আজ পাঁচ তারিখ। ৫ই অক্টোবর। আজ বোধ হয় পিতৃপক্ষ এর চতুর্দ্দশী। আগামীকাল মহালয়া।
এই মহালয়া কি এবং কেন ?
পিতৃপক্ষ পূর্বপূরুষের তর্পণের জন্য এক
বিশেষ পক্ষ। এই পক্ষকে পিত্রুপক্ষ, ষোলা শ্রাদ্ধ,
কানাগাত, জিতিয়া, মহালয়া পক্ষ ও অপরপক্ষ
বলেও বলে।
তর্পণ কি
দেবতা, ঋষি ও মৃত পূর্বপুরুষদের (পিতৃকুল ও মাতৃকুল) উদ্দেশ্যে জল নিবেদন করে তাঁদের সন্তুষ্ট করার পদ্ধতিকে তর্পণ বলা হয়। বংশের যে সকল পিতৃপুরুষ পরলোক গমন করেছেন, তাঁদের প্রীতির উদ্দেশ্যে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক স-তিল জল (তিল মেশানো জল) দান করে সাধারণত পুত্রসন্তানেরা পিতৃ তর্পণ করে থাকেন।
পিতৃপক্ষে প্রেতকর্ম (শ্রাদ্ধ), তর্পণ ইত্যাদি
মৃত্যু-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় ।
তাই এই পক্ষ শুভকার্যের জন্য প্রশস্ত নয়।
দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরবর্তী পূর্ণিমা (ভাদ্রপূর্ণিমা) তিথিতে এই পক্ষ শুরু হয় এবং শেষ হয় সর্বপিতৃ অমাবস্যা, মহালয়া অমাবস্যা বা মহালয়ার দিনে । উত্তর ভারত ও নেপালে ভাদ্রের বদলে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয়।
পুরাণ মতে , জীবিত ব্যক্তির আগের মৃত তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক
স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত।
পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই
সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে
পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের
একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের
একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে চলে যান।
এবং পরমাত্মায় (ঈশ্বর) লীন হন এই
ভাবে তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের উর্ধ্বে উঠে যান।
এই কারণে, কেবলমাত্র আগের তিন পুরুষেরই শ্রাদ্ধ হয় ; এই অনুষ্ঠানে যমরাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে । সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ
করলে পিতৃপক্ষ শুরু হয়। , এই সময় পূর্বপুরুষগণ পিতৃলোক ছেড়ে তাঁদের উত্তরপুরুষদের ঘরে আসেন । এর পর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে
প্রবেশ করলে, তাঁরা আবার পিতৃলোকে ফিরে
যান। পিতৃগণের অবস্থানের সময়ে আমরা
পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে তর্পণাদি করি ।
মহাভারত আছে, কর্ণের মৃত্যু
পর তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করলে, তাঁকে
স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ
ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র
বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন,
তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য
প্রদান করেননি। তাই স্বর্গে তাঁকে স্বর্ণই খাদ্য
হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি
যেহেতু তাঁর পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত
ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণকে স্বর্ণ প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো
দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের
উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি
দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।
কেউ কেউ বলেন কর্ণকে ইন্দ্র নয় যম এই কথা বলেছিলেন।
মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী,
সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা।
তর্পণ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে তাঁর পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়। তর্পণের
ফলেই মৃতের আত্মা স্বর্গে প্রবেশাধিকার পান।
কেউ কেউ বলেন "পুত্র বিনা মুক্তি নাই।"
ধর্মগ্রন্থে গৃহস্থদের দেব, ভূত ও অতিথিদের সঙ্গে পিতৃতর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পিতৃগণ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং
পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ
প্রদান করেন।
বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাঁরা অপারগ, তাঁরা সর্বপিতৃ অমাবস্যা পালন করে পিতৃদায় থেকে মুক্ত হতে পারেন। এই অনুষ্ঠানে পূর্ববর্তী তিন
পুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড ও জল প্রদান করা হয়,
তাঁদের নাম উচ্চারণ করা হয় এবং গোত্রের
পিতাকে স্মরণ করা হয়। এই কারণে একজন
ব্যক্তির পক্ষে বংশের ছয় প্রজন্মের নাম
স্মরণ রাখা সম্ভব হয় এবং এর ফলে বংশের বন্ধন
দৃঢ় হয়। পিতৃপক্ষ বংশের বিভিন্ন
প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে। এই পক্ষে বংশের বর্তমান প্রজন্ম পূর্বপুরুষের নাম স্মরণ করে তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পিতৃপুরুষের ঋণ
হিন্দুধর্মে পিতৃমাতৃঋণ অথবা গুরুঋণের সমান
গুরুত্বপূর্ণ। জীবিত ব্যক্তির পিতা বা পিতামহ যে তিথিতে মারা যান, পিতৃপক্ষের সেই তিথিতে তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তবে এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। পূর্ববর্তী বছরে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ হয় চতুর্থী (চৌথা ভরণী) বা পঞ্চমী (ভরণী
পঞ্চমী) তিথিতে। সধবা নারীর মৃত্যু হলে, তাঁর
শ্রাদ্ধ হয় নবমী (অবিধবা নবমী) তিথিতে।
বিপত্নীক ব্যক্তি ব্রাহ্মণী নারীদের শ্রাদ্ধে
নিমন্ত্রণ করেন। শিশু বা সন্ন্যাসীর শ্রাদ্ধ হয়
চতুর্দশী (ঘট চতুর্দশী) তিথিতে। অস্ত্রাঘাতে
বা অপঘাতে মৃত ব্যক্তিদেরও শ্রাদ্ধ হয় এই
তিথিতেই (ঘায়েল চতুর্দশী)।
সর্বপিতৃ অমাবস্যা দিবসে তিথির নিয়মের বাইরে
সকল পূর্বপুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়। যাঁরা নির্দিষ্ট
দিনে শ্রাদ্ধ করতে ভুলে যান, তাঁরা এই দিন শ্রাদ্ধ
করতে পারেন। এই দিন গয়ায় শ্রাদ্ধ করলে তা
বিশেষ ফলপ্রসূ হয়। উল্লেখ্য, গয়ায় সমগ্র
পিতৃপক্ষ জুড়ে মেলা চলে। মহালয়ার দিন
দুর্গাপূজার সূচনা হয়।
ছোটো বেলায় দেখেছি দাদা সব রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুর মর্দিনী শুনে ফুটবল খেলত। এইটাই ছিল সেই বছরের শেষ ফুটবল খেলা । তারপর ক্রিকেট মরসুম শুরু । আবার পরের বছরের ১ লা বৈশাখে গোল বার পূজো করে আবার ফুটবল মরসুমের শুরুয়াৎ।
লোকে বলে এইদিনই দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে আবির্ভূতা হন। মহালয়ার দিন ভোরবেলাতে চণ্ডীপাঠ করার রীতি রয়েছে। আশ্বিন শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে দৌহিত্র( নাতি বা মেয়ের পুত্র
মাতামহের তর্পণ করেন। মহালয়ার দিন পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় দ্বিপ্রহরে নদী বা হ্রদের তীরে বা শ্রাদ্ধকর্তার গৃহে। অনেক পরিবার
বারাণসী বা গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন । মৃত
ব্যক্তির পুত্র (বহুপুত্রক হলে জ্যেষ্ঠ পুত্র) বা
পিতৃকুলের কোনো পুরুষ আত্মীয়ই
শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অধিকারী এবং শ্রাদ্ধ কেবলমাত্র
আগের তিন পুরুষেরই হয়ে থাকে। মাতার
কুলে পুরুষ সদস্য না থাকলে সর্বপিতৃ অমাবস্যায়
দৌহিত্র মাতামহের শ্রাদ্ধ করতে পারেন।
কোনো কোনো বর্ণে কেবলমাত্র
পূর্ববর্তী এক পুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়।
পূর্বপুরুষকে যে খাদ্য উৎসর্গ করা হয়, তা সাধারণত রান্না করে রুপো বা তামার পাত্রে কলাপাতার উপর দেওয়া হয়। এই খাদ্যগুলি হল ক্ষীর, লপসি, ভাত, ডাল, গুড় ও কুমড়ো । শ্রাদ্ধকর্তাকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ধুতি পরে
শ্রাদ্ধ করতে হয়। শ্রাদ্ধের পূর্বে তিনি
কুশাঙ্গুরীয় (কুশ ঘাসের আঙটি) ধারণ করেন।
এরপর সেই আঙটিতে পূর্বপুরুষদের আবাহন করা
হয়। শ্রাদ্ধ খালি গায়ে করতে হয়, কারণ শ্রাদ্ধ
চলাকালীন যজ্ঞোপবীতের অবস্থান বারংবার
পরিবর্তন করতে হয়। শ্রাদ্ধের সময় সিদ্ধ অন্ন
ও ময়দা ঘি ও তিল দিয়ে মাখিয়ে পিণ্ডের আকারে
উৎসর্গ করা হয়। একে পিণ্ডদান বলে। এরপর
দুর্বাঘাস, শালগ্রাম শিলা বা স্বর্ণমূর্তিতে বিষ্ণু এবং
যমের পূজা করা হয়। এরপর পিতৃপুরুষের
উদ্দেশ্যে খাদ্য প্রদান করা হয়। এই খাদ্য সাধারণত
ছাদে রেখে আসা হয়।
0 Comments