🌸জগন্নাথ লীলা পার্ট - ১১🌸


🍀জগন্নাথদেবের যে মহিমা আমরা শ্রবণ করছি প্রত্যেকটি লীলার মধ্যে জগন্নাথদেবের যে একটি বিশেষ গুণ প্রতিফলিত হয় তা হলো, জগন্নাথদেব হচ্ছেন পতিতপাবন। কৃষ্ণের প্রণাম মন্ত্রে যেমন করুণাসিন্ধু, দীনবন্ধু আর জগন্নাথদেব হচ্ছেন পতিতপাবন। প্রভুপাদ বলেছেন গৃহস্থরা ঘরে ঘরে জগন্নাথ, বলদেব, সুভদ্রা মহারাণীকে রাখতে পারে কিন্তু রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ রাখতে পারবে না কারণ ভগবান কৃষ্ণ যখন জগন্নাথ রুপে আবির্ভূত হন তখন ওই মনোভাব নিয়ে আবির্ভূত হন, সবাইকে খুব আপন করে নেয়, ভক্তদের অপরাধ সেরকম গ্রহণ করেন না।


🌼 যদিও আমরা দেখেছি মাঝে মাঝে জগন্নাথ, বলদেব শাসন করেছেন কিছু কিছু ভক্তকে যেমনঃ পুন্ডরিক বিদ্যানিধিকে চড় মেরে একদম গাল লাল করে দিয়েছেন। কিছু ব্যতিক্রম আমরা দেখি কিন্তু শাসনের মাধ্যমে ভগবান যে পতিতপাবন তা প্রকাশিত হয়। বাবা-মা যখন সন্তানকে শাসন করে সে শাসনের মধ্যেও বাবা-মার ভালোবাসা প্রকাশ পায়। জগন্নাথদেবের বিভিন্ন লীলা যেখানে আমরা দেখছি জগন্নাথ, বলদেব, সুভদ্রা দেবী কোনো ভক্তকে শাসন করছেন সেখানে জগন্নাথদেবের করুণার প্রকাশ পায়। ভক্তদের মনোভাব কিরকম-

🌸'যোগ্যতা বিচারে কিছু নাহি পাই তোমার করুণা সার'🌸


 🍀ভক্তরা সবসময় বিনম্রভাবে ভগবান এবং তাঁর প্রতিনিধির শরণাপন্ন হন এবং শরণাগত ভক্তদের ভগবান শাসন করেন। ভগবান যাকে তাকে শাসন করেন না। সাধারণ লোককে শাসন করার জন্য মায়া যথেষ্ট। ভগবান তাঁর অতিপ্রিয়জনদের শাসন করে আমাদের মতো বদ্ধজীবদেরকে শিক্ষা দেন। 

🌸'অনর্পিতচরিংচিরাতকরুণাবতীর্ণকলৌ'🌸


🌼দুইরুপে ভগবানের মহাবদান্যতার প্রকাশ পায়- ১. জগন্নাথ রুপ ২. মহাপ্রভু রুপ

সচল জগন্নাথ এবং অচল জগন্নাথ দুইজনে যখন একসাথে নীলাচলে উনারা থাকেন তখন সেই স্থানটি মাধুর্য ধাম, ঐশ্বর্য ধাম এবং ঔদার্য ধাম এই তিনটি একত্রিত হয়। নবদ্বীপ ধাম হচ্ছে ঔদার্য ধাম, বৃন্দাবন ধাম হচ্ছে মাধুর্য ধাম, দ্বারকা হচ্ছে ঐশ্বর্য ধাম। 

🍁'নমো মহাবদান্যায় কৃষ্ণপ্রেম প্রদায়তে'🍁

মহাপ্রভু হচ্ছেন মহাবদান্য অবতার, তিনি অকাতরে কৃষ্ণপ্রেম বিতরণ করছেন। মহাপ্রভু নাম দিয়ে প্রেম বিতরণ করছেন আর জগন্নাথদেব মহাপ্রসাদ দিয়ে। জগন্নাথ বলছেন- আসো জগন্নাথ পুরীতে আমার প্রসাদ পাও, আমার ভক্তি পাও ভগবদ্ধামে ফিরে যাও। মহাপ্রভু বলছেন প্রসাদ পাও, হরিনাম করো, যুগধর্ম হরিনাম। আমাদের দুটোই দরকার। আমরা তো মাঝে মাঝে জপ করতেও ঘুমিয়ে পড়ি এটা আমাদের অবস্থা কিন্তু আমাদের এই দুর্ভাগ্য দেখে ভগবান আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন না। ভগবান জানেন একে কোনো না কোনোভাবে আকর্ষিত করতে হবে- মহাপ্রসাদ রুপে আসে। ভগবানের একটি রুপ মহাপ্রসাদ। 


🌼জগন্নাথ দেব অত্যন্ত করুণাময়, উনি পতিতপাবন। জগন্নাথপুরীতে সিংহদ্বারের ডানদিকে জগন্নাথ দেব অবস্থান করেন। ওখানে বলদেব, সুভদ্রা নেই। ওই মন্দিরের নিয়ম অনুযায়ী সনাতনধর্ম অবলম্বনকারী ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের লোক প্রবেশ করতে পারেনা। এই নিয়মটি কঠোরভাবে বলবৎ করা হয়েছে। যারা মন্দিরে যেতে পারেন না তাদের জন্য  জগন্নাথদেব একদম গেইটে দাঁড়িয়ে আছেন। বছরে যখন জগন্নাথ দেব রথে যান তখন সবাই জগন্নাথের সেবা করতে পারে। শুধু তাই নয় জগন্নাথ উল্টো রথের পরে মন্দিরের সামনে এসে রথের উপর কয়েকদিন যাবৎ বসে থাকেন। কতো করুণাময় জগন্নাথ,, মন্দিরে সবসময় অবস্থান করছেন, ২৪ ঘন্টার মধ্যে মাত্র ২-৩ ঘন্টা ঘুমায়.. আমরা ভাবি ২-৩ ঘন্টা ঘুমায় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘুমায় ই না কারণ মানবজাতিকে জগন্নাথ দর্শন দেন আর রাতের কয়েক ঘন্টা দেবতারা এসে দর্শন করেন জগন্নাথদেবকে। সারাদিন শুধু ভোগ গ্রহণ করতেই থাকে যাতে আমরা পাই। জগন্নাথদেবের কিচেনে একবারে একলক্ষ লোকের রান্না হতে পারে। তিনি তো অখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক, জগতের নাথ তাই যারা দর্শন করতে যেতে পারছেন না তাদের জন্য উনি তো গেইটে আছেন। প্রভুপাদের অহৈতুকী  কৃপায় আজ সারাবিশ্বে জগন্নাথদেব আরাধিত হচ্ছেন, জগন্নাথদেবের প্রসাদ আমরা পাচ্ছি, জগন্নাথদেবকে আরতি করতে পারছি,  জগন্নাথদেবের রথের রশি আমরা স্পর্শ করতে পারছি। কেবল ভারতবর্ষে এবং বাংলাদেশে কত রথযাত্রা হয় তা হিসাব করা মুশকিল। করোনার কারণে এখন বাড়িতে বাড়িতে রথযাত্রা হচ্ছে। 


🍀লালবেগ নামে মোগল সম্রাটে একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী সৈন্য ছিলো। মোগল সম্রাটের হয়ে উনি যখন উড়িষ্যার পুরী, কটক ইত্যাদি স্থানে দখল নিতে যাচ্ছিলেন রাস্তার ধারে একটি পদ্মপুষ্করিণীতে একজন বিধবা ব্রাহ্মণীর রুপ দর্শন করে লালবেগ মোহিত হয়ে যায়। এতই মোহিত হয়ে যায় যে উনি কোথায় যাচ্ছিলেন, কিজন্য যাচ্ছিলেন সব ভুলে যায়। লালবেগ উনাকে অপহরণ করেন। উনার নাম ছিলো ললিতা। ব্রাহ্মণী অনেক বাঁধা দেয় কিন্তু লালবেগ বাঁধা মানতে রাজি না। অনেক চাপ দিয়েছিলো লালবেগ উনাকে বিবাহ করার জন্য। নিরুপায় হয়ে ললিতা দেবী লালবেগকে বিবাহ করতে রাজি হলেন। ললিতা দেবীর নাম পাল্টে দেয় তো উনাদের সন্তানরুপে শালবেগ জন্মগ্রহণ করেন। যেহেতু বাবা অত্যন্ত প্রভাবশালী সৈন্য ছিলেন সেহেতু ছোট্টবেলা থেকে শালবেগ ওইভাবে বড় হয়,, যুদ্ধ করতে করতে।


 🌼বাবা মারা যাওয়ার পরে শালবেগ বাবার মতোই প্রভাবশালী সৈন্য হলেন এবং একবার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সে এমনভাবে আহত হয়ে অনেক ওষুধপত্র দিয়ে চিকিৎসা করেও সে সুস্থ হতে পারে না। তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মা জানে সে তার একমাত্র সন্তান কিন্তু শালবেগ জানতো না যে তার মা একসময় ললিতাদেবী ছিলেন। যখন মা দেখছে আর কোনো উপায় নেই,, তার সন্তান কত কষ্ট পাচ্ছে তখন তার ললিতাদেবী তাকে বলে- দেখো তোমাকে একমাত্র ভগবান গোপীনাথ পারবে সুস্থ করতে কারণ উনারা যে গ্রামে থাকতেন সেখানকার আরাধ্য ছিলেন ভগবান গোপীনাথ। তুমি ভগবান কৃষ্ণচন্দ্রের চরণকমলে আত্মসমর্পণ করো। মায়ের কথা শুনে শালবেগ অবাক হয়ে যায়। তুমি আমাকে সনাতনধর্ম অবলম্বনকারীদের ভগবানকে ডাকতে বলছো❓এ তোমার কেমন স্বভাব❓

তখন শালবেগের মা পুরো কাহিনী বলে,,শালবেগ বুঝতে পারে। কিন্তু ভগবান বৃন্দাবনচন্দ্রের সম্বন্ধে কিচ্ছু জানতো না শালবেগ। সে তার মাকে বলে- তুমি বলছো গোপীনাথের চরণে আত্মসমর্পণ করতে, গোপীনাথকে ডাকতে। কে এই গোপীনাথ❓তাঁর পরিচয় দাও আমাকে। 


🍀তখন ললিতাদেবী খুব সুন্দরভাবে বৃন্দাবনের মহিমা করেন, কৃষ্ণচন্দ্রের রুপের মহিমা বর্ণনা করেন,, ভগবানের যে স্বভাব তার মহিমা বর্ণনা করেন, নন্দমহারাজ, যশোদা মা, গোপ-গোপীদের সম্বন্ধে বলেন। কৃষ্ণের সম্বন্ধে শ্রবণ করেন স্বাভাবিকভাবে কৃষ্ণের প্রতি একটু আকর্ষিত হন শালবেগ। কিন্তু মনে একটু সন্দেহ আছে,, মাকে বলেন যে- তুমি আমাকে ডাকতে বলছো,, ভগবানকে ডাকার ফলে আমি সুস্থ হয়ে যাবো। ডাকার পর আমি যদি সুস্থ না হই‼️তখন কি হবে.. মা বলে- ঠিক আছে আমারা ১২ দিন ডাকি ভগবানকে ডাকি,, দেখি তারপর কি হয়। তুমি তো নিরুপায় হয়ে কষ্ট পাচ্ছো। ভগবানকে ডাকি আমরা একনিষ্ঠ হয়ে। মা এবং সন্তান দুইজনে কাতরভাবে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন। ১২ দিন পরে কিচ্ছু হয়নি,, যেরকম কষ্ট পাচ্ছিলো সেরকম কষ্ট পাচ্ছে। শালবেগ তখন মাকে বলছে- তুমি বললে ১২ দিন ভগবানকে ডাকতে আমি তো ডাকলাম কিন্তু কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। কেনো মা? ভগবান যদি সত্যিকারে থাকেন তাহলে আমার কেনো রোগ নিরাময় হলো না? তুমি যেরকমভাবে আমাকে ধ্যান করতে বলছো, ডাকতে বলেছো আমি তো সেরকমই ডাকছি। 


🌼তখন মা তার সন্তানকে বুঝানোর চেষ্টা করে যে কিভাবে ভগবান তার ভক্তকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে। আমাদের কর্মফল রয়েছে, ভগবান আমাদের পরীক্ষা করেন আর এই পরীক্ষায় যদি আমরা ফেল হয়ে যাই তাহলে ক্ষতিটা আমাদেরই। তোমাকে বিশ্বাস রাখতে হবে নিরুৎসাহিত না হয়ে। ভগবান আমাদের চাকর নয় যে ভগবানকে অর্ডার করলাম আর ভগবান আমাদের ইচ্ছা পূরণ করে দেবে। ভগবান হচ্ছেন স্বাধীন। এভাবে বিভিন্নভাবে উনার মা উনাকে বুঝান। শালবেগ উনার মায়ের কথা শ্রবণ করার পর উনার হৃদয়টা পরিষ্কার হয়। এখন কোনোকিছু লাভের আশায় না সত্যিকারে ভগবান ভালোবেসে ডাকতে লাগলেন শালবেগ। আগে ডাকছিলেন কিছু পাওয়ার আশায় কিন্তু মায়ের কথাতে তার হৃদয় পরিবর্তন হলো এবং সে মনপ্রাণ দিয়ে ভগবানকে ডাকতে লাগলো। কিছুদিন পরে রাত্রিবেলা গোপীনাত শালবেগের স্বপ্নে আসলেন। কারণ নিঃস্বার্থভাবে ভগবানকে ভালোবেসেছিলেন শালবেগ। শালবেগের স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে ভগবান বলছেন- এই ছাইটি দেখতে পাচ্ছো? এই ছাইটা নাও। ছাইটি নিয়ে তুমি তোমার অঙ্গে মাখো,, তুমি ঠিক হয়ে যাবে। স্বপ্নেই শালবেগ ভগবানের সেই প্রদত্ত ছাইটি সারা অঙ্গে লেপন করলেন। ঘুম থেকে উঠে যখন দেখে উনার শরীরে আর কোনো অসুবিধা নেই। 


🍀যুদ্ধক্ষেত্রে যেভাবে উনি আহত হয়েছিলেন তার কোনো চিহ্ন নেই, কোনো ব্যাথা অনুভব করছেন না, পুরো স্বাভাবিক। শরীরটা মনে হয় আগের থেকে আরো অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সে অপ্রাকৃত আনন্দে মার কাছে দৌড়ে যায় এবং ভগবানের প্রতি যে তার পূর্ণ বিশ্বাস আনন্দের সহিত তার মায়ের কাছে প্রকাশ করলেন। ভগবান কেনো শালবেগের স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ছিলো তার আরেকটি কারণ ছিলো। কারণ উনার মা ললিতা দেবী ভগবানের কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা করেছিলেন যে- হে ভাগবান🙏 আমার সন্তানের কাছে তোমার অস্তিত্বের সন্দেহ আছে। তুমি দয়া করে তাকে করুণা করো। ললিতাদেবীর ডাকে এবং শালবেগের ভক্তিতে ভগবান আবির্ভূত হয়েছিলেন। 


🌼শালবেগ যখন দেখলেন তার শরীর পুরো সুস্থ হয়ে গেছে উনি মায়ের কাছে উনার মনোভাব ব্যক্ত করলেন যে উনি আর গৃহে থাকতে চান না। জগন্নাথদেব উনাকে পুরো সুস্থ করে দিয়েছেন সেজন্য উনি পূর্ণরুপে জগন্নাথদেবের চরণকমলে আত্মসমর্পণ করতে চান। সন্তানের এই মনোভাব শ্রবণ করে মা খুশি হয়েছেন। মায়ের অনুমতি নিয়ে শালবেগ জগন্নাথপুরীতে আসেন। যেহেতু শালবেগ অন্য সম্প্রদায়ের সেজন্য শালবেগের মন্দিরে প্রবেশ করার অধিকার ছিলো না। সিংহদ্বারের কাছে এসে শালবেগ অনেক ক্রন্দন করছিলেন। 


🍀জগন্নাথদেবকে এমন কাতরভাবে ডেকেছিলেন যে জগন্নাথদেব পতিতপাবন রুপে সিংহদ্বারে আবির্ভূত হয়ে শালবেগকে দর্শন দিয়েছিলেন। যদিও অন্যান্যরা অনেক কটুক্তি করেছিলেন, অনেক খারাপ ব্যবহার করেছিলেন শালবেগের সাথে তথাপি শালবেগ কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করি নি। এখন সমগ্র পুরীধামে, সমগ্র বিশ্বে ভক্ত শালবেগ সমাদৃত। উনার রচিত কবিতা জগন্নাথদেবের মহিমা এবং যে বিপ্রলম্ভভাবে শালবেগ জগন্নাথদেবের মহিমা প্রকাশ করেছিলেন বৈষ্ণব সমাজে তা সমাদৃত। বিশেষ করে পুরীধামে উনার কবিতা গাওয়া হয়।


-শ্রীপাদ নাড়ু গোপাল দাস (বৈকালীন ক্লাস,১৭-০৭-২০২১)


W.C- পুষ্পিতা শর্মা

Post a Comment

0 Comments