*শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের  আবির্ভাব তিথি পূজা মহোৎসব।*

---------------------------------------

 দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণলীলায় যিনি চম্পকমঞ্জরী ছিলেন, তিনিই ভগবান্ শ্রীমন্মহাপ্রভুর পারিষদ্ শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর রূপে জগতে আবির্ভূত হইয়াছেন। তিনি রাজা শ্রীকৃষ্ণানন্দ দত্ত ও শ্রীনারায়নী দেবীর পুত্র ছিলেন। তিনি শ্রীলোকনাথ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। 

শ্রীলোকনাথ গোস্বামী শ্রীমন্মহাপ্রভুর অত্যন্ত প্রিয় ভক্ত ছিলেন। তিনি ভগবৎ আদেশপ্রাপ্ত হইয়া শ্রীল ভূগর্ভ গোস্বামীকে সঙ্গে লইয়া শ্রীবৃন্দাবনে ভজন করিতেছিলেন। তিনি কাহাকেও শিষ্য করিবেন না, এইরূপ তাঁহার মনের ইচ্ছা ছিল, শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর শ্রীজীব গোস্বামী আদেশে লোকনাথ গোস্বামীর চরণ সেবা করিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিলে, শ্রীল গোস্বামী বলিলেন ,--

 শ্রীগৌর- গোবিন্দের সেবা করিতে পারিলাম না, অপরের সেবা কি করিয়া গ্রহণ করিব? তথাপি শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের একান্ত ইচ্ছা তিনি লোকনাথ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিবেন। তাই তিনি গভীর রাত্রিতে প্রত্যহ গোস্বামী বাহ্য কৃত্যের স্থানটি পরিষ্কার করিতেন। শ্রীগোস্বামী এইরূপ দেখিয়া অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলেন এবং এই কার্য কে করে? তাহা জানিবার জন্য একদা রাত্রিতে গোপনে অবস্থান করিয়া দেখিলেন শ্রীল ঠাকুর প্রত্যহ এই সকল কার্য করেন। তাই তিনি শ্রীনরোত্তমের সেবায় সন্তুষ্ট হইয়া তঁহাকে শ্রাবণ পূর্ণ মাসীতে দীক্ষাদান করেন।

শৈশবকাল হইতেই শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের চরিত্রে মহাপুরুষের লক্ষণ প্রকাশিত হইয়াছিল। সর্বদা তিনি শ্রীগৌর- নিত্যানন্দের মহিমার চিন্তায় মগ্ন থাকিতেন। কলিযুগাবতারী শ্রীমন্মহাপ্রভু এই জগতে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ- এই চারি পরম ও পুরুষার্থের উপর প্রেমভক্তি যে সর্বমানবের চরম ও পরম পঞ্চম পুরুষার্থ, তাহাই জগৎকে আচরণ করে শিক্ষাদান করিয়াছেন।

 শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু জীবে দয়া করি। 

স্বপার্ষদ স্বীয় ধাম সহ অবতরী।। 

শ্রীমন্মহাপ্রভু কানাইর নাটশালা গ্রামে এসে আনন্দে নৃত্য- কীর্তন করিতে করিতে "নরোত্তম" বলিয়া ডাকিয়াছিলেন। এইরূপ অলৌকিক ভাব দেখিয়া শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু, ইহার কারণ জানিতে চাহিলে, শ্রীমন্মহাপ্রভু বলিয়াছিলেন,- "দেখ শ্রীপাদ, তোমার মহিমা তুমি নিজে জান না, নীলাচলে যাইবার সময় তুমি প্রেমে দিনের পর দিন কান্দিয়াছিলে, তাহা আমি বান্ধিয়া রাখিয়াছি। নরোত্তমকে সেই প্রেম দিবার জন্য পদ্মাবতী তীরে সেই প্রেম রাখিবো।"  বারো বৎসর বয়সে নরোত্তম ঠাকুর স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া একাকী পদ্মাবতীর নদীতে স্নান করিলে, তাঁহার চরণ স্পর্শে পদ্মাবতীর জল  উত্তাল হইয়াছিল। নরোত্তম ঠাকুর সেই গৌর- নিত্যানন্দের দেওয়া প্রেমে উন্মত্ত হইয়া গৃহ হইতে বৃন্দাবনে যাইতেছিলেন। পথে তিনি দেহসুখ ত্যাগ করিয়া চলিতে চলিতে একটি গাছের তলে অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়াছিলেন। এই অবস্থায় একজন ব্রাহ্মণ এক ভান্ড দুগ্ধ আনিয়া বলিলেন,-"ওহে নরোত্তম", এই দুধ খাও, তুমি সুখে চলিতে পারিবে, এই বলিয়া সেই ব্রাহ্মণ অদৃশ্য হইলেন  এবং শ্রী রূপ সনাতনকে নরোত্তম ঠাকুর দর্শন করলেন। তাঁহারা স্নেহভরে নরোত্তম ঠাকুরকে সেই দুগ্ধ পান করাইলেন। নরোত্তম ঠাকুরের সমস্ত কষ্ট দূর হইল।

শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর  মহাভাগবত, ভগবানের নিজজন ছিলেন। 

"যে তে  কুলে বৈষ্ণবের জন্ম কেনে নহে। তথাপিহ সর্বোত্তম  সর্বশাস্ত্রে কহে।।

যে পাপীষ্ঠ  বৈষ্ণবের  জাতিবুদ্ধি করে।  জন্ম জন্ম  অধম-  যোনিতে  ডুবি' মরে।।

(চৈঃ ভাঃ মধ্য 10/100,102)।

কোন এক সময় এক স্মার্ত ব্রাহ্মণ শ্রীনরোত্তম ঠাকুরকে শূদ্র বুদ্ধি করে নিন্দা করেছিলেন। সেই অপরাধে ওই ব্রাহ্মণের কুষ্ঠ রোগ হয়, যন্ত্রণা সহ্য  করিতে না পেরে তিনি গঙ্গায় ডুবে মরিবে এইরূপ সংকল্প করিলে শ্রীভগবতী দেবী স্বপ্নে বলেছিলেন, পরম ভাগবত শ্রীনরোত্তম ঠাকুরকে তুমি শূদ্র বুদ্ধি করিয়াছ, তাঁহার চরণে ক্ষমা প্রার্থনা করিলে তোমার ভালো হইবে। পরদিন সেই ব্রাহ্মণ কাঁদিতে কাঁদিতে শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের চরণে পতিত হইয়াছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার কুষ্ঠ রোগ ভাল হইয়াছিল।

এক ব্রাহ্মণের গৃহে ধানের গোলায় এক ভয়ঙ্কর সর্প ছিল। কেহ তাহার ভয়ে সেখানে যাইতে পারিত না, সেই গৃহে নরোত্তম ঠাকুর যখনই যাইলেন, তখনই সর্প অন্তর্ধান হইল এবং সেই গোলা হইতে শ্রীগৌর বিষ্ণুপ্রিয়া বিগ্রহ প্রকটিত হইয়া শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের কোলে উঠিয়া ছিলেন।

"যাঁহার ভক্তিনিষ্ঠা পাষাণের উপর অঙ্কিত রেখার ন্যায় অত্যন্ত দৃঢ়া, যাঁহার শ্রীঅঙ্গস্পর্শ স্পর্শমণির স্পর্শের ন্যায় সর্ব বাঞ্ছিত সুফলপ্রদ এবং যাঁহার শ্রীমুখনিঃসৃত বাক্য সমূহ বেদবাক্য তুল্য প্রামাণ্য, সেই শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর মহাশয়কে পুনঃ পুনঃ প্রণাম।"

Post a Comment

0 Comments