দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকা লেখাটা আজকের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
কাহিনীর শুরু করছি কলকাতার এক বালক যাঁর নাম ছিল কিশোর কুমার দাস। তাঁর পিতার নাম ছিল শ্রীযুক্ত কুমুদরঞ্জন দাস এবং মাতার নাম শ্রীমতী চিন্ময়ী দেবী দাসী । কলকাতার বালিগঞ্জস্থিত ডোবার লেনে বসবাস করতেন। কিশোর কুমারের আদি পূর্ব পুরুষদের বাড়ি বর্তমান বাংলাদেশর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কুঠি গ্রামে। কিশোর কুমারের বড় দাদার জন্ম হয় কলকাতা। কিশোরের কুমারের জন্ম হওয়ার পূর্বে উনার বাবার মা (ঠাকুরমা) ইচ্ছা প্রকাশ করেন,সন্তানের জন্ম যেন পূর্ববঙ্গের আদি বাড়িতে থেকেই হয়। সেই হিসেবে জন্মের পূর্ব ও পরবর্তী সময়কাল নিয়ে মোট ১১ মাস বাংলাদেশর আদি বাড়িতে ছিলেন। কিশোর কুমারের জন্ম (আধ্যাত্মিক ব্যবহারিক শব্দ আবির্ভাব) ১৯৪৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর। কিশোরের বাবা ছিলেন শিক্ষিত,আধুনিক ও প্রগতিশীল সাহেবি কেতাদুরস্ত। তিনি ছিলেন সিনেমা পরিচালক ও নির্দেশনক। আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি বেশ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। সাহেবি কায়দায় স্যুট সজ্জিত হয়ে জীব গাড়ি করে নিজের কাজে যেতেন। ছোট বেলায় তিনিই ছিলেন কিশোরের আদর্শ পুরুষ।
কিশোর কুমারের মাতা ছিলেন ধর্মপরায়ণ,তিনি সন্তানদেরকে শিখিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামচন্দ্রে বিশ্বাস রাখতে, তাঁদের উপর নির্ভর করতে এবং ভয় পেলে বা দুঃখ হলে তাদের শরণাপন্ন হতে।
কিশোর কুমারের বয়স যখন সাত বছর তখন তাঁর মা যক্ষ্মা সংক্রমণ ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে দেহ ত্যাগ করেন। শৈশবের মাতৃ স্নেহ এবং ভালবাসা থেকে কিশোর কিছুটা বঞ্চিত রয়ে গেলেন।
পরবর্তীতে কিশোর কুমার ত্রিপুরার ছোট্ট শহর খোয়াই মেজোকাকার বাড়ি থেকে লেখাপড়া করেন এবং নর্থ বেঙ্গল বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কিশোরের ক্রিকেট ও ফুটবল ছিল প্রিয় খেলা।
ইংরেজি ছিল কিশোরের প্রিয় বিষয়।তাঁর প্রিয় শিক্ষক নীরদবাবু ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ইংরেজি ক্লাসের শিক্ষক বলেছিলেন ইংরেজি শিখতে হলে ইংরেজি পড়তে হবে,লিখতে হবে,ইংরেজিতে কথা বলতে হবে,ইংরেজি চিন্তা করতে হবে এমনকি ইংরেজিতে স্বপ্নও দেখতে হবে। শিক্ষকের উপদেশ মানার ফলে কিশোর কুমার খুবই সুন্দর সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষা আয়ত্ত্ব করে নিয়েছিলেন।
যদিও স্বপ্ন ছিল বৈজ্ঞানিক হওয়ার,ঘটনাক্রমে ফ্লাইং ট্রেনিং এর একটা স্কলারশিপ পেয়ে যান। ১৯৭০ সালে কলকাতায় ফিরে এসে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এরপর জলপথে ও স্থলপথে ইউরোপে ভ্রমণ করতে বেরিয়েযান। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত ভ্রমণ করে যখন জার্মানীতে ছিলেন তখন জীবনের আনন্দঘন মূহুর্তে কিছু ঘটনা ঘটে গেল,তখন তাঁর এক আমেরিকান বন্ধু ভারতবর্ষকে দরিদ্রগ্রস্ত, রোগাক্রান্ত, সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত বলে অপমান করেছিল। তখন মাতৃভূমির প্রতি প্রথমবারের মত গভীর অনুরাগ অনুভব করেছিলেন এবং ভারতের ঐতিহ্যে এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তাঁর বন্ধুকে বলেছিলেন ভারতবর্ষ দরিদ্র নয় বরং আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ ইত্যাদি.... ।তখনই তাঁর মনে বাসনা জাগ্রত হয় মাতৃভূমির আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে যথাযথ ভাবে অবগত হওয়ার জন্য তীব্র আকাঙ্খার উদয় হয়।
সত্যের অন্বেষণে ১৯৭৫ সালে ভারতবর্ষে ফিরে হিমালয়ের বিভিন্ন প্রান্ত ভ্রমণ করে সদগুরু অন্বেষণে কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন) এর প্রতিষ্ঠাতা আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমুর্তী শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তি বেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন। কুম্ভ মেলায় প্রথম শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে সাক্ষাত দর্শন হয়। সেই সময় প্রভুপাদের সঙ্গে ট্রেনে যাত্রা পথে যোগ্যতা সম্পন্ন সুশিক্ষিত কিশোর কুমারকে উপদেশ দিয়ে শ্রীল প্রভুপাদ বললেন " উনার ইংরেজি বইগুলোকে বঙ্গানুবাদ করার জন্য ।" তখন কিশোর নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে প্রভুপাদকে বললেন 'আমি কি সেটি পারবো?' প্রভুপাদ বললেন অনুশীলনই মানুষ পূর্ণতা লাভ করে। কেবল চেষ্টা করে যাও। পরবর্তীতে প্রভুপাদের লেখা ইংরেজি গ্রন্থ সমূহের ৫০টির অধিক গ্রন্থ তিনি বহু বছরের এক সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর মধ্যে উল্খেযোগ্য "শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা যথাযথ" এবং ১৮০০০ শ্লোক সমন্বিত "ভাগবতম" যা ধর্মপ্রাণ বাঙালি জাতির এক বিরাট অমূল্য সম্পদ।
শ্রীল প্রভুপাদ এত কৃপা বর্ষণ করেন কিশোর কুমারের উপর কেবল তিন মাসের মধ্যেই হরিনাম দীক্ষা,গায়ত্রী দীক্ষা এবং সন্ন্যাসও পেয়ে যান। যা ইস্কনের ইতিহাসে বিরল।তিনি সবার হৃদয়ের প্রভুপাদগত প্রাণ হয়ে যান এবং নিজেকে আধ্যাত্মিক গুরুর নিকট আত্মসমর্পণ করে দেন। সন্ন্যাস দিক্ষাকালিন তাঁর নাম শ্রীল প্রভুপাদ দেন "শ্রীমৎ ভক্তি চারু স্বামী মহারাজ"।
তিনি ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ- এর সেক্রেটারি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে শ্রীল প্রভুপাদের অপ্রকটের পর থেকে ইস্কনের একজন আধ্যাত্মিক নেতৃস্থানীয় প্রচারক হিসেবে সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কৃষ্ণ কথা প্রচারকের গুরু দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি পৃথিবীর এমন এমন সব স্থানে ও যেতেন যেখানে হয়ত একদুই জন কৃষ্ণ ভক্ত আছেন। উনাদের দ্বারা কৃষ্ণ ভক্তি প্রচারে যাতে আরো গতি আসে সেই প্রয়াস নিয়ে ধীর সংকল্প নিয়ে চলতেন। তিনি ইস্কনের গভর্নিং বডির সদস্য ও দুই বার (সর্ব উচ্চ নির্ণয়ক) গভর্নিং বডি কমিশনার চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত ছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদের জীবনের উপর ভিত্তি করে তিনি একটি জীবনীমূলক চলচ্চিত্র বানানের অতি বৃহৎ কার্য সম্পাদন করেন। যা রাষ্ট্রীয় চ্যানেল দূরদর্শে ১০৪ পর্বের এই ধারাবাহিক চলচ্চিত্রটি "অভয়চরণ" নামে সারা বিশ্বে প্রদর্শিত হয়।
শ্রীমৎ ভক্তি চারু স্বামী গুরু মহারাজ ছিলেন ইস্কনের একজন নেতৃস্থানীয় আধ্যাত্মিক গুরু,সুমধুর সুবক্তা ও পরিব্রাজক সন্ন্যাসী। দেশ দেশান্তরে ছিল প্রচুর অনুগামী ।
ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের একজন শিষ্য হিসেবে ভক্তি চারু মহারাজ বৈদিক জ্ঞানের একজন নেতৃস্থানীয় প্রচারক ও প্রবক্তা হিসাবে তিনি সমগ্র বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেন এবং শ্রীল প্রভুপাদের প্রদর্শিত ভক্তিযোগের তত্ত্ব ও দর্শন প্রচার করেন।
2004 সালে, মধ্যপ্রদেশের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী উমা ভারতীর আমন্ত্রণে, ভক্তি চারু মহারাজ উজ্জয়নে মাত্র 10 মাসের মধ্যে একটি দুর্দান্ত মার্বেল পাথরের নতুন ইসকন মন্দির তৈরি করেছিলেন - প্রাচীন এবং পবিত্র এই শহরটি অবন্তিকা নামেও পরিচিত, যেখানে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ, তাঁর ভাই বলরাম এবং বন্ধু সুদামার সাথে মহর্ষি সন্দীপনীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে
ছিলেন ।
ভক্তিচারু স্বামী পরিচালিত উজ্জয়িনী ইসকন মন্দিরে প্রতিদিন ২৩,০০০ এরও বেশি স্কুল শিশুকে খাওয়ানো হয়। এই খাওয়ানোর প্রকল্পটির সুবিধার্থে শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী একটি ৬,০০০ বর্গফুটের রান্নাঘর তৈরি করেছিলেন। তিনি অন্নামৃত ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন, যে সংস্থাটি হল ইসকনের মধ্যাহ্নভোজ অনুষ্ঠান, যা সারা ভারত জুড়ে ১.৭ মিলিয়ন শিশুর মাঝে আহার বিতরণ করা হয় ।
তিনি উজ্জয়িনীতে একটি বিভাগও প্রতিষ্ঠা করেছেন যা বিশ্বজুড়ে ভক্তদের এবং ইসকন মন্দিরের জন্য সজ্জিত বেদী,মূর্তি এবং শ্রীবিগ্রহের পোশাক তৈরি করে।
২০১৩ সালে,তিনি পানিহাটির (পশ্চিমবঙ্গ) নতুন ইসকন মন্দিরের বিকাশের পথ দেখিয়েছিলেন যা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্যের এক অতি পবিত্র স্থান, এখানে রয়েছে রাঘব পণ্ডিতের বাড়ি এবং নিত্যানন্দের চিড়াদধি উৎসবের স্থান।একই বছরে,তিনি আর্থ ফোরামে যোগ দিয়েছিলেন এবং বিশাল শ্রোতাদের কাছে আধ্যাত্মিকতার উপর বিশ্বব্যাপী মূল বক্তব্য প্রদান শুরু করেছিলেন। ভক্তিচারু স্বামী বহুবার পরিচালনা ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এবং সম্পর্ককে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। তিনি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ইনস্টিটিউটে এমআইটি বোস্টন, আইআইএম এবং আইআইটিতে প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থাপনা করেছেন।
তিনি যুক্তরাজ্যের একটি শীর্ষস্থানীয় দাতব্য সংস্থা আই-ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
২০১৬ সালে ভক্তিচারু স্বামী একটি সুন্দর স্মৃতিচারণ শুরু করেছিলেন," করুনার মহাসাগর -একটি অনুসন্ধান পরিপূর্ণ", যেখানে তিনি শ্রীল প্রভুপাদের সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্মরণ করেন। এই বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কীভাবে তিনি শ্রীল প্রভুপাদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা এবং উৎসর্গ গড়ে তুলেছিলেন, যিনি তাঁকে কৃষ্ণভক্তির পথ দিয়েছিলেন এবং তাঁর কাছে প্রকাশ করেছিলেন যে তিনি সত্যই "করুণার সাগর" হতে পেরেছিলেন।
১৭ নভেম্বর,২০১৬ তে,আন্তর্জাতিক সামাজিক উন্নয়ন ইনস্টিটিউট,নিউ ইয়র্ক,সকলের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতার প্রদর্শন হিসাবে ভক্তিচারু স্বামীকে প্রশংসিত করে ও ইস্কনের হয়ে জাতি ও সভ্যতার মধ্যে বিশ্ব শান্তি ও সমঝোতার জন্য ও আধ্যাত্মিকতার বার্তা প্রচারের জন্য তাকে সাধুবাদ জানায়।
সচেতন ও নৈতিক নেতৃত্ব, বিশ্বাসযোগ্য নেতা গঠন, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে সফল সম্পর্ক এবং সম্প্রদায়ের বিষয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার জন্য বিভিন্ন সময় সম্মানিত অতিথি হিসাবে আমন্ত্রিত হন বিভিন্ন বিভাগে।
শ্রীমৎ ভক্তি চারু মহারাজ ‘বেদ ফাউন্ডেশন এবং গো-অভয়ারণ্য’ নামে একটি নতুন প্রকল্প শুরু করেছিলেন যা ফ্লোরিডার ডিল্যান্ডে ১২০ একর এলাকাব্যাপী পরিকল্পিত প্রজেক্ট। সেখানে তাঁর মিশন হল গতিময় খামার সম্প্রদায় এবং ভিজ্যুয়াল মিডিয়া স্থাপনের মাধ্যমে বৈদিক সংস্কৃতি এবং প্রজ্ঞা, পশ্চিম পৃথিবীতে আরো প্রচার করা।
গত ২০২০ সাল জুন মাস তখন কোভিড অতিমারি এক ভয়ানক রূপ ধারণ করে ছিল, সেই সময় কিছু ইস্কন অনুগামী ভক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য কৃষ্ণ প্রসাদ বিতরণ করছিলেন বিভিন্ন সেচ্ছা সেবকের মাঝে। মহারাজ জী চিন্তা করলেন তিনিও সেই সেবাতে সামিল হবেন। সেই মনোভাব নিয়ে তিনি ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। কিছু দিনের মধ্যেই মহারাজ জী অসুস্থ হয়ে যান এবং সেখানেই এক যুদ্ধার মত দেহ ত্যাগ করেন, ৪জুলাই ২০২০ইং (৭৪বৎসর বয়সে)। এরপর ভারত সরকার ও পশ্চিম বঙ্গ সরকারের বিশেষ সহযোগিতায় মহারাজ জী কে মায়াপুরের ইস্কন পরিসরে এনে যথাযথ মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়।
গত ৪৫ বছর ধরে তিনি হাজার হাজার মানুষের অনুপ্রেরণা ও পথপ্রদর্শক ছিলেন যারা তাঁর জীবনশিক্ষা ও নির্দেশাবলীর দ্বারা নিজেদের পরিবর্তন করেচলছেন।
ইতি
বিনীত
ধীর নায়ক দাস ।।
0 Comments