিত্যানন্দ প্রভু জোর করে তাকে ধরে আনলেন এবং নিত্যানন্দ প্রভু শ্রীচরণপদ্ম তার মস্তকে স্থাপন করে বললেন,-


''নিকটে না আইস,চোরা ভাগ দূরে দূরে।

আজি লাগ পাইয়াছি,দণ্ডিমু তোমার।।

চিড়া দধি ভক্ষণ করাহ মোর গণে।

শুনিয়া আনন্দ হইল রঘুনাথের মনে।।‘’ 


আর সেই শাস্তিটি হলো, আমার সমস্ত নিজ জনদের আজ তোকে "চিড়া-দধি" খাওয়াতে হবে। সেই কথা শুনে রঘুনাথ দাস অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তৎক্ষণাৎ তার অঙ্গরক্ষক দেরকে পাঠিয়ে চিড়া, দধি, দুধ, সন্দেশ, চিনি ও কলা প্রভৃতি দ্রব্য কিনে আনলেন এবং বিভিন্ন গ্রাম থেকে সেইসব দ্রব্য এনে সাজালেন, চারশোটি গোল হোলনা আনলেন। পাঁচ সাতটি বিশাল বিশাল মাটির পাত্র আনালেন। সেগুলিতে এক ব্রাহ্মণ চিড়া ভিজাতে লাগলেন। দুধ গরম করে এনে তাতে চিড়া ভেজানো হলো। কোনো পাত্রে দধি, চিনি, কলা মেশানো হলো। অন্য পাত্রে ঘন দুধের সাথে কলা, চিনি, ঘি ও সামান্য কর্পূর মিশানো হলো।


এভাবে সাতটি বড় বড় পাত্র এনে নিত্যানন্দ প্রভুর সামনে রাখা হলো। বটবৃক্ষের তলে বেদীর উপর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বসে আছেন, তাঁর চতুর্দিকে তাঁর নিজজন বড় বড় সমস্ত লোকেরা মণ্ডলী রচনা করে বসে আছেন। চিড়াদধি উৎসবের কথা শুনে যত ব্রাহ্মণ, পুরোহিত, পণ্ডিত এসেছিলেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তাদের সবাইকে চাতালের উপর বসালেন। সবাইকে দুটি করে হোলনা দিয়েছিল যার একটিতে দুধ চিড়া, অন্যটিতে দধি চিড়া দেওয়া হয়েছিল। চাতালের তলায় মণ্ডলাকারে অসংখ্য ভক্ত বসেছিল। অনেক অনেক ব্রাহ্মণ চাতালে জায়গা না পেয়ে চাতালের নিচে বসলেন। সেখানে অনেকে স্থান না পেয়ে জলের ধারে বসেছিলেন। সেখানেও অনেকে স্থান না পেয়ে জলে নেমে গিয়ে হোলনাগুলো জলের উপর ভাসিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করলেন।


কুড়িজন পরিবেশনকারী সবাইকে চিড়াদধি দিতে লাগলেন। সবাইকে চিড়াদধি দেওয়া হলেও কেউই ভোজন করছিলেন না। কারণ সেই সমস্ত ভক্তের মনোভিলাষ এই যে, নিত্যানন্দ প্রভু আগে ভোজন শুরু করবেন, তারপর তাঁর নির্দেশক্রমে আমরা ভোজন শুরু করব। ঠিক সেই সময় সেখানে এসে পৌঁছালেন রাঘব পণ্ডিত গোস্বামী। তিনি সেই বিশাল মহোৎসব দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে হাঁসতে লাগলেন। তিনিও নানা রকমের প্রসাদ নিয়ে এসে নিত্যানন্দ প্রভুকে বললেন,-‘’আপনার জন্য আমি গৃহে ভোগ নিবেদন করেছি, আর এখানে উৎসব! এদিকে আমার ঘরে প্রসাদ রয়েছে।‘’  নিত্যানন্দ প্রভু বললেন, তোমার ঘরে আমি রাত্রে প্রসাদ পাবো। আমি জাতিতে গোপ তাই নদীর তীরে এই গোপদের সঙ্গে পুলিন ভোজন করতে আমার খুব আনন্দ হয়। এই দুটি হোলনা নিয়ে তুমি আমাদের সাথে প্রসাদ পাও।

অসংখ্য ভক্তমণ্ডলীর কাছে চিড়াদধি থাকলেও কেউই ভোজন করছিলেন না। নিত্যানন্দ প্রভুর ধ্যানের মাধ্যমে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নিয়ে এলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এলেন আর নিত্যানন্দ প্রভু দাঁড়িয়ে পড়লেন। প্রত্যেকের চিড়াদধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। প্রতিটি পাত্র থেকে এক এক গ্রাস করে চিড়া তুলে নিয়ে তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মুখে দিতে লাগলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও মৃদু মৃদু হেঁসে এক এক গ্রাস চিড়া তুলে নিয়ে নিত্যানন্দ প্রভুর মুখে দিলেন। এভাবে তাঁরা হাঁসতে হাঁসতে পরস্পর পরস্পরকে খাওয়াতে লাগলেন। এভাবে নিত্যানন্দ প্রভু সব মণ্ডলে বেড়াতে লাগলেন এবং সমস্ত বৈষ্ণবগণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই লীলা দর্শন করতে লাগলেন।


কোন কোন ভাগ্যবান সেই ব্যাপার লক্ষ্য করছিলেন। অনেকেই বুঝতেই পারছিলেন না নিত্যানন্দ প্রভু কি করছেন? কারণ অনেকেই চৈতন্য মহাপ্রভুকেই দেখতে পাচ্ছেন না। তারপর নিত্যানন্দ প্রভু আসনে বসলেন, মহাপ্রভুকে বসালেন। আনন্দে নানা ভাবাবেশে নিত্যানন্দ প্রভু সবাইকে নির্দেশ দিলেন হরিনাম উচ্চারণ করতে করতে তোমরা সকলে ভোজন কর। তখন হরি ধ্বনিতে আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ হলো। নিত্যানন্দ প্রভু আগে মুখে গ্রাস তুললেন, তখন অন্যরা ভোজন করতে শুরু করলেন। সেই সময় ভোজনকারী বৈষ্ণবগণের প্রত্যেকের মনে পানিহাটি কিংবা গঙ্গাতটের কথা মনে হলো না, মনে হলো শ্রীবৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের সাথে তারা সব গোপসখা যমুনার তীরে পুলিনভোজন করছেন।


এদিকে সেখানে মহোৎসব হচ্ছে শুনে দূরের, পাশের সমস্ত গ্রাম থেকে অনেক ভক্ত বহুল পরিমাণে চিড়া, দই, সন্দেশ, প্রভূতি নিয়ে এসে পৌঁছাল। যে যা নিয়ে এল, রঘুনাথ দাস গোস্বামী তাদের সমস্ত মূল্য দিয়ে সেগুলি ক্রয় করলেন এবং তাদেরই সেগুলি খাওয়ালেন। অসংখ্য ভক্ত সেখানে মজা দেখতে আসতে লাগল, তাদেরকেও চিড়া দধি কলা খাওয়ানো হলো। তাঁর কাছে চারটি কুণ্ডীতে অবশেষ প্রসাদটি রঘুনাথ গোস্বামীকে দিয়েছিলেন, বাকী তিনটি কুণ্ডী থেকে অবশেষ প্রসাদ একটু একটু করে নিয়ে এক ব্রাহ্মণ অন্য সমস্ত ভক্তকে দিতে লাগলেন। রঘুনাথ দাস গোস্বামীও প্রভুর দেওয়া অবশেষ প্রসাদ তাঁর ভক্তদের বন্টন করতে লাগলেন। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যা কালে শুরু হলো শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মহা হরিনাম সংকীর্ত্তন।


ভগবৎ প্রেমে যেন জগত প্লাবিত করছেন। অনেকেই সেখানে নিত্যানন্দ প্রভুর সঙ্গে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নাচতে দেখলেন, আবার অনেকে মহাপ্রভুকে দেখেননি। তাঁরা জানেন, মহাপ্রভু তো জগন্নাথপুরী ধামে রয়েছেন। যাই হোক, সেই চিড়া দধি মহোৎসবে রঘুনাথ দাস গোস্বামী সহ সমস্ত ভক্ত পরম আনন্দে বিহ্বল হলো। সেই চিড়াদধি মহোৎসব স্মৃতি অনুসারে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে এই পানিহাটিতে সেই বটবৃক্ষতলে চিড়াদধি মহোৎসব হয়।

Post a Comment

0 Comments