নৃসিংহ স্তুতির ব্যাখ্যা
শ্রীল প্রভুপাদ আমাদের জন্য সকাল-সন্ধ্যা নৃসিংহ স্তুতি অনুমোদন করেছে তা আমাদের যন্ত্রের মতো নয় বরং ভক্তি সহকারে কীর্তন করা উচিত করা।
কিভাবে নৃসিংহদেবের পূজা ইস্কনে শুরু হয়?
সমস্ত ভক্তরা সানফ্রান্সিসকোতে রথযাত্রায় গিয়েছিল। শ্রীল প্রভুপাদ একটু অসুস্থ থাকায় লস্ এঞ্জেলেসে কিছু ভক্ত তার সাথে মন্দিরে ছিল। এমন সময় কেউ একজন মন্দিরে একটা বোম নিক্ষেপ করে। তেমন ক্ষতি একটা হয়নি কিন্তু ধোঁয়া, তীব্র শব্দের কারণে ভক্তরা আতঙ্কিত হয়। তারপর প্রভুপাদ ভক্তদের বলেন, আমাদের প্রচার দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়াতে কিছু ব্যক্তি আমাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত। এজন্য আমাদের সকল মন্দিরে ভগবান নৃসিংহদেবের পূজা চলমান থাকবে। কেননা নৃসিংহদেব ভক্তকে রক্ষা করে। তারপর ঐ মন্দিরে নৃসিংহদেবের চিত্র স্থাপন করে প্রভুপাদ প্রথম নৃসিংহ আরতি কীর্তন করেন।
নৃসিংহ স্তুতির উৎস
জয় নৃসিংহ শ্রী নৃসিংহ।
জয় জয় জয় শ্রী নৃসিংহ ॥
উগ্রং বীরং মহাবিষ্ণু
জ্বলন্তং সর্বতোমুখম্।
নৃসিংহ ভীষণং ভদ্রং
মৃতোমৃত্যুং নমাম্যহম্ ॥
শ্রী নৃসিংহ জয় নৃসিংহ জয় জয় নৃসিংহ।
প্রহ্লাদেশ জয় পদ্মমুখ পদ্মভৃঙ্গং ॥
(নৃসিংহ পূর্বতাপনী উপনিষদ)
এ মন্ত্র প্রবল শক্তিশালী ও প্রভাবশালী
এ মন্ত্র সিংহাচলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ভগবান নৃসিংহদেবকে দর্শন করে উচ্চারিত করতে থাকেন। ব্রহ্মা দেবতাদের বলেছেন, যদি কখনো তোমাদের ভয় লাগে তবে এই মন্ত্র তোমরা উচ্চারণ করবে।
লঘু ভাগবতমৃতে রূপগোস্বামী বলেছেন, নৃসিংহদেব অবতীর্ণ হন ৬ষ্ঠ মন্বন্তরে অন্ত কল্পে সত্যযুগের শেষে ত্রেতা যুগের শুরুর লগ্নে। সমুদ্র মন্থন শুরুর পূর্বে নৃসিংহদেব এসে হিরণ্যকশিপুরকে বধ করে প্রহ্লাদকে রক্ষা করেন।
বিভিন্ন যুগে ভিন্ন ভিন্ন রূপে নৃসিংহদেব
পুরাণে কাহিনী রয়েছে, বিশ্বকসেন নামক নৃসিংহদেবের এক ভক্ত ছিলেন। এবার বিশ্বকসেন হেঁটে এক গ্রাম হতে অন্য গ্রামে যাত্রা করেন। এক গ্রাম হতে অন্য গ্রাম অতিক্রমকালীন রাত হয়ে যায়। বিশ্বকসেন সেই গ্রামের বৃদ্ধ প্রধানের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
সেই বৃদ্ধ প্রধান বিশ্বকসেনকে বলেন:
প্রধান: তুমি আমার ঘরে রয়েছো, কিছু সেবা করতে হবে।
বিশ্বকসেন: অবশ্যই। বলেন আমাকে কী করতে হবে?
প্রধান: আমরা কাছে শিবলিঙ্গ রয়েছে তুমি তা পূজা করো। পূজার সমস্ত সামগ্রী আমি দিবো।
বিশ্বকসেন: আমি বিষ্ণুভক্ত শিব পূজা করতে পারি না।
প্রধান: (চাকুর ভয় দেখিয়ে বিশ্বকসেনকে রাজি করালো)
প্রধান পাশের ঘরে শুয়ে থাকে আর বিশ্বকসেন পূজা করতে থাকে। বিশ্বকসেনের মুখ দিয়ে “ওঁ নমঃ শিবায়” উচ্চারিত হয় না। সে শিবলিঙ্গে বিল্ব পত্র দিয়ে বলতে থাকে “ওঁ নরসিহায় নমঃ”, “ওঁ নরসিহায় নমঃ”। পাশের ঘর থেকে প্রধান তা শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে দরজা খুলে তার গলায় চাকু ধরে। আর ভগবান নৃসিংহদেব শিবলিঙ্গ ভেঙ্গে বের হয়ে ভক্তকে রক্ষা করে। এমন নয় নৃসিংহদেব শুধু সত্য যুগে আসেন। নৃসিংহদেব সবসময় আসেন কিন্তু ডাকার জন্য প্রহ্লাদের মতো ভক্ত হতে হবে।
নমস্তে–‘নমস্তে’ শব্দটি ভারতীয় সংস্কৃতির এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। বাস্তবিক ভারতীয় সংস্কৃতি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিপূর্ণ। কেননা আমরা কোনো অজানা ব্যক্তির সাথে কুশল বিনিময়ে কেন তার সাথে আমরা হাত মিলিত করব। হাত জোড় করে ‘নমস্তে’ বলা সবচেয়ে উত্তম। ‘নমস্তে’ শব্দটির অর্থ “আমার নয়”। আমাদের দেহগত অহঙ্কার আমিত্ব বোধ নয়, আমাদের প্রকৃত পরিচয় আমরা ভগবানের ভক্ত, তার দাস। মূলত আমি এই দেহ নয় আমি আত্মা ভগবানের অংশ। কাউকে ‘নমস্তে’ সম্বোধনের মাধ্যমে বুঝায় আমি দেহগত মিথ্যা অহংকার হতে প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধির পথে যাত্রা করেছি আমাদের কৃপা করে আশির্বাদ প্রদান করুন ।
নরসিংহায়–ভগবান এসেছেন নর-সিংহ রূপে। নিম্নাংশ মানুষের মতো, উর্ধ্বাংশ সিংহের মতো। যখন ভগবান নৃসিংহ রূপে আসে তখন তীব্র গর্জন করে আসেন। নৃসিংহ ভগবান যখন স্তম্ভ হতে বের হন, তখন এতো তীব্র শব্দ হয় যে ব্রহ্মা স্তমিত হয়ে ভাবে হয়তো প্রলয় শুরু হয়েছে অথবা কোনো গ্রহদ্বয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। নৃসিংহদেব তীব্র গর্জন করে স্তম্ভ হতে বের হয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। দেবতারা মেঘের আড়াল হতে যুদ্ধ দেখতে থাকেন। যখন নৃসিংহদেব জয় লাভ করতে থাকেন, তখন তারা মেঘের আড়াল হতে বের হয়ে ‘জয়’ ‘জয়’ বলতে থাকে। নৃসিংহদেবের কুস্তি করতে বড় মজা লাগছে। কেননা কুস্তি করার জন্যই এই লীলার আয়োজন। বৈকুণ্ঠের দ্বারপাল জয়-বিজয় তারা তো ভগবানকে কুস্তির মজা প্রদান করার জন্য এসব আয়োজন করেছে। তারা ভাবছে ভগবানের তো সবরকম আনন্দ মিলে কিন্তু ভগবান তো কারো সাথে কুস্তি করার আনন্দ লাভ করতে পারেন না। কেননা তার সাথে কে কুস্তি করবে! ভগবান এই কথা মনে করে হাসেন, তোমরা তো কুস্তির আনন্দ প্রদান করতে চাইতে, তাই কুস্তির আনন্দ লাভ করছি। অন্তে ভগবান হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করেন এবং প্রহ্লাদকে রক্ষা করেন।
প্রহ্ণাদাহ্ণাদ-দায়িনে-নৃসিংহদেব আসেন প্রহ্লাদকে আনন্দ প্রদান করার জন্য। প্রহ্লাদ অর্থও আনন্দ।
হিরণ্যকশিপুর চার পুত্র (আহ্লাদ, সমহ্লাদ, অনুহ্লাদ ও প্রহ্লাদ) ও এক কন্যা (সীমহিকা) ছিল। আহ্লাদের পুত্রের নাম সুন্দর। সুন্দরের স্ত্রীর নাম তারকা। তারকাকে ত্রেতাযুগে রাম বধ করেছিলেন। এদের পরিবার খুবই বিখ্যাত, কেননা প্রতিটি যুগে এই পরিবারের সাথে ভগবানের বিশেষ লীলা সংঘটিত হয়। অসুরদের মধ্যে সমস্ত গুণ বিদ্যমান। শক্তিশালী, জ্ঞানী, বিদ্বান, নাম, যশ সবকিছু রয়েছে। আমরা কেনো অসুরদের অপছন্দ করি? কেননা তারা ভগবানের প্রতি বিমুখ বা ভগবৎবিদ্বেষী। আর এই দোষই সমস্ত দোষের আকর।
নৃসিংহদেব আবির্ভাবের ৬টি কারণ
বৃহৎভাগবতে নারদ মুনি প্রহ্লাদকে বলেছেন, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত, কেননা ভগবান তোমার জন্য অবতীর্ণ হয়েছেন।
১. ব্রহ্মার বর : ব্রহ্মার বর যেন মিথ্যা না হয়। ভগবানকে স্বয়ং অবতীর্ণ হতে হয়েছে কারণ ভগবান ব্রহ্মার সৃষ্ট জীব নয়।
২. নারদমুনির জন্য : ভগবান আপনার (নারদমুনির) জন্য অবতীর্ণ হয়েছেন। কেননা আপনি আমাকে ও মাকে প্রচার করেন গর্ভে থাকা অবস্থায়। ভগবান বলেছেন, যারা আমার ভক্তের সান্নিধ্যে থাকে তাকে আমি রক্ষা করি।
৩. দেবতাদের জন্য : দেবতাদের সমস্ত কষ্ট দূর করার জন্য ভগবান অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যেমন ইন্দ্র ঘোড়া দেখাশুনা করতেন, অগ্নিদেব রন্ধন করতেন সমস্ত দেবতা তার সেবা করত।
৪. নিজের প্রতিজ্ঞা : ভগবান নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে অবতীর্ণ হয়েছেন,-‘ন মে ভক্ত প্রণশ্যতি’। আমার ভক্তের বিনাশ নেই বা আমি সব সময় রক্ষা করি কথাটি স্বার্থক করতে।
৫. জয়-বিজয়ের জন্য : ভগবান জয়-বিজয়ের জন্য এসেছেন। কেননা জয়-বিজয় তার প্রিয় ভক্ত হিরন্যকশিপু-হিরণাক্ষ্য। তাদের মুক্ত করার জন্য তিনি এসেছেন।
৬. চতুঃষ্কুমারের জন্য : ভগবান চতুঃষ্কুমারের জন্য এসেছেন, কেননা চতুঃষ্কুমারের যে অভিশাপ তা বৃথা যেন না হয়।
এসব বর্ণনা করে প্রহ্লাদ বুঝাতে চাইছেন, ভগবান শুধু তার জন্য আসেননি তিনি বিভিন্ন কারণে এসেছেন।
ভগবানের কি ক্রোধ প্রকাশ করা উচিত ?
হিরণ্যকশিপোর্বক্ষঃ শিলাটঙ্ক-নখালয়ে – হিরণ্যকশিপোর্বক্ষঃ-হিরণ্য অর্থ ‘সোনা’ যার সোনা তথা ধন-সম্পদের উপর মোহ এবং কশিপো অর্থ ‘কমল শয্যা’ অর্থ্যাৎ হিরণ্যকশিপু কামী ও লোভী। শিলা অর্থ ‘পাথর’। ভগবান নৃসিংহদেব নখ দিয়ে হিরণ্যকশিপুর পাথরের মতো বক্ষকে বিদীর্ণ করে তার দেহের অভ্যন্তরের সমস্ত অঙ্গগুলো বের করেন।
শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, পাঁচ প্রকার ব্যক্তির হৃদয় পাথরের মতো।
১. নাস্তিক (বৈদিক শাস্ত্রকে অস্বীকার করে ও ভগবানে অবিশ্বাসী)
২. মায়াবাদী (ভগবানের সাকার রূপকে মানে না, নিরাকার রূপে বিশ্বাসী)
৩. দেবতা পূজক
৪. বৈষ্ণব অপরাধী
৫. কপট ভক্ত
হিরণ্যকশিপুর নাস্তিক তাই তার হৃদয় ‘শিলাটঙ্ক’ পাথরের মতো। ভগবান নৃসিংহদেব অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে হিরণ্যকশিপুর পাথরের মতো দৃঢ় বক্ষ ছিন্নভিন্ন করে।
ভগবান স্বয়ং ভগবদ্গীতাতে বলেছেন, কাম, ক্রোধ ও লোভ হলো তিনটি নরকের দ্বার। কিন্তু ভগবানের ক্রোধ হলো দিব্য, জড় নয়। আমরা যখন ভগবানের রাসলীলা শ্রবণ করি তখন আমাদের কাম দূরীভূত হয়। আবার যখন আমরা নৃসিংহলীলা শ্রবণ করি তখন ক্রোধ দূরীভূত হয়। অনেকেই ক্রোধিত হয়েছেন। কিন্তু শুদ্ধ ভক্তের ব্যবহার দেখে আমরা তার গভীরতা বুঝতে পারি না। যেমন সমুদ্রে হাজার হাজার তরঙ্গ সৃষ্টি হলেও আমরা বুঝতে পারি না সমুদ্রের গভীরতা কতো? তেমনি বৈষ্ণব কখনো ক্রোধ করবে, কখনো ভালোবাসবে এভাবে আমরা বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখতে পারি। কিন্তু অন্তরে সে কৃষ্ণের সাথে গভীরভাবে যুক্ত থাকায় বাহিরে কোনো বিষয় তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে না।
ইতো নৃসিংহ পরতো নৃসিংহ যতো যতো যামি ততো নৃসিংহ-নৃসিংহদেব সর্বত্র রয়েছেন। প্রভুপাদের শিষ্য বিবিটি’র সম্পাদক শ্রীমৎ জয়াদ্বৈত স্বামী প্রভুপাদকে জিজ্ঞাসা করেন:
শ্রীমৎ জয়াদ্বৈত স্বামী: অহোবিলামেই কি হিরণ্যকশিপুকে বধ করা হয়েছে? ওখানে যে স্তম্ভ আছে সেখান থেকেই কি প্রকাশিত হয়েছিলেন?
প্রভুপাদ: তুমি এসব কেনো জিজ্ঞাস করছো? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভগবানের কাছে প্রার্থনা, ভজন, পূজা ও জপ করা। তিনি কোথায় আবির্ভূত হয়েছেন এসবের জন্য প্রচেষ্টা করো না।
ভক্ত: সবই ঠিক আছে। আমরা শুধু জানতে চাইছি সেই স্তম্ভ থেকেই এসেছে কি?
প্রভুপাদ: (বিরক্ত হয়ে) তোমরা কেনো ভগবানকে সীমাবদ্ধ করছো! ইতো নৃসিংহ পরতো নৃসিংহ যতো যতো যামি ততো নৃসিংহ, যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় ভগবান আসতে পারে, তুমি ভগবানকে সীমাবদ্ধ করো না।
এখনো নৃসিংহদেব রয়েছেন!
বহির্নৃসিংহ হৃদয়ে নৃসিংহ- ভগবান নৃসিংহদেব হৃদয়েও প্রকট হতে পারেন। তিনি সর্বত্র রয়েছেন। একবার বেদব্যাস যখন পুরাণে ‘নৃসিংহ কথা’ লিপিবদ্ধ করছিলেন, তখন তার মনে ভাবনার উদয় হলো যে, নৃসিংহদেব যখন প্রকট হয়েছিলেন তিনি দেখতে কেমন ছিলেন? তাকে সরাসরি দেখলে কেমন অনুভূতি হবে হৃদয়ে? কতটা শব্দ হবে? এসব ভাবতেই নৃসিংহদেব তার হৃদয়ে প্রকট হন। হৃদয়ে তার দেহে পূর্ণ অনুভূতি প্রকাশ পায় নৃসিংহদেবের অবতীর্ণ মুহূর্তের। তারপর ব্যাসদেব ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন আপনি আমার হৃদয়ে যে রূপে প্রকট হয়েছেন সে রূপে সবাইকে দর্শন দিবেন। এরপর ভগবান তার হৃদয় হতে বাহিরে এসে বিগ্রহরূপে প্রকট হন। এই বিগ্রহ আজও রয়েছে নলগন্ডা জেলায় বটপল্লী নীলিয়াগোরা গ্রামের এক মন্দিরে। এখনো নৃসিংহদেব এই মন্দিরে রয়েছেন, তার প্রমাণ পূজারী আমাদের নিকট তুলে ধরেন। নৃসিংহদেবের নাক ও চরণের নিকট দুইটি দীপ প্রজ্জ্বলন করে রাখে। মন্দিরের ভিতর বাতাস চলাচল করে না। আপনি দেখতে পারবেন, যে দীপ ভগবানের চরণের নিকট, তার আগুন একটুও দুলবে না। কিন্তু, যে দীপ ভগবানের নাকের নিকট, তার আগুন দুলতে থাকে। কেননা ভগবানের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে।
নৃসিংহদেবের আদি রূপের ৮টি মস্তক
নৃসিংহমাদিং শরণং প্রপদ্যে-“নৃসিংহদেবের আদি রূপ বা মূল রূপ সব কিছুর মূল কারণ। নৃসিংহদেবের আদি রূপের আট মস্তক। একেকটি মস্তক বিশেষ বিশেষ কার্যের প্রতিনিধি স্বরূপ।
ঘোড়া রূপ: অজ্ঞনতা দূর করে ভগবৎ প্রাপ্তির জন্য দিব্যজ্ঞান প্রদান করেন।
গরুড় রূপ: বিষ হতে রক্ষা করেন কিংবা সাপের বিষ থেকে মুক্ত করেন।
হনুমান রূপ: কিছু হারিয়ে গেলে ও ভূত-পিশাচ হতে মুক্ত করেন।
বরাহ রূপ: তান্ত্রিক সমস্যা থেকে মুক্ত করেন।
সিংহ রূপ: ভক্তি ও মুক্তি প্রদান করেন।
বাঘ রূপ: রোগ হতে মুক্ত করেন।
ভাল্লুক রূপ: ভয় হতে আমাদের রক্ষা করেন।
দু’মুখো পাখি রূপ: শান্তি প্রদান করেন।
নিম্নের অংশটুকু জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দের দশাবতার স্তব হতে নেওয়া হয়েছে।
তব করকমলবরে নখমদ্ভূতশৃঙ্গং
দলিতহিরণ্যকশিপুতনুভৃঙ্গম্।
কেশব ধৃত-নরহরিরূপ জয় জগদীশ হরে ॥
তব করকমলবরে নখমদ্ভূতশৃঙ্গং-‘তব করকমল’
ভগবানের হাত কমল প্রহ্লাদের জন্য। কিন্তু হিরণ্যকশিপুর জন্য ‘নখমদ্ভূতশৃঙ্গ’। হিরণ্যকশিপুর জন্য ভগবানের নখ বজ্রের মতো। ভগবান তার নখ দিয়ে হিরণ্যকশিপুরের দেহ ছিন্ন করেছেন।
কেশব ধৃত-নরহরিরূপ জয় জগদীশ হরে-‘কে’ অর্থ ব্রহ্মা, ‘ইশব’ মানে শিব। কেশব মানে যে ব্রহ্মা ও শিবকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
দলিতহিরণ্যকশিপুতনুভৃঙ্গম্ – নৃসিংহদেব যখন হিরণ্যকশিপুরকে বধ করেন তখন লক্ষ্মীদেবী খুব দুঃখিত হন।
নৃসিংহদেব: তুমি কেনো দুঃখী?
লক্ষ্মীদেবী: এ কেমন কথা! আপনি স্তম্ভ থেকে প্রকাশিত হয়ে সরাসরি বধ করলেন! তাকে সময় দেওয়া উচিত। তাকে বলা উচিত, তুমি কি সঠিক পথে ফিরে আসবে? এটা পছন্দ হয়নি।
ভগবান: ঠিক আছে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে সাবধান থাকবো।
রাম অবতারে এজন্য রাবণকে বারবার সুযোগ প্রদান করেন। কিন্তু রাবণ সে সুযোগ গ্রহণ করেনি। তার দশটা মাথা, কিন্তু সুবুদ্ধি কোনো মাথায় নেই। পরিশেষে ভগবান তাকে সংহার করেন।
কেশব ধৃত-নরহরিরূপ জয় জগদীশ হরে- ভগবানের আর একটা নাম ‘হরি’। ‘হরি’ অর্থ হরণ করে। সংস্কৃতিতে ‘হরি’ বিভিন্ন অর্থ রয়েছে, বানর, সূর্য, সিংহ। এই তিনটি কী করে?
সিংহ: জীবনকে নিয়ে নেয়।
সূর্য: আমাদের জীবন হতে অন্ধকার নাশ করে।
বানর: আমাদের সমস্ত বস্তু হরণ করে নেয়।
আমাদের হৃদয়ে ষড়রিপু রয়েছে তা রাক্ষসের প্রতিনিধি করে।
কাম: রাবণ জয়-বিজয়, হিরণ্যকশিপু-হিরণাক্ষ, রাবণ-কুম্ভকর্ণ, শিশুপাল-দন্তবক্র। তারা ছয় রূপে এসেছে ছয় অনর্থের প্রতিনিধি করে। এই ছয় অসুরকে দেবতা বধ করেনি ভগবান করেছেন।
এজন্য আমাদের হৃদয়ে ষড়রিপু রয়েছে তা কোনো দেবতা নাশ করতে পারবে না। দেবতার পূজা করলে তা শুধু বৃদ্ধি পাবে। আমরা যদি এসব অনর্থকে দূর করতে চাই তাহলে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজা করতে হবে।
* কংস দুর্গাদেবীর পূজা করে ভগবানকে মারতে চায়।
* রাবণ শিবের পূজা করে পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত।
* হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার পূজা করেছে ভগবান থেকে বড় হতে।
কিন্তু ধ্রুব মহারাজের চাওয়া ছিল রাজ্য কিন্তু ভগবানকে প্রাপ্তির পর তার কামনা-বাসনা ভক্তিতে রুপান্তরিত হয়ে যায়।
গণপতি (গনেশ) বিঘ্নবিনাশক। কিন্তু তার শক্তিও ভগবান নৃসিংহদেব হতে আসে। গনেশ নৃসিংহলোকের পূজারী। গনেশের পূজা করার ফলে ভৌতিক জীবনের সকল বিঘ্ন নাশ হয় কিন্তু আমরা যদি ভগবান নৃসিংহদেবের পূজা করি তাহলে আলাদা ভাবে অন্য দেবতার পূজা করার প্রয়োজন নাই। তার পূজা করলে সবার পূজা করা হয়ে যায়।
0 Comments