"প্রভু কহে, কোন বিদ্যা বিদ্যা মধ্যো সার।
রাই কহে, কৃষ্ণভক্তি বিনা বিদ্যা নাহি আর।।
অর্থাৎ— কৃষ্ণভক্তি ছাড়া সকল বিদ্যায় প্রকৃতপক্ষে অবিদ্যা। তাই বিদ্যারুপিনী মাতা সরস্বতী তার শুদ্ধ
স্বরুপে মায়াবদ্ধ জীবকে ভগবৎভক্তির জ্ঞান দিয়ে
তাঁদের অবিদ্যা নাশ করেন। মাতা সরস্বতী সমস্ত
বৈদিক শাস্ত্রের অধীশ্বরী!
আর সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে শ্রীমন্মহাপ্রভুর উক্তি—
"গৌন মুখ্য বৃত্তি বা অন্বয় ব্যাতিরেকে।
বেদের প্রতিজ্ঞা কেবল কহয় কৃষ্ণকে"।।
মাতা সরস্বতী! ভগবৎভক্তদের কৃপা করে তাঁদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করেন। কিন্তু তিনি জাগতিক ভোগাকাঙ্খীদের কপট কৃপা করেন। তাঁর দৃষ্টান্ত আমরা রামায়নে দেখি। যখন কুম্ভকর্ণ জগতের জন্য
অহিতকর বর চাইবেন ব্রক্ষার কাছে এরুপ বুঝে তিনি মাতা সরস্বতীর শরনাপন্ন হলে বাগ যন্ত্রের অধিশ্বরী মাতা সরস্বতী তখন কুম্ভকর্ণের জিহ্বায় আবির্ভুত হন। যাঁর ফলে কুম্ভকর্ণ ইন্দ্রাসন চাইতে গিয়ে নিদ্রাসন চেয়ে বসেন। ফলে কুম্ভকর্ণ স্বর্গাসনের বদলে গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকতো।
সুতরাং — তাই মাতা সরস্বতীর কাছে এই প্রার্থনা করা উচিত যাতে আমরা সকলে ভগবানের সান্নিধ্যে আসতে পারি ও কৃষ্ণভক্তি লাভ করতে পারি, এবং এই শুদ্ধ ভগবৎভক্তির মাধ্যমে আমরা আমাদের সুদুর্লভ মানব জীবন সার্থক করতে পারি।
হে কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনী মাতা! কৃপাপূর্বক আপনি আমাদের সকলকে কৃষ্ণভক্তি প্রদান করুন।
হরেকৃষ্ণ!
সকলকে শুভ কৃষ্ণময় সরস্বতী পূজার অগ্রীম কৃষ্ণপ্রীতি ও শুভেচ্ছা।
দেবী সরস্বতী কার পত্নী?
বৈদিক শাস্ত্রে দেখা যায় দেবী সরস্বতী হলেন ব্রহ্মার পত্নী, শিবের কন্যা, বিষ্ণুর পত্নী।
এমনকি শ্রীনৃসিংহদেবের পত্নী।
প্রকৃতপক্ষে দেবী সরস্বতীর প্রকৃত পরিচয় কি?
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে বর্ণিত আছে এই যে, ব্রহ্মা যখন সৃষ্টিকালে ধ্যান করছিলেন সেই সময় তাঁর মন থেকে একটি কন্যা উদ্ভূত হয়। ব্রহ্মা সেই কন্যাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে?’ কন্যা উত্তর দিল, ‘আমি আপনার থেকে প্রকাশিতা, আমার স্থিতি ও কর্তব্য আপনি নির্ধারণ করুন।’ ব্রহ্মা বললেন, ‘তোমার নাম সরস্বতী। তুমি জীবের জিহ্বাতে অবস্থান করবে। বিশেষ করে সভ্যজনের জিহ্বাতে নৃত্য করতে থাকবে। তুমি পৃথিবীতে সরস্বতী নদী রূপে প্রবাহিত হবে। আর একটি রূপে তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে।’
এই সরস্বতী ব্রহ্মার পত্মী। এই সরস্বতী আসুরিক লোকের কন্ঠে বলে উল্টা-পাল্টা কথা উচ্চারণ করিয়ে অসুরদের বিভ্রান্ত করে থাকেন।
ব্রহ্মা, রাবণ ভ্রাতা কুম্ভকর্ণকে বললেন, ‘হে বৎস, তোমার কঠোর তপস্যায় আমি তুষ্ট হয়েছি, এখন তুমি কি বর চাও বলো।’ সে বলল, ‘আমি যাতে ছয় মাস ব্যাপী ঘুমাতে পারি এবং একদিন উঠে ভোজন করতে পারি, সেই আশির্বাদ করুন।’ ব্রহ্মা বললেন ‘তথাস্তু’। রাবণ কুম্ভকর্ণকে বলল, ‘তুমি গণ্ড মূর্খ। কোনও তপস্যা না করেই সহজে ঘুমাতে পারতে এবং খেতে পারতে। কঠোর তপস্যা করে কেন ঘুমানোর জন্য ও একদিন খাওয়ার জন্য বর চাইলে?’ কুম্ভকর্ণ বলে, ‘হায়! আমার বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়েছে। তাই কি সব বলে ফেললাম’, যারা ভগবদ্ভক্তি বিরুদ্ধ ব্যক্তি, তাদের বুদ্ধি বিগড়িয়ে দেওয়া এই সরস্বতীর কাজ।
কোনো কোনো অভিধানে সরস্বতীকে ‘রুদ্রানী’ বলা হয়েছে। সরস্বতী শিবের পত্মী। মহামায়া দূর্গা যখন উগ্ররূপা হন অসুরদের উৎপাত মূলক কার্যকলাপ দেখে, তখন তিনি চন্ডী বা কালি রূপে খ্যাত হন। কালী যখন উগ্ররূপা থেকে শান্তরূপা হয় তখন তিনি ভদ্রকালী বা সরস্বতী রূপে প্রকাশিত হন।
তিনি জড়বিদ্যা ধাত্রী। জড় বুদ্ধিধাত্রী সরস্বতী শিবপত্মী। এই জন্য লোকে জড় বিদ্যা প্রার্থনা কালে এই সরস্বতীর পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলী নিবেদন কালে বলে থাকেন, ওঁ ভদ্রকল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ। হে ভদ্রকালী সরস্বতী আপনাকে সর্বদা প্রতি নিবেদন করি।
গর্গ সংহিতায় বলা হয়েছে, বিষ্ণুর পত্মী সরস্বতী। বৈকুন্ঠস্য পতেঃ সাক্ষাৎ প্রিয়ামুখ্যা সরস্বতী। সাক্ষাৎ বৈকুন্ঠপতির মুখ্যা সরস্বতী। (মথুরা খন্ডম্ ২১/৩৫) আগতং সাক্ষাদ্ বাগদেবীং। শ্রীসরস্বতীম্ বিষ্ণোঃ প্রিয়াং দিব্যবর্ণাং। সমাগত সাক্ষাৎ বাগ্দেবী সরস্বতী, যিনি দিব্যবর্ণা, শ্রী বিষ্ণুর প্রিয়া।
বিষ্ণুপত্মী সরস্বতী নারদ মুনিকে কৃষ্ণনাম গান করার উদ্দেশ্যে চৌষট্টি কোটি রকমের তান শিখিয়ে ছিলেন এবং দেবদত্ত নামক বীণা দিয়ে ছিলেন। নারদ মুনি তারপর হরিনাম কীর্তনে তৎপর হয়ে সর্বত্র বিচরণ করতে লাগলেন সরস্বতী বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী। তিনি বিষ্ণুবল্লভা। তাঁর চার হাত। দুই হাতে বীনা বাজিয়ে শ্রীহরিনাম গান করে। এর দুই হাতে এক হাতে বৈদিক শাস্ত্র গ্রন্থ এবং অন্য হাতে হরিনামের জপমালা।
মহান টীকাকার শ্রীধর স্বামী উল্লেখ করেছেন, সরস্বতী শ্রীনৃৃসিংহকান্তা নৃসিংহদেবের পত্নী। বাগীশা যস্য বদনে লক্ষ্মীর্যস্য চ বক্ষসি। বাক্দেবী সরস্বতী বাক্শক্তিরূপে তা নৃসিংহদেবের বদনে বিরাজ করেন এবং বক্ষে স্বর্ণরেখা রূপে লক্ষ্মীদেবী বিরাজ করেন।
শ্রী বৃন্দাবন দাস ঠাকুর (শ্রীচৈতন্য ভাগবতে আদি ১৩/২১) উল্লেখ করেছেন-
বিষ্ণুভক্তি স্বরূপিনী, বিষ্ণুবক্ষঃ স্থিতা।
মূর্তিভেদে রমা-সরস্বতী জগন্মাতা।
জগন্মাতা হচ্ছেন বিষ্ণুর স্ত্রী, ভূ ও লীলাশক্তি। পরস্পর মূর্তি ভেদে থাকলেও বস্তুত ভগবান শ্রী নারায়ণের অন্তরঙ্গ শক্তি নারায়ণী বা লক্ষ্মী। শ্রী বা রমা, ভূ বা সরস্বতী, লীলা বা দুর্গা নামে পরিচিতা। প্রত্যেকেই মূর্তিমর্তী শ্রীবিষ্ণু দাস্য স্বরূপিনী প্রত্যেকেই মূল আশ্রয় বিগ্রহ। অর্থাৎ তাদের আশ্রয়ে থেকে জীবকে চলতে হয়।
যে সমস্ত ব্যক্তি মিথ্যা অহংকারবশতঃ নিজেকে এই সংসারে কর্তা বা ভোক্তা মনে করছে, সেই সব জীবের কাছে পরা বিদ্যা বা শুদ্ধা সরস্বতী নিজেকে আড়াল করে রেখে ছায়ামূর্তি দুষ্টা সরস্বতী রূপে তাদেরকে বঞ্চনা করার জন্য নানারকম জড় বিদ্যা বৈভব দিয়ে থাকেন।
শুদ্ধা সরস্বতী দেবী নিজের সাধক ভক্তকে ভগবৎ সেবায় উন্মুক্ত না হতে দেখলে তাকে নিজ ছায়ারূপিনী অপরা বিদ্যা বা জড়া বিদ্যা দিয়ে এই জড় সংসারে বিমোহিত করেন।
শুদ্ধা সরস্বতীর নিষ্কপট করুনা কটাক্ষের হরিভক্তিরূপ পরম শ্রেয় লাভ ঘটে। একজন হরিভক্তের কাছে জড় বিদ্যা বৈভব অত্যান্ত তুচ্ছ ব্যাপার।
মহান আচার্য শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর গেয়েছেন-
সরস্বতী কৃষ্ণপ্রিয়া, কৃষ্ণভক্তি তার হেয়া
বিনোদের সেই সে বৈভব।
মায়াপুরে কেশব কাশ্মিরী পণ্ডিতকে সরস্বতী দেবী বলেন, ‘হে বৎস তুমি যাঁর সামনে পাণ্ডিত্য দেখাতে গিয়েছিলে সেই নিমাই পণ্ডিত অন্য কেউ নন। তিনি আমার প্রভু, আমি তো তাঁর দাসী। তোমার একমাত্র মঙ্গল হলো তাঁর শরণাগত হওয়ায়। পরদিন সেই পণ্ডিত শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর চরণে পতিত হয়ে তাঁর কাছ থেকে হরে কৃষ্ণ মন্ত্র গ্রহণ করেন এবং কৃষ্ণভক্তি অনুশীলনে ব্রতী হন। বিদ্যা-বুদ্ধির গর্বে স্ফীত অনেক ব্যক্তি আছেন যারা শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরণাশ্রয় করতে চান না। রামানন্দ রায় মহাপ্রভুর কথোপকথনে বলেছেন
‘কোন বিদ্যা বিদ্যা-মধ্যে সার?’
রায় কহে, ”কৃষ্ণভক্তি বিনা বিদ্যা নাহি আর ॥”
দিগ্বিজয়ী হওয়া প্রকৃত বিদ্যার উদ্দেশ্য নয়। কৃষ্ণপ্রেমভক্তি আসল বিদ্যা। সকল বিদ্যা নষ্ট হয়ে যায় জীবনাবসানে। কিন্তু কৃষ্ণভক্তিরূপ বিদ্যা অবিনশ্বর। তাই জড়বিদ্যার সাথে আধ্যাত্ম বিদ্যা তথা কৃষ্ণভক্তি বিদ্যা লাভের প্রত্যাশাই হউক সরস্বতী মাতার নিকট আকুল প্রার্থনা।
আমাদের বঙ্গঁদেশে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মী পূজা এবং মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীকৃষ্ণের বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজার প্রচলন রয়েছে। আবার আশ্বিনের দুর্গাপূজার সময় দেখা যায় দূর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক একই প্যান্ডেলে পূজিত হয়। সেক্ষেত্রে লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে শিব-দূর্গার কন্যা বলে মান্য করা হয়। লক্ষ্মী ও সরস্বতী উভয়ে শ্রী নারায়ণের পত্মীরূপে আক্ষায়িত।
সিদ্ধান্ত হলো এই যে, শ্রীহরি প্রিয়া চিন্ময়া সরস্বতীই বিভিন্ন কল্পে অংশতঃ ছায়া বা মায়া সরস্বতী রূপে বিভিন্ন রূপে এই জড়জগতে প্রকাশিত হয়েছেন।
রাম লীলায় সরস্বতী
পরাক্রমশালী রাক্ষসরাজ রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণসহ তিন ভাই একদা কঠোর তপস্যায় ব্রতী হয়েছিলেন ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করার সংকল্পে। অবশেষে কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তিন ভাইয়ের অভীষ্ট সংকল্প পূরণের জন্য সম্মত হল। রাবণ ও বিভীষণ যথাক্রমে তাদের স্ব-স্ব প্রার্থনা করার পর ব্রহ্মা তা পূরণ করলেন। কিন্তু দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন কুম্ভকর্ণ লোভময় এক বর প্রার্থনা করে বসলেন। তিনি তার হৃদয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের আসন লাভের সংকল্প করেছিলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র তার অভিলাষ বুঝতে পেরে অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়লেন। উপায়ান্ত না দেখে অবশেষে তিনি মাতা সরস্বতী দেবীর শরণাপন্ন হলে, সরস্বতী দেবী তাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। যখন কুম্ভকর্ণ ব্রহ্মার কাছে ‘ইন্দ্রাসন’ লাভ করার সংকল্প তুলে ধরতে চাইলে মাতা সরস্বতী দেবী তৎক্ষণাৎ তার জিহ্বায় উঠে বসেন। তখন কুম্ভকর্ণ ‘ইন্দ্রাসন’ এর পরিবর্তে ‘নিদ্রাসন’ চেয়ে বসেন। পরবর্তীতে ব্রহ্মা তাকে সারা জীবনের জন্য নিদ্রাসন বর দিলে তাকে বছরে ছয় মাস ঘুমেই কাটাতে হয়। আর এভাবে সরস্বতী দেবী দেবরাজ ইন্দ্রকে রক্ষা করেন এবং ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের রাবণ বধের অংশস্বরূপ কুম্ভকর্ণকে বিনাশে সমর্থ হয়।
কৃষ্ণলীলায় সরস্বতী
একদা গোকুলে বৃষভানু নামে এক মহান রাজা বাস করতেন। পরমেশ্বর শ্রীহরির প্রীতিসাধনের উদ্দেশ্যে বৃষভানু রাজা রাজসূয় প্রভৃতি শত শত যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছিলেন। অবশেষে যথাবিধানে তিনি প্রজেয় বাসিন্দা বিষ্ণুভক্ত বিন্দুগোপের কনিষ্ঠা কন্যা গুণবতী কীর্তিদার পাণিগ্রহণ করেন। বহুদিন অতিবাহিত হলো। তাদের কোনো সন্তান জন্মাল না। সন্তান লাভের নিমিত্তে বহু রকমের যজ্ঞ, দান, পূজা-অর্চনা, তীর্থ সেবা করেও ফল হলো না। বৃষভানু নিজেকে অত্যন্ত পাপী বলে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। সাধ্বী পত্নী কীর্তিদা তাকে সুস্থ করিয়ে বললেন, চলো যাই, আমরা দেবী কাত্যায়নীর আরাধনা করি। তখন তারা দু’জনই কাত্যায়নী দেবীর আরাধনা করতে আরম্ভ করলেন। সহসা একদিন বিদ্যাবুদ্ধিদাত্রী সরস্বতী দেবী গগণমার্গে আবির্ভূত হয়ে বলতে লাগলেন-
হরিনাম বিনা বৎস কর্ণশুদ্ধিঃ ন জায়তে।
তস্মাৎ শ্রেয়স্করং রাজন্ হরিনামানুকীর্তনম্॥
গৃৃহান্ হরিনামানি যথাক্রমমনিন্দিত ॥
হে! হরিনাম বিনা কারও কর্ণশুদ্ধি হয় না। সেইজন্য হে বৃষভানু! শ্রেয়স্কর কোন বিষয় যদি পেতে চাও তবে যথাবিধি হরিনাম গ্রহণ করো। হে বৃষভানু, তুমি যাও, মহামুনি ক্রতুর আশ্রমে গিয়ে তাঁর কাছে হরিনাম গ্রহণ করো। এভাবে তিনি হরিনামকে জগতের কাছে মহিমান্বিত করলেন।
বি দ্র: নিম্নের তালিকাটি সরস্বতী দেবীর মহিমা
সরস্বতী মরভূমির তলদেশে প্রবাহিত হচ্ছে
একদা ব্যাসদেব শাস্ত্র গ্রন্থ রচনার জন্য সিদ্ধিধাতা গনেশের সহায়তা নিয়েছিলেন। প্রায় ১কি.মি. দূরত্ব ব্যবধানে ব্যাসদেব মুখ দিয়ে শাস্ত্র উক্তি করছিলেন আর তখন গণেশ নিরবে খুব মনোযোগ সহকারে তা গ্রন্থ আকারে লিপিবদ্ধ করছিলেন, তখন পাশেই সরস্বতী নদী উপর থেকে ঝরণা আকারে পতিত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আর নদীর পানির সেই শব্দে গণেশের মন বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল বারবার। তখন ব্যাসদেব সরস্বতী নদীকে গ্রন্থ রচনায় বাধা সৃষ্টি না করতে বললে, সরস্বতী নদী তার কর্ণপাত করেননি। এরই ফলশ্রুতিতে ব্যাসদেব উত্তেজিত হয়ে সরস্বতী নদীকে অভিশাপ দেয় যে, ”তুমি পাতাল লোকে চলে যাবে”। ব্যাসদেবের অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে তখন থেকেই সরস্বতী নদীর কিছু অংশ পাতাল পথ দিয়ে কিছু অংশ গঙ্গা নদীতে গিয়ে মিশেছে। যাকে একত্রে ”ত্রিবেণী”বলে ডাকা হয়।
অনাদিকাল থেকে বয়ে যাওয়া এ নদী এখনো পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে আসছে, পাতাল পথ দিয়ে এ নদীর পানি প্রবাহিত হয়ে আসছে। যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অনেকটা অবিশ্বাস্য মতবাদ ছিল। অনেকেই এ বিশ্বাস তুরি মেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলত এটা অসম্ভব। কিন্তু বাস্তবিকই সরস্বতী নদী এখনও পর্যন্ত পাতাল পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে। যদিও নদীটির অস্তিত্ত্ব ভারতের অনেক জায়গায় রয়েছে, কিন্তু অনেক অনেক জায়গায় এটা পাতাল পথ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, সম্প্রতি ২০০ জন বিজ্ঞানীদের একটি দল দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ গবেষণা করে জানতে পেরেছে যে ঋগবেদে উল্লেখিত সরস্বতী নদী সম্পর্কে বিশ্লেষণ প্রমাণিত হয়েছে।
এটা খুবই অবিশ্বাস্য যে কিভাবে একটি নদী বছরের পর বছর পাতাল পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সরস্বতী নদীর অস্তিত্ব অনুসন্ধানের জন্য NASA সহায়তা করেছিল। NASA স্যাটেলাইট থেকে সরস্বতী নদীর ইমেজও সংগ্রহ করেছিলেন রাজস্তানের মরুভূমির তলদেশে সরস্বতী নদী প্রবাহিত হচ্ছে তারা এ সম্পর্কিত তথ্য প্রধান করেছে। মরুস্থালি নামে এই The Great Indian Desert হিসেবে খ্যাত মরুভূমির তলদেশে এটি প্রবাহিত হচ্ছে, ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা ঐ স্থান থেকে কিভাবে পানি উত্তোলন করা যায় তার একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যদি তাদের পরিকল্পনা সফল হয় তাহলে ঐ স্থান তথা ভারতের লোকেরা হাজার হাজার বছরের পুরানো পানি জনগনের জন্য সরবরাহ করতে পারবে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যদি এ নদীর পানি উত্তোলনে দেরী হয় তাহলে সমগ্র ভারতে একটি পানি যুদ্ধ সংঘটিত হবে ২৫ বছরের মধ্যে।
সরস্বতী নদী
কথিত আছে একদা গঙ্গা ও সরস্বতী দেবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা অভিলাষ নিয়ে বাকযুদ্ধ করছিলেন তখন শ্রীমতি লক্ষ্মী দেবী এসে তাদের ঝগড়া থামাবার চেষ্টা করলে একটি বিশেষ কারণে তাঁরা লক্ষ্মীদেবীকে অভিশাপ্ত করেন যে, তিনি বৃক্ষ হয়ে জন্ম নিবে। এ কারণে লক্ষ্মী দেবী পরবর্তীতে তুলসী বৃক্ষরূপে জন্ম নেয়। ‘সরস্বতী’ দেবী ‘গঙ্গা’ দেবীকে অভিশাপ দেয় যে গঙ্গা দেবী নদী হয়ে যাক এবং গঙ্গা দেবী সরস্বতী দেবীকে অভিশাপ দেয় যে তিনিও যেন নদী হয়ে যান । আর এ কারণে গঙ্গা ও সরস্বতী নদীর সৃষ্টি হয়। যা আজও ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রবাহিত হয়ে আসছে। তাই গঙ্গা, যমুনা ও অন্যান্য নদীর মত ‘সরস্বতী’ নদীও বৈষ্ণব আচার্যদের কাছে এক বিশাল গুরুত্ব বহন করে থাকে। একটি মহান তীর্থক্ষেত্র হিসেবেও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ।
মহাপ্রভুর শিক্ষাষ্টকমে ও শ্রীমদ্ভাগবতে সরস্বতী
কৃষ্ণনাম বিদ্যাদেবী সরস্বতীর অত্যন্ত প্রিয়। কৃষ্ণনাম কীর্তনে তিনি আনন্দ লাভ করেন। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর শিক্ষাষ্টকে বলছেন, ‘বিদ্যাবধুজীবনং শ্রীকৃষ্ণসংকীর্তনম্’। শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তন বিদ্যা-রূপিনী বধূর জীবনস্বরূপ।
শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়নের পূর্বে সরস্বতী দেবী সম্পর্কে বলতে গিয়ে পরিশেষে উল্লেখ করা হয়েছে-
নারায়ণং নমস্কৃত্য নরং চৈব নরোত্তমম্॥
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ॥ (১/২/৪)
অনুবাদ: সংসারবিজয়ী গ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবত উচ্চারণ করার পূর্বে পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নর-নারায়ণ ঋষি নামক ভগবৎ-অবতার, বিদ্যাদেবী সরস্বতী এবং ব্যাসদেবকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
এভাবে মাতা সরস্বতী দেবী একজন পরম পূজনীয় বৈষ্ণবীর উদ্দেশ্যে কৃষ্ণভক্তিমূলক বিদ্যা অর্জনের জন্য একজন যথার্থ কৃষ্ণভক্ত প্রার্থনা করে থাকেন। মাতা সরস্বতীই আমাদের প্রগতির জন্য সহায়তা করতে পারেন।
0 Comments